Written by Pinuram
ষষ্ঠ পর্বঃ আতঙ্কিত আর্তনাদ। (#1)
আতঙ্কে ভরা ধরা নারী কন্ঠ চিন্তে অসুবিধা হয় না বুধাদিত্যের। ঝিলামের কি হল, এত রাতে ফোন করেছে? বুধাদিত্যের সারা শরীর টানটান হয়ে যায় ঝিলামের আর্তনাদ শুনে। বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে ঝিলামকে, “তুমি কোথায়?”
কাঁপা গলায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, “আমি গুরগাওএর একটা ফার্ম হাউসে। সমীর ভেতরে কোথাও। প্লিস আমাকে বাঁচাও।”
ঝিলাম যে ফার্ম হাউসের নাম বলে সেটা আয়েশার বাড়ি থেকে বেশি দুরে নয়। পাশের সিটের নিচে হাত দিয়ে দেখে নেয় বাক্স আছে ত। একটা ছোটো বাক্সে পিস্তল রাখা। পিস্তলটা বেশ কয়েক বছর আগে কিনেছিল, এক শখে দ্বিতীয় মাঝে মাঝেই নিরুদ্দেশের পানে ঘুরতে বেড়িয়ে পরে তাই নিজের নিরাপত্তার জন্য।
পাগলের মতন গাড়ি ছুটিয়ে দিল বুধাদিত্য। সাড়ে দশটার মধ্যে ফার্ম হাউসের সামনে পৌঁছে গেল। বাক্স থেকে পিস্তল বার করে প্যান্টের পেছনে বেল্টের ভেতরে গুঁজে নেয়। পকেটে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে নেয়। গাড়ি থেকে নামার আগে জামার হাতা গুটিয়ে নেয়, জামা ছেড়ে দেয় প্যান্টের ওপরে যাতে পেছনে গোঁজা পিস্তল্টা দেখা না যায়। চোয়াল শক্ত করে ঢুকে পরে ফার্ম হাউসে। দারয়ান জিজ্ঞেস করে কাকে চাই। ভারী গলায় কম্পানির নাম বলে উত্তর দেয় সে এই পার্টির লোক। বুকের মধ্যে তুমুল ঝড়, ঝিলামের যদি কিছু হয় তাহলে আজ সারা পৃথিবীর রক্ত ঝরিয়ে দেবে। মাথার মধ্যে রক্ত টগবগ করে ফুটছে, চোয়াল শক্ত করে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখে। অধীর উৎকণ্ঠায় এদিক ওদিক চেয়ে দেখে, খোঁজে ঝিলামকে। ফার্ম হাউসের সামনের বাগানে বেশ কিছু চেয়ার পাতা। বুফে সিস্টেমে এক পাশে খাবার রাখা। বেশ কিছু লোক হাতে প্লেট নিয়ে খাবার খাচ্ছে। একটি জায়গায় দেখে যে একটা লোক মদের নেশায় চুড় হয়ে টেবিলে শুয়ে। ওর চোখ শুধু ঝিলামকে খুঁজে বেড়ায়।
বুকের মাঝে হুহু করে ওঠে যখন লক্ষ্য করে যে ঝিলাম এক কোনায় একটি চেয়ারে একাকী মাথা নিচু করে বসে। চওড়া ফর্সা পিঠ থেকে থেকে ফুলে উঠছে। বুঝতে দেরি হয়না বুধাদিত্যের, ওই মীনাক্ষী অশ্রু সিক্ত। কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে বুধাদিত্য। কাঁধের ওপরে কারুর হাতের পরশ পেয়ে সারা শরীর কেঁপে ওঠে থরথর করে, ভীষণ আতঙ্কে কুঁকড়ে যায় ঝিলাম। ভয়ার্ত চোখে মাথা তুলে পাশের লোকের দিকে তাকায়। ঝাপসা চোখের সামনে বুধাদিত্যকে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা।
উঠে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্যের হাত ধরে কাতর আবেদন জানায়, “দয়া করে সমীরকে ভেতর থেকে খুঁজে আনো। আমাকে বাঁচাও, এখান থেকে নিয়ে চল। আমি এখানে থাকতে পারছিনা।”
বুধাদিত্য ঝিলামের সুন্দর মুখখানির দিকে তাকিয়ে থাকে, দুই চোখে কাজল এঁকেছিল। কান্নার জলে সেই কাজল মুছে গেছে, ভয়ে গালের লালিমা উবে গেছে, ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাসে। মাথায় সুন্দর করে একটা খোঁপা বেঁধেছিল কিন্তু এখন কেমন আলুথালু। নভেম্বরের ঠাণ্ডা কিন্তু ঝিলাম আতঙ্কে ঘেমে গেছে। বুধাদিত্য ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে যে এখানে কেউ ওর সাথে কিছু দুরব্যাবহার করেছে কি না? মাথা দুলিয়ে জানায় যে এখনো পর্যন্ত কেউ কিছু করেনি।
ঝিলাম ওর হাত প্রানপন শক্তি দিয়ে চেপে ধরে থাকে, বুধাদিত্য ওর শেষ সম্বল। ধরা গলায় বলে, “এই নাকি অফিসের পার্টি। আমার ভেতরে যেতে ভয় করছে, বুধাদিত্য।”
ঝিলাম এই রকম উদ্দাম চালচলনে অভ্যস্ত নয়। বুধাদিত্য ওকে আসস্থ করে বলে, “চল আমার সাথে ভেতরে।”
ঝিলাম জোরে মাথা দোলায়, “না না, আমি ভেতরে যাবনা। তুমি দয়া করে সমীরকে খুঁজে আনো। আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।”
চোয়াল শক্ত করে ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে, “ভেতরে কেন যাবেনা?”
ঝিলাম ধরা গলায় উত্তর দেয়, “ভেতরে সবাই উন্মাদ, সবাই ইতর। জঘন্য নোংরামো করে বেড়াচ্ছে ছেলেরা আর মেয়েরা। আমার যেতে ঘেন্না আর ভয় করছে।”
ঝিলামের বাজু টেনে পেছনে নিয়ে বলে, “আমি আছি, আমার পেছন পেছন এস।” বুধাদিত্য বাড়িটার দিকে পা বাড়ায়।
ঝিলাম ওর পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে ফার্ম হাউসের হলের মধ্যে ঢোকে। খুব শক্ত করে বুধাদিত্যের জামা আঁকড়ে ধরে থাকে। হলের মধ্যে অন্ধকার, শুধু মাত্র ঝিকিমিকি আলো সামনের নাচের জায়গা আলোকিত করে রেখেছে। খুব জোরে গান বেজে চলেছে। নাচের জায়গায় খান আটেক মেয়ে আর প্রায় খান পনেরো ছেলে মিলে উদ্দাম নাচে মগ্ন। মেয়ে গুলোর পরনের কাপড় দেখে মনে হয় অঙ্গ ঢাকার চেয়ে খুলে রাখা ভালো ছিল। বেশির ভাগ মেয়েদের পরনে ইভিনিং পারটির হাতাবিহীন কাঁধবিহীন ছোটো বস্ত্র, যা পাছার নিচে এসে শেষ হয়ে গেছে। তিনটে মেয়ের পরনে ছোটো স্কার্ট, উদ্দাম নাচের ফলে তাদের প্যান্টি ঢাকা জানুসন্ধি দেখা যায় বারেবারে। কয়েকটা মেয়ের পরনে ছোটো জিন্সের প্যান্ট শুধু মাত্র পাছা ঢেকে রাখতে পেরেছে। সবাই নেশায় চুড়, সবাই মাতাল। ছেলগুলো মেয়েদের ঘিরে অশ্লিল ভাবে নেচে চলেছে। মেয়েগুলো সেই তালেতালে নেচে চলেছে। সবার বয়স এই পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। কেউ বিবাহিতা কেউ অবিবাহিতা। একটি মেয়ের স্কার্ট কোমরের উপরে উঠে গেছে, সামনে পেছনে দুটি ছেলে ওদের যৌনাঙ্গ মেয়েটির সামনে আর পেছনের অঙ্গের সাথে চেপে ধরে এক কোনায় নেচে চলেছে। বুধাদিত্য এই সব দৃশ্য দেখে অভ্যস্থ, দিল্লীর পার্টিতে এই সব জামা কাপড় পরে উন্মাদ হয়ে যাওয়া খুব সামান্য ব্যাপার।
কোথায় এই সব মেয়েরা আর কোথায় ঝিলাম। স্বামীর সাথে অফিস পার্টিতে যাবে তাই সুন্দর গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছিল। কপালে গোলাপি আর লাল টিপ আঁকা। ঠোঁটে লাল রঙ, গালে গোলাপি রুস, চোখের কোণে কাজল এঁকে সুন্দর সেজেছিল। গোলাপি শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়ে গোলাপি রঙের ব্লাউস পরনে। ভারী সুন্দর শাড়ি, আঁচলে রুপোলী সুতোর ভারী কাজ করা। সোনার লোহা বাধানোর সাথে দুই হাতে গোলাপি আর সাদা রঙের চুড়ি। পরনের শাড়ি আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ঝিলামের নধর দেহপল্লব, গলা আর দুই হাত ছাড়া বাকি সব অঙ্গ কাপরে ঢাকা। অসামান্য সুন্দরী দেখতে লাগছিল ঝিলামকে। সামনের মেয়েদের দিকে তাকায় বুধাদিত্য আর একবার পেছনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত সুন্দরীর মুখের পানে তাকায়। সামনে পাতাললোকের পাপের উদ্দাম নাচ, পেছনে স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরা।
পেছন থেকে একজন ঝিলামকে বলে “কি ম্যাডাম, একা দাঁড়িয়ে কেন? চলুন একটু নাচা যাক। সমীর ত মদ খেয়ে কোথাও পড়ে আছে।”
ওই লোকটার কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যায় বুধাদিত্যের। ভয়ে সিটিয়ে যায় ঝিলাম। শক্ত করে ধরে বুধাদিত্যের হাতা, থরথর করে কাঁপতে থাকে। সামনে এসে বুধাদিত্যের দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে ড্রিঙ্ক করতে বলে। বুধাদিত্যের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। এক থাবরে ওর হাতের গ্লাস মেঝেতে ফেলে দেয়। হকচকিয়ে যায় লোকটা। থতমত খেয়ে নেশার ঘোরে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম বুধাদিত্যের জামা খামচে ধরে পিঠের পেছনে লুকিয়ে যায়। বুধাদিত্য ওর চোখে দেখে বুঝতে পারে যে ইতর লোকটির নজরে ঝিলামের দিকে। প্যান্টের পেছন থেকে পিস্তল বের করে আনে। এক ঝটকায় লোকটাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে খোলা মুখের মধ্যে পিস্তল ধরে। পিস্তলের চমকানি দেখে নেশা ছুটে যায়। গম্ভির গলায় লোকটাকে জিজ্ঞেস করে সমীরের কথা। লোকটা কাঁপতে কাঁপতে হাত উলটে জানায় যে, সমীরের খবর জানেনা। আশপাশ থেকে বেশ কিছু লোক ওদের দিকে আসে। সবার চোখে মদের নেশা, সবাই যেন ঝিলামকে ক্ষুধার্ত হায়নার মতন খুবলে খাবলে লুটেপুটে খাচ্ছে। বুধাদিত্য সামনের লোকটার হাঁ করা মুখের মধ্যে পিস্তলের নলি চেপে দিয়ে হুঙ্কার দেয়, একপা এগোলে মাথার সবকটা গুলি এর মুখের মধ্যে ঢেলে দেবে। আশেপাশের লোকজন এতটা ভাবতে পারেনি, থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পরে। ঝিলাম চোখ বন্ধ করে বুধাদিত্যের পিঠের সাথে নিজেকে লুকিয়ে নিতে প্রানপন চেষ্টা করে। আবার হুঙ্কার দেয় বুধাদিত্য, কেঁপে ওঠে বড় হল ঘর, জিজ্ঞেস করে, সমীর কোথায়।
পেছন থেকে একজন উত্তর দেয়, “ওই বোকা… উপরের কোন এক রুমের মধ্যে কবিতার সাথে পরে আছে। যা গিয়ে নিজের চোখে দেখে নে শালা…”
ওই খবর শোনার আগে ঝিলাম মরে কেন যায়নি। বুধাদিত্য অনুভব করে যে ঝিলামের চোখের জলে ওর জামার পিঠের দিক ভিজে গেছে। লোকটার কথা কানে যেতেই, ঘৃণায়, রোষে, তীব্র দুঃখে বুধাদিত্যের পিঠের ওপরে দশ আঙ্গুলের নখ বসিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টা করে।
বুধাদিত্য সামনের লোকটাকে ছেড়ে দেয়। পিস্তলের নল দেখে অনেকের নেশার ঘোর কেটে যায়। লোকটা ছাড়া পেয়ে দৌড়ে ওর সামনে থেকে পালিয়ে যায়। বুধাদিত্য ঝিলামের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
ঝিলামের দুই চোখ শক্ত করে বন্ধ, মাথা নিচু, বুধাদিত্যের বুকের কাছে হাত জোর করে কাতর মিনতি জানায়, “সমীরকে অইখান থেকে নিয়ে এস দয়া করে।”
ষষ্ঠ পর্বঃ আতঙ্কিত আর্তনাদ। (#2)
বুধাদিত্য ঝিলামের হাত ধরে হল ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে একটা ঘরের দরজায় লাথি মারে। হাতে উঁচিয়ে থাকে পিস্তল। কিছু এদিক ওদিক হলে সামনে যে আসবে তার ঘুলি গুঁড়িয়ে দেবে। ঘরের ভেতর দেখে যে বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ে সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ভরে টানছে আর উদ্দাম নাচে ব্যস্ত। দরজা খোলার আওয়াজে ঢুলুঢুলু চোখে ওই ছেলে মেয়েরা ওদের দিকে তাকায়। বুধাদিত্যক গর্জন করে জিজ্ঞেস করে সমীরের কথা। একজন উত্তর দেয় যে পাশের ঘরে সমীর থাকতে পারে।
পাশের ঘরের দরজায় লাথি মারে বুধাদিত্য। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল তাই প্রথম লাথিতে খুলতে পারেনা। দ্বিতীয় লাথি জোরে মারে, ছিটকিনি ভেঙ্গে খুলে যায় দরজা।
ভেতরের দৃশ্য দেখে চাপা আর্তনাদ করে ওঠে ঝিলাম। মেঝের ওপরে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় লুটিয়ে পরে আছে সমীর। পরনের কাপড় আগছলা, প্যান্টের চেন খোলা, নেতান লিঙ্গ কিছুটা বেড়িয়ে। খাটের ওপরে অর্ধনগ্ন একটি মেয়ে শুয়ে। পরনের জিন্সের ক্যাপ্রি হাঁটুর কাছে নামান, কালো প্যান্টিতে ঢাকা জানুসন্ধি, মাথার কাছে টপ দলা পাকিয়ে পরে আছে। ফাঁক করা উরুর মাঝে একটি ছেলে শুয়ে, তার প্যান্ট নেমে গেছে কোমর থেকে। দুইজনের কারুর শরীর নড়ছে না। ওই দৃশ্য দেখে ঝিলাম ঘর থেকে বেড়িয়ে মুখের ওপরে হাত রেখে পাঁজর ভাঙ্গা বেদনার আর্তনাদ গিলে নেয়। চোখ বন্ধ করে, দুই হাত মুঠি করে মাথায় বাড়ি মারতে মারতে মেঝের ওপরে বসে পরে। সেই করুন দৃশ্য বুধাদিত্যের সহ্য হয়না। সমীরের দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে পরে। নাকের কাছে আঙুল দিয়ে দেখে যে ধড়ে প্রান আছে কিনা। শ্বাস চলছে, কিন্তু বেশ ধিমে তালে। নেশার ঘোরে কি করেছে হয়ত নিজেই জানেনা সমীর। প্যান্টের পেছনে পিস্তল গুঁজে নেয়। সমীরের লিঙ্গ প্যান্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, প্যান্টের চেন আটকে দেয়। ওর ঘাড়ের নিচে হাত গলিয়ে দিয়ে বস্তার মতন কাঁধের ওপরে উঠিয়ে নেয় সমীরের নেশা গ্রস্থ সংজ্ঞাহীন দেহ। ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখে ঝিলাম, উন্মাদিনির মতন হয়ে গেছে। দু’চোখ জবা ফুলের মতন লাল। ঝাপসা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় ঝিলাম। বুধাদিত্য ওকে ইশারা করে ওর পেছন পেছন আসার জন্য। কোনোরকমে নিজেকে মেঝে থেকে টেনে তোলে ঝিলাম। কাঁদতে কাঁদতে গুটি পায়ে বুধাদিত্যের পেছন পেছন সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে আসে। গাড়ির কাছে গিয়ে বুধাদিত্য গাড়ির পেছনের দরজা খুলতে বলে। ঝিলাম গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ধরে, পেছনের সিটে সমীরকে শুইয়ে দেয়।
ঝিলাম গাড়িতে উঠে সমীরের মাথা নিজের কোলের মধ্যে নিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে, “হায় বিধাতা আজ আমাকে এই দিন দেখতে হল?”
বুধাদিত্য আবার ফিরে যায় ফার্ম হাউসে, একটা ছোটো বালতিতে জল নিয়ে আসে। সমীরের মাথা ধরে বালতির সব জল মাথার মধ্যে ঢেলে দেয়। সমীরের সম্বিৎ ক্ষণিকের জন্য ফিরে আসে। ঝাপসা চোখে একবার বুধাদিত্যের দিকে তাকায় একবার ঝিলামের দিকে তাকায়। শরীর কেঁপে ওঠে সমীরের। হরহর করে কালো মদের বমি করে দেয় ঝিলামের কোলের ওপরে। ঝিলামের শাড়ি মদের বমিতে নোংরা হয়ে যায়। রাগে কাঁপতে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলামের অশ্রুসিক্ত চোখ আর করুন মুখ দেখে সমীর কে কিছু বলেনা। ঝিলাম সমীরের মাথা বুকের কাছে টেনে ধরে শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর মুখ মুছিয়ে দেয়। সেই দৃশ্য দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনা বুধাদিত্য। রাগে গজগজ করতে করতে দুম করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। থমথমে মুখে চালকের সিটে বসে গাড়ি হাকিয়ে দেয় বাড়ির দিকে।
পাগলের মতন ফাঁকা হাইওয়ে দিয়ে দিল্লীর দিকে গাড়ি ধেয়ে চলে। আয়নার প্রতিফলনে দেখে যে সিক্ত বসনা, সিক্ত নয়না ঝিলাম স্বামীর মাথা বুকে করে নিয়ে বারেবারে কপাল, মুখ শাড়ির আঁচলে মুছে দেয়।
বুধাদিত্য ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে, “আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।”
ঝিলাম কাঁপা গলায় নিচু সুরে উত্তর দেয়, “যেখানে একটু শান্তি পাবো সেখানে নিয়ে চল।”
রাত প্রায় একটা নাগাদ বুধাদিত্য ওদের নিয়ে বাড়ি পৌঁছায়। ঝিলামের শাড়ি সমীরের বমিতে ভর্তি, গাড়ির ভেতর থেকে বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। ঝিলাম সেই নোংরা শাড়ি পরে সমীর কে দুহাতে আগলে রেখেছে, ওর ভিজে মাথার ওপরে গাল চেপে ধরে আছে। চোখে মুখে একটা হেরে যাওয়া ভাব, দুঃখে বুক ফেটে যায় ঝিলামের। বুধাদিত্য ওর মনের ভাব ওর মুখ দেখেই বুঝতে পেরে যায়। ঝিলামকে শান্তনা দেবার মতন ভাষা খুঁজে পায়না বুধাদিত্য। মনে হয় যেন সমীরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এই সুন্দরী প্রতিমাকে বুকের কোণে লুকিয়ে রাখে। চোয়াল শক্ত করে সেই অভিব্যাক্তি চেহারায় আনতে দেয় না। পেছনের দরজা খুলে সমীরকে টেনে কাঁধের ওপরে নিয়ে নেয়। ঝিলামকে বাড়ির চাবি হাতে দিয়ে বলে তিনতলায় উঠে যেতে। ঝিলাম আগে আগে, পেছনে বুধাদিত্য সমীরের শরীর কাঁধে ফেলে সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলায় ওর ফ্লাটে আসে।
ঝিলাম তালা খুলে দেয়, বুধাদিত্য সমীরকে বয়ে নিয়ে গেস্টরুমে ঢুকে বিছানার ওপরে শুইয়ে দেয়। ঝিলামের চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখের কোনের কাজল লেপটে গেছে চোখের পাশে। শাড়ি ভিজে গেছে সমীরের বমিতে, সারা শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। গা ঘিনঘিন করে ওঠে বুধাদিত্যের, কিন্তু ঝিলামের সেদিকে খেয়াল নেই। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে একটা তোয়ালে জলে ভিজিয়ে নিয়ে আসে। সমীরের পাশে বসে অতি যত্ন সহকারে ওর কপাল, মুখ মুছিয়ে দেয়। ভালোবাসার সেই স্পর্শ দেখে বুধাদিত্য বুক ফাঁকা হয়ে ওঠে। বুধাদিত্য সমীরের জামা কাপড় ছাড়িয়ে দেয়, ঘরের এসি চালিয়ে দেয়। আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে সমীরের অর্ধ নগ্ন দেহ ঢেকে দেয়। ঝিলাম চুপ করে গালে হাত দিয়ে থমথমে মুখে সমীরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে আর মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। সমীর অচেতন। দু’চোখে অবিরাম বয়ে চলে শ্রাবন ধারা। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ায় ঝিলাম।
বুধাদিত্য ঝিলামের কাঁধে হাত রেখে বলে, “ওই পাগলার কিছু হয়নি। মদ খেয়ে উলটে পরে গেছে ব্যাস। সকাল হলেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বাথরুমে গিয়ে স্নান করে নাও। আমি দেখি তোমার জন্য কোন কিছু পড়তে দিতে পারি কিনা।”
ঝিলাম বুক ভাঙ্গা কৃতজ্ঞ ভরা চাহনি নিয়ে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়। গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পরে। ঘরের মৃদু আলোতে দু’ফোঁটা চোখের জল দুটি মুক্তোর ফোঁটার মতন ফর্সা গালে চিকচিক করছে। ঠোঁট কেঁপে ওঠে ঝিলামের, “তুমি না থাকলে আমি আজ মরে যেতাম।”
বুধাদিত্য কিছু বলে না। মাথা নিচু করে আলমারি থেকে একটা ট্রাক প্যান্ট, একটা কালো পাঞ্জাবী আর একটা তোয়ালে বের করে আনে। বুধাদিত্য ইচ্ছে করেই কালো লম্বা পাঞ্জাবী বার করে, বিবকে চায়নি ঝিলামের দেহপল্লব দেখার জন্য। ঝিলামের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “বাথরুমে যাও, ওখানে সাবান শ্যম্পু সব আছে। ঠান্ডা লাগলে গিজার চালিয়ে নিও। স্নান করে পরিষ্কার হয়ে এস।”
ঝিলাম ওর হাত থেকে কাপড়, তোয়ালে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পরে। চোখের জল মুছতে মুছতে বাথরুমে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ সমীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মরার মতন বিছানার ওপরে এলিয়ে পরে আছে সমীর। রাগে ফেটে পরে বুধাদিত্য, মনে হয় পিস্তলের গুলি সবকটা ওর মাথার মধ্যে নামিয়ে দেয়। এত সুন্দরী বউ, প্রান দিয়ে ভালোবাসে তোকে, তা সত্তেও তুই মদ গিলে একটা অন্য মেয়ের কোলে ঢলে পরে গেলি? আমার না হয় কেউ নিজের বলতে নেই, আমি শালা জাত শয়তান। আলমারি থেকে নিজের জন্য বারমুডা নিয়ে নিজের বাথরুমে ঢুকে পরে বুধাদিত্য।
স্নান সেরে বেড়িয়ে আসে বুধাদিত্য। গেস্টরুমে ঢুকে দেখে সমীর অচেতন অবস্থায় উলটে শুয়ে। ঝিলাম তখন বাথরুম থেকে বের হয়নি, বাথরুম থেকে কোন আওয়াজ শুনতে পায়না। চিন্তায় পরে যায় বুধাদিত্য, রাগে দুঃখে কিছু করে বসেনি ত। দরজায় টোকা মেরে দেখবে কি? গুটি পায়ে বাথরুমের দরজার দিকে এগোয়, ঠিক সেইসময়ে দরজা খুলে ঝিলাম বেড়িয়ে আসে। সামনে বুধাদিত্য কে দেখে মাথা নিচু করে নেয়।
বুধাদিত্য ঘর থেকে বেড়িয়ে ফ্রিজের কাছে চলে যায়। কিছু খাওয়া হয়নি, ঝিলাম হয়ত এখন কিছু খায়নি। ফ্রিজ খুলে দেখে একটু খানি ভাত আছে, তাতে দু’জনার হয়ে যাবে, একটু ডাল আছে আর একটু আলু ভাজা। বুধাদিত্য খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে দেখে পেছনে ঝিলাম দাঁড়িয়ে। কালো পাঞ্জাবী হাঁটু ছেড়ে অনেকটা নেমে এসেছে, সারা শরীর আজ ঢাকা। হাতা গুটিয়ে নিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বুধাদিত্যের দিকে তাকায়।
ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্য, “কিছু খাওয়া হয়েছে?”
ম্লান হাসি দিয়ে বলে, “খাওয়া মাথায় উঠে গেছে আমার। তুমি কিছু খেয়েছ?”
বুধাদিত্য মাথা নাড়ায়, “না কিকরে খাবো। তোমার গলা শুনে দৌড়ে গেছি।” লুকিয়ে নিল যে বিকেলে একজনের সাথে ছিল।
ঝিলাম কাঁধের ওপরে তোয়ালে রেখে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “দাও ওই গুলো গরম করে দেই।”
বুধাদিত্য, “রান্না ঘরে ঢুকে দেখবে কোনার দিকে মাইক্রো অভেন আছে।”
ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে ওর হাত থেকে খাবার নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য চুপ করে সোফার ওপরে বসে টিভি চালিয়ে দেয়। কিছু পরে ঝিলাম একটা থালায় ভাত ডাল আর ভাজা নিয়ে ওর সামনে রাখে।
বুধাদিত্য ঝিলামকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি খাবে না?”
ঝিলাম মাথা নাড়িয়ে বলে, “না আমার খিধে নেই, তুমি খেয়ে নাও। আমি ও কাছে গিয়ে একটু বসি।”
ষষ্ঠ পর্বঃ আতঙ্কিত আর্তনাদ। (#3)
ঝিলামকে জোর করার ক্ষমতা নেই বুধাদিত্যর, তাই খাওয়ার প্রতি মন উঠে যায়। ঝিলাম ওর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বুধাদিত্য কোনোরকমে ভাত মাখতে শুরু করে।
ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিছু খেয়ে নাও, না হলে শরীর খারাপ করবে।”
ঝিলাম কাষ্ঠ হেসে উত্তর দেয়, “খেয়ে আর কি হবে। তোমার জন্য জল নিয়ে আসি, তুমি খাও।”
ঝিলাম জল আনতে চলে যায়। বুধাদিত্যের খাওয়া আর হয়না। ঝিলাম জলের গ্লাস হাতে এসে দেখে ভাত পরে আছে, বুধাদিত্য মাথা নিচু করে সোফার ওপরে বসে। ঝিলাম জিজ্ঞেস করে, “কি হল, খাও?”
বুধাদিত্য মাথা তুলে বলে, “না খিদে মরে গেছে আমার।”
ঝিলাম একটু কড়া গলায় ওকে আদেশ করে, “চুপচাপ খেয়ে নাও, আমার কথা চিন্তা করে কোন লাভ নেই তোমার।”
বুধাদিত্য চুপ করে কয়েক গ্রাস ভাত মুখে তোলে। ঝিলাম সেই দেখে একটু হেসে শোয়ার ঘরে ঢুকে যায়। ঝিলাম চলে যাওয়া মাত্রই বুধাদিত্য থালা নিয়ে উঠে পরে। রান্না ঘরে গিয়ে সব খাবার ডাস্টবিনে ঢেলে থালা সিঙ্কে রেখে দেয়। ফ্রিজ থেকে এক বোতল হুইস্কি আর বরফ বার করে। ফ্রিজের ওপরে ওর কাট গ্লাস সবসময়ে রাখা থাকে। সেই কাট গ্লাসে বরফ ঢেলে হুইস্কি ঢেলে নেয়। বোতল, বরফ আর গ্লাস নিয়ে সোফার ওপরে বসে পরে। সামনে টিভি চলছে, ডিস্কভারি চ্যানেলে সেই পুরানো সেরেঙ্গেটি। এক দল সিংহ একটি হরিণ ধরে তাকে খাবলে খুবলে খায়। বুধাদিত্য হুইস্কির গ্লাসে ছোটো ছোটো চুমুক দেয়।
ঠিক সেই সময়ে ঝিলাম ওর পাশের সোফার ওপরে এসে বসে। ঝিলামকে বসতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসে বুধাদিত্য। ঝিলাম কিছুক্ষণ ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে টিভির দিকে। ড্রয়িং রুমের মৃদু আলোতে বুধাদিত্য লক্ষ্য করে ঝিলামের সুন্দর গোল মুখখানি অসামান্য বেদনায় মাখা। চোখ দুটি ফাঁকা ভাষা হীন, ঠোঁট দুটি শুকিয়ে গেছে, চোখের কোনে যেন একটু কালি পরে গেছে।
ঝিলাম ওর দিকে তাকিয়ে বেদনা ভরা চোখে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কি ছাইপাশ গেল বলতে পার? কি আছে এই মদে?”
বুধাদিত্যের গ্লাস হাতেই থেমে যায়, কি উত্তর দেবে। টিভির দিকে মুখ করে উত্তর দেয়, “জানি না কি আছে, তবে এর স্বাদ অন্য। তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।”
হটাত করে ঝিলাম বুধাদিত্যের সামনে রাখা মদের বোতল হাতে নিয়ে বলে, “আজ আমি খাব, দেখব কি নেশা আছে এই মদে। কত শান্তি পাও এই সব ছাইপাস গিলে।”
হকচকিয়ে যায় বুধাদিত্য আঁতকে ওঠে, “না তোমাকে খেতে দিতে পারিনা। তুমি খেও না ঝিলাম।”
ঝিলাম বোতল ঠোঁটের কাছে এনে রেগে দুঃখে গঙ্গিয়ে ওঠে, “কেন, আমি কেন খেতে পারিনা, তোমরা খেলে কিছু না, আমি খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”
বুধাদিত্য ওর হাত ধরে ফেলে, “তুমি খাওনি কোন দিন, তুমি খেওনা এই সব।”
ঝিলাম ওর হাতের কবল থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে, চেঁচিয়ে বলে, “সবকিছুর প্রথম বার বলে কিছু আছে। আজ আমি খাবো, আজ এর স্বাদ নিয়ে দেখতে চাই, কি মধু এই মদে।”
বুধাদিত্য দাঁড়িয়ে পরে ঝিলামের সামনে। বোতলের ওপরে শক্ত করে ধরে থাকে। ঝিলাম দাঁড়িয়ে পরে ওর সামনে বোতল কিছুতেই ছাড়ে না। ওর মাথায় রক্ত চেপে গেছে। আজ যেন ঝিলামের দেহে দেবীর শক্তি ভর করে এসেছে। শক্ত করে ঠোঁটের কাছে ধরে থাকে বোতল। বুধাদিত্য একটানে বোতল ছিনিয়ে নেয়, ঝিলাম বোতল ধরতে গিয়ে ওর বুকের ওপরে পরে যায়।
ঝিলাম কেঁদে ফেলে, “তোমরা খেতে পার, তোমরা সব কিছু করতে পার আর আমি খেলে দোষ?”
বুধাদিত্য চোয়াল শক্ত করে। বুকের মাঝে তোলপাড় হয়ে যায়, বুকের ওপরে টিশার্টএর কলার চেপে ধরে ঝিলাম। মাথা ঝিমঝিম করে বুধাদিত্যের। ছুঁড়ে ফেলে দেয় মদের বোতল, মেঝেতে পরে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে যায় কাঁচের বোতল, ছড়িয়ে পরে মদ আর কাঁচের টুকরো।
বুধাদিত্য ঝিলামকে নিচু গলায় বলে, “আমি প্রতিজ্ঞা করছি, ঝিলাম, আজ থেকে আমি আর মদ ছোঁব না।”
কলার ছেড়ে মুখ চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে ঝিলাম, “যার প্রতিজ্ঞার অপেক্ষায় আমি, সে করে না কেন? বল আমাকে, উত্তর দাও।”
কি উত্তর দেবে বুধাদিত্য, তাও স্বান্তনা দেয় ঝিলামকে, “আমি কথা দিচ্ছি, সমীরকে আমি মদ খেতে বিরত করব।”
ঝিলাম চুপ করে হাঁটু মুড়ে নিজেকে গুটিয়ে সোফার ওপরে বসে পরে। খুব ক্লান্ত ঝিলাম, ক্লান্তিতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, কিন্তু বুকের মাঝে সমীরের চিন্তা। এখন জাগেনি, এখন চোখ খোলেনি। বুধাদিত্য ওর চোখমুখ দেখে বুঝে যায় যে ঝিলাম সমীরের চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। ঝিলামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতের ওপরে হাত রাখে। জল ভরা চোখে বুধাদিত্যের দিকে তাকায় ঝিলাম।
ঝিলামের ঠোঁট কেঁপে ওঠে, “ভালো হয়ে যাবে ত?”
বুধাদিত্য ম্লান হাসে, “আরে বাবা, কিছু হয়নি। শুধু মদ খেয়ে উলটে পরে আছে। দাঁড়াও আমি এক গ্লাস নুন জল বানিয়ে দিচ্ছি, তুমি ওকে খাইয়ে দাও, দেখবে সব মদ পেট থেকে হরহর করে বেড়িয়ে যাবে, শালা একদম ঠিক হয়ে যাবে।”
ঝিলাম কিছু বলেনা, চুপ করে বসে থাকে। বুধাদিত্য রান্না ঘরে ঢুকে নুন জল বানিয়ে ঝিলামের হাতে ধরিয়ে দেয়। ঝিলাম গ্লাস নিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে। বুধাদিত্য বালতি আনতে বাথরুমে ঢুকে পরে। ঝিলাম সমীরের মাথা কোলের ওপরে তুলে ধরে, কানেকানে মুখ খুলতে বলে। সমীর অচেতন, একটু নড়াচড়া করে ব্যাস। ঝিলাম ওর ঠোঁটের কাছে জলের গ্লাস ধরে, সমীর কোনোরকমে একটু ঠোঁট খোলে, ঝিলাম নুন জল ওর গলায় ঢেলে দেয়। নুন জল পেটে যাওয়ার কিছু পরে ওর শরীর কেঁপে ওঠে। বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি বালতি নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে। হরহর করে বমি করতে শুরু করে সমীর। কালো হলদে মদ আর কিছু খাবার বেড়িয়ে যায় পেট থেকে। ঝিলাম বারেবারে সমীরের মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। বুধাদিত্য জলের নিয়ে বোতল ঝিলামের হাতে ধরিয়ে দেয়। ঝিলাম আঁজলা করে জল নিয়ে সমীরের মুখে চোখে ছিটিয়ে দেয়। কিছু পরে সমীর শান্ত ছেলের মতন চুপ করে শুয়ে পরে ঝিলামের কোলে।
বুধাদিত্য ঝিলাম কে বলে, “ব্যাস, নো চিন্তা। এবারে একটু পরে দেখবে তোমার সমু ডারলিং চোখ খুলেছে।”
ঝিলাম ম্লান হেসে বলে, “চোখ খুল্লেই খেয়ে ফেলব আমি।”
হেসে ওঠে বুধাদিত্য, “পরে খেও, এখন একটু বিশ্রাম করো।”
ঝিলাম, “তুমি শুয়ে পড়ো, অনেক ধকল দিলাম তোমাকে।”
বুধাদিত্য, “না এমন কিছু ধকল দাওনি আমাকে। আমি ঠিক আছি।”
বুধাদিত্য বসার ঘরে চলে যায়, সোফার ওপরে বসে চুপ করে টিভি দেখে। ওদিকে ঘরের মধ্যে ঝিলাম সমীরের মাথার কাছে বসে থাকে চুপ করে। সমীর কিছু পরে চোখ খুলে ঝিলামের দিকে তাকায়। বুধাদিত্য দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে যে ঝিলাম ওর মুখের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। সমীর কাচুমাচু মুখ করে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে। ঝিলামের ফর্সা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। উলটো হাতে চোখ মুছে নেয়। বুধাদিত্য চুপ করে সোফা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ঝিলাম সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন লাগছে তোমার শরীর?”
সমীরের গলা শুকিয়ে গেছে, ঝিলামের মুখ দেখে ওর নেশার ঘোর কেটে গেছে। মাথা নিচু করে বিছানার ওপরে উঠে বসে। ঝিলাম ওর চিবুকে হাত রেখে মুখ নিজের দিকে করে। ঝিমীর চোখ বন্ধ করে থাকে। ঝিলাম ওর গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দেয়। চড়ের আওয়াজ সেই রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। সমীর চুপ করে বসে থাকে কিছু বলে না।
ঝিলাম সমীরের দিকে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমাকে একটু বিষ দিতে পার না। খেয়ে মরে গেলে শান্তি পাবে।”
সমীর লাল চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলে, “দয়া করে ক্ষমা করে দাও আমাকে। আমি মদের নেশায় কি করেছি কিছুই মনে নেই।” ওর পায়ের ওপরে ঝুঁকে পরে সমীর। ঝিলাম পা সরিয়ে নিয়ে চুলের মুঠি ধরে মাথা তুলে ধরে।
সমীরকে বলে, “ছিঃ পা ধরতে নেই।” ওর মুখখানি আঁজলা করে ধরে কাতর সুরে বলে, “কেন গেল ওই ছাইভস্ম? কি স্বাদ পাও ওর মধ্যে? আমি কি দেয়নি তোমাকে?”
সমীর ককিয়ে ওঠে, “না ঝিলাম, না, তোমার মধ্যে কোন খুত নেই। আমি দুঃখিত ঝিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দাও।” কেঁদে ফেলে সমীর। ঝিলাম ওকে দুহাতে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।
বুধাদিত্য চুপচাপ দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে আসে। এবারে সমীর আর ঝিলামের মান অভিমানের পালা চলবে, তারপরে বাইবে প্রেমের ভেলা।
______________________________
সপ্তম পর্বঃ অন্তরদ্বন্দ। (#1)
বুধাদিত্য ইচ্ছে করেই ওদের থেকে দুরে চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ঝিলামের কাতর আর্তনাদ আবার করে সেই ছিন্ন বন্ধন বেঁধে নেয়। বুধাদিত্য চাইলেও যেন সমীরের কাছ থেকে দুরে যেতে পারে না। সমীর আর ঝিলাম পরের দিন বাড়ি ফিরে যায়। ওদের মনমালিন্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। ঝিলামের প্রতি পাশবিক ক্ষুধার জ্বালা নিভে এক ভালোলাগা ভরে যায় বুধাদিত্যের বুকে।
পুজোতে কিছু উপহার দেওয়া হয়নি সমীর আর ঝিলামকে। ওই রাতের ঘটনার দুই দিন পরে, দুপুরে বেলা অফিস থেকে বেড়িয়ে বাজার চলে যায়। ঠাণ্ডার ভাব বাতাসে ভরে উঠেছে। লাজপত নগর মারকেট জনবহুল বাজার, নানা ধরনের জিনিস পাওয়া যায়। ঝিলামের জন্য একটা দামী সাদা ফারের জ্যাকেট কেনে আর সমীরের জন্য রেমন্ডসের সুট পিস কেনে। ঝিলামের আবার কিসান্থিমাম আর ডালিয়া বেশি পছন্দ, তাই খুঁজে খুঁজে সেই ফুলের তৈরি বড় তোড়া কিনে নেয়। মন মেজাজ বেশ খুশি, নিজের বিবেক ওকে অনেক শান্ত করে দিয়েছে।
ফোন না করেই ভেবেছিল আচমকা হাজির হবে ওদের দরজায়। ঠিক সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ওদের বাড়ি পৌঁছে যায় বুধাদিত্য। হাতে উপহারের বাক্স আর ফুলের তোড়া নিয়ে। সেদিন আর মদের বোতল নিয়ে যায়নি। ঝিলামকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার পরে ফ্রিজ থেকে সব হুইস্কি আর ভদকার বোতল ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছিল। দশ বছরের পুরানো পাপের অভ্যেস এক ঝটকায় ঝিলাম ভেঙ্গে দিয়েছিল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পরে বুধাদিত্য। ঘরের ভেতরে সমীরের জোর গলার আওয়াজ তার সাথে ঝিলামের গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
সমীর, “এমনি সময়ে জিন্স, টপ, ক্যাপ্রি পড়তে তোমার খারাপ লাগে না। কিন্তু পার্টিতে আমি ওই ড্রেস পড়তে বলেছি তাই তোমার খারাপ লেগে গেল?”
ঝিলাম, “কি ড্রেস ছিল সেটা, ছিঃ একটা কাঁধ হীন পাছার নিচ পর্যন্ত ছোটো নীল রঙের ইভিনিং ড্রেস?”
সমীর, “দিল্লীর পার্টিতে ওই সব পরে যায় লোকে। কেন দেখনি ওখানে কি রকম সবাই পরে গেছিল? তার মধ্যে তুমি ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালির মতন শাড়ি পরে। আমার যা লজ্জা করছিল সেই সময় বলে বুঝাতে পারব না।”
ঝিলাম, “কি বুঝতে পারি না আমি?”
সমীর, “দিল্লীর লোকেরা অনেক উদার চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকে তোমার মতন দুর্গাপুরের ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর মতন মানসিকতা নয় ওদের। এখানে মানুষের চিন্তাধারা অনেক স্বাধীন।”
ঝিলাম, “ছোটো কাপড় জামা পরে, অর্ধ উলঙ্গ হয়ে যারতার সাথে নেচেকুদে, মদ গিলে ব্যাভিচার করাকে স্বাধীনতা বলে না। স্বাধীনতা শিক্ষাদিক্ষায় আসে, সমীর। উদার চিন্তাধারা শিক্ষাদিক্ষার ফলাফল।”
সমীর, “বেশি জ্ঞান দিয়ো না আমাকে। কি জানো তুমি, ছিলে ত ওই দুর্গাপুরে?”
ঝিলাম, “আমার শিক্ষা তোমার চেয়ে বেশি।”
সমীর, “তোমার মানসিকতা নিচ, মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর মতন। স্বাধীন চিন্তাধারা তোমার মধ্যে নেই।”
ঝিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক স্বাধীনতা দেখিয়ছ আমাকে। তুমি সারাদিন অফিসে থাক, আমি একা একা বাড়িতে পরে থাকি, চার দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ। একবার ভেবে দেখেছ কি সেই সব কথা?”
সমীর, “কেন ভাবিনা, নিশ্চয় ভাবি।”
ঝিলাম, “কি ভাবো? আমি পুজোতে বাড়ি যাবো বলেছিলাম, নিয়ে যাওনি। দুর্গাপুজোর দিনে একটা দিন ছুটি নিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম, নিয়ে যাওনি। আমি অষ্টমীর দিন সেজেগুজে তোমার জন্য পথ চেয়ে বসেছিলাম, তুমি এলে রাত দশ’টায়, মদে ডুবে।”
সমীর, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি জানি, সেইদিন আমার অনেক কাজ ছিল তাই দেরি হয়ে গেছিল।”
ঝিলাম, “তোমার সব কথা আমাকে মেনে নিতে হয়। তুমি আমার কোন কথা মানো শুনি? তুমি মদ খাবে, আমি কিছু বলতে পারব না। তোমার ইচ্ছে মতন আমাকে কাপড় পড়তে হবে, আমি কিছু বলতে পারব না।”
সমীর, “কি চাও তুমি, আমি চাকরি ছেড়ে তোমার সামনে পুতল হয়ে বসে থাকি। গত ছয় মাসে শুধু ছয় সাতবারের জন্য বাইরে গেছি, তাও আবার এক রাতের জন্য। তোমার জ্বালায় ফিরে আসতে হয় আমাকে। আমার কেরিয়ারে কত বড় ধাক্কা সেটা তুমি বুঝতে পার না।”
ঝিলাম, “তোমাকে বাড়িতে বসতে ত বলিনি আমি। আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে বললে, তুমি কোন এক বাহানা দেখাও প্রতি ছুটির দিনে। আমি কি এখানে শুধু তোমার সাথে শুতে এসেছি? শুধু মাত্র বিছানা গরম করার জন্য আমাকে বিয়ে করেছ?”
সমীর, “সারা সপ্তাহ কাজে ডুবে আর ইচ্ছে থাকে না আমার তাই বের হই না।”
ঝিলাম, “মদ গেলার সময়ে তোমার অফিস থেকে দেরি হয় না, আমি একটু ঘুরতে যাবো বললে তোমার দেরি হয়।”
সমীর, “তোমাকে দুর্গাপুরে রেখে এলে ভালো হত।”
ঝিলাম, “তুমি জানো যে আমার যাবার জায়গা নেই তাই বারেবারে আমাকে দুর্গাপুরের কথা বল। আমার বাবার পয়সার অত জোর নেই, তাই আমার ওপরে তুমি জোর খাটাতে পার।”
সমীর, “মায়ের কথা শুনে বিয়ে করেছিলাম। বিয়েতে কি দিয়েছে তোমার বাবা?”
ঝিলাম, “আর কি দেবে, আর কি চাইতে?”
সমীর, “এক লাখ টাকা ও দিতে পারল না।”
ঝিলাম, “কেন? খাট, বিছানা, টিভি, ফ্রিজ সব কিছু বাবা কিনে দিয়েছে তারপরেও তোমার চাই?”
সমীর, “বলেছিল এক লাখ দেবে শেষ পর্যন্ত পঁচাত্তর হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়।”
ঝিলাম, “কেন? তোমাকে তার মেয়ে দিয়েছেন, সেই মেয়েকে পড়িয়েছেন, সেটার দাম কি তুমি আমার বাবাকে দিয়েছ? তুমি আবার স্বাধীনচেতার কথা বল? ছিঃ তোমার লজ্জা করে না এই সব কথা বলতে?”
সমীর, “তোমাকে নিয়ে আর পারা যায়না।”
ঝিলাম, “তুমি আমাকে এগিয়ে যেতে দাও নি। আমি কোলকাতায় থাকতেই তোমাকে বলেছিলাম যে আমাকে চাকরি করতে দাও, করতে দাওনি? কেন সেই সময়ে তোমার বউ বাইরে যাবে বলে খুব গায়ে লেগেছিল? আর যখন তুমি অন্য মেয়েদের দেখ, তখন তাদের স্বামীদের বা ভাইদের গায়ে লাগে কি লাগে না সেটা ভাব না ত?”
সমীর, “তুমি চাকরি করবে? তোমাকে আমি দুর্গাপুরে পাঠিয়ে দেব এবারে।”
ঝিলাম, “আমি কোথাও যাবো না। বিয়ে করে এনেছ যখন তখন আমার সব দায়িত্ব তোমার।”
সমীর, “তোমার জেদ আর রাগের জন্য আমি মদ খাই, আমার মাথার ঠিক থাকে না।”
ঝিলাম, “হ্যাঁ তাত বলবেই এখন। গত আড়াই বছরে কতটুকু নজর দিয়েছ আমার প্রতি? কোলকাতায় থাকতে তুমি একটু আধটু মদ খেতে আমি কিছু বলতাম না। এখানে এসে একটু বেড়ে যায় তাও আমি কিছু বলিনি। কিন্তু শেষের কয়েক মাস ধরে তুমি যা শুরু করেছ সেটা সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত তুমি কিনা অন্য একজনের সাথে, আর সেই দৃশ্য আমাকে দেখতে হল? তার থেকে আমার মরে যাওয়া ভালো ছিল।”
সমীর, “তুমি কি দিয়েছ আমাকে? এতদিনে একটা বাচ্চার মা হতে পারলে না।”
ঝিলাম কেঁদে ফেলে, “শুধু কি আমার দোষ দেখ? গত বছরে একটা মিস্ক্যারেজ হয়েছে, অনেকের হয়, তাই বলে কি শুধু আমার দোষ? তুমিও ত ডাক্তার দেখাবে না।”
সমীর, “আমার কি হয়েছে? আমার কিছু হয়নি।”
ঝিলাম, “বললেই হয়ে যাবে? ওই ত তোমার মুরদ। কত বার বলেছি, আমার গায়নকলজিস্ট ও বলেছিল তোমাকে স্পারম কাউন্ট করাতে আর তার ওষুধ খেতে তুমি শুনেছিলে?”
সমীর, “না আমার স্পারম কাউন্ট ঠিক আছে।”
ঝিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ জানা আছে, দু মিনিটে নেতিয়ে পড়ে যে মানুষ সে আবার বড় বড় কথা বলে। আমি বলে তোমার সাথে টিকে আছি, অন্য মেয়ে হলে এতদিনে ছেড়ে চলে যেত।”
সমীর, “হ্যাঁ যাও, আর আমি তাহলে বেঁচে যাই।”
ঝিলাম, “আমি সত্যি বলছি, গলায় দড়ি দিয়ে এবারে আত্মহত্যা করব।”
বাইরে দাঁড়িয়ে বুধাদিত্য কলিং বেল বাজাতে ভুলে গেল। ভেতরে তুমুল ঝগড়া চলছে, এই ভীষণ ঝড়ের মধ্যে ওর ঢোকা উচিত কি না তাই ভাবছিল। কিন্তু শেষ বাক্য ওকে নাড়িয়ে দেয়, ঝিলামের গলা শুনে মনে হল রাগের বশে হয়ত কোন উল্টো পদক্ষেপ নিয়ে ফেলবে। ঝিলামের এই দুরাবস্থা বুধাদিত্য সহ্য করতে পারেনা। মনে হয় এখুনি সমীরের মাথার ঘুলি ভেঙ্গে দেয়। প্রথম বার মনে হয়েছিল যে চলে যায় কিন্তু ঝিলামের কান্না শুনে মনে হয় দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পরে। বুধাদিত্যের শরীর রাগে কেঁপে ওঠে। চোয়াল চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে জোরে দরজায় ধাক্কা মারে। ভেতরের থেকে ভেসে আসা আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। কোন সারা শব্দ নেই, বুধাদিত্য দ্বিতীয় বার দরজায় ধাক্কা মারে। সমীর এসে দরজা খুলে দিল। ঝিলামের চোখে জল, সারা মুখ লাল, বিধ্বস্ত পরাজিত এক নারী, জীবন যুদ্ধে হেরে গেছে সবকিছু। চুরিদারের ওড়না গলায় জড়িয়ে ফাঁসে বাঁধা, তার মানে ঝিলাম সত্যি নিজেকে সমীরের সামনে শেষ করে দিত আর সমীর শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত।
বুধাদিত্য এমন ভান করল যেন কিছু জানেনা, কিছুই শোনেনি। বুধাদিত্য হেসে সমীরকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ব্রাদার, ভাবলাম তোদের পুজোতে কিছু দেওয়া হয়নি তাই নিয়ে এলাম।” ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি ব্যাপার, গলায় ঠাণ্ডা লেগেছে নাকি? ওড়নাটা মাফ্লারের মতন পরে আছো।”
ঝিলামের চোখ ছলছল, চোখ মুখ থমথমে। বুধাদিত্যের কথা শুনে, চোখ মুছে অতি কষ্টে একটু হাসি নিয়ে আসে ঠোঁটে। সমীরের চোখমুখ লাল, জড়িয়ে ধরার সময়ে অনুভব করেছিল যে সমীরের গা গরম, প্রচন্ড ক্রোধের ফলাফল।
বুধাদিত্যে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দেখ তোমার জন্য ক্রিসান্থিমাম এনেছি, এবারে হাসো একটু।”
ঝিলাম কোনরকমে ঠোঁটে হাসি টানতে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। মুখ চেপে দৌড়ে শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে। সমীরের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায় বুধাদিত্য। ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।
সমীর চেপে যায় ওদের ঝগড়ার কথা, থমথমে ভারী গলায় বলে, “কিছু না রে। তুই ভেতরে আয়। আর হ্যাঁ এই সব কি পাগলামি করেছিস?”
বুধাদিত্য, “আরে বাপ্স, কিছুই করিনি। নে ধর, আর ঝিলামকে ডাক।”
সমীরের মুখ থমথমে, বুধাদিত্য তার কারন জানে, তাও না জানার ভান করে সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে তোরা ঝগড়া করেছিস নাকি?”
বুধাদিত্য সোফার ওপরে বসে পরে, সামনে সমীর। সমীর মাথা নিচু করে ভারী গলায় বলে, “হ্যাঁ একটু মনমালিন্য হয়ে গেছে। একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।” বুধাদিত্যর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, ঝিলামের চোখে জল যেন আর সহ্য করতে পারছেনা। কিন্তু বাইরের লোক, তাই ওদের স্বামী-স্ত্রীর বাক বিতন্ডের মধ্যে আসতে চায়না। সমীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে কিছু এনেছিস আজ? মাথা ঝিমঝিম করছে, একটু খেলে ভালো হত।”
ঝিলাম ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পায় ওদের কথা। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মদের সাথে সাথে আমাকে মেরে ফেলে আমার রক্ত গিলে নাও, তবে তোমার মনে শান্তি হবে।”
সমীর মাথা বিরক্তিতে মাথা নাড়ায়, চিৎকার করে ওঠে, “চুপ করে থাক তুমি, একটা কথা বলবে না।”
বুধাদিত্যের কান গরম হয়ে যায়, হাতের মুঠি শক্ত হয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রনে রাখে। গম্ভির স্বরে সমীরকে বলে, “না আমি আজ কোন মদের বোতল আনিনি। ড্রিঙ্ক করা এক প্রকার ছেড়ে দিয়েছি।”
একটু যেন অবাক হয়ে যায় সমীর, বুধাদিত্যের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে, “কি ব্যাপার তুই মদ ছেড়ে দিয়েছিস?”
বুধাদিত্য চিবিয়ে বলে, “তোর সেইদিনের পরে শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল।”
সমীর ঝাঁঝিয়ে ওঠে ওর দিকে, “তুই আর জ্ঞান দিতে আসিস না প্লিস।”
ঝিলাম বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। সমীরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, “ও ছিল বলে এই যাত্রায় বেঁচে ফিরেছ। ও না থাকলে ওখানে মরে পরে থাকতে আর আমি ওখানে আত্মহত্যা করতাম।”
মাথা নিচু করে বসে থাকে সমীর। বুধাদিত্য বুক ভরে এক শ্বাস নেয়, এই ঝড় দুরন্ত গতি ধারন করেছে, না থামালে ভবিষ্যতে অনেক বড় আকার ধারন করবে। ওর আনা উপহারের প্যাকেট গুলো সোফার ওপরে পরে, কেউ খুলে পর্যন্ত দেখেনি। ঝিলামের দিকে তাকায় বুধাদিত্য, চোখে দুটি ছলছল, নাকের ডগা লাল, সারা মুখ লাল, কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে গেছে।
আবহাওয়ার সামাল দিতে ঝিলামকে বলে বুধাদিত্য, “এক গ্লাস জল দেবে ত, এত খুঁজে খুঁজে বিশেষ করে তোমার জন্য ক্রিসান্থিমাম এনে দিলাম, আর এক গ্লাস জল পাবো না?”
সপ্তম পর্বঃ অন্তরদ্বন্দ। (#2)
ঝিলাম ওর কথা শুনে লজ্জিত হয়ে হাল্কা হেসে ফেলে। সেই হাসি দেখে বুধাদিত্য সমীরকে বলে, “ওই দেখ ঝিলাম হেসেছে, এবারে মিটমাট কর। চল কোথাও যাই, আজ রাতে আর বাড়িতে খাবার বানাস না।”
সমীর, “না আমার আর কিছু মন করছে না।”
বুধাদিত্য, “আচ্ছা, ঠিক আছে যেতে হবে না। কি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া? আমাকে জানাতে কি কোন বাধা আছে?”
ঝিলাম বুধাদিত্যকে বলে, “আমি একটা চাকরি করব। আমার জন্য একটা চাকরি খুঁজে দেবে তুমি?”
সমীর চুপ করে বসে থাকে, ঝিলামের কথার উত্তর দেয় না। বুধাদিত্য সমীরের কাঁধ নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার? চাকরি করতে চায় বাধা দিচ্ছিস কেন?”
সমীর বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, “চাকরি করতে চায় ঝিলাম, কিন্তু…”
বুধাদিত্য, “ঝিলাম চাকরি করবে, সেট খুব ভালো কথা। তাতে তোর আপত্তি কেন?”
সমীর, “না মানে আমার আপত্তি নেই, নিজে চাকরি খুঁজে করতে পারলে করুক।” ওর গলার স্বরে প্রবল দ্বন্দের প্রতিধ্বনি।
বুধাদিত্যের কান গরম হয়ে যায়। অবস্থা নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য আবার বলে, “নে অনেক কথা কাটাকাটি করেছিস, এবারে জামা কাপড় পরে নে। চল বাইরে কোথাও যাই, ভালো লাগবে। দেখ ঘরের আবহাওয়া গুমোট মনে হচ্ছে আমার। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।” ঝিলামকে বলে, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নাও। আজ আমার তরফ থেকে ডিনার।”
ঝিলাম ওকে বলে, “না আমি যাবো না ওর সাথে।”
বুধাদিত্য দেখল যে প্রচন্ড বিগড়ে গেছে ঝিলাম। সত্যি সমীর যা করেছে তারপরে ওকে ক্ষমা করে দেওয়া একটু মুশকিল। বুধাদিত্য ঝিলামের দিকে নরম স্বরে বলে, “ঠিক আছে ওর সাথে যেতে হবে না। তুমি আমার সাথে চল, তাহলে হবে ত। মনে করে নিও যে গাড়িতে শুধু তুমি আর আমি ব্যাস আর কেউ নেই।”
বুধাদিত্য নেহেরু প্লেসে একটা বড় বাঙালি রেস্টুরেন্ট, অহঃ ক্যালক্যাটা, ফোন করে তিন জনের জন্য একটা টেবিল বুক করে নিল। সমীরের মুখ দেখে মনে হল সেখানে আগে গেছে। বুধাদিত্য আর কথা বাড়াল না, কিছু জিজ্ঞেস করল না সে বিষয়ে। সমীর মুখ কাচুমাচু করে বসে ঝিলামের দিকে তাকায়, ঝিলাম বুধাদিত্যের দিকে একটু হাসি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। সমীর কিছু পরে উঠে চলে যায় জামা কাপড় পড়তে। কিছু পরে সমীর আর ঝিলাম তৈরি হয়ে বেড়িয়ে আসে। ঝিলামের পরনে বেশ সুন্দর একটি সালোয়ার। বিশেষ কিছু সাজগোজ করেনি কারন মাথা এখন গরম। সমীর একটা জিন্স আর শার্ট পরে বেড়িয়ে আসে। বুধাদিত্য ওদের নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
গাড়িতে সমীর বুধাদিত্যের সাথে সামনের সিটে বসে, পেছনে ঝিলাম। কারুর মুখে কোন কথা নেই, এই নিস্তব্ধতা এক বিশাল ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছু করে হোক এই অবস্থার সামাল দেওয়া উচিত, ভাবতে থাকে বুধাদিত্য। ঝিলামের চোখ যে বড় ডাকে, ঝিলামের চোখে যেন জল দেখতে পারেনা বুধাদিত্য। ওই কাজল কালো চোখে জল দেখলেই বুধাদিত্যের বুক বড় কেঁপে ওঠে। আয়েশার পরে আরও এক নারীর প্রতি ওর বুকের মাঝে টান ধরেছে, এক প্রশান্ত ভালোলাগা’র টান। কিন্তু দু’জনেই ওর হতে পারেনা। কেন ওর বুকে কোন অবিবাহিতা জোটে না? রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি চেয়ারে সমীর আর ঝিলামকে বসিয়ে দেয়, ওদের সামনের চেয়ারে বুধাদিত্য। দিল্লীর বেশ নামকরা বাঙালি রেস্টুরেন্ট, ওঃ ক্যালক্যাটা।
বুধাদিত্য মজা করে সমীরকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, এই রকম চুপ করে বসে থাকবি নাকি? কিছু বল, ঝড়ের পরে’ত বৃষ্টি হওয়া উচিত রে বোকা…”
ঝিলাম উত্তর দেয়, “একটু বুঝিয়ে বল তোমার বন্ধুকে, আমাকে একদম দেখে না।”
বুধাদিত্য ঝিলামকে বলল, “তুমি চাকরি করতে চাও?” মনের কোনে এক প্রবল ইচ্ছে জাগে, ঝিলামকে সমীরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিজের করে নিতে। খুব ভারী পাথর দিয়ে বুকের মাঝে চেপে রাখে সেই প্রবল অনুভুতি।
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ। সমীর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ঠিক আছে আমি মত দিচ্ছি তুমি চাকরি করতে পার। কিন্তু আমি কাউকে চিনি না, আমি কিছু সাহায্য করতে পারব না কিন্তু।”
বুধাদিত্য সমীরকে বলে, “রাগ এখনো কমেনি তোর? ঝিলামের পাশে একটু চেপে বস’ত একটা সুন্দর ছবি তুলি তোদের। শালা আমার কাছে তোদের কোন ছবি নেই। একটু জড়িয়ে ধর ঝিলামকে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ঝিলামের কাঁধে কাঁধ দিয়ে একটু ঠেলে দেয় সমীর। ঝিলাম কপট রাগ দেখিয়ে হেসে বলে, “ন্যাকামো ছাড়ো, অনেক হয়েছে।”
বুধাদিত্য ওর মোবাইল বের করে ওদের একটা ছবি তোলে। ইচ্ছে করেই শুধু মাত্র ঝিলামের আরও একটা ছবি তোলে। বুধাদিত্য অর্ডার দিল ডাব চিংড়ি আর ভাপা ইলিশ। ঝিলামের জিবে যেন জল চলে এল, একটু হেসে বুধাদিত্যকে ধন্যবাদ জানায়। বুধাদিত্য খাওয়ার সময়ে জানায় যে ঝিলামের জন্য চাকরি খুঁজে দেবে। গল্প করতে করতে স্বামী স্ত্রীর মাঝের বরফ খানিকটা গলে যায়। সেই দেখে বুধাদিত্যের বেশ ভালো লাগে, বিশেষ করে ভালো লাগে ঝিলামের গালের লালিমা, দুটি বড় চোখের ভাষা আর ঠোঁটের হাসি। ফিরে এসেছে ঝিলাম, খুব খুশি বুধাদিত্য। কিন্তু সেই খুশি চেহারায় আনতে দেয় না। খাওয়ার সময়ে সমীর মজা করে বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে মদ ছাড়ার কারন। বুধাদিত্য কপট হেসে সমীরকে উত্তর দেয় যে একজনের কথায় মদ ছেড়ে দিয়েছে। উত্তরটা ধরতে পারে ঝিলাম, মৃদু মাথা নাড়ায়। বুধাদিত্য চোখের ইঙ্গিতে ঝিলামের অভিবাদন স্বীকার করে।
খাওয়ার পরে ওদের পৌঁছে দেয় বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকে বুধাদিত্য দুই জনকে এক সাথে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে, ওর ছোঁয়ায় শুধু মাত্র বন্ধুসুলভ অনুভুতি। এই প্রথম বার ঝিলামের কোমল দেহপল্লব বাঁধা পরে বুধাদিত্যের পেশি বহুল বাজুর মাঝে, একটুখানি কুঁকড়ে যায় ঝিলাম।
বুধাদিত্য ওদের বলে, “তোরা দুজন এই ভাবে মারামারি করলে আমি কোথায় যাই বলত? প্লিস করিস না। আর ঝিলাম, শেষবারের মতন ক্ষমা করে দাও সমীরকে। আর সমীর তুই কথা দে ঝিলামকে যে আর কোনদিন মদ খাবি না।”
ঝিলাম ম্লান হেসে বলে বুধাদিত্যকে বলে, “আমি কি ইচ্ছে করে ঝগড়া করেছি?”
সমীর মৃদু মাথা দুলিয়ে জানায় যে ও পরিতপ্ত, ভবিষ্যতে আর মদ খাবে না। সোফার ওপরে পরে আছে উপহারের প্যাকেট। বুধাদিত্য প্যাকেট গুলো ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে যে ওদের ভালো লেগেছে কিনা। সমীর প্যাকেট খুলে অবাক, এত দামী সুট পিস। সাদা ধবধবে ফারের জ্যাকেট দেখে ঝিলামের মুখে হাসি ধরেনা। ঝিলাম জানায় যে ছোটো বেলা থেকে ওর খুব শখ ছিল ওই রকম একটা জ্যাকেট পাওয়ার। ঝিলামের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সমীর সামনে না থাকলে বুধাদিত্যকে জড়িয়ে ধরত। ঝিলামের ঠোঁটের মিষ্টি হসি বুধাদিত্যকে আবার মাতাল করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ ওদের বাড়িতে বসে বুধাদিত্য খুশি মনে বারি ফিরে আসে।
ভিশাল সিনহার স্ত্রী, শমিতা, ডি.পি.এস ইস্ট অফ কৈলাস, জুনিয়ার সেক্সসান, স্কুলে অঙ্কের টিচার। বুধাদিত্য ভিশালের সাথে কথা বলে। ভিশাল জানায় যে এই ব্যাপারে বুধাদিত্য যেন শমিতার সাথে বিস্তারিত কথা বলে, এই সব ব্যাপারে ওর কোন হাত নেই। একদিন বুধাদিত্য ভিশালের বাড়ি গিয়ে ঝিলামের চাকরির ব্যাপারে কথা বলে আসে। শমিতা জানায় যে বুধাদিত্য যেন ওকে ঝিলামের প্রোফাইল মেইল করে দেয়।
সমীরের সাথে একদিন কথা হয় এই ব্যাপারে। সমীর একটু মনক্ষুণ্ণ, ঝিলামের চাকরির ব্যাপারে। কিন্তু ঝিলামের দৃঢ় সঙ্কল্পের সামনে মাথা নত করে দেয় সমীর। বুধাদিত্য এক বিকেলে সমীরের বাড়ি গিয়ে ঝিলামের সাথে বসে ওর কারিকুলাম ভিটা বানিয়ে ফেলে। বুধাদিত্য ঝিলামকে জানায় যে ওর ইংরাজি উচ্চারন প্রচন্ড বাঙালি ঘেঁষা, সেটা আগে ঠিক করতে হবে। সমীরকে অনুরোধ করে যে ঝিলামকে একটা ইংরাজি স্পিকিং কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিতে। সমীররে অনিচ্ছে থাকা স্বত্তেও ঝিলামের দৃঢ়তার জন্য শেষ পর্যন্ত ওকে ইংরাজি স্পিকিং কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। বুধাদিত্য প্রতিদিন ফোন করে সমীরের কাছ থেকে ঝিলামের খবর নেয়। ঝিলামের সাথে প্রতি রাতে কথা হয় বুধাদিত্যের। বুধাদিত্যের মনের মধ্যে এক অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে, বারেবারে মনে হয় ঝিলাম ওর অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। এইকদিনে ওদের সাথে বিশেষ দেখা সাক্ষাৎ হয়না বটে কিন্তু প্রায় প্রতিদিন ওদের সাথে কথা হয়। বুধাদিত্য কোনদিন ঝিলামকে একা ফোন করেনা, যখনি করে সমীরের ফোনে ফোন করে আর তারপরে ঝিলামের সাথে কথা বলে। বুধাদিত্য কোনদিন নিজের মনের ভালোবাসা ওদের বুঝতে দেয়না, সবসময়ে অতি প্রিয় বন্ধুসুলভ আচরন করে যায়। মনপ্রান ঝুঁকে যায় ঝিলামের দিকে কিন্তু বিবেকের কাছে হার মেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখে বুধাদিত্য।
একদিন বিকেলে অফিস থেকে বেড়িয়ে খুব ঝিলামের কথা মনে পরে যায় বুধাদিত্যের। অহেতুক কোন সমস্যায় জড়াতে চায়না তাই সমীরকে ফোন করে বুধাদিত্য। সমীরকে বলে যে ওদের বাড়ি আসছে, সেই শুনে সমীর একটু চেপে যায়, বলে বাইরে দেখা করেতে, বুধাদিত্যের সাথে ওর কিছু কথা আছে। বাড়িতে থাকলে ঝিলামের সামনে মন খুলে কথা বলতে পারবেনা। অনেকদিন বুধাদিত্যের সাথে সামনা সামনি দেখা হয়নি। সমীরের সাথে বিকেলে দেখা করে। সমীর একটু মনক্ষুণ্ণ যে ঝিলাম ঘরের বাইরে পা রেখেছে।
সমীর, “তোকে সত্যি কথাটা বলি। আমি বিয়ে করেছিলাম রুপে মুগ্ধ হয়ে। এত সুন্দরী আর প্রানবন্ত মেয়ে, যে আমি প্রথম দেখাতেই প্রেমে পরে গেছিলাম।” বুধাদিত্য যেদিন প্রথম ঝিলামকে দেখে সেদিনই ওর খিধে চাগিয়ে ওঠে, কিন্তু পরে সেই খিধে মরে এক অন্য ভালোলাগায় বুক ভরে যায়।
সমীর বলতে থাকে, “বিয়ের পরে বেশ কয়েকবার বার বলে যে ও চাকরি করবে। আমার মনের কোনায় হিংসে ভাব জাগে, একে ভীষণ সুন্দরী তার ওপরে চাকরি করতে গেলে যদি আমার হাত ছাড়া হয়ে যায় বউ, সেই ভেবে আমি ওকে চাকরি করতে বারন করি। কোলকাতায় থাকতে ওর বেশ কয়েকজন কলেজের বন্ধুদের সাথে আবার করে দেখা হয়, তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন ছেলেও ছিল। কেউ কেউ দুর্গাপুর, বর্ধমান ছেড়ে কোলকাতায় চাকরির খোঁজে এসে গেছে। ঝিলাম খুব প্রানবন্ত খোলামেলা মনের মেয়ে, আমার খুব হিংসে হত যখন ওর বন্ধুরা আমার বাড়িতে আসত। আমি মাঝে মাঝে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম যে ঝিলাম বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারছে। সত্যি বলছি তোকে, আমি সহ্য করতে পারিনি ওর হাসি। আমার ধারনা সুন্দরী বউ আমার পেছনে অন্য কারুর সাথে প্রেম করছে। একদিন খুব ঝগড়া হয় এই নিয়ে। ঝিলাম খুব জেদি মেয়ে, আমার কথা মানে না। আমি ওকে দুর্গাপুর পাঠিয়ে দিলাম একদিন। আমার মনে হয়েছিল যে দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। বাবা মায়ের কথা শুনে আমি আবার ঝিলামকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। ঝিলাম আমাকে বলে যে কোন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক রাখবে না। আমি চাকরি বদলে দিল্লী চলে আসি, শুধু ওকে বেঁধে রাখার জন্য।”
বেঁধে রাখার কথা শুনে বুধাদিত্যের মনে হয় যে সমীরের গালে সজোরে এক থাপ্পর কষিয়ে দেয়। গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে বুধাদিত্যের তাও ওর কথা চুপ করে শুনে যায়।
সমীর বলতে থাকে, “তুই যেদিন আমাদের বাড়ি প্রথমবার গেছিলি তার আগে পর্যন্ত মোটামুটি ঠিকঠাক ছিল সব কিছু। কিন্তু তার মাঝে ওর এক বান্ধবীর ফোন আসে, সে কোলকাতায় একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। সেই শুনে ঝিলাম আবার বিগড়ে যায়। আবার বায়না ধরে যে চাকরি করবে। আমি প্রথমে মানা করি, কিন্তু কিছুতেই শোনেনা ঝিলাম। আমাদের মধ্যে মনমালিন্য বেড়ে চলে। এমন দিন গেছে যে আমাকে ওর পাশে পর্যন্ত যেতে দেয়নি। নিজে না খেয়ে সারা রাত মাটিতে শুয়ে থেকেছে। কোলকাতায় থাকাকালীন শুধু অকেসানে মদ খেতাম। এখানে ওর জ্বালায় নিয়মিত হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হত বাড়ি গিয়ে কি হবে। সেই ত আবার ওর মুখ দেখা, কিছু না কিছু আছিলায় আবার ঝগড়া শুরু করে দেবে, নিজেকে কষ্ট দেবে।”
অনেকক্ষণ পরে বুধাদিত্য মুখ খোলে, “সত্যি কথা বলতে তুই অনেক নিচ, তুই অনেক স্বার্থপর, বুঝলি। আমি তোর পুরানো বন্ধু বা শত্রু, যাই বলসি, আজ আমি তোর মুখের সামনে বলছি, তুই যা করছিস ওর সাথে খুব ভুল করছিস।”
সমীর রেগে যায়, বুধাদিত্যকে বলে, “আমি জানি ওর সাথে কি করতে হয়। তুই সেদিন না এলে আমি ওকে মেরে বকে ঠিক চুপ করিয়ে দিতাম।”
যেই শোনে যে সমীর ঝিলামের গায়ে হাত তুলবে, সেইখনে বুধাদিত্যের কান গরম হয়ে ওঠে। কোনোরকমে রাগ গিলে নেয়, “আমি সেদিন তোদের ঝগড়ার কথা সব শুনে ছিলাম বাইরে দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ, আমি শুনেছিলাম। আমি চলে যেতাম জানিস, তোদের মাঝে আসতে চাইনি আমি। কিন্তু তোদের কথা কাটাকাটি সহ্য সীমার বাইরে চলে যায়। সেইজন্য আমি ঘরে ঢুকেছিলাম।”
সমীর বলে, “তুই এসে ওকে আরও মাথায় চড়িয়ে দিয়েছিস, এবারে কিছু হলে তুই দায়ী। দেখে নিস আমি ওকে বেশি দিন চাকরি করতে দেব না। আমার আর ভালো লাগছে না রে। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। সত্যি কথা বলতে ওর রুপ যৌবন আমার কাছে শেষ পর্যন্ত বিষ হয়ে দাঁড়াল। কিছুদিন পরে স্কুল জয়েন করবে আমাকে পায়ের নখের যোগ্য বলে গন্য করবে না দেখে নিস।”
বুধাদিত্যের সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়, বুধাদিত্য ওকে বিরত করতে চেষ্টা করে, “তুই কি করবি ওর সাথে? রাগের মাথায় প্লিস কিছু করিস না, একটু ভেবে চিন্তে কাজ করিস। দেখ যেদিন তুই মদ খেয়ে উলটে পরেছিলিস, অন্য মেয়ে হলে সেদিন সেখানে তোকে ওই অবস্থায় ফেলে চলে যেত। তুই জানিস তোর কি অবস্থা ছিল? ঘরের মধ্যে একটা উলঙ্গ মেয়ে উলটে পরে আছে বিছানায়, তুই মাটিতে তোর বাড়া বের করে উলটে পরে। তা সত্ত্বেও ঝিলাম তোকে বুকে আঁকড়ে ধরে, তোর বমি গায়ে মেখে তোকে আগলে রেখেছিল। সত্যি রে, ঝিলামের মতন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”
সমীর চুপ করে থাকে বুধাদিত্যের কথা শুনে, “এত কিছু’ত আমাকে বলেনি কোনদিন?”
বুধাদিত্য, “কেন বলতে যাবে? ও’যে তোকে ভালোবাসে সেটা কি বুক চিরে দেখাবে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানাবে?”
সমীরের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যায়, বুক ভরে এক শ্বাস নিয়ে বলে, “জানি না কি করব, এখন মাথার ঠিক নেই।”
সেই মুখ দেখে বুধাদিত্যের মনে হল, যে ঝিলাম আর সমীরের মাঝের অন্তরদ্বন্দ অনেক বেড়ে গেছে। ফাটল ধরেছে বিশ্বাসের প্রাচীরে। বড় ভয়ানক এই ফাটল, বুধাদিত্য তাঁর জীবন দিয়ে জানে এই ফাটল কত বড় দ্বন্দ আনতে পারে। বাবা মায়ের মধ্যে সেই প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। ছোটোবেলায় মা ওকে নিয়ে সেই যে চলে আসে কোলকাতার বাড়িতে আর ফিরে যায় না ধানবাদে। বুধাদিত্যের সামনে সেই অতীতের চক্র ঘুরে দাঁড়ায়। যতক্ষণ না কেউ ওকে ডাকে ততক্ষণ ও স্বামী স্ত্রীর মাঝে নাক গলাবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু ঝিলামের কি হবে সেটা একবারের জন্য মনে করে বুক কেঁপে ওঠে।
সপ্তম পর্বঃ অন্তরদ্বন্দ। (#3)
দিনেদিনে বুধাদিত্য বদলে যায়, মদ ছেড়ে দিয়েছে, তবে সিগারেট খাওয়া কমাতে পারেনি। আর বারে যাওয়া হয় না বুধাদিত্যের, নারীসঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে। শুধু মাঝে মাঝে আয়েশার কথা খুব মনে পরে। জানে যে এই বুকে আয়েশা কোন দিন আসতে পারবে না, ঝিলামও কোনদিন আসতে পারবে না। শুধু এক ফাঁকা হৃদয় নিয়ে খুঁজে বেড়ায় মনের মানুষ। কিন্তু সেই মানুষ ধরা দেয়না বুধাদিত্যকে। বুঝতে দেরি হয়না বুধাদিত্যের যে ঝিলামের চোখ, ঝিলামের ঠোঁট বড় ডাকে ওকে, সেটা শুধু ওর মনের ভ্রম। কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনা ঝিলামকে। চোখ বন্ধ করলেই ঝিলামের সেই রাতের সুরেলা কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে, একটা ফোন করতে বলেছিল ঝিলাম। ঝিলামের কথা মনে পরতেই, মোবাইলে তোলা ঝিলামের ছবি খুলে দেখে। একটু গম্ভির মুখ, তাও যেন ঠোঁটে হাসি টেনে ধরে। রাগলে ভারী সুন্দরী দেখায় ঝিলামকে।
সমীরের সাথে কথা বলে বোঝে যে সমীর একটু নরম হয়ে গেছে। মেনে নিয়েছে ঝিলামের আব্দার, তবে মন থেকে নয়, উপর উপর। বুধাদিত্য একদিন ঝিলাম আর সমীরকে নিয়ে ভিশালের বাড়ি যায়। দিনেদিনে ঝিলাম অনেক পরিনত হয়ে ওঠে। কথাবার্তাতে এক নতুন আত্মপ্রত্যয় দেখা দেয়। বুধাদিত্য লক্ষ্য করল যে ঝিলাম দুর্গাপুর ছেড়েছিল সেই ঝিলাম আর নেই। শীতকাল, ঝিলাম একটা গাড় নীল রঙের জিন্স পড়েছে, উপরে হাল্কা বেগুনি রঙের শার্ট। তারপরে বুধাদিত্যের দেওয়া সাদা ফারের জ্যাকেট। ঝিলাম যেন সুন্দরী এক জলপরী। সমীরের চোখে মুখে যেন হেরে যাওয়ার ভাব বেশি করে ফুটে ওঠে। বুধাদিত্য ঝিলামকে দেখে বেশ খুশি হয়। কিন্তু নিজের মনের ভাব লুকিয়ে রাখে সমীরের সামনে। শমিতাকে বুধাদিত্য ঝিলামের কথা আগে থেকেই বলে রেখেছিল। সামনা সামনি কথা বলার পরে শমিতার মনে হয় যে ঝিলাম এবারে তৈরি। একদিন শমিতা বুধাদিত্যকে ফোন করে জানায় যে ঝিলামকে নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে আসতে হবে। সমীরের সাথে কথা বলে বুধাদিত্য, সমীরকে ছুটি নিতে বাধ্য করে। সমীর ছুটি নিয়ে ঝিলামের সাথে স্কুলে যায়। রাতের বেলা সমীর বুধাদিত্যকে ইন্টারভিউর কথা জানায়। কিছুদিনের মধ্যে ঝিলামের চাকরি হয়ে যায়।
ঝিলাম মনেপ্রানে বুঝতে পারে যে বুধাদিত্য না থাকলে এই যাত্রায় ওকে বাঁচানোর কেউ ছিলনা, এমন কি বিবাহিত স্বামী ওর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল। যেদিন এপয়েন্মেন্ট লেটার পায় সেদিন খুশিতে মাটিতে যেন পা পরেনা। সব থেকে আগে বুধাদিত্যকে ফোন করে। এই প্রথম বার ঝিলামের সাথে একা কথা বলছে বুধাদিত্য। ওর সুরেলা উচ্ছল গলার স্বর শুনে বুধাদিত্য পাগল হয়ে যায়।
ঝিলাম, “জানো আজ কুরিয়ারে আমার এপয়েন্মেন্ট লেটার এসেছে। শীতের ছুটির পরে আমার জয়েনিং, জানুয়ারির মাঝামাঝি।” মনে হয় এখুনি দৌড়ে গিয়ে ঝিলামকে জড়িয়ে ধরে। নিজের কেবিনে চুপ করে বসে সেই মনোভাব চেপে নেয় বুধাদিত্য। বুধাদিত্য শুধু একটু হুম করে উত্তর দেয়। ঝিলাম খুশিতে যেন ফেটে পড়ছে, “তুমি আজ বিকেলে আমাদের বাড়ি চলে এস। আমি সমীরকে এখুনি ফোন করে দিচ্ছি অফিস থেকে যাতে তাড়াতাড়ি বের হয়। আমি চিকেন নিয়ে এসছি, চিলি চিকেন বানিয়ে খাওয়াব তোমাকে।”
বুধাদিত্য কাজের আছিলা দেখায়, “না, আজ অনেক কাজ আছে অফিসে। পরে একদিন যাবো। যাই হোক তুমি এখনো সমীরকে ফোন করে জানাও নি কেন? তাড়াতাড়ি ফোন করো ওকে, এযে বড় খুশির খবর।”
ঝিলাম একটু মনমরা হয়ে উত্তর দেয়, “তুমি সত্যি আসবে না?”
ওই গলার স্বর শুনে বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করে বুধাদিত্যের, চোয়াল শক্ত করে ধির গলায় বলে, “না ঝিলাম আমার অনেক কাজ আছে আজকে থাক। তোমরা আনন্দ কর, পরে আমি যাব। আমি তোমার চাকরি পাওয়াতে খুব খুশি হয়েছি।”
ঝিলাম মনমরা হয়ে বলে, “তুমি আসলে খুব ভালো লাগত।” ফোন রেখে দেয় ঝিলাম।
বুধাদিরত্য মোবাইল খুলে ঝিলামের ছবি দেখে বসে বসে। ঝিলামের শেষের আওয়াজ বড় কানের মধ্যে বেজে ওঠে, “তুমি আসলে খুব ভালো লাগত।” ওর দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিধ্বনি হয় সুরেলা গলার আওয়াজ।
কিছু পরে সমীর ওকে ফোন করে। সমীরের গলার স্বর বদলে গেছে, বউয়ের চাকরি নিয়ে একটু খুশি ব্যাক্ত করল। বুধাদিত্যকে অশেষ ধন্যবাদ জানাল। ঝিলামের মিষ্টি ঠোঁটের হসি, নরম গালের লালিমা, দুটি গভীর চোখের অব্যাক্ত ভাষা বুধাদিত্যকে বড় কাছে টানে। শেষ পর্যন্ত হেরে যায় বুধাদিত্য, হুহু করে ওঠে বুক, ফাঁকা হয়ে যায় সবকিছু। খুব মনে হয় আয়েশার কথা। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে আয়েশাকে ফোন করে বুধাদিত্য। কিন্তু ফোনের রিং বেজে বেজে থেমে যায়, অপাশ থেকে কেউ ফোন তোলেনা। বুধাদিত্য একটু ভাবনায় পরে, কিছু হল না ত সেই উচ্ছল তরঙ্গিণীর, বুক আবার যেন হুহু করে ওঠে। ওর কপালে ভাগ্য বিধাতা শুধু মাত্র দেহাত্মবাদী সুখের কথা লিখে গেছে, ওর জন্য ভাগ্য বিধাতা প্রানের আনন্দের কথা লিখে যায়নি। আয়েশার অফিসে ফোন করে জানে যে বেশ কয়েকদিন আয়েশা অফিসে আসছে না, কোন এক কাজে বম্বে গেছে। খুব ইচ্ছে করে নিজের কাউকে ফোন করে কথা বলতে, কিন্তু ওর মনের কথা শোনানোর মতন লোক খুঁজে পায়না।
বিকেলে ফাঁকা বাড়িতে ফিরে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। ঝিলামকে কথা দিয়েছিল যে মদ ছোঁবে না, তাই ড্রিঙ্কস আর করেনা। মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বুধাদিত্য নিজের মনের কথা বলে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে মাকে বলে, “মা আমি ঝিলাম কে ভালোবেসে ফেলেছি মা। আমি কি করব মা, আমাকে একটু পথ দেখাও। আমার যে তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ নেই মা।” মঞ্জুষাদেবী কাঁচের আড়াল থেকে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসেন, কিছু বলেন না সেইদিন।
বুধাদিত্য জানত কোন তারিখে ঝিলাম স্কুল জয়েন করবে তাও চুপ ছিল। সমীর ফোন করে বুধাদিত্যকে জানায় যে ঝিলাম স্কুল জয়েন করবে। সমীর অনুরোধ করে ওদের সাথে যেতে। বুধাদিত্য মজা করে জানায় যে অত সকালে ঘুম থেকেই ওঠে না, ওদের কি করে নিয়ে যাবে। ঝিলাম সমীরের হাত থেকে ফোন নিয়ে বুধাদিত্যকে অনুরোধ করে। ঝিলামের কর্ম জীবনের প্রথম দিন, গত কয়েক দিন ধরে উত্তেজনায় ঝিলামের ঘুম হয় না। সমীর নাছোড়বান্দা, বুধাদিত্যকে সাথে যেতে হবে। বুধাদিত্যের মনে চাপা উত্তেজনা। সমীর ওকে বলে, যেহেতু ঝিলামের স্কুল আর বুধাদিত্যের অফিস একদম কাছাকাছি। সুতরাং ওকে স্কুলে ছেড়ে ও অনায়াসে অফিস যেতে পারবে। বুধাদিত্য ঝিলামের মিষ্টি অনুরোধ প্রত্যাখান করতে পারেনা। জানিয়ে দেয় যে সকালে ওদের বাড়ি পৌঁছে যাবে।
শীতকাল, প্রচন্ড ঠাণ্ডা পড়েছে দিল্লীতে। সকাল বেলা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যায় সমীরদের বাড়ি। দরজা খোলে ঝিলাম, স্কুল যাবার জন্য তৈরি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে বুধাদিত্য। সত্যি একদম শিখিকার মতন দেখতে লাগছে। পরনে হাক্লা গোলাপি তাঁতের শাড়ি, গাড় বাদামি রঙের চওড়া পাড়। গায়ের ওপরে ভারী একটা সোয়েটার। মাথার চুল বেনুনি করা, কপালে লাল টিপ, দুই হাতে পলা বাঁধানো আর একটা ঘড়ি ছাড়া কিছু নেই, ঠোঁটে দুটি হাল্কা গোলাপি। খুব মার্জিত সাজ অতিব সুন্দরী শিক্ষিকা। সমীর যাবার জন্য তৈরি। বুধাদিত্য ওদের নিয়ে গাড়ি করে বেড়িয়ে পরে। সমীর গাড়ির সামনের সিটে উঠতে যায়, ঝিলাম ওকে টেনে ধরে পেছনের সিটে বসিয়ে দেয়। সমীর হাসতে হাসতে পেছনের সিটে গিয়ে বসে। ঝিলাম সারাটা পথ সমীরের হাত ধরে থাকে। আয়নায় সেই দৃশ্য দেখে বুধাদিত্যের মনের খুশি খুশি ভাবটা একটু কেটে যায়। চঞ্চল মনকে শান্ত করে নেয় বুধাদিত্য। ঝিলামকে নামিয়ে দেয়, স্কুলের সামনে। সমীর আলতো করে ওর হাত টেনে ধরে। ঝিলাম চোখের ইশারা করে জিজ্ঞেস করে কি করছ? সমীর গাড়ি থেকে নেমে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিছু বলে। ঝিলামের গাল লাল হয়ে যায় লজ্জায়। চট করে সমীর ওর গালে একটা ছোটো চুমু খেয়ে নেয়। অনেক দিন পরে একটু যেন আদরের পরশ পায় ঝিলাম, হটাত করে চোখের কোনে জল চলে আসে। সমীর ঝুঁকে পরে ওর গালে হাত দিয়ে যেতে বলে। ঝিলাম গেটের ভেতরে না ঢোকা পর্যন্ত সমীর দাঁড়িয়ে থাকে। বুধাদিত্য সবকিছু গাড়ি থেকে বসে বসে দেখে, একবারের জন্য গাড়ি থেকে নামে না।
ঝিলাম ঢুকে যাবার পরে সমীর সামনের সিটে এসে বসে পরে। বুধাদিত্য ওকে জিজ্ঞেস করে যে ঝিলামের চাকরিতে সমীর খুশি কিনা। সমীর প্রান খোলা হাসি হেসে বলে ঝিলামের মুখের হাসির ফিরে পাবার জন্য ও খুশি। ক্ষণিকের জন্য বুধাদিত্যের মনে হিংসে হয়, আমি তোর কাছ থেকে ঝিলামকে কেড়ে নেব একদিন। অফিসে নামিয়ে দেয় সমীরকে।
ঠিক নামার আগে সমীর বুধাদিত্যের হাত ধরে বলে, “তুই অনেক করেছিস আমাদের জন্য। সেই রাতে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিস, ঝিলামকে চাকরি দিয়েছিস। তাও তুই আমাদের থেকে দুরে দুরে কেন থাকিস? আমাকে সত্যি কথা বলত একটু?”
ভাষা হারিয়ে ফেলে বুধাদিত্য, কি উত্তর দেবে? বলবে যে ঝিলামকে ভালোবাসে সেই ভালোবাসা যে শুধু শরীরের নয় শুধু মাত্র আত্মার এক অন্য মাত্রার ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার সংজ্ঞা জানেনা বুধাদিত্য, কেউ বুঝবে সেই প্রেমের মানে। আর তাই বুধাদিত্য নিজেকে ওদের থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। কি বলবে, বুধাদিত্য, ভেবে পায়না উত্তর।
আমতা আমতা করে বলে, “আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই।” সমীরকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। বুকের ভেতরে একটা চিনচিন বেদনা শুরু হয়ে যায়। সমীরের হাসি মুখ, ঝিলামের হাসি মুখ, এর মাঝে কি করছে বুধাদিত্য?
______________________________
অষ্টম পর্বঃ প্রজাপতির প্রস্থান।
ঝিলামের স্কুল আর বুধাদিত্যের অফিস একদম কাছাকাছি। লাঞ্চের পরে বিকেলের দিকে ঝিলামের স্কুল ছুটি হয়ে যায় আর ঝিলাম বুধাদিত্যের অফিস পৌঁছে যায়। বুধাদিত্য ঝিলামকে অফিসের নিচে দেখে অবাক একেবারে আশাতীত দর্শন। সেদিন ঝিলামের পরনে আঁটো গোলাপি রঙের চুড়িদার কামিজ, হাল্কা নীল রঙের সোয়েটার বেশ ফোলা ফোলা। মাথার চুল চুড় করে মাথার ওপরে বাঁধা, তাঁর মধ্যে আবার একটা পেন গোঁজা, ঠিক জাপানি পুতলের মতন দেখতে মনে হয় ঝিলামকে। ঝিলাম অফিসের রিসেপ্সানে বসে ছিল। বুধাদিত্যকে দেখে খুব খুশি, যেন অনেক দিন পরে অতি পুরানো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে।
একটু কপট অভিমান দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে বুধাদিত্যকে, “চাকরি পাওয়ার পরে এত ডাকলাম তাও একবারের জন্য বাড়ি এলেনা কেন? আমাদের ওপরে রাগ করে আছো? ভাব বড় জ্বালায় এই স্বামী স্ত্রী তাই ওদের থেকে দুরে থাকা ভালো।”
বুধাদিত্য কি উত্তর দেবে ঝিলামকে, অজে সত্যি ঝিলামের থেকে দুরে সরে যেতে চাইছে। যতবার দুরে যায় ততবার ঝিলাম ওকে কাছে ডেকে নেয়। এবারেও ভেবেছিল যে ঝিলামের চাকরির পরে বুধাদিত্য ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দেবে। কিন্তু চোখের সামনে ঝিলামকে দেখে মাথার মধ্যে সব কিছু গুবলেট হয়ে যায়। হাসতে হাসতে ঝিলামকে বলে যে কাজের চাপের জন্য ওদের সাথে দেখা করতে পারছে না। ঝিলাম ওর কথা বিশ্বাস করে না। ঝিলাম ওকে অনুরোধ করে বাড়িতে ছেড়ে আসতে। বুধাদিত্য মহা ফাঁপরে পরে যায়। বুধাদিত্য বুঝাতে চেষ্টা করে যে অফিসে অনেক কাজ আছে। ঝিলাম জেদ ধরে বসে থাকে, বলে যে অফিসের কাজ শেষ করে ওর সাথে বাড়ি যেতে হবে। নিরুপায় বুধাদিত্য, শেষ পর্যন্ত ঝিলামের জেদের কাছে হার মেনে যায়। রিসেপ্সানে বসিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। একটু ভালোলাগা, একটু পূর্বরাগ বুকের ভেতর জেগে ওঠে। কিছু পরে ঝিলামকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে। রাস্তায় যেতে যেতে ঝিলাম ওকে স্কুলের গল্প শুনাতে শুরু করে দেয়। নতুন চাকরি, নতুন লোকজন, নতুন পরিবেশ, উচ্ছল তরঙ্গিণীর মতন বয়ে চলেছে ঝিলামের মধুর কণ্ঠস্বর। বুধাদিত্য শুধু মাত্র হু, হ্যাঁ ছাড়া বিশেষ উত্তর দিতে চায় না। ঝিলামকে ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসে। ঝিলাম অনেক বার বুধাদিত্যকে বাড়ির মধ্যে আসতে বলে কিন্তু বুধাদিত্য কাজের আছিলায় ঝিলামের চোখের সামনে থেকে সরে আসে।
কয়েক দিন পরে স্কুল থেকে আবার ঝিলামের ফোন, “আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে?”
এবারে বুধাদিত্য ওকে মজা করে বলে, “আমি কি তোমার ড্রাইভার?”
ঝিলাম মজা করে বলে, “যদি বলি হ্যাঁ…”
বুধাদিত্য, “সমীর কে বল তোমার জন্য একটা গাড়ি কনে দেবে।”
ঝিলাম, “নিজের জন্য একটা কিনুক আগে তারপরে দেখা যাবে। আর সে’ত আজকাল রাত করে ঘরে ফেরে, আমি আর কিছু বলিনা।”
বুধাদিত্য একটু খানি থমকে যায়, “মানে?”
ঝিলাম শুকনো গলায় বলে, “সমীরের অফিসে নাকি আজ কাল অনেক কাজের চাপ তাই দেরি করে ফেরে। আজকাল আবার টুর একটু বেড়ে গেছে, তবে যেদিন যায় সেদিনেই ফিরে আসে। কিছু বললেই বলে, যে আমি চাকরি পেয়ে গেছি, আমি সব কিছু পেয়ে গেছি, এবারে ওর আর কি দরকার। জানো আমার মনটা খুব কাঁদে সমীরের ওই কথা শুনে।”
বুধাদিত্যের বুক ঝিলামের কথা শুনে কেঁদে ওঠে, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সমীরের সাথে কথা বলব খানে।”
ঝিলাম, “তুমি আর কত করবে আমাদের জন্য, ছাড়ো আমার ভাগ্য যা আছে তাই নিয়ে থাকি। হ্যাঁ এবারে বল আমাকে ছেড়ে আসবে বাড়িতে না আমি অটো করে চলে যাবো।”
বুধাদিত্য, “তুমি প্লিস অটো করে চলে যাও, আমি দেখি কয়েক দিনের মধ্যে একটা ড্রাইভার যোগাড় করে নেব।”
ওর কথা শুনে হেসে ফেলে ঝিলাম, “আমার জন্য তুমি ড্রাইভার রাখবে? তুমিই ত আমার ড্রাইভার, এক বান্ধবীর জন্য এইটুকু করতে পারবে না?”
বুধাদিত্য, “বাঃ রে তুমি আমাকে জ্বালাতন করবে রোজদিন, গাড়িতে যেতে চাইবে, অফিসে কাজ থাকে তাই একটা ড্রাইভার রাখা ভালো। যেদিন আমার কাজ থাকবে না সেদিন আমি পৌঁছে দেব না হলে ড্রাইভার তোমাকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসবে।”
ঝিলাম হটাত ফিসফিস করে বলে ফেলে, “আমার ড্রাইভার চাইনা, তুমি পাশে থাকলে বড় ভালো লাগে তাই বললাম।” বলেই ঝিলাম ফোন কেটে দেয়। বুধাদিত্য হটাত ওর গলায় ওই কথা শুনে স্থম্ভিত হয়ে যায়। এটাকি ভাললাগার পূর্বাভাস না শুধু মাত্র বন্ধুপ্রীতি?
সেদিনের পরে ঝিলামের ফোন আর আসেনা। বুধাদিত্যের হৃদয় ছটফট করে ঝিলামের সাথে দেখা করার জন্য, কিন্তু আগ বাড়িয়ে যেতে বড় বাধা লাগে। ঝিলামের কথা মনে পড়লেই রোজরাতে মোবাইল খুলে একবার ঝিলামের সেই অভিমান করা মুখের ছবি দেখে আর নিজের মনের ভালোবাসা কে সংযত করে রাখে। এইভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়।
এর মাঝে একদিন সকাল বেলায় আয়েশার ফোন আসে। বুধাদিত্য সবে অফিস যাবার জন্য স্নান করে বেড়িয়েছে। এবারে বেশ জমে ঠাণ্ডা পড়েছে। জানালার বাইরে কুয়াশায় ঢাকা।
আয়েশা, “এই তুমি কি করছ আজকে?”
আয়েশার গলা একটু মনমরা বলে মনে হয়। অনেকদিন পরে আয়েশার গলা শুনে অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার, কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে তুমি?”
আয়েশার গলা একটু খানি শুকনো, “তুমি কি আজ ফ্রি আছো?”
বুধাদিত্য, “কেন বলত? এমনিতে আমার আজকে অনেক কাজ আছে তবে সেটা তোমার ইচ্ছের ওপরে নির্ভর করছে।”
আয়েশা কাতর কণ্ঠে বলে, “তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই বুধাদিত্য। প্লিস আজকে না কোরো না।”
বুধাদিত্য ভেবে পায়না হটাত আয়েশার একি হল, “ওকে, চলে এস, আমি তাহলে আজ আর অফিস যাচ্ছি না।”
বুধাদিত্য সাতপাঁচ ভাবতে থাকে। রোহিতের সাথে কি কিছু মনমালিন্য ঘটল আয়েশার? না আবার কোন অফিসের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে এর মাঝে। মদ, মেয়ে সব ছেড়ে এক নতুন বুধাদিত্য, তাও আয়েশা ওকে খুব টানে। আগে আয়েশা যখনি আসত, নিজে রান্না করে যেত। বুধাদিত্যের প্রতি ওর একটা অন্য টান আছে।
আয়েশা যথা সময়ে বুধাদিত্যের দরজার কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে আয়েশাকে সাদর আহবান জানায়। আয়েশা যেন আজ একটু বেশি নিজেকে সাজিয়ে এনেছে। এত সকাল বেলা, বেশ সুন্দর পরিপাটি সেজে এসেছে। সাদা আঁটো জিন্স, গাড় নীল রঙের লম্বা জ্যাকেট, কানে বড় দুল, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙ, চোখের কোনে আবার কাজল পড়েছে। কাঁধের ব্যাগ দেখে মনে হল যে অফিসের জন্য বের হয়নি, শুধু মাত্র ওর সাথে দেখা করার জন্যই এসেছে। আয়েশার চোখে মুখে এক অধভুত খুশির আলো ছড়িয়ে।
আয়েশা দরজা বন্ধ করে ওকে ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বলে, “কেমন আছো? আমার কথা মনে পড়ত তোমার?”
বুধাদিত্য ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়েশাকে, “হ্যাঁ মনে পড়েছিল, তাই ত ফোন করেছিলাম কতবার। কিন্তু ফোন রিং হয়ে যেত কেউ উঠাত না। এত দিন কোথায় ছিলে?”
আয়েশা গায়ের জ্যাকেট খুলে সোফার ওপরে বসে বলে, “হ্যাঁ ফোনটা খারাপ হয়ে গেছিল, এই কদিনে কারুর ফোন ধরতে পারিনি।”
বুধাদিত্য ওর পাশে বসে ওর কাঁধের ওপরে হাত রাখে, আয়েশা ওর দিকে সরে এসে ঘন হয়ে বুকের কাছে বসে বুকের ওপরে আদর করে দেয়। আয়েশার গাঁ থেকে খুব মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে ওর নাকে, আয়েশার মাথার ওপরে ঠোঁট চেপে প্রগার করে নেয় আলিঙ্গন। আয়েশা নিজেকে ছেড়ে দেয় বুধাদিত্যের পেসিবহুল বাহুবন্ধনের মাঝে।
বুধাদিত্য ওকে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বলত, কোথায় গেছিলে আর কেন এতদিনে একবার যোগাযোগ করনি।”
আয়েশা বুধাদিত্যের কথার উত্তর দেয় না, পালটে জিজ্ঞেস করে, “কি আছে রান্না করার মতন, দেখি আগে তোমার জন্য রান্না করে ফেলি তারপরে দুজনে মিলে অনেক গল্প করব, তোমার সব গল্প আমি শুনব আজকে।”
আয়েশা নিজেকে বুধাদিত্যের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে পরে সোফা থেকে। হাঁটার তালে ভারী পাছা বুধাদিত্যের চোখের সামনে দুলে ওঠে। বুধাদিত্যের তলপেটে চিনচিন করে ওঠে, লিঙ্গ একটু শক্ত হয়ে যায়, আয়েশার পাছার দুলুনি দেখে। রান্না ঘরে ঢোকার আগে আয়েশা ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে যে বুধাদিত্যের নজর ওর সুগোল নিটোল পাছার ওপরে নিবদ্ধ। খিলখিল করে হেসে ফেলে আয়েশা, সেই মিষ্টি হাসির সুর বন্ধ ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়।
বুধাদিত্য আয়েশাকে জানায়, “আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, আয়েশা।”
আয়েশা ওই কথা শুনে অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, “কি বলছ? তুমি ড্রিঙ্ক করা ছেড়ে দিয়েছ? হতেই পারে না।”
বুধাদিত্য কাষ্ঠ হাসি হেসে বলে, “বিশ্বাস না হলে ফ্রিজ খুলে দেখতে পার।”
আয়েশা নিজের কান বিশ্বাস করে না, ফ্রিজ খুলে দেখে যে শুধু খাবার দাবার ছাড়া, কোন মদের বোতল ফ্রিজে নেই। ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে বুধাদিত্যের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন ভাবত, যে বুধাদিত্য শুধু ওর কথা শোনে, কিন্তু ওর জীবনে অন্য কেউ এসেছে জেনে চোখের কোনায় নিজের অজান্তে একটু খানি ছলকে ওঠে খুশির আর বেদনা মাখা অশ্রু।
আয়েশা আবার বুধাদিত্যের কাছে এগিয়ে আসে, ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর মুখখানি আঁজলা করে তুলে ধরে। বুধাদিত্যের মন হুহু করে ওঠে আয়েশার স্নেহ ভালোবাসা মাখানো পরশে। আয়েশা ওকে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে শেষ পর্যন্ত কাউকে পেয়েছ, বল? আমি খুব খুশি। কে সে আমার সাথে দেখা করাবে না, তাকে?”
বুধাদিত্য কি বলবে, বলবে যে মনে মনে ঝিলামকে ভালোবেসে ফেলেছে আর তাই ওর কথা মেনে মদ, নারীসঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে। বুধাদিত্য মুখে হাসি টেনে এনে বলে, “না গো ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, বোকা… ড্রিঙ্ক করতে করতে লিভারটা বড় হয়ে গেছে তাই মদ ছাড়তে হল।”
আয়েশা ম্লান হেসে বলে, “তোমার চোখ বলছে তুমি খুব বড় ব্যাথা লুকিয়ে আছো, ডাক্তারের কথা সব মিথ্যে। সত্যি কথা বল না আমাকে, কে এসেছে তোমার জীবনে, আমি তোমাকে কিছু বলব না।”
বুধাদিত্য চেপে যায় ঝিলামের সাথে ওর অপ্রকাশিত সম্পর্কের কথা, “সত্যি তোমার প্রমিস, আয়েশা, এই বুক বড় ফাঁকা।”
আয়েশা ওকে জড়িয়ে ধরে দুইহাতে, ওর মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে বলে, “আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব যাতে খুব তারাতারি তুমি মনের মানুষ খুঁজে পাও।”
বুধাদিত্য ওর বুকের মাঝে মাথা রেখে দুহাতে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। অনেকদিন পরে ওর ভাললাগার পাত্রীকে বুকের কাছে পেয়েছে। মনের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যাথা থাকা স্বত্তেও আয়েশাকে পেয়ে সেই বেদনা একটু খানি স্তিমিত হয়ে গেছে।
আয়েশা কিছু পরে বলে, “এই ছাড়ো আমাকে, রান্না সেরে ফেলি, তারপরে দুজনে মিলে শুধু গল্প করব।”
ফ্রিজে কিছু কাঁচা চিকেন রাখা ছিল, সেটা রান্না করে ফেলে আয়েশা। রান্না করতে করতে বুধাদিত্যের সাথে গল্প করে এইকদিনে কোথায় ছিল। রোহিতের একমাস লম্বা একটা অফিসিয়াল টুর ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাই তাঁর সাথে ইউরোপ গিয়েছিল। রোম, প্যারিস, মিলান, হেগ, বার্লিন অনেক জায়গা ঘুরেছে। নানান জায়গা ঘুরে ওর খুব ভালো লেগেছে, কোথায় কিকি দেখেছে সেই সব বর্ণনা। বুধাদিত্য উচ্ছল সেই প্রজাপতির মধুর ধ্বনি শোনে মন দিয়ে। একবার মনে হয় পেছন থেকে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে ওর ওই মরালী গর্দানে ঠোঁট চেপে ধরে। দুই ভারী পাছার মাঝে নিজের উত্থিত লিঙ্গ চেপে, পিষে দেয় আয়েশার নরম দেহ।
আয়েশা ওর চোখের ভাষা পড়ে ফেলে, বাঁকা হেসে বলে, “পড়ে হবে ডারলিং একটু সবুর করো। ওই ভাবে দেখতে থাকলে আমার দেহ জ্বলে পুরে ছারখার হয়ে যাবে।”
বুধাদিত্য হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, “উম্মম্ম… আমি যে আর থাকতে পারছি না, বেবি… তোমাকে আমার এখুনি চাই।”
আয়েশা খিলখিল করে হেসে ফেলে, বলে, “যাও আমার পেছনে এইরকম ভাবে দাঁড়িয়ে থেকও না। একটু হিটার চালিয়ে দাও বড় ঠাণ্ডা লাগছে।”
বুধাদিত্য আয়েশার পেছনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীর ওর পেছনে চেপে ধরে। পাতলা কোমরের দুপাশ থেকে হাত নিয়ে গিয়ে গোল নরম তুলতুলে পেট চেপে ধরে এক হাতের থাবায়, অন্য হাত নিয়ে যায় ওর পাঁজরের ওপরে, ঠিক উন্নত স্তনের নিচে চেপে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে আয়েশাকে। আয়েশা বুধাদিত্যের প্রেমঘন বাহুর মাঝে জড়িয়ে পড়ে ককিয়ে ওঠে। নিটোল পাছার খাঁজে উত্থিত লিঙ্গের কঠিন পরশ অনুভব করে। আয়েশা ওর হাত ধরে নিজের দেহের ওপরে বুধাদিত্যের বাহুবন্ধন আরও প্রগাড় করে নেয়। মাথা বেঁকিয়ে বুধাদিত্যের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দেয়। উষ্ণ শ্বাসে ভরিয়ে দেয় পরস্পরের মুখ।
চুম্বন শেষে আয়েশা বুধাদিত্যের হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। রান্না ঘর থেকে একটা থালা নিয়ে আসে, বলে, “আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দেব, তুমি আমাকে কোলে নিয়ে বসে থেকো। তুমি আমাকে একটু জোরে জড়িয়ে ধরবে, প্লিস?”
আয়েশা হাতে থালা নিয়ে বুধাদিত্যের কোলের ওপরে বসে পরে। বুধাদিত্য দুহাতে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। আয়েশা ওকে খাইয়ে দেয় আর মিটিমিটি হাসে। দুই প্রেমঘন নরনারীর মাঝে ভালোবাসার আগুন জ্বলে ওঠে। নরম পাছার চাপের নিচে বুধাদিত্যের লিঙ্গ ধিরেধিরে নিজের কঠিন অবয়াব ধারন করে। বারেবারে নিচ থেকে ঠেলে দেয় নরম আয়েশাকে, আয়েশা ইচ্ছে করেই বুধাদিত্যকে উত্যক্ত করার জন্য পাছা দিয়ে চেপে ধরে কঠিন লিঙ্গ। খাওয়া চলাকালীন চলে আদরের খেলা, মিষ্টি মধুর আহা, উহু ধ্বনি, মাঝে মাঝে একটু চুম্বন, নিজে খায় আর বুধাদিত্যকে খাইয়ে দেয়। মাঝে মাঝে বুধাদিত্যের মুখের ভেতর থেকে মাংসের টুকরো কামড়ে ধরে, দুটি প্রেমাসিক্ত নরনারী কামনার খেলায় মেতে ওঠে খেতে খেতে।
খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে, আয়েশা ঝাঁপিয়ে পরে বুধাদিত্যের কোলে। বুধাদিত্য আয়েশার হাবভাব ঠিক ভাবে ধরতে পারেনা। উদ্দাম আয়েশা আজ যেন আজ এক সুন্দরী প্রজাপতি, ওকে আদরে, ভালবাসায় ভরিয়ে দেবার জন্য তৎপর। প্রাণপণে দুহাতে বুধাদিত্যকে জড়িয়ে ধরে, প্রসস্থ কঠিন বুকের ওপরে, নরম স্তন চেপে ফিসফিস করে প্রেমঘন গলায় অনুরোধ করে ওকে ভালোবাসার জন্য। আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। চুম্বন গভীর করে তোলে আয়েশা, বুধাদিত্যের পরনের গেঞ্জি খুলে নগ্ন বুকের ত্বকের ওপরে নরম আঙুল দিয়ে আঁচর কাটে। বুধাদিত্য ওর পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে নরম পাছা চেপে ধরে। আয়েশাকে ঠেলে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। আয়েশা বুধাদিত্যের ঠোঁট ছেড়ে ওর গলায়, কাঁধে, বুলের ওপরে চুম্বনের ঝড় বইয়ে দেয়। ছোটো ছোটো চুম্বনের সাথে সাথে, জিবের ডগা বের করে লালার দাগ এঁকে দেয় বুধাদিত্যের বুকে। বুধাদিত্য আয়েশার কোমরে হাত নিয়ে গিয়ে গায়ের জামা উপর দিকে টেনে তোলে। আয়েশা হাত উঁচু করে বুধাদিত্যকে সাহায্য করে জামা খুলে দিতে। আয়েশার পরনে ছোটো লাল ব্রা বেড়িয়ে পরে জামার ভেতর থেকে। পীনোন্নত স্তন জোড়া ছোটো ব্রার বাধুনির মাঝে পরস্পরের সাথে মারামারি করে। আয়েশা বুধাদিত্যের মাথার চুল আঁকড়ে ধরে বুকের খাঁজের ওপরে চেপে ধরে। ঘন মৃদু কন্ঠে ওর স্তনের নরম মাংসে চুম্বনে চুষে ভরিয়ে দিতে অনুরোধ করে বারেবারে। বুধাদিত্য ঠোঁট নামিয়ে আনে আয়েশার কাঁধের ওপরে, গলার ওপরে চুমু খেতে থাকে, ধিরে ধিরে ঠোঁট নিচে নামে, বুকের ওপরে জিবের ডগা দিয়ে লালার দাগ কেটে দেয়। তপ্ত ত্বকের ওপরে জলের দাগ পরে যেন ছ্যাক করে ওঠে। কামনার আগুনে দুই জনের শরীর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আয়েশার উরু মাঝে বুধাদিত্যের কঠিন লিঙ্গ স্পর্শ করে। জিন্সের উপর দিয়েই চেপে ধরে যৌনাঙ্গের সাথে যৌনাঙ্গ। কঠিন অনুভুতি পেয়ে আয়েশা পাগল হয়ে যায়। ঠোঁট অল্প ফাঁক করে শীৎকার করে প্রেমে পাগল আয়েশা। বুধাদিত্যের ঠোঁট নেমে যায় ব্রার ওপরে, কামড়ে, চুষে পিষে একাকার করে দেয় আয়েশার স্তন জোড়া। হাত দুটি একবার পাছার ওপরে, একবার পিঠের ওপরে ইতরের মতন বিচরন করে।
আয়েশা বুধাদিত্যের মাথা স্তনের ওপরে চেপে ধরে বলে, “হানি, আই মিস ইউ। আজ আমাকে খুব করে ভালোবাস।”
আয়েশার ধরা গলার আওয়াজে বুধাদিত্য ওর মুখের দিকে মুখ তুলে তাকায়, “কি হয়েছে তোমার?”
চোখ দুটি ছলছল, চোখের পাতা ভিজে গেছে। ঠোঁটে হাসি টেনে বলে, “আমি চলে যাচ্ছি, দিল্লী ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে।”
বুধাদিত্যের মাথা ঘুরে যায়, নাকের ডগা লাল হয়ে আসে, চোয়াল শক্ত করে চাপা গলায় আয়েশাকে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছ?”
আয়েশা হাসিহাসি মুখে চোখে জল নিয়ে বলে, “অনেক দুরে, সাত সমুদ্র তের নদী পার করে। রোহিতের লন্ডনে চাকরি হয়েছে, ওর সাথে আমাকে যেতে হবে, বুধাদিত্য। আমার ভিসা হয়ে গেছে, পরের মাসে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।” বুধাদিত্য এক’পা পেছনে সরে যায়, কিন্তু আয়েশার কোমর থেকে হাত সরায় না, আলতো করে ধরে থাকে আয়েশার কোমর। আয়েশা ওর গলা জড়িয়ে বলে, “আরও একটা খবর আছে,” একটু থেমে যায় আয়েশা, “আমি প্রেগ্ন্যান্ট। গত মাসে, রোহিতের সাথে, বার্লিনে। ছয় সপ্তাহ হল আমার প্রেগ্ন্যান্সির।”
বুধাদিত্য আয়েশার কোমর ছেড়ে দেয়, ওর বুকের মাঝে হুহু করে ওঠে এক আর্তনাদ। ব্যাথিত বুধাদিত্য, কাঁপা গলায় আয়েশাকে বলে, “আমি জানি আমি বড় পাপী, আমি নিচ, আমি ইতর, ব্যাভিচারি। আমি অন্যের বউয়ের সাথে শুই, অন্যের বউয়ের সাথে প্রেম করি। সেই পর্যন্ত ঠিক ছিল আয়েশা, কিন্তু কারুর মায়ের গায়ে হাত দিতে পারিনা, কারুর মাকে আমি কলুষিত করতে পারব না, আয়েশা।” ধুপ করে সোফার ওপরে বসে পরে বুধাদিত্য, দু’চোখে শ্রাবনের অঝর বারিধারা। মাথার চুল আঁকড়ে, নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকে, “আমার মতন পাপী, আমার মতন দুঃখী যেন এই পৃথিবীতে আর কেউ না জন্মায়, সেই প্রার্থনা কর। আমি মাকে হারিয়েছি ছোটো বেলায়, কারুর মাকে আমি কলুষিত করতে পারব না আয়েশা। তুমি চলে যাও।” বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বুধাদিত্য, “আয়েশা তুমি চলে যাও।”
আয়েশা ওর সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলে, কিছু বলার নেই আর বুধাদিত্যকে। বড় বেদনা এই বুকে সামনে বসা ছেলেটার জন্য, যতদিন শরীরে খেলা হিসাবে ছিল ততদিন ঠিক ছিল, কিন্তু সব কিছু জেনে বুঝে প্রেমে পড়েছিল বুধাদিত্য, ঝুঁকে গেছিল আয়েশাও।
আয়েশা ওর কপালে ছোটো চুমু খেয়ে বলে, দুই কাজল কালো চোখে জল, চোখের পাতা ভারী, ঠোঁট দুটি তিরতির করে কেঁপে ওঠে, “প্রথম যেদিন তোমার কোলে এসেছিলাম, সেদিন আমাকে একটা গোলাপ দিয়েছিলে সেটা শুকিয়ে গেছে। আমাদের ভালোবাসা বড় মেকি, বড় নিষ্ঠুর। আমি নিজেই জানিনা আমি কাকে বেশি ভালোবাসি, রোহিত না তুমি। শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করলাম যে আমি রোহিতের সাথে চলে যাব। আমি চললাম বুধাদিত্য, আমাকে আর খুঁজতে চেষ্টা করো না। জানি পৃথিবীটা অনেক ছোটো, হয়ত কোন এক মোড়ে আবার দেখা হবে কিন্তু দয়া করে তুমি আমাকে আর খুঁজতে এস না।”
জামা কাপড় পরে, চোখের জল মুছে ফেলে আয়েশা। আর দাঁড়ায় না, দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় চুপ করে। বুধাদিত্য সোফার ওপরে পাথরের মূর্তির মতন বসে থাকে। দরজা খোলা, ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে পরে ঘরের মধ্যে, কিন্তু বুকের আগুন নেভাতে অক্ষম সেই ঠাণ্ডা বাতাস।
______________________________
নবম পর্বঃ প্রবাহিণীর পায়ের ছাপ। (#1)
“কি হয়েছে তোমার? ওইরকম মাথা নিচু করে বসে আছো কেন? আর একি, তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে মদ খাবে না, আবার খাচ্ছ?” একটা সুরেলা ধমকে চেতনা ভঙ্গ হয় বুধাদিত্যের। দরজা খোলা ছিল, হাতে বোতল নিয়ে সোফায় বসে ছিল বুধাদিত্য। বোতলের অর্ধেক গলায় ঢালা হয়ে গেছে। কখন সেই দরজা দিয়ে ঝিলাম এসে ঢুকেছে তার খেয়াল নেই। চোখ মুখ লাল, কঠোর শূন্য চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই দরজা দিয়েই বেশ কিছু আগে আয়েশা বেড়িয়ে গেছে, চিরতরে চলে গেছে, কোন দিন ফিরে আসবেনা। যদিও জানত বুধাদিত্য যে আয়েশা কোনদিন ওর হতে পারবেনা তাও এক নেশার মতন আয়েশার পেছনে ঘুরেছে। আয়েশা চলে যাবার পরে, জ্যাকেট গলিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। ভুলে যায় ঝিলামকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার কথা। নিচে নেমে, দোকান থেকে হুইস্কির বোতল কিনে আনে। বাড়ি ঢোকে কিন্তু দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায়। সোফার ওপরে বসে ঢক ঢক করে অর্ধেক বোতল খালি করে দেয়। মাথার মধ্যে সবকিছু গুবলেট হয়ে যায়। নিজের জীবন আর মিস্টার সুবির গুহর জীবন যেন এক পথের পথিক। ওর বাবা নারীসঙ্গে মত্ত ছিলেন, বুধাদিত্য কিছুদিন আগেও নারীসঙ্গে মত্ত ছিল। তফাত কোথায় মিস্টার সুবির গুহ আর বুধাদিত্য গুহ’র মধ্যে?
ঝিলাম দরজা বন্ধ করে বুধাদিত্যের দিকে এগিয়ে আসে। বুধাদিত্য ওকে দেখে কিছু বলতে পারেনা। চুপ করে বসে বাকি বোতল শেষ করার জন্য ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসে। ঝিলাম দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে ফেলে। জোর গলায় ধমক দেয় বুধাদিত্যকে, “কি হয়েছে তোমার?” বুধাদিত্য হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে, ঝিলাম ওর হাত থেকে বোতল কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কাঁচের বোতল দ্বিতীয় বার মেঝের ওপরে পরে ভেঙ্গে যায়। ঝিলাম ওর পাশে বসে বুধাদিত্যকে আবার জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?” বুদ্ধিমতী ঝিলামের বুঝতে দেরি হয় না যে বুধাদিত্যের ভালোবাসা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ঝিলামের ওর হাতের ওপরে হাত রেখে প্রিয় বান্ধবীর মতন হেসে বলে, “কি হয়েছে, গার্ল ফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গেছে তাই এত দুঃখ? যাঃ বাবা, আমি ত ভাবতাম এই সব কান্না কাটি শুধু কলেজের ছেলে মেয়েরা করে। এত বুড়োধাড়ির চোখে জল আসবে ভাবতেই পারিনি।”
ঝিলামের উচ্ছল আওয়াজে মন কেমন করে ওঠে বুধাদিত্যের, এতক্ষণ চুপ করে থাকা বুধাদিত্য, হাতের ওপরে ঝিলামের হাতের পরশ পেয়ে যেন একটু শক্তি পায় মনের মধ্যে। ওর মিষ্টি হসিহাসি মুখ আর তরতাজা আওয়াজে বুধাদিত্যের মনের বেদনাভাব কেটে যায়। আয়েশার প্রস্থানের সাথে ঝিলামের আগমনের যেন একটা সুপ্ত যোগসূত্র আছে। ঝিলামের টান যখন বুকের মাঝে শেষ রেশ টানে তখন আয়েশার আগমন হয় আর ঠিক আয়েশা চলে যাবার পরেই যেন ঝিলামের প্রত্যাবর্তন হয় প্রতিবার। ঝাপসা চোখের সামনে ঝিলামের মিষ্টি মুখবয়াব দেখে বুক ফাঁকা এক হাসি দেয়। তারপরে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ঝিলামকে বলে, “আমি আজ একটু মুক্ত।”
ঝিলাম ওর হাত ছেড়ে হেসে বলে, “হ্যাঁ তা’ত দেখতেই পাচ্ছি। কে গেছে বললে না’ত? ঠিক আছে বলতে হবে না। সারাদিন কোথায় ছিলে? এতবার ফোন করলাম, ফোন উঠালে না?”
বুধাদিত্যের খেয়াল পড়ল যে মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখা ছিল এতক্ষণ। হেসে বলে, “ছাড়ো অসব কথা। আমি অনেক ভুল করে ফেলেছি, তার খেসারত গুনছি এখন। যাই হোক আমার কথা নাই শুনলে। কোন খবর নেই তোমার, হটাত এখানে কি মনে করে?”
ঝিলাম, “বাঃ রে, তুমি না হয় নাই বা গেলে আমাদের বাড়িতে, তাই বলে কি আমি কি এখানে আসতে পারিনা?”
বুধাদিত্য একটু লজ্জায় পরে যায় ঝিলামের কথা শুনে, “আরে না না, তোমাদের জন্য আমার বাড়ির দরজা খোলা সময়ে। তা শালা কুত্তা টাকে দেখছি না যে।”
ঝিলাম, “বম্বে গেছে অফিসের কাজে, রাতে বাড়ি ফিরবে। আমি ভাবলাম একটু তোমার সাথে দেখা করে আসি। খবর নিতে হয় সেটা ত ভুলেই গেছ। অফিসে গেছিলাম, শুনলাম তুমি আসনি। মোবাইলে ফোন করলাম কতবার, কেউ উঠাল না, আমি একটু চিন্তায় পরে গেলাম তাই চলে এলাম।”
বুধাদিত্য, “ভালো করেছ চলে এসেছ।”
ঝিলাম, “ঠাণ্ডা’টা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।” বলে গায়ের সোয়েটারটা আরও জড়িয়ে নিয়ে উঠে গেল রান্না ঘরের দিকে, রান্না ঘরের দরজা থেকে ওর দিকে জিজ্ঞেস করে “কিছু রান্না করা আছে? না সারাদিনে কিছু খাওয়া হয়নি।”
বুধাদিত্য, “না দুপুরে খাওয়া হয়েছে, তোমাকে অত কষ্ট দেব না প্রথম দিনেই।”
ঝিলাম, “ধুত এতে আবার কষ্ট কি।” তারপরে বেশ খুশির হাসি হেসে বলে “যাই হোক, রাতে ওকে আনতে যাবো এয়ারপোর্ট থেকে, বেশ একটা সারপ্রাইস দেওয়া হবে ওকে।”
সেই হাসি দেখে বুধাদিত্য মনে মনে ভাবে, এই স্বামী স্ত্রী ওকে কলুর বলদ পেয়েছে। যাক ঝিলামের সান্নিধ্য, কাছে থাকা, ওর মিষ্টি হাসি, চোখের ভাষা এই যথেষ্ট ওর জন্য। বুধাদিত্য হেসে বলে, “বাপরে, প্রেম উথলে পড়ছে মনে হচ্ছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করব, যদি কিছু মনে না কর।”
ঝিলাম হাসতে হাসতে বলে, “হ্যাঁ জিজ্ঞেস করে ফেল।”
বুধাদিত্য, “সমীরের সাথে সব ঠিকঠাক চলছে?”
ঝিলাম ভুরু কুঁচকে বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হটাত এই কথা কেন জিজ্ঞেস করলে?”
বুধাদিত্য হেসে কথা ঘুড়িয়ে বলল, “না মানে, সমীরের মাথার কোন ঠিক নেই তাই বললাম।” বুঝতে দিলনা যে সমীরের সাথে ওর কথা হয়েছে আর সেদিনের ঝগড়ার কথা বুধাদিত্য সব জানে।
ঝিলামের গলায় বেশ খুশির সুর, “হ্যাঁ আজকাল ভালোই আছি। সমীর ইদানীং অনেক বদলে গেছে। বেশ খুশি খুশি মনে হয়। তবে অফিসের কাজ বেড়ে গেছে ওর, আজকাল বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে।” ফ্রিজ খুলে ওকে বলে, “তোমার ফ্রিজে কিছু নেই ত। যাও কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়ে এস, আমি দেখি কিছু রান্না করে ফেলি। ডাল, তেল নুন কোথায়? সব আছে না আমাকে তোমার সাথে যেতে হবে?”
এযে দেখি একদিনেই গৃহিণী হয়ে গেল। বুধাদিত্য ওকে বারন করে, “তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? প্রথম বার এসেছ আর এসেই রান্না ঘরে? যা বাবা, একটু বস আমি কফি বানাই।”
ঝিলাম খিলখিল করে হেসে বলে, “আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না আমাকে। অনেক হয়েছে, তুমি যাও কিছু নিয়ে এস আমি চা বানিয়ে রাখছি।”
অগত্যা বুধাদিত্যকে বাজার বের হতে হয়। এমনিতে সকালে কাজের লোক রান্না করে যায়, না থাকলে বাইরে খেয়ে নেয়, মাঝে মাঝে নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে অবশ্য। কিন্তু ঝিলামকে দেখে উৎফুল্ল মনে বাজারে চলে যায়। কিছু পরে কাঁচা বাজার করে ফিরে আসে। বাড়ি ঢুকে দেখে, ঝিলাম কফি বানিয়ে সোফার ওপরে বসে ওর অপেক্ষা করছে।
বুধাদিত্য, “কি হল চুপ করে বসে কেন? টিভি চালাতে পারতে’ত।”
ঝিলাম ওর হাত থেকে বাজারের প্লাস্টিক গুলি নিয়ে বলে, “বাড়ির মালিক বাড়ি নেই আর আমি একাএকা বসে কফি খাব নাকি? নাও খেয়ে নাও, দেখি কি এনেছ? কিছু কাটাকাটি করতে পার? একটু আলু না হয় কেটে দাও, পটল দিয়ে একটা ঝোল আর ডাল করে রেখে যাই।”
বুধাদিত্য চুপ করে সোফার ওপরে বসে দেখে। ঝিলামের উচ্ছল রুপ যৌবন দেখে বুকের ভেতর বেশ একটা ভালোলাগায় ভরে যায়, ওর সান্নিধ্য বড় মিঠে। আলু ছুরি দিয়ে গেল ঝিলাম। হাত মুখ ধুয়ে, গায়ের সোয়েটার খুলে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ল ঝিলাম। আলু কাটা হয়ে গেলে আলু নিয়ে চলে যায়। শীতকালে সন্ধ্যে অনেক তাড়াতাড়ি নেমে আসে। সাতটার মধ্যে যেন চারদিকে ঘন অন্ধকারে ডুবে যায়। দিল্লী তখন যেন জেগে ওঠে। বুধাদিত্য চুপ করে বসার ঘরে বসে শুধু ঝিলামের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক উচ্ছল প্রবাহিণী ওর ঘরের মধ্যে নেচে বেড়াচ্ছে। নীল রঙের শাড়ি, নীল রঙের ব্লাউস, আঁচল কোমরে গুঁজে নিয়েছে, বেনুনি খুলে মাথার পেছনে একটা হাত খোঁপা করে বাঁধা। পেছন থেকে ঠিক একটা বালির ঘড়ির মতন দেহ গঠন। ঝিলামের যৌবনের ডালি ভরা আকর্ষণীয় রুপসুধা আকণ্ঠ পান করে চুপিচুপি। ঝিলামের সেদিকে খেয়াল নেই, নিজের মনের মতন রান্নায় মশগুল। স্বামীর বন্ধুর চেয়ে বুধাদিত্য যেন ওর বেশি কাছের বন্ধু। গুনগুন গানে রান্না সেরে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখে যে বুধাদিত্য ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে।
মিচকি হেসে বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, “কি হল কি দেখছ?”
বুধাদিত্য একবার বলতে চায় যে তোমার রুপে পাগল হয়ে তোমাকে দেখছি, কিন্তু ম্লান হেসে বলে, “রান্না শেষ?”
মাথা নাড়ায় ঝিলাম চোখে একটু বিরহের বিষণ্ণতা, “হ্যাঁ শেষ। সবে সাড়ে আটটা বাজে, অনেক সময় বাকি। সেই রাত এগারটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। কি করা যায় বলত আমার আজকে আর তর সইছে না।”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “প্রেম যে উথলে পড়ছে। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আর বাড়িতে মন টিকছে না। বেড়াতে যেতে চাও?”
ঝিলাম, “কোথায় যাবো এই রাতে?”
বুধাদিত্য, “গাড়িতে এমনি এমনি। সময় মতন তোমাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবো চিন্তা নেই।”
ঝিলাম, “হ্যাঁ, তাই চল। বাড়িতে সত্যি আর মন টিকছে না।”
একবার যখন হ্যাঁ বলেছে ঝিলাম, তখন সিদ্ধান্ত বদলে ফেলার আগেই বেড়িয়ে পরা ভালো। উচ্ছল রমণীর যদি হটাত করে আবার মতিগতি বদলে যায়। বুধাদিত্য তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে ঝিলামকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। বাইরে লোক চলাচল কমে এসেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রায় শেষের দিকে, ঠাণ্ডা একটু যেন জাঁকিয়ে, ছেড়ে যাবার আগে যেন শেষ কামড় বসিয়ে দিয়ে তবে যাবে। ঝিলাম বুঝতে পারেনি যে বাইরে এত ঠাণ্ডা হবে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে ওকে বলে হিটার চালিয়ে দিতে।
বুধদিত্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল, নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে। গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে জয়পুর হাইওয়ে ধরে ফেলে। এয়ারপোর্ট ছাড়াতেই ঝিলাম ওকে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে? উত্তরে বলে, ঠিক নেই, তবে ঠিক সময়ে ওকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে। বুধাদিত্য চুপ করে গাড়ি চালায়, পাশে ঝিলাম চুপ করে বসে থাকে। একজনের মনে ভালোলাগার পূর্বরাগ কিন্তু সেটা অবৈধ, অন্য জনের মনে খুশির আমেজ, স্বামীর সাথে দেখা হবে।
ঝিলাম কিছু পরে বুধাদিত্যকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পিস্তল নিয়ে ঘোরাফেরা কর কেন? তুমি ত আই.টি’তে চাকরি কর?”
বুধাদিত্য হেসে মজা করে উত্তর দেয়, “ওই তোমাকে বাঁচানোর জন্য পিস্তল যোগাড় করেছিলাম।”
ঝিলাম, “ধুত, সত্যি বল না, তুমি পিস্তল নিয়ে কি কর?”
বুধাদিত্য, “আমি একটু পাগলা প্রকৃতির লোক, তাই মাঝেমাঝে নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করি একাএকা। রাত বিরাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যাই যেদিকে দু’চোখ যায়। নিজের আত্মরক্ষার করার জন্য একটা অস্ত্র চাই তাই পিস্তল কিনেছিলাম।”
ঝিলাম, “বাপরে,কাউকে সাথে না নিয়ে, তোমার একাএকা বেড়াতে ভালো লাগে?”
বুধাদিত্য ম্লান হেসে বলে, “সবাই’ত আর সমীরের মতন ভাগ্যবান নয়, কি করব আর, একা তাই একা ঘুরে বেড়াই।”
ঝিলাম লাজুক হসে বলে, “তুমি বিয়ে করনি কেন?”
খুব কঠিন প্রশ্ন, বুধাদিত্য কেন বিয়ে করেনি। বিয়ের কথা, কাউকে সাথে নিয়ে চলার কথা ওর মাথায় কোনদিন আসেনি। ঝিলামকে দেখে সেই কথা প্রথম মাথায় আসে যে যদি ঝিলামের মতন কাউকে পেত তাহলে বুকের বামদিকে বসিয়ে রাখত চিরজীবন। বুধাদিত্যকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে ঝিলাম, “গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে বলে দুঃখ হচ্ছে?”
কাষ্ঠ হাসি হাসল বুধাদিত্য, আয়েশা চলে গেছে, একদিকে ভালো হয়েছে, ফাঁকা বুকে এক নতুন মানুষ খোঁজা যাবে যাকে নিজের করে নিতে পারবে বুধাদিত্য। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কারুর চলে যাওয়াতে আজকাল আর দুঃখ হয় না।”
ঝিলাম, “তাই নাকি? কে কে ছেড়ে গেছে তোমাকে?”
নবম পর্বঃ প্রবাহিণীর পায়ের ছাপ। (#2)
বুধাদিত্য বলতে গিয়েও দুঃখের কথা বলতে পারেনা। ঝিলামকে হেসে বলে, “সমীরকে সারপ্রাইস দেবে কি খালি হাতে?”
ঝিলাম মিষ্টি হেসে বলে, “না না, যাওয়ার আগে ওর জন্য একটা বোকে কিনে নেব। অইত আসার সময় একটা জায়গায় দেখলাম একটা দোকান খোলা আছে।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “শীতকাল ডিয়ার, রাতে ফেরার সময়ে সেই দোকান খোলা পাবেনা।”
মুখ শুকিয়ে যায় ঝিলামের, “তাহলে কি হবে? আমি যে কিছুই কিনি নি।”
মনে মনে বলে, তুমি থাকতে আর ফুলের কি দরকার, নিজেই ত একটা ফুলের ডালি সাজিয়ে বসে। বাঁকা হাসি হেসে বলে, “তাহলে গাড়ি ঘুড়িয়ে নেই, বোকে কিনে আবার দেখা যাবে।”
খুশি হয়ে যায় ঝিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ গাড়ি ঘুড়িয়ে নাও, আমি ওর জন্য বোকে কিনবোই, খালি হাতে সারপ্রাইস দিতে ঠিক মন মানছে না।”
বুধাদিত্য যেন চালক আর ঝিলাম কর্ত্রী। বুধাদিত্য গাড়ি ঘুড়িয়ে নেয়, দোকানের সামনে এসে ফুলের বোকে কিনে আবার উঠে পরে গাড়িতে। সবে দশ’টা আরও অনেক সময় আছে হাতে। হাতে বোকে, ঠোঁটে হাসি, ফুলের চেয়ে ওর ঠোঁট গুলি বেশি মিষ্টি দেখায়। বুধাদিত্য একবার ঝিলামের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে দিল।
ঝিলাম, “এবারে বেশি দুরে যেওনা, তাহলে কিন্তু ঠিক সময়ে ফিরতে পারব না।”
বুধাদিত্য, “জো হুকুম মালকিন, আপনার আদেশ শিরোধার্য।” হেসে ফেলে দু’জনেই।
ঝিলাম, “আমরা দু’জনে তোমাকে খুব জ্বালাতন করি তাই না?”
বুধাদিত্য হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, “তা করো বইকি, খুব জ্বালাতন করো। ছোটোবেলায় হস্টেলে তেলু শালা জ্বালাতন করেছে, বিয়ের পরে ওর বউ জ্বালাতন করে মারছে।”
ঝিলাম হেসে বলে, “না আর জ্বালাতন করব না তোমাকে। সত্যি বলছি, আমাকে নামিয়ে দাও এখানে তাহলে।”
বুধাদিত্য, “পাগল হলে? সমীর ছেড়ে দেবে আমাকে? গলা টিপে মেরে ফেলবে তাহলে।”
ঝিলাম, “ওর আগে আমি তোমাকে মেরে ফেলব।”
বুধাদিত্য একবার ভাবে, খুব বাধে গো খুব বাধে, বেশি করে বাধে। হেসে বলে, “তুমি বললে আর আমি নামিয়ে দেব, ভাবলে কি করে? এত সুন্দর করে রান্না করে রেখে গেলে, তারপরেও স্বার্থপরের মতন তোমাকে ছেড়ে দেব, হতেই পারে না।”
ঝিলাম ঘড়ি দেখে, গল্প করতে করতে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলে, “বুধাদিত্য, আমার মনে হয় এবারে আমাদের এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়া উচিত। এগারোটা বাজতে যায়।” ফুলের তোড়া’টা নাকের কাছে আনে গোলাপ আর অন্য ফুল মেশানো, ঘ্রান টেনে নেয় ঝিলাম। “উম্মম, জানো খুব ভালো লাগছে। পরের মাসের দশ তারিখের মধ্যে জীবনের প্রথম মাইনে পাবো। সবটা দুহাতে খরচ করে দেব।” গলার স্বর বেশ উৎফুল্ল, “সমুর জন্য একটা কালো চামড়ার জ্যাকেট কিনব, তোমার জন্য কিছু কিনব, বাড়ির সবার জন্য কিনব।”
বুধাদিত্য জিজ্ঞেস করে, “নিজের জন্য কিছু কিনবে না?”
ঝিলাম মাথা নাড়ায়, “না, প্রথম মাইনে দিয়ে আমি কি কিনব? যা কেনার সমু কিনে দেবে আমাকে।”
এয়ারপোর্ট এসে যায়, ঘড়িতে এগারোটা বাজে। সামনের বড় এল.সি.ডি তে লক্ষ্য করল যে বম্বের ফ্লাইট ল্যান্ড করে গেছে একটু আগে। ঝিলাম সমীরকে ফোন করে জানল যে কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে যাবে। ঝিলামের চোখে মুখে উত্তেজনা ফেটে পড়ছে, সমীরকে জানায় নি যে ওর জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে ঝিলাম। উৎকণ্ঠায় বারেবারে ঘড়ি দেখে, মনের মধ্যে উশখুস ভাব। বুধাদিত্যকে বারেবারে জিজ্ঞেস করে, এত দেরি কেন? বুধাদিত্য বুঝিয়ে হাল ছেড়ে দেয়।
কিছুপরে সমীর গেট থেকে বেড়িয়ে আসে। ঝিলাম ওকে দেখে প্রায় দৌড় লাগিয়ে হাত ধরে ফেলে। সমীর ঝিলামকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে ওঠে। বুধাদিত্য কিছু দুরেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওদের প্রগাড় আলিঙ্গন দেখে বুকের ভেতর একটু চিনচিন করে ওঠে। ক্ষণিকের জন্য ওদের ভালোবাসা দেখে হিংসে হয় বুধাদিত্যের। কাউকে ভালোবাসা হয়ত ওর কপালে আর নেই। সমীর ঝিলামকে একহাতে জড়িয়ে ধরে, তারপরে কিছু দুরে দাঁড়িয়ে থাকা বুধাদিত্যের দিকে চোখ যায়। সমীরের চোখে একটু যেন ধরাপরে যাওয়ার একটা ভীতি লুকিয়ে আছে, সেটা বুধাদিত্যের চোখ এড়াতে পারেনা। বুধাদিত্যের সন্দেহ চেতন মন কিছুর একটা গন্ধ পায়।
সমীর মিচকি হেসে বলে বুধাদিত্যকে, “কিরে, আমার বউ তোকে খুব জ্বালাচ্ছে, তাই না?”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, “সেই বিকেল থেকে মাথা খেয়ে রখেছে, কখন আসবে কখন আসবে।” ঝিলামের দিকে তাকিয়ে বলে, “এবারে শান্তি, এসে গেছে তোমার প্রানে বাতাস ঢালতে।”
ঝিলাম লাজুক চোখে সমীরের দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভ গলায় আব্দার করে, “কিছু এনেছে আমার জন্যে?”
সমীর ওর কাঁধে হাত দিয়ে টেনে বলে, “নিশ্চয় ডার্লিঙ, সেটা কি করে ভুলে যাই।”
ঝিলাম উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি এনেছ?”
গোলাপি নরম গালে আলতো করে নাক ঘষে বলে, “বম্বে থেকে একটা জুয়েলারি সেট।”
আনন্দে ঝিলাম ওর বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বলে, “সত্যি আমার কথা মনে ছিল তাহলে?”
সমীর উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মনে ছিল।” স্ত্রীকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় সমীরের চোখ একদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে থাকে, মনে হয় কাউকে যেন খুঁজছে এই ভিড়ে।
বুকের কাছে জড়িয়ে থাকা ঝিলাম সমীরের চোখ দেখে জিজ্ঞেস করে, “কি হল, কাউকে খুঁজছ নাকি?”
সমীর, “কই না ত। না না, আমি এমনি দেখছিলাম এদিক ওদিক। চল বাড়ি চল, অনেক রাত হয়ে গেছে আর ঠাণ্ডা টাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।” বুধাদিত্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কাল তোর ছুটি না অফিস যেতে হবে?”
বুধাদিত্য হেসে ফেলে, সেই প্রথম রাতের কথা মনে পরে যায়, না আর নয়, এই একবার যা ঘটে গেছিল আবার যদি পেছল খায় তাহলে আবার সেই প্রেমকেলি রত স্বামী স্ত্রীর খেলা দেখতে হবে। কান লাল হয়ে যায় বুধাদিত্যের, চাপা হেসে বলে, “কাল ছুটি, তবে আমি তোদের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাব।”
ওরা তিনজনে মিলে গাড়ি পারকিঙ্গের দিকে হাঁটতে শুরু করে দেয়। সমীরের হাত জড়িয়ে ঝিলাম আগে আগে হেঁটে যায়, বুধাদিত্য ওদের পেছন পেছন হাঁটে। বুধাদিত্য লক্ষ্য করে বেশ কিছু দুরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। দুরে দাঁড়ান সেই মেয়েটাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বুধাদিত্য, মনে করতে চেষ্টা করে, ওকে কি আগে কোথাও দেখেছে? না দেখেনি। পারকিঙ্গে ঢোকার মুখে সমীর পেছন দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে আলতো করে মাথা দোলায়। দুরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা প্রত্যুত্তরে আলতো করে মাথা দোলায়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় বুধাদিত্যের, মনের কোনে এতক্ষণ যে সন্দেহের মেঘ জমে এসেছিল সেটা সুনিশ্চিত হয়ে যায়। ঝিলামকে নিয়ে সমীর গাড়িতে উঠে পরে। বুধাদিত্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে ছবি এঁকে নেয়। এখন নয়, পরে সময় হলে জিজ্ঞেস করবে এই ব্যাপারে। ঝিলামকে দেখে খুব কষ্ট হয়, বুকে কত আশা বেঁধে স্বামীর হাত ধরে পেছনের সিটে বসে, আর এই ছেলে শেষে কিনা অন্য কারুর সাথে? জানে সমীরের উত্তর, মিথ্যে কথা বলে দেবে সোজা।
ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বুধাদিত্য বাড়ি ফিরে যায়। সমীর আর ঝিলাম বারবার বলে রাতে থেকে যেতে, কিন্তু হেসে ফেলে বুধাদিত্য, চোখ টিপে ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম বুঝে যায় বুধাদিত্যের চোখের ইঙ্গিত, সেই প্রথম দিনের কথা। আকর্ষণীয় কমনীয় যৌবনের ডালি নিয়ে সেই রাতে ভিজে স্লিপ পরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে বুধাদিত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ঝিলাম লজ্জায় লাল হয়ে যায়, মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। বুধাদিত্য চলে আসে ওদের ছেড়ে।
একদিন বিকেল বেলা, বুধাদিত্য চুপ করে বসে টিভি দেখছিল, এমন সময়ে কলিং বেল বাজে। ঠাণ্ডা কমে এসেছে, ছুটির দিন, কোন কাজ নেই। আজকাল আর বারে বসে মদ গেলা হয় না, কোন নারীসঙ্গে আর মন নেই। দরজা খুলে দেখে ঝিলাম দাঁড়িয়ে হাতে বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ। ধবধবে সাদা জিন্স আর গাড় নীল রঙের টপে দারুন দেখাচ্ছে ঝিলামকে। পেছনে দাঁড়িয়ে সমীরের, তাঁর হাতেও বেশ কয়েকটা শপিঙ্গের ব্যাগ। বুধাদিত্য বুঝে যায় যে ফেব্রুয়ারির দশ তারিখে ঝিলাম প্রথম বেতন পেয়েছে আর সেই খুশিতে সারা বাজার কিনে ওর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। সমীর মুখ কাচুমাচু করে পেছনে দাঁড়িয়ে।
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, “শালা এতদিনে পরে তোকে দেখে মনে হচ্ছে কলুর বলদ। আয় আয় ভেতরে আয়।”
ঝিলাম ভেতরে ঢুকেই ওর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়, বলে, “এক বার খুলে দেখত পছন্দ হয়েছে কিনা? তোমার চয়েস ত আবার অনেক বড় বড়, জানি না বাবা মনে খুব খুত খুত ছিল কেনার সময়ে।”
বুধাদিত্য সমীর আর ঝিলামকে বলে, “শালা এই সব করতে গেলি কেন?”
সমীর, “অনেক হয়েছে, অনেক দেখিয়েছিস তুই। জানি শালা তুই অনেক বড়লোক এবারে একবার খুলে দেখ, পছন্দ কিনা। সারা বাজার আমার মাথা খেয়ে ফেলল এই নিয়ে।”
ব্যাগ খুলে দেখে একটা ছাই রঙের দামী সুটের পিস। মাথায় হাত বুধাদিত্যের, আলমারিতে প্রায় গোটা দশ বারো সুট আছে, তারপরে আবার। সমীর হেসে জিজ্ঞেস করে পছন্দ কিনা? বুধাদিত্য ঝিলামের দিকে তাকিয়ে জানায় যে উপহার খুব পছন্দ হয়েছে, ঝিলামের মুখ দেখে কি আর না বলা যায়। সমীর জানায় যে ঝিলাম সব পয়সা শপিং করে শেষ করে দিয়েছে। ওর জন্য একটা সুট পিস কিনেছে। বাড়ির সবার জন্য জামা কাপড় বা কোন না কোন উপহার কেনা হয়েছে। সমীর বলে যে বুধাদিত্যকে পুজোতেও কিছু দেওয়া হয়নি তাই ওর সুট ঝিলাম কিনেছে। দুই বন্ধু মিলে বসে গল্প করে, ঝিলাম রান্না ঘরে ঢুকে ওদের জন্য কফি বানিয়ে আনে। বুধাদিত্যের ফাঁকা বাড়ি ঝিলামের হাসির কল্লোলে ভরে ওঠে।
কফি খেতে খেতে ঝিলাম সমীরকে বলে, “যাও ত বাজারে একটু মাংস নিয়ে এস, রান্না করে রেখে যাই ওর জন্য।”
সমীর বুধাদিত্যকে বলে, “আরে শোন, আজ রাতে আমার বাড়ি চল।”
ঝিলাম কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “ওকে বলে লাভ নেই, ও যাবেনা আমাদের বাড়ি।” একটু ঠেস দিয়ে কাষ্ঠ হেসে বলে, “একাএকা ঘুরে বেড়াবে, একা একা সব করবে, থাকুক একা। তুমি যাও।”
বুধাদিত্য ঝিলামের সাথে পেরে ওঠে না। সমীর ওর কথায় সায় দেয়, কিছুপরে দুই বন্ধু মিলে বাজারে বেড়িয়ে যায়। বুধাদিত্য একবার ভাবে যে এয়ারপোর্টে দাঁড়ান সেই মেয়েটার কথা একবার জিজ্ঞেস করে, বিকেলের কথা ভেবে আর জিজ্ঞেস করেনা, এই সুন্দর বিকেল মাটি করে দিতে মন করেনা।
বুধাদিত্য সমীরকে বলে, “হুম শালা বেশ আনন্দে আছিস, কি বল। তা এত খরচ করতে গেলি কেন?”
সমীর, “নারে বাবা, খরচা আর কি। তুই শালা এত করিস, আর এইটুকু আমরা করব না? জানি বাবা জানি তুই শালা অনেক বড়লোক, আমাদের দুজনের মাইনে মিলিয়ে হয়ত তোকে ছুঁতে পারব না।”
বুধাদিত্য হাল্কা হেসে বলে, “ছাড় ওই সব কথা, আছিস কেমন তাই বল?”
সমীর, “ভালো আছি, একদম মস্ত। আজকাল একটু কাজের চাপ বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝেই বাইরে যেতে হয়, তবে ঝিলামের জন্য রাতে থাকিনা, সেদিনেই ফিরে আসি। তবে এবারে ভাবছি, একটু কাজে মন লাগাতে, ঝিলামের চাকরি হয়ে গেছে, এবারে ও শান্ত হয়ে যাবে। এবারে একটু কাজের দিকে মন দিতে হবে।”
বুধাদিত্যের একবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কাজের দিকে না অকাজের দিকে? চেপে যায় সেই প্রশ্ন। মাংস কিনে বাড়ি ফিরে আসে। ওদের গল্প চলাকালীন ঝিলাম রান্না সেরে ফেলে। অনেকক্ষণ এইসেই, কাজের গল্প, অকাজের গল্প করে খাওয়াদাওয়া সেরে ঝিলাম আর সমীর বারি ফিরে যায়। যাওয়ার সময়ে বুধাদিত্য করুন চোখে ঝিলামের দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে হল যেন ঘর ফাঁকা করে কেউ চলে গেল। সেই করুন চোখের চাহনি, ঝিলামের চোখে পরেনা। ঝিলাম বেশ খুশি, সমীর অনেক দিন পরে ওর সাথে শপিং করতে বেড়িয়েছে, জীবনের প্রথম মাইনে পেয়ে সবার জন্য জিনিস কিনেছে।
নবম পর্বঃ প্রবাহিণীর পায়ের ছাপ। (#3)
সারা অফিস মাতামাতি একটা বেশ বড় প্রজেক্ট নিয়ে। পরে মাসে হয়ত আবার একটা ট্রিপ আছে। সারা অফিস মাতামাতি একটা বেশ বড় প্রজেক্ট নিয়ে। এবারে হয়ত সিডনি না হয় মেলবোর্ন যেতে হবে। টেকনিকাল কিছু প্রেসেন্টেসান দেবার আছে, সাথে সি.ই.ও বিশ্বনাথ আহুজা, সি.টি.ও অরুন ঠাকুর এবং আরও কিছু মার্কেটিঙের লোক যাবে। অফিসে বেশ ব্যাস্তই থাকে, তবে দুপুরের দিকে নিজেকে কয়েক ঘন্টার জন্য খালি রাখে, কখন প্রিয় বান্ধবী, ঝিলামের ডাক পরে ঠিক নেই। একবার ভেবেছিল একটা ড্রাইভার রাখবে, কিন্তু দুপুরে ঝিলামকে বাড়ি পৌঁছে দেবার আনন্দ হারাতে চায় না বুধাদিত্য। ঝিলাম মাঝে মাঝেই হানা দেয় বুধাদিত্যের অফিসে। অগত্যা বুধাদিত্যকে কিছু সময়ের জন্য অফিস ছেড়ে বেড়িয়ে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়। বাড়ির পথে ওর সারাদিনের স্কুলের গল্প শুনতে হয়, চুপ করে শুনে যায়, মাঝে মধ্যে কিছু মন্তব্য করে। কোন কোন সময় কোন স্কুলের কোন লোক ওর দিকে তাকাল, কেমন ভাবে তাকাল সেইসব কথা হয়। দুজনে সেই সব কথা শুনে বেশ হাসি ঠাট্টা করে।
একদিন সমীর কে ফোন করে দেখা করতে বলে বুধাদিত্য, জানতে চায় যে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মহিলা কে। বুধাদিত্য জানত সমীরের উত্তর, তাও জিজ্ঞেস করে। সমীর অকাট মিথ্যের প্রশ্রয় নিয়ে জানিয়ে দেয় যে কেউ ওর জন্য এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছিল না। সমীর হেসে জানিয়ে দেয় যে অন্য কোন নারীর প্রতি ওর কোন টান নেই, ওর বুকের মাঝে শুধু মাত্র ঝিলামের ছবি আঁকা। বুধাদিত্য সমীরের ফাঁকা হাসি বুঝতে পেরে যায়। সমীরের সাথে বাকবিতন্ডে যায় না বুধাদিত্য, একটু খানি সাবধান করে মাত্র, বলে যে, মদে আর নারীসঙ্গে যেন নিজেকে ডুবিয়ে না দেয়।
মার্চের শেষের সপ্তাহ, ঠাণ্ডা চলে গেছে দিল্লীর আকাশ থেকে। হোলি পেরিয়ে গেছে। বাতাসে বেশ একটা গরম ভাব এসে গেছে। বুধাদিত্যের জন্মদিন। প্রতিবছরের মতন সাতসকালে বুবাইয়ের ফোন আসে, মামাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। তারপরে অনিন্দিতাদি ফোন ধরে শুভেচ্ছা জানায়। মামিমা, প্রমীলা দেবী একটু দেরি করেই ফোন করেন প্রতিবারের মতন। ওর জীবনের বাধা ধরা নিয়ম। মামা, মামি, বুবাই আর অনিন্দিতাদি ছাড়া আরও একজন ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাত, আয়েশা, কিন্তু দেশ ছেড়ে, বুধাদিত্যকে ছেড়ে চলে গেছে। এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে, বুধাদিত্য বেশ খুশি হয়, নিশ্চয় আয়েশার ফোন। ফোন তুলেই থমকে যায় বুধাদিত্য, ওপর পাশে এক নারী কণ্ঠস্বর, সেই স্বর ঝিলামের নয়, সেই স্বর আয়েশার নয়। কণ্ঠস্বর মিস্টার সুবির গুহ’র দ্বিতীয় ভার্যা, দেবস্মিতার। ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করে বুকের মাঝে ছলকে ওঠা উত্তপ্ত রক্ত সামলে নেয় বুধাদিত্য।
দেবস্মিতা, “মেনি মেনি হ্যাপি রিটারন্স অফ দা ডে; হ্যাপি বার্থডে, শরীর কেমন আছে? সব ঠিকঠাক?” সেই পুরানো, ভাববাচ্যে কথা। দু’জনেই দু’জনকে কি’ভাবে সম্বোধন করবে সেটা ঠিক করতে পারে না। কণ্ঠস্বরে মধুঢালা তাও যেন কানের কাছে বড় বাজে। বুধাদিত্যকে চুপ থাকতে দেখে দেবস্মিতা হেসে বলেন, “কি হল? কথা বলা মানা, আমাদের সাথে? মিস্টার গুহ কথা বলতে চান।”
বুধাদিত্য চিবিয়ে উত্তর দেয়, “ঠিক আছে।”
সুবিরবাবু ফোন ধরে বলেন, “কেমন আছো?”
সুবিরবাবুর গলার আওয়াজে পুরো দিনটা মাটি হয়ে গেল বলে মনে হল বুধাদিত্যের। চিবিয়ে উত্তর দেয়, “ভালো আছি, খারাপ থাকার ত প্রশ্ন ওঠে না। এতদিন পরেও যে মনে রেখেছ এই বড় কথা।” বিশেষ কথা বাড়াবার ইচ্ছে ছিলনা বুধাদিত্যের। কিন্তু একটা শিশুর গলার আওয়াজ পাচ্ছিল পেছন থেকে, বায়না ধরেছে কথা বলবে। দেবস্মিতার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, বারন করে চলেছে বাপ্পাদিত্যকে, কিন্তু সেই ছোটো বাচ্চা শুনতে নারাজ, এই কেঁদে ফেলে প্রায়। বুঝে গেল বুধাদিত্য যে, বাপ্পাদিত্য কথা বলতে চায়। বুধাদিত্যের মন একটু নরম হয়ে গেল সেই কাঁদো কাঁদো গলার আওয়াজ শুনে, সুবিরবাবুকে বলে, “বাপ্পাদিত্যকে ফোন দাও, কি বলছে একটু শুনি।”
হেসে ফেলেন সুবিরবাবু। বাপ্পাদিত্য ফোন ধরেই চেঁচিয়ে ওঠে, “তুমি কে? তোমার নাম কি? আমাকে মা জানো একটা প্লেন কিনে দিয়েছে কালকে। আমি না পরে গেছি, পায়ে খুব ব্যাথা তাই আজকে আর স্কুল যাইনি।”
সেই শিশুর মিষ্টি গলা শুনে বুধাধিত্যের মন গলে যায়, হেসে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় পরে গেছ? কোথায় লেগেছে?”
বাপ্পাদিত্য, “বাগানে খেলছিলাম, আর না, ধুপ করে পরে গেছি। আচ্ছা আমি আসছি, বাই।” বলেই ফোন সুবিরবাবুকে ধরিয়ে দেয়।
বুধাদিত্য কিছু বলার আগেই সুবিরবাবু ওকে বলেন, “ভালো থেকো, আর কি বলব।”
বুধাদিত্য, “তোমরা ভালো থেক।” ফোন রেখে দেয়। চুপ করে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁধানো কাঁচের ভেতর থেকে মঞ্জুষাদেবী মিটিমিটি হেসে বুধাদিত্যকে তিরিশ বসন্তের শুভেচ্ছা জানায়।
অফিসে দিন মোটামুটি কেটে যায়, অনেকের শুভেচ্ছা, বিশেষ করে যারা নিচে কাজ করে তাদের একটু তেল মারার স্বভাব বেশি থাকে। লাঞ্চের পরে আশা করে বসে থাকে ঝিলামের হয়ত ফোন আসবে কিম্বা হয়ত নিজেই এসে উপস্থিত হবে বাড়ি পৌঁছে দেবার বায়না ধরবে। লাঞ্চ পেরিয়ে যাবার পরেও ঝিলামের ফোন আসেনা। একবার ভাবে নিজেই ফোন করবে, কিন্তু ফোন করতে গিয়েও মন খুতখুত করে ওঠে, ঠিক যেন সাহস জুগিয়ে পায়না। এমনি দিনে যদি কাজ থাকত তাহলে ফোন করে দিতে দ্বিধা বোধ করত না। এই যেমন সপ্তাহ দুই আগে, সি.এম.ও’র ফেয়ারওয়েল পার্টির জন্য ঝিলামকে জিজ্ঞেস করেছিল যে কি দেওয়া যায়। ঝিলাম ওকে বুদ্ধি দিয়েছিল যে চাঁদা তুলে একটা দামী হাতঘড়ি দিতে। তাই করেছিল বুধাদিত্য, অফিসের সবাই সেই বুদ্ধিতে মত দিয়েছিল। কারুর একজনার পকেট থেকে বেশি টাকা খসেনি, উপরন্তু একটা ভালো উপহার কিনে দিতে পেরেছিল ওরা সবাই। বুধাদিত্য রাতের বেলা অবশ্য ঝিলামকে ফোন করে সেই বুদ্ধি দেবার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিল। ঝিলাম হেসে বলেছিল, মাঝে মাঝে একটু যেন ওর কথা শোনে। লাঞ্চ পেরিয়ে বিকেল হয়ে যায়, অফিস ছুটিও হয়ে যায়। মনের কোনে ক্ষীণ এক ব্যাথা নিয়ে বাড়ি ফেরে বুধাদিত্য। বাড়ি ফিরে নিজের মনেই হেসে ফেলে, ওর জন্মদিন নিয়ে, ঝিলাম বা সমীরের সাথে কোনদিন কোন কথা হয়নি, সুতরাং ওদের জানার কোন প্রশ্ন ওঠে না। জামা কাপড় খুলে যথারীতি, কফি বানিয়ে চুপ করে ল্যাপটপ খুলে মেইল দেখে। মিয়ুসিক সিস্টেমে মান্না দের গান, তার সাথে কোল্ড ড্রিঙ্কস আর সিগারেট। এমন সময় দরজায় দুমদুম শব্দ। চমকে ওঠে বুধাদিত্য। দরজা খুলে দেখে সমীর আর ঝিলাম।
সমীর হাতে একটা বড় প্যাকেট, একটা ফুলের তোড়া। ঝিলাম পেছনে দাঁড়িয়ে লাজুক হাসে। সমীর এক লাথি মেরে ওকে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে পরে।
সমীর, “বোকা… আজকের দিনে জন্মেছিস শালা পার্টি কি না তোর দেবার কথা আর দিচ্ছি বাড়া আমরা। নে শালা কেক কাট।”
অবাক হয়ে যায় বুধাদিত্য, ঠিক কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারে না। ঝিলামের দিকে তাকায়। ঝিলাম জানায় যে অনির্বাণ নাকি সমীরকে দুপুর বেলা ফোন করেছিল, ওর কাছ থেকে জানতে পারে জন্মদিনের কথা। কিন্তু তারিখ ঠিক মনে ছিল না অনির্বাণের। সমীর বাড়ি ফিরে ওর পুরানো ডায়রি ঘেঁটেঘুটে ঠিক তারিখ উদ্ধার করে।
বুধাদিত্য, “শালা শত্রুর জন্মদিন কি লিখে রেখেছিলি ডায়রি তে?”
সমীর, “না শালা, শত্রু বা বন্ধু নয়, আমার একটা ডায়রিতে স্কুলের সবার জন্মদিনের তারিখ লেখা আছে রে। নে কুত্তা, এবারে কেক কাট, দেখি। তোর জন্য স্পেশাল অর্ডার দিয়ে কেক বানিয়ে এনেছি।”
বুধাদিত্য, “তোরা পাগল নাকি যে এখন আমি কেক কাটবো? বুড়ো হতে চললাম, শালা।”
ঝিলাম, “হ্যাঁ হয়েছে, তুই তিরিশে বুড়ো। বোকা… দেখ গিয়ে বিদেশে, শালা পঞ্চাস বছরে লোকে বিয়ে করে বাচ্চা পারছে।”
কথাটা খুব গায়ে লাগে বুধাদিত্যের, নিজের বাবা, সুবির গুহ, মনে হয় পঞ্চাসে গিয়ে দ্বিতীয় বার পিতা হয়েছেন। তবে সঠিক জানেনা, আদৌ বাপ্পাদিত্য কার ঔরসজাত, ওর বাবার না অন্য কারুর?
বুধাদিত্য মিচকি হেসে বলে, “ঠিক আছে বাবা, কেক কাটলাম তারপরে?”
ঝিলাম “তাঁর আর পর নেই, নেই কোন ঠিকানা। জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে বের হও, বেশি দুরে নয়, ওই ইস্ট অফ কৈলাসেই একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে খাওয়াবে চল।”
বুধাদিত্য, “সেখানে কেন? আরও ভালো জায়গা আছে। বল ত পান্ডারা রোড নিয়ে যেতে পারি।”
সমীর, “চল শালা যেখানে নিয়ে যাবি সেখানে যাব, তবে তোর পকেট মারব আজকে।”
হেসে ফেলে বুধাদিত্য, ঝিলামের হাসির জন্য, পকেট কেন বুকের পাঁজর খুলে দিতে বললে খুলে দেবে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেড়িয়ে পরে। পান্ডারা রোডের একটা নামি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার সারে। খাবার সময়ে সমীর আর বুধাদিত্য সেই পুরানো দিনের স্কুলের কথা নিয়ে আবার শুরু হয়ে যায়। ঝিলাম অগত্যা বসে থাকে মাঝে মাঝে ওদের সেই কীর্তি কলাপ শুনে হাসে আর মন্তব্য করে। খাওয়া শেষ সমীরদের বাড়ি পৌঁছে দেয়। গাড়ি থেকে নামার পরে সমীর ঝিলামের দিকে একটু তাকিয়ে কিছু ইঙ্গিত করে। ঝিলাম একটা ছোটো বাটি বের করে ওর কাঁধের ব্যাগ থেকে। বুধাদিত্য ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
সমীর বুধাদিত্যের হাতে সেই বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলে, “একটু পায়েস খাস ঝিলাম বানিয়েছে তোর জন্য। তুই ত বেশ বড়লোক মানুষ। পায়েস খাবি কি খাবি না, তাই দিতে একটু কেমন লাগছিল।” বুধাদিত্য ঝাপসা চোখে সমীর আর ঝিলামের দিকে তাকায়। সমীর ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে, কি হল? মাসিমার কথা মনে পরে গেল? ঝিলাম বলল পায়েসের কথা, না হলে আমার মনেও আসত না।”
বুধাদিত্য দুহাত বাড়িয়ে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে। ধরা গলায় বলে, “শালা, বন্ধুতের মধ্যে কি বড়লোক, কি গরিব লোক রে?”
ওর কথা শুনে ঝিলামের চোখে একটু জল চলে আসে। একটু হাসি, একটু কাঁপা গলায় বলে, “সমু মাসিমার কথা বলল তাই আমার পায়েসের কথা মনে পরে গেল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে পায়েস বানিয়েছিলাম, খেয়ে দেখ।”
ভীষণ খুশি মনে বুধাদিত্য সেই পায়েসের বাটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সারারাত ঘুমাতে পারেনা বুধাদিত্য, শুধু মায়ের কথা খুব মনে পরে। হস্টেলে থাকার সময় প্রতি বছরে মা ওর জন্য পায়েস বানিয়ে নিয়ে যেত, আর সেই পায়েস ওর ক্লাসের সবাই খেত। সারারাত পায়েসের বাটি হাতে করে মায়ের ছবির সামনে বসে থাকে। সকালে কাজের লোক এসেছিল, কাজ করে গেছে, রান্না করে গেছে। তারপরে আবার ঘুমিয়ে পরে বুধদিত্য। যথারীতি পরেরদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে।
ঠিক দুপুর আড়াইটে নাগাদ ঝিলামের ফোন, অপাশ থেকে চেঁচানি, “তুমি কোথায়? আমি তোমার অফিসে এসে শুনলাম তুমি অফিসে আসোনি। কি হয়েছে?”
বুধাদিত্য ঘুমচোখে উত্তর দেয়, “চেঁচাচ্ছ কেন, আমি কানে কালা নাকি? ঘুমাচ্ছিলাম আমি, এই উঠলাম।”
ঝিলাম, “কেন শরীর খারাপ নাকি? আমি এখুনি আসছি।”
বুধাদিত্য মজা করে বলে, “না মানে তোমার পায়েস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলে নাকি পায়েসের মধ্যে?”
ঝিলাম, “ধ্যাত, সত্যি বল, শরীর খারাপ?”
বুধাদিত্য, “না আমার শরীর খারাপ হতে যাবে কোন দুঃখে? আমি ভাল আছি, আসল কথা কাল রাতে ঠিক ঘুম আসেনি তাই দেরি ওরে উঠেছি।”
ঝিলাম একটু নিচু গলায় বলে, “আমি জানি কেন তোমার কাল রাতে ঘুম হয়নি। মাসিমার কথা খুব মনে পড়ছিল তাই না?” বুধাদিত্য চুপ করে থাকে, সত্যি কাল রাতে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। অন্যদিন হলে হয়ত নিজেকে মদে ডুবিয়ে নিত আর এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু মদ ছেড়ে দিয়েছে তাই ব্যাথায় আর ঘুম আসেনি, চোখ বন্ধ করলেই মায়ের মুখ সামনে চলে আসে। ঝিলাম অনুধাবন করে বুধাদিত্যের মনের অবস্থা, বুঝে যায় যে বড় ব্যাথার জায়গায় ঘা দিয়েছে, হয়ত নাড়া দেওয়া ঠিক হয়নি। একটু ক্ষমার সুরে বলে, “প্লিস উলটো পাল্টা কিছু করো না, ভালো থেক। পরে দেখা হবে।”
ঝিলামের পায়ের ছাপ সোজা বুধাদিত্যের বুকের ওপরে এসে পরে। ঝিলাম আর বুধাদিত্যের মাঝে এক প্রগাড় বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে।