মধ্যরাত্রে সূর্যোদয়ঃ ১ম অধ্যায় [২]

Written By pinuram

ম্লান আশার আলো (#01)
দিনের পর দিন চলে যায়। দমদমে ফিরে আসার পরে আমাকে কিছু টা স্বাধীনতা দেওয়া হয়। রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে শুতে গেলে ছোটমা আর বকেন না। একদিন রাতে খাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে সেই ডায়রি খুলে বসি। অনেক দিন পরে ডায়রি হাতে নিয়ে আমার মনটা খুব ভালো লাগে। শুরুর কয়েক পাতা শুধু আবল তাবল কবিতায় ভর্তি যার কোন মাথা মুন্ডু নেই। অনেক দিন পরে ওর কথা ভেবে আমার হাসি পায় আর মনের ভেতরের সেই কালো মেঘ যেন উড়ে চলে যায়। রোজ রাতে ওর ডায়রি খুলে বসতাম আর ওর হাতের লেখা পড়ে মনে হত যেন ও মার পাসে বসে আমার সাথে কথা বলছে। বুকের মাখে এক নতুন আশার আলো উঁকি দিয়ে ওঠে। ছোটমা আর বাবু আমার হাসি মুখ দেখে খুশি। ওরা ভাবে যে আমি পুরানো কথা ভুলে গেছি, কিন্তু আসল কথা যে আমার বুকে, ও যে ডায়রির মাধ্যমে রোজ রাতে আমার সাথে কথা বলে।
ক্রিসমাসের ঠিক দিন পনেরো আগের ঘটনা, সুব্রত আর মৈথিলীর প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ছিল সেইদিন। আর সেইদিন ওর সাথে বড় হওয়ার পড়ে আমার প্রথম দেখা। আমার পক্ষে খুব স্মরণীয় দিন ছিল সেদিন। সকাল থেকেই আমি বেশ খুশি ছিলাম, কোলকাতার শীত যেমন মিষ্টি তেমন মিষ্টি মনে হয়েছিল সেদিনের সকাল। আমার প্রথম চুম্বনের দিন, কপালে চুমু খেয়েছিল কিন্তু খুব মিষ্টি সেই পরশ। সকালে ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি সেই চুম্বনের পরশ কপালে অনুভব করেছিলাম। বুকের মাঝে যেন এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ খেলে বেড়ায়। আমার হৃদয় জানে, যেখানেই থাকুক ও সেই এক অনুভব করছে নিজের ঠোঁটের ওপরে।
ছোটমা আর বাবু এই সবে সুব্রত আর মৈথিলীকে ফোন করে। ছোটমা আমাকে ও মৈথিলীর সাথে কথা বলতে বলে, কিন্তু সেইদিনের ঘটনার পরে ওর নাম শুনলেও যেন আমার গা পিত্তি জ্বলে যেত। তাই আমি ছোটমাকে বলি যে বলে দিতে আমি বাথরুমে আছি আর পরে ওদের ফোন করে নেব। মৈথিলীর সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপের কথা মনে পরে যায়, মনে হয় যেন ওর জন্যেই আজ আমার দুজনা একসাথে নেই। রাগে বুক কেঁপে ওঠে আমার।
তারপরে ছোটমা স্কুলে বেড়িয়ে যান। আমি কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম নিজের ঘরে। বাবু ফোনের কাছেই কিছু করছিলেন, ঠিক সেইসময়ে ফোন বেজে ওঠে। আমার মন বলছিল যে ফোন যেন ওর হয়।
বাবু, “হ্যালো, কে বলছে?”
আমি চুপ করে দরজায় দাঁড়িয়ে। যেই ওপারে ছিল, তাঁর গলার আওয়াজ শুনে বাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বাবু আমার দরজার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাই আমাকে দেখতে পান না। আমি বাবুর মুখ দেখতে পাই।
বাবু, “আমরা সবাই ভালো আছি। কেন ফোন করেছিস তুই?”
বাবুর কথা শুনে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। বুকের মাঝে যেন রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। ওপারে যে ও কথা বলছে সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয় না আমার। আমি ঝাঁপ দিয়ে ওই ফোনের রিসিভারের মধ্যে ঢুকে যেতে চাই যেন, মন চায় যে ওই ফোনের তার আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাক। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, যদি একটু ওর গলার আওয়াজ শোনা যায়।
বাবু, “না ও বাড়িতে নেই, ও গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।”
বাবুর মুখে মিথ্যে কথা শুনে আমার গা রিরি করে জ্বলে ওঠে। ও জানে না যে আমার গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন এসে গেছে, না হলে নিশ্চয় বাড়িতে ফোন করে খবর নিত। আমি চোখ বন্ধ করে নেই, আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে, কান গরম হয়ে যায়, বুক কাঁপতে থাকে।
বাবু, “হ্যাঁ, ও এমএসসি পড়ছে। আমরা ওর বিয়ের ঠিক করে ফেলেছি, এমএসসি শেষ হলেই ওর বিয়ে হয়ে যাবে।”
আমি জানতে পারিনা যে ওই কথা শুনে ওর মনের কি অবস্থা হতে পারে। কিন্তু এই টুকু বিশ্বাস ছিল যে বাবুর কথা ও বিশ্বাস করবে না। আমি দরজার পর্দা ধরে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকি। ঝাপসা চোখের সামনে সারা পৃথিবী দুলতে শুরু করে দেয়। বুকের মাঝে শুধু এক চিন্তা ঘুরে বেড়ায়, এত কাছে এসেও আমি ওকে আবার হারিয়ে দিলাম, শুধু মাত্র বাবুর একটি ছোটো মিথ্যে কথার জন্য। না, বিশ্বাস যে বড় জিনিস, আমার ওপর সেই বিশ্বাস যেন ওর থাকে।
বাবু, “এখানে ফোন করে আর ওকে জ্বালাতন করিস না। ও সব কিছু ভুলে সুখী আছে এখন।”
আমি চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পরি। রাগে দুঃখে বালিশ ছিঁড়ে ফেলি কুটি কুটি করে। বিছানায় মাথা পিটিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। ফোন করেছিল আমাকে, কিন্তু অদৃষ্ট আমার, শেষ পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলতে পারেনা। আমি বালিশ কামড়ে নিজের বুক ফাটার আওয়াজ ঢেকে ফেলি।
বাবু আমার দরজায় টোকা মেরে বলেন, “সোনা মা, কলেজের দেরি হয়ে যাবে যে।”
আমি বুক ফাটিয়ে আর্তনাদ করে ছিলাম, “না আমি ভালো নেই, আমাকে তোমরা মেরে ফেললে না কেন। চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। কি করে এত বড় মিথ্যে কথা তুমি বলতে পারলে বাবু?”
না গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়নি সেদিন। বুকের কান্না বুকের মাঝে ঢাকা পরে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে নিচু স্বরে উত্তর দেই, “আমার শরীর ভালো লাগছে না বাবু, আজকে আর কলেজ যাবো না।”
বাবু, “ঠিক আছে, বিশ্রাম করো। বিকেলে তোমার ছোটমা এলে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে খানে।”
আমার ভাগ্য এই টুকু ভালো যে বাবু জানতেন না যে আমি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে বাবুর আর ওর সব কথা শুনে ফেলেছিলাম। যদি জানতে পারতেন তাহলে হয়ত বাড়িতে আরও একটা কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত।
সেইদিনের ঘটনার পরে আমি খুব মর্মাহত হয়ে পরি। আমার বেদনা আমার ব্যাথা আমার চেহারায় ছড়িয়ে পরে আর সেই ছায়া ডেলিসা আর তিস্তা বুঝতে পারে। বারে বারে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার ভারাক্রান্ত মনের কথা কিন্তু আমি কাউকে আসল কারন জানাইনি। সেই দিনের ঘটনার পরে আমি নিজেকে একটা শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে ফেলি। মাথার মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা ঘুরে ফিরে দানা বাঁধে যে এত কাছে আসা সত্তেও আমি ওকে আবার হারিয়ে ফেললাম। বাবুর একটা বাক্য আমার সব আশার আলো মুছে দিয়ে চলে গেল।
সেইদিনের কিছু দিন পরে আমি কলেজ স্ট্রিটের বাসস্টান্ডে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোলকাতায় শীত কাল চলে এসেছিল। ক্রিসমাসের আমজে যেন আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। সালোয়ার আর কারডিগান ছিল গায়ে। শীত বিশেষ ছিল না কিন্তু মনের দুখের জন্যে আমার যেন বেশি করে শীত লেগেছিল। ঠিক সেই সময়ে আমার কাঁধে কেউ হাত রাখে, আমি চমকে যাই।
আমাদের কলেজের সঙ্খ চক্রবর্তী, “অনেক ক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি তোমাকে, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কিন্তু কোন বাসে উঠছ না।”
সঙ্খ আমার সাথে এমএসসি পরে, খুব কম কথা বলে। বিশেষ লম্বা নয় ছেলেটা, খুবই সাধারন দেখতে কিন্তু ভারী বুদ্ধিমান এবং পড়াশুনায় খুব ভালো। আমার ধারে কাছে কোনদিন ঘেঁসেনি কেননা সবসময়ে আমার চারদিকে তিস্তা, ডেলিসার বাঁ দেবব্রত থাকত। এমনিতে ক্লাসে আমার নামের পেছনেও সবাই বলত বইয়ের পোকা, আর আমি শুধু তিস্তা বাঁ দেলিসা ছাড়া কারুর সাথে বিশেষ কথাও বলতাম না।
আমি ওর দিকে হালকা হেসে জিজ্ঞেস করি, “এমনি দাঁড়িয়ে, বাস গুলো সব খুব ভিড় ছিল তাই আর চরিনি।”
সঙ্খ, “শিয়ালদা পর্যন্ত হাঁটবে আমার সাথে? ওখান থেকে তুমি বাড়ি ফেরার অনেক বাস পেয়ে যাবে।”
আমি মাথা নাড়িয়ে বলি, ঠিক আছে।
আমি আর সঙ্খ হাটা শুরু করেছি কি দেবব্রত আমদের দেখে শীষ দেয়। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে যাই যে শয়তানটা অনেক কিছু ভেবে বসে আছে। দেবব্রত আমাদের দিকে দৌড়ে এসে বলে, “সঙ্খ, তুই? হ্যাঁ রে তুই আমার গার্ল ফ্রেন্ড কে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলি?”

ম্লান আশার আলো (#02)
দেবব্রত আমাকে অনেক খেপাত, সবসময়ে যেন প্রানপন চাইত আমার ম্লান ঠোঁটে হাসি ফোটানোর। আমি ওর কথা শুনে ব্যাগ ছুঁড়ে মারি ওর দিকে। সঙ্খ ওর কথা শুনে লজ্জায় পরে যায়। দেবব্রত সঙ্খর পিঠে থাবড়ে বলে, “যা ভাই বাড়ি যা, এখান থেকে আমি ওকে নিয়ে যাবো।”
আমি ওর দিকে জোর গলায় বলে উঠি, “শয়তান ছেলে এই রকম ভাবে বলছিস যেন আমি তোর কেনা বাঁদি?”
দেবব্রত আবার আমাকে খেপিয়ে বলে, “এখনো নয় তবে…”
সঙ্খ আমাদের মারামারি দেখে বেশি ক্ষণ দাঁড়ায় না, চুপ চাপ ওখান থেকে চলে যায়।
সঙ্খ চলে যাওয়ার পরেই দেবব্রত গম্ভির হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা বলো তো কি হয়েছে তোমার? কয়েক দিন থেকে নজর করছি তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ, কারুর সাথে ঠিক করে কথা বলছ না বা হাসছ না।”
আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই, “কিছু না রে, আমার বড় বৌদি মারা গেছেন তাই মন খারাপ।”
আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আরে বাবা, এতে আর দুঃখ করে কি হবে।”
ওর হাতের বন্ধুতের স্পর্শ আমার ভারাক্রান্ত মনের মাঝে একটু শান্তির বারি প্রদান করে। আমাকে জিজ্ঞেস করে দেবব্রত, “শীতের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছও নাকি?”
আমি মাথা নাড়াই, “নারে যাচ্ছি না, তুই কোথাও যাচ্ছিস কি?”
দেবব্রত, “হ্যাঁ।”
আমি, “কোথায়?”
দেবব্রত, “দিল্লী, আমার বড়দি থাকে ওখানে।”
দিল্লীর নামে শুনেই আমার মন নেচে ওঠে, আমার ভালোবাসা দিল্লীতে থাকে, কিছু করে যদি একটা খবর পাঠানো যায়।
দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি হল?”
আমি প্রায় ভিক্ষে চাওয়ার মতন কাতর প্রার্থনা করি ওর সামনে, “আমার একটা কাজ করে দিবি?”
দেবব্রত, “হ্যাঁ নিশ্চয়, কি করতে হবে বলো?”
আমি শুধু জানতাম যে সুপ্রতিমদা সিআরপার্কে থাকে কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানতাম না। আমার শুধু মনে আছে যে বাড়ির কাছে একটা বড় কালি মন্দির ছিল আর একটা বড় বাজার ছিল। জায়গার নাম জানতাম না ঠিক মতন।
আমি ওকে বলি, “আমি তোকে একটা চিঠি দেব আর একটা ফোন নাম্বার দেব। তুই প্লিস দিল্লী গিয়ে সেই ফোন নাম্বারে ফোন করে আমার চিঠি পৌঁছে দিবি?”
আমার কথা শুনে ওর চোখ যেন দুষ্টুমিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে, “হুম্মম্ম… পুরান ভালোবাসা, হ্যাঁ?”
আমি বুকের ভাষা লুকিয়ে ওকে বলি, “না না, সেই রকম কিছু নয়। চিঠিটা আমার এক বান্ধবীর বর কে দিতে হবে।”
আমার কথা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি চাও আমি তোমার বান্ধবীর বরের সাথে দেখা করে তাঁর হাতে চিঠি দেই?”
আমি, “হ্যাঁ প্লিস আমার এই কথাটা রাখ।”
দেবব্রত, “আচ্ছা দিয়ে দেব। আমি কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চলে যাবো। চিঠিটা তার আগেই দিয়ে দিও।”
আমি খুব খুশি হয়ে গেছিলাম, আমার চিঠি অন্তত কিছু একটা খবর নিয়ে আসবে এই ভেবে। কেউ ত ছিল যে কিনা আমার মনের খবর আমার ভালোবাসার কাছে পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু সেইসাথে মনের মধ্যে একটা সংশয় জাগে, দেবব্রত ঠিক মানুষের হাতে চিঠি পৌঁছে দেবে ত? আমি যে সুপ্রতিমদার বাড়ির ঠিকানা জানতাম না, শুধু মাত্র একটা ফোন নাম্বার সম্বল করে আমি চিঠি পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিছুদিন পরে আমি সুপ্রতিমদার নামে একটা চিঠি লিখে দেবব্রতর হাতে দেই। সেই চিঠিতে আমি সুপ্রতিমদাকে লিখেছিলাম যে আমার ভালোবাসা যেন আমার ওপরে বিশ্বাস রাখে আর আমি ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকব।
সেইবারে আমি আরও এক কারনে খুব খুশিতে ছিলাম, ছোটমা কথা দিয়েছিলেন যে আমাকে সেলফোন কোনে দেবেন। কিন্তু বাড়িতে কেউ সেই নিয়ে কোনদিন কথা বলেনা তাই সেলফোন পাওয়া নিয়েও আমার মনের মধ্যে সংশয় থেকে যায়। আদৌ কি বাবু আমাকে সেলফোন উপহার দেবে?
ক্রিসমাসের দিন সকালবেলা। ছোটমা বাবুর অভ্যাস, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার, আমি উঠে দেখি যে ছোটমা বাবু বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলেন। আমি বাথরুমে থেকে বেড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখি বিছানার ওপরে একটা উপহারের বাক্স। সেই বাক্স খুলে দেখি তাঁর মধ্যে সেলফোন, নোকিয়া 3330, আমার স্বাধিনতার প্রথম পদক্ষেপ ভেবে বুকে চেপে ধরি সেই বাক্স। দৌড়ে বসার ঘরে গিয়ে ছোটমাকে জড়িয়ে ধরি।
ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “এবারে খুশি ত?”
আমি তখন খুব খুশি, “হ্যাঁ, খুউউউউউব…”
ছোটমার সাবধান বানী ঠিক তারপরে, “কিন্তু আমাকে একটা কথা দিতে হবে। তুমি এমন কোন পদক্ষেপ নেবেনা যার জন্য অপমানিত হয়ে সবার সামনে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়।”
মনের ভেতরে যত খুশি যত আনন্দ ছিল, সব যেন এক ফুঁ তে উবে গেল। আমি সেলফোন ধরে নিজের ঘরে ঢুকে পরি। ছোটমা আমার পেছন পেছন আসেন। ছোটমা আবার জিজ্ঞেস করেন, “পরী আমি কিন্তু উত্তর পেলাম না।”
আমার বুকে যেন শক্তিশেল ফুটে, আমি ধিরে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেই যে আমি কোন পদক্ষেপ নেবনা যার জন্য ছোটমায়ের মাথা অপমানে সবার সামনে নিচু হয়ে যায়। আমি সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলাম, আমি যদি কোন রকমে ওর একটা খবর পেতাম তাহলে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতাম। ছোটমা আমার উত্তরে খুশি হয়ে চলে গেলেন।
চলে যাবার পরেই আমার মনে হয়েছিল ওকে ফোন করার কিন্তু আমি যে ওর ফোন নাম্বার জানতাম না। মন কেঁদে উঠেছিল, কিন্তু আমি নিরুপায়। রাতের বেলা খাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রথম ফোন ওর খবর নেওয়ার জন্য করি। আমি সুপ্রতিমদার বাড়িতে ফোন করেছিলাম, মনে একটু সংশয় ছিল যে অত রাতে হয়ত বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরে যাবে কিন্তু ব্যাথিত মন মানতে চায় নি।
সুপ্রতিমদার মা ফোন ধরেছিলেন, “হ্যালো, কে বলচ্ছে?”
আমি, “আমি সুপ্রতিমদার বান্ধবী, কোলকাতা থেকে বলছি।”
আমার গলা শুনে মাসিমা চিনতে পেরেছিলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, তোমরা আমার বাড়িতে এসেছিলে। কেমন আছো?”
যাক শেষ পর্যন্ত একটা আশার আলো দেখা গেল, খড়া বুকের মাঝে যেন শান্তির জল পরে। আমি মাসিমা কে জিজ্ঞেস করি যে সুপ্রতিমদার সাথে কথা বলা যাবে কি?
মাসিমা জানালেন, “সুপ্রতিম তো দিল্লী থাকেনা। বিয়ের পরে কর্ম সুত্রে ব্যাঙ্গালর চলে গেছে।”
সুপ্রতিমদার চলে যাওয়ার খবর শুনে একটু ধাক্কা লাগে বটে কিন্তু আশা হারিয়ে ফেলিনা। আমি মাসিমাকে সুপ্রতিমদার ফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করি।
তারপরে আমি জিজ্ঞেস করি, “অভিমন্যুর কোন খবর আছে আপনার কাছে?” অনেক দিন পরে ওর নাম নিজের ঠোঁটে শুনে আমার মন কেমন করে ওঠে, ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি।
মাসিমা।, “হ্যাঁ, সপ্তাহ দুয়েক আগে বাড়িতে এসেছিল।”
সেই কথা শুনে মনে হল যেন আমার জীবনে এক নতুন সূর্যোদয় ঘটতে চলেছে, আমি জিজ্ঞেস করি, “ওর ফোন নাম্বার দেবেন?”
মাসিমা, “ঠিক বলতে পারব না, এখন ও দিল্লীতে আছে কি না।”
আমার সেদিন মনে হয়েছিল যেন আমি প্রানপন দৌড়ে রেসের শেষ সীমানায় পৌছাতে চেষ্টা করছি কিন্তু শেষ প্রান্তে এসে দেখি যে সেই লাল ফিতে কেউ যেন টেনে নিয়ে চলে গেছে। বুকের মাঝে কান্নার রোল বেজে ওঠে, নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করি, “কোথায় গেছে কিছু জানেন?”
মাসিমা, “না মা, তবে সুপ্রতিম জানতে পারে হয়ত, ওকে ফোন করতে পার।”
বাবুর একটা বাক্য আমাদের জীবন আবার ধ্বংস করে দিল। আমি ফোন রেখে সুপ্রতিমদাকে ফোন করি। সুপ্রতিমদা আমার ফোন পেয়ে খুব অবাক। আমার বুকের মাঝে উত্তাল ঢেউ দোলা দেয়, যদি কিছু খবর পাই ওর, আর না পেলে আমি কি করব জানিনা। কিন্তু যে খবর সুপ্রতিমদা আমাকে দেয় সেই শুনে আমার সব আশা সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
সুপ্রতিমদা, “অভি লাস্ট সপ্তাহে কল করেছিল আমকে। ও বলল তোমার নাকি বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে?”
আমি চাপা কেঁদে উঠে বলি, “না, মিথ্যে কথা।”
সুপ্রতিমদা, “অভি খুব মর্মাহত হয়ে পড়েছিল সেই খবর শুনে। শুধু মাত্র তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছিল। ও জানাতে চেয়েছিল যে নিজের মাথা উঁচু করে সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তোমাকে নিয়ে যাবে। জানো ত এই সমাজ শুধু টাকা চেনে, তাই টাকা রোজগার করতে এখন ব্যাস্ত কিন্তু বিপথে যায়নি তোমার অভি। শুধু তোমার ভালোবাসা বুকে বেঁধে এখন বেঁচে আছে, কিন্তু…”
আমি, “কিন্তু কি? ও এখন কোথায়? আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই, ওর নাম্বার দেবে আমাকে?”
সুপ্রতিমদা, “অভি আমাকে জানিয়েছিল যে ও ইস্রায়েল যাচ্ছে, ওর কম্পানি ওকে কয়েক বছরের জন্য ওখানে পাঠাবে। ও আমাকে বলে, যেহেতু তোমার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে তাই ও আর কোনদিন কোলকাতা ফিরবে না। মাত্র চারদিন আগে ইসরায়েল চলে গেছে অভিমন্যু। তুমি যদি আর কিছুদিন আগে ফোন করতে তাহলে হয়ত কিছু হত। এখন কি করতে চাও তুমি?”
আমি একদম ভেঙ্গে পরি, চোখের সামনে যেন কালো ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়। সুপ্রতিমদা, “তোমরা যে হেরে গেলে।”
আমি চিৎকার করে উঠি, “না আমি হেরে যেতে পারিনা। আমি হারিনি, আমাকে ছল কপট করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমার অভি হারতে পারেনা।”
আমি ফোন রেখে বিছানায় শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ ধরে। কান্না চাপার জন্য বুকের ওপরে বালিশ চেপে ধরেছিলাম। অনেক পরে বিছানা ছেড়ে উঠে আমি তাক থেকে ওর সেই ডায়রি নামাই। ঝাপসা চোখে সেই ডায়রির পাতা গুলো এক এক করে পড়তে থাকি। সেই ডায়রির সব লেখা আমার কেমন যেন মেকি মনে হয়, সব প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা যেন মিথ্যে। একবারের জন্য মনে হয় সেই ডায়রির পাতা গুলো ছিঁড়ে ফেলে জ্বালিয়ে দেই। সেই “অপ্টিক্স নোটবুক” যেন একটা মিথ্যে প্ররোচনার বাসা। এই ডায়রি গত কয়েক মাসে আমার প্রানের উৎস ছিল, কিন্তু সেদিনের খবর শুনে মনে হয়েছিল যে সেই ডায়রি মিথ্যে। কিন্তু আম্মি সেই ডায়রি ছিঁড়ে ফেলতে পারিনি আবার সযত্নে তাকে তুলে রেখে দিয়েছিলাম।
প্রথম এই সমাজের বন্ধন আমাদের ভালোবাসার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু একটা আশা ছিল যে আমার অভি আমার বুকে আবার ফিরে আসবে। বাবুর একটা ছোট্ট মিথ্যে আবার যেন আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায়। আমার সব আশা, সব স্বপ্নের আলো যেন চোখের সামনে থেকে নিভে আসে ধিরে ধিরে। যদি একবারের জন্যেও আমার প্রতি ওর বিশ্বাস থাকে তাহলে নিশ্চয় বিশ্বাস করবে যে বাবুর কথা মিথ্যে আর আমি সেই বিয়েতে মত দেই নি। কিন্তু সেই কথা আমি ওকে জানাতাম কি করে।
কিচুদিন পরে আমি দেবব্রতর কাছে সেই চিঠি ফেরত চাই। তার কিছুদিন পরে আমি গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমি কল্যাণীর হাতে সেই ডায়রি তুলে দিয়ে বলেছিলাম। ডায়রি খুলে আমাকে কল্যাণী জিজ্ঞেস করে যে এতে কি আছে। আমি জানিয়েছিলাম যে ওই ডায়রি আমার কাছে প্রানের উৎস, কিন্তু এখন আর নয়।
কল্যাণী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এটা ত অভিমন্যুর ডায়রি, এটা আমি নিয়ে কি করব?”
আমার গলা ধরে আসে, কিন্তু আমি কল্যাণীকে সব ঘটনা খুলে জানাই। সবকিছু শুনে আমাকে বলে, “তুই এটা তোর কাছেই রাখ।”
আমি, “আমাকে ছেড়ে যখন চলেই গেছে তাহলে আর ডায়রি রেখে কি করব।”
কল্যাণী ডায়রি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা তোর সম্পত্তি, তুই এটা জ্বালিয়ে দিচ্ছিস না কেন তাহলে?”
আমি বুক ভরা শ্বাস নিয়ে ওকে জানিয়েছিলাম, “এই ডায়রির পাতায় ওর ছোটবেলা আছে, এই ডায়রির পাতায় ওর লেখা আছে সেই 1992 থেকে। এই ডায়রি শুধু মাত্র আমাদের ভালোবাসা নয়, এই ডায়রিতে আছে ওর ছোটবেলা, ওর দুঃখ, ওর কষ্ট, ওর সুখ, ওর শান্তি, ওর খুশি ওর বন্ধু ওর বান্ধবী। আমি নিজে থেকে ওকে হত্যা করতে পারব না, কল্যাণী।”
কল্যাণী, “তুই এখন কি করবি তাহলে?”
আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি জানি না রে আমার ভবিষ্যতে কি হবে, তবে যাই আসুক আমি তাই মেনে নেব।”
কল্যাণী, “মানে?”
আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে কল্যাণীর মানের উত্তর দেই, “আমার মাও মনে হয় আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। আমার থেকে দু বছরের ছোটো আর আমাদের মাঝে যদিও একটা ক্ষীণ সম্পর্কের বন্ধন আছে। এইমত অবস্থায় আমার কাছে কে বেশি গুরুত্তপূর্ণ আমার ভালোবাসা না আমার মা আর ছোটমা? আমি এক গ্রামের সাধারন ঘরের মেয়ে, আমাদের জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করে চলতে হয় আমাদের। যদি ও আমাকে এই রকম ভাবে ছেড়ে চলে না যেত তাহলে আমি ওর জন্য সারা জীবন বসে থাকতাম, সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে যেতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আমি আর কি নিয়ে থাকব?”
কল্যাণী আমার কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বলে, “তোরা দুজনেই জানতিস তোদের ভবিষ্যৎ, তোরা প্রন করেছিলিশ যে দুজনে মিলে একসাথে সেই ভবিষ্যতের সাথে যুদ্ধ করবি। সেই প্রতিজ্ঞার কথা কি হল? এটাও ত হতে পারে যে, ও কিছু করার জন্য বাইরে গেছে, এটাও ত হতে পারে যে তোর জন্য একদিন ও আবার ফিরে আসবে। এত তাড়াতাড়ি সব আশার জলাঞ্জলি দিস না।”
আমি, “আমি খুব ক্লান্ত রে কল্যাণী। সুপ্রতিমদার কাছে যদি কোন কিছু বলে যেত তাহলে না হয় অন্য কথা ছিল, কিন্তু অজে কিছুই বলে যায়নি। ও যে শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গা মন নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।”
কল্যাণী, “তোর বাবুর মুখে ওই কথা শোনার পরে যে তোর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে, কি করা উচিত ছিল ওর?”
আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের ভালোবাসার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা। আমার চোখের সামনে সব আশা, সব স্বপ্নের আলো ধিরে ধিরে ম্লান হয়ে যায়।

শ্বেত পাথরের মূর্তি (#01)
কেউ চলে গেলে কি কারুর জীবন থেমে যায়? পুবালি ছেড়ে চলে যাবার পরে কি অরুন্ধুতির জীবন থমকে গিয়েছিল, না অরুনা আবার ফিরে পেয়েছিল তার জীবন। আমিও মন কে প্রবোধ দেই যে আমার দূর্ভাগ্যের জন্য আজ আমাদের এই দশা। ভাগ্য আমাদের একসাথে এনেছিল এক সময়ে, কিন্তু সেই ভাগ্যের পরিহাসে আমরা দুইজন আজ পৃথক পৃথক পথে চলে গেছিলাম। এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। দিন যায়, আমি আমার মন শক্ত করতে চেষ্টা করি। কিন্তু বারে বারে পাপী মন মানে না, বারে বারে তার কথা মনে পরে যায়। দিনে দিনে আমি শুকিয়ে গেছিলাম। ছোটমা বাবু দুজনেই আমার শরীর খারাপ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
এক রবিবার সকালবেলায় বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে তোমার? ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করছ না তুমি। ওজন কমে গেছে, দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছও? এই ভাবে কত দিন চলবে, পরী?” ছোটমা গলায় চিন্তার সুর। সেদিন বিকেলে ছোটমা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, কিন্তু সেই অসুধে আমার শরীর ঠিক হয় না। আমার ওষুধ যে অন্য কারুর কাছে, সেটা আমি বলে বুঝাতে পারিনা।
শীতের ছুটির পরে কলেজ শুরু হয়ে যায়। আমি নিজেকে পড়াশুনায় আর কলজের কাজে ব্যাস্ত রাখতে চেষ্টা করি। আমার সেই চঞ্চল, উচ্ছল হাসি মুখ হারিয়ে যায়। ছোটমায়ের মন যেন কেঁদে ওঠে আমার ম্লান চেহারা দেখে।
একদিন ছোটমা আমাকে বলেন, “পরী তোকে এইরকম ভাবে ভেঙ্গে পড়লে ত হবে না। তুই বড় হয়েছিস, তোকে তোর অতীত ভুলে নতুন জীবনে পা রাখতে হবে। তোর সামনে এক বিশাল সুন্দর জীবন পরে আছে।”
আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলি, “তুমি কি করে আমাকে বল সেই সব দিনের কথা ভুলে যেতে?”
ছোটমা আমার হাত ধরে বলেন, “আমি ওর মা, পরী। আমি যদি থাকতে পারি তাহলে তুই কেন পারবি না।”
আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি নিজেকে পড়াশুনায় ডুবিয়ে দেব, ছোটমা। আমি প্রানপন চেষ্টা করব নিজেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ছোটমা, তোমার ছেলে তুমি হারিয়েছ, তার বেলায় তুমি কি করবে?”
ছোটমা, “ও হয়ত একদিন বুঝতে পারবে, যে আমি যা করেছি ওর ভালর জন্য করেছি।”
আমি ধরা গলায় বলি, “ছোটমা, আমি একটু একা থাকতে চাই।”
ছোটমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম ছোটমায়ের প্রান তাঁর ছেলের জন্য প্রতিরাতে কাঁদে, কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ কোনদিন বুক থেকে মুখে আনেননি ছোটমা, শুধু মাত্র সমাজ আর আত্মীয় সজ্জনের কাছে মুখ দেখানর ভয়ে। ছোটমা কি জানে যে তার একমাত্র পুত্র দেশ ছেড়ে চলে গেছে? হয়ত জানে না।
ছোটমা আর বাবু বুঝতে পারেন যে আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি আর নিজেকে পড়াশুনায় ডুবিয়ে দিয়েছি। আমার স্বাধিনতার বেড়ি একটু বেড়ে যায় তারপর থেকে।
শীতকাল চলে যায়। চিতকুলের ভ্রমণের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। একদিন আমরা সব বন্ধু বান্ধবী মিলে মেডিকেলের দিকে হেটে যাচ্ছিলাম।
দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা সেই চিঠি টা তুমি নিয়ে নিলে কেন?”
আমি, “সুপ্রতিমদা, যার জন্য সেই চিঠি লিখেছিলাম সে আর দিল্লীতে থাকেনা, সে ব্যাঙ্গালর থাকে।”
দেবব্রত, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি? সেদিন সেই চিঠি পৌঁছানর ব্যাপারে তোমাকে খুব মরিয়া লাগছিল?”
আমি বুকের বেদনা লুকিয়ে হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “না আমাকে কোন প্রশ্ন করতে পারিস না তুই। আমার বান্ধবীর কাছে লেখা সেই চিঠি আর এই সব মেয়েলি ব্যাপার।”
কি বুঝল দেবব্রত জানিনা। কিন্তু তিস্তা আর দেলিসা আমাদের দেখে ফিকফিক করে হেসে ফেলে।
তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি গো, কিছু যেন গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে?”
দেবব্রত ওর মাথার ওপরে চাঁটি মেরে বলে, “নিজের মতন সবাইকে ভাবিস কেন বলত?”
দেলিসা, “হুম খুব বেশি ভাব মনে হচ্ছে, এখন থেকেই এত আগলে রাখা।”
দেবব্রত, “শোন, আমি তির্থাঙ্কর নই আর মিতা, তিস্তা নয়। সুতরাং তোরা মুখে কুলুপ এটে থাকলে ভালো হবে।”
আমি বুঝতে পারলাম যে কথার প্রসঙ্গ আমাকে নিয়ে আর সেই প্রসঙ্গ ধিরে ধিরে বিরূপ ধারন করছে। আমি সবাইকে বলি, “আমরা সবাই বন্ধু বান্ধবী, সেই সম্পর্ক যেন আমাদের মধ্যে থাকে আর সেটাই বিবেচ্য। আর যেন এই নিয়ে কোন কথা না হয় আমাদের মধ্যে।”
দেবব্রত সবাইকে বলে, “ভালো ত, এই তোরা সিনেমা দেখতে যাবি?”
রজত, পুশপাঞ্জলি, সঙ্খ সবাই এক মত। আমার সেদিন সিনেমা দেখতে যাওয়ার মন ছিল না। আমি চুপ করে ছিলাম। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি হল?”
আমি বলি, “না আজকে নয়, অন্য কোনদিন যেতে পারি।”
দেবব্রত, “রবিবার?”
আমি জানালাম যে ছোটমাকে না জানিয়ে আমি কথা দিতে পারছিনা। দেবব্রত, “ঠিক আছে, রবিবার, গ্লোব।”
রজত পুশপাঞ্জলি একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে, “এক জনের জন্য কেন সিনেমা দেখা বন্ধ করা হবে?”
তিস্তা আমার মনের কথা বুঝে ফেলে ওদের বলে, “না না, আজ নয়, রবিবার হলে, তির্থাঙ্কর আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যেতে পারবে।”
দেলিসা ওদের বলে, “ভালো ভালো, তাহলে দানিস কে আমি ডেকে নেব।”
শনিবার রাতে আমি ছোটমাকে রবিবারের সিনেমা দেখার কথা জিজ্ঞেস করি। ছোটমাকে আমাকে সিনেমা দেখতে অনুমতি দিলেন সাথে সাথে সাবধান বানী দিলেন, যেন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসি। মায়ের মন, সর্বদা যেন চিন্তিত কিন্তু তাও যেন আমি সোনার খাচায় বন্দিনী এক রাজকন্যে। সেই প্রথম বার বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া। বুকের মাঝে স্বাধীনতার মলয় কিন্তু সেই বাতাসে যেন পরাধীনতার কটু গন্ধ ভেসে আসে মাঝে মাঝে।
রবিবার সকালে তিস্তা আমাকে ফোন করে জানায় যে ও আমাকে নিতে আসবে। আমি ওর কথা শুনে একটু থমকে যাই কেননা ওর সাথে নিশ্চয় তির্থাঙ্কর থাকবে। প্রথম দিনে তির্থাঙ্কর যেরকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাতে আমার মনে ওর প্রতি একটু ঘৃণা ভাব জাগে। মন শক্ত করে নিলাম আমি, দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আমি বাসস্টান্ডে ওদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ কিছু পরে মারুতি চেপে তির্থাঙ্কর আর তিস্তা এসে পৌঁছায়।
আমাকে দেখে তিস্তা আনন্দে দৌড়ে এসে বলে, “তোমাকে সব কিছুতেই মানিয়ে যায়।”
আমি সেদিন একটা খুব সাধারন গোলাপি রঙের চুরিদার পড়েছিলাম। তিস্তা একটা চাপা গাড় নীল রঙের টপ আর হাল্কা নীল রঙের জিন্স পড়েছিল। তিরথাঙ্করের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নারিয়েছিলাম ভদ্রতার খাতিরে। আমাকে দেখে তির্থাঙ্কর ইশারা করে পেছনের সিটে বসতে বলে। আমি আর তিস্তা পেছনের সিটে বসে পরি।
তিস্তা তির্থাঙ্করের মাথায় চাঁটি মেরে বলে, “একদম পেছনের দিকে দেখবে না, বুঝলে, সোজা গাড়ি চালাও।”
তির্থাঙ্কর, “পেছনের সিটে যদি এত সুন্দরী দুই মহিলা বসে থাকে তাহলে কি করে মন দিয়ে গাড়ি চালাই বল?”
আমি জানতাম যে ওর কথার ছোবল আমার দিকে, তাও আমি চুপ করে থাকি। আমি চুপ করে বসে থাকি আর তিস্তা গল্প শুরু করে, একবার বকতে শুরু করলে তিস্তা যেন আর থামতে চায় না।
আমাকে চুপচাপ দেখে তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি হয়েছে বলতো? তুমি এত চুপচাপ কেন?”
আমি মৃদু হেসে বলি, “আমার স্বভাব এইরকম তাই।”
মাথা নাড়ায় তিস্তা, “না না, একদম নয়। সেই পুরানো মিতা যেন নেই, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই মিতা।”
আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “আরে বাবা, জগত পরিবর্তনশীল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝলি না রে।” সবাই আমরা হেসে ফেলি।
গ্লোবে পৌঁছে দেখি দানিস আর দেলিসা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দানিস কে সেই প্রথম বার দেখলাম। অনেক লম্বা চওড়া ছেলে, প্রায় ছ ফুটের মতন লম্বা, ফর্সা আর দারুন দেখতে। হালকা নীল রঙের জিন্স আর গোলাপি চেক শার্টএ দারুন মানিয়ে ছিল ওকে।
দেলিসা আমকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আর বদলাবে না। সেই সাদা মাটা কাপড় কিন্তু কত আভিজাত্য আছে তোমার মধ্যে।”
দানিস কে দেখে আমি হাত জোর করে অভিবাদন জানাই। দানিস সেই দেখে হেসে ফেলে। দানিস যেন অন্য মাটির মানুষ, ওর চোখের চাহনি যেন সব ছেলেদের থেকে অনেক আলাদা। আমাকে দেখে হেসে বলে, “প্রনাম করতে নেই আপা।”
আমি বুঝতে পারিনা ও কি বলে আমাকে ডাকল। দেলিসা আমাকে জানিয়ে দিল যে দিদিকে আপা বলে ডাকে। দানিস আমার কাছে এসে বলে, “আপা, আমার বড় আপা দুবাই থাকে। অনেকদিন তাঁর সাথে দেখা হয়নি। তোমাকে দেখতে ঠিক আমার বড় আপার মতন, তাই তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।”
ওর কথা শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। দেলিসা আমার ঝাপসা চোখ দেখে বলে, “আরে চল, সিনেমা দেখি।”
আমি দেলিসা কে বলি, “হ্যাঁ রে, তোর দানিস ত ভারী হ্যান্ডসাম ছেলে। তোদের দুজনকে যেন ভগবান একসাথে বানিয়েছে।”
ওদের দেখে আমার নিজের ভালোবাসার কথা মনে পরে যায়। মনে পরে যায় আমাদের “সিন্ডলারস লিস্ট” সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা। কিছু পরেই পুশপাঞ্জলি আর সঙ্খ এসে পৌঁছে যায়। কিন্তু আমাদের দলের মাথা, দেবব্রতর দেখা নেই। আমি সিনেমার পোস্টার দেখলাম, গ্লোবে সেদিন স্টালনের “ক্লিফহ্যাঙ্গার” চলছিল।
তিস্তা সঙ্খর সাথে পুস্পাঞ্জলিকে দেখে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “কিরে তুই আর পুশপাঞ্জলি একসাথে, কি ব্যাপার?”
সঙ্খ এমনিতে চুপচাপ থাকার ছেলে, তাই লাজুক হেসে বলে, “নারে, পুশপাঞ্জলি আমার বাড়ির পাসে থাকে তাই আমরা একসাথে এসেছি।”
আমি পুস্পাঞ্জলিকে রজতের কথা জিজ্ঞেস করাতে একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়, “আমি কি করে জানব ওর কথা।”
দেলিসা আমার কানে কানে এসে বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করো না, তেতে আছে মেয়ে। কাল দুজনার মাঝে এক চোট হয়ে গেছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মানে, ওরা কি পস্পরের সাথে…” আমি ওদের ভেতরের খবর জানতাম না যে রজত আর পুশপাঞ্জলির মাঝে প্রেমের খেলা চলছে।
বেশ কিছু পরে লক্ষ করি যে দেবব্রত আর রজত সিগারেট ধরিয়ে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। আমাদের সাথে দানিস আর তিরথাঙ্করকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ দেখি সব জামাইদের মেলা, আমরা তাহলে আর খরচ কেন করব, জামাই রা করুক।” ওর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে, দানিস সবার টিকিট কাটে।
সিনেমা হলে ঢুকে সবাই সিনেমা দেখতে বসে পরে। আমার একদিকে তিস্তা আর তার পাসে তির্থাঙ্কর। আমার অন্য পাসে পুশপাঞ্জলি তাঁর পাশে দেবব্রত, পুশপাঞ্জলি রাগে রজতকে পাশে বসতে দেয়না। সিনেমা শুরু হওয়ার কিছু পরে আমার মনে হল যেন কেউ আমার পিঠে হাত রেখেছে, ঠিক ঘাড়ের খোঁপার নিচে, আঙুল দিয়ে আঁচর কেটে দিচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি তির্থাঙ্করের হাত, রাগে আমার মাথা জ্বলে ওঠে। চোখে জল চলে আসে, মনে হল যেন ওই আঙুল আমাকে ধর্ষণ করছে। কামুক প্রব্রিতির মানুষ, পাসে ওর প্রেমিকা বসে তাও আমার ওপরে ওর নজর। আমি সামনের দিকে ঝুঁকে যাই। পুশপাঞ্জলি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে কেন আমি সামনে ঝুঁকে আমি ওকে কিছু বলি না। কিছু পরে পেছনে ফিরে দেখি সেখানে আর তির্থাঙ্করের হাত নেই, তাই আমি আবার সিটে হেলান দিয়ে বসি। কিছু পরে আবার সেই একি ঘটনা, তির্থাঙ্করের হাত আমার পিঠে এসে পরে। আমি রাগে অপমানে কেঁপে উঠি, কিন্তু আবার কিছু না বলে সামনে ঝুঁকে যাই। এবারে দেবব্রত আমাকে লক্ষ্য করে। দেবব্রত পেছনে দেখে যে আমার সিটের ওপরে তির্থাঙ্করের হাত। চুপচাপ পুশপাঞ্জলির পেছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার সিটের পেছনে হাত রাখে। আমি বুঝতে পারি যে একটা মারামারি লাগবে এবারে কেননা দেবব্রত খুব গরম মাথার ছেলে।
ঠিক সেই, কিছু পরে আবার তিরথাঙ্কর হাত দিতে চেষ্টা করে আমার পিঠে আর এবারে ওর হাত ধরে ফেলে দেবব্রত। সিনেমা হলের মাঝে দেবব্রত তিরথাঙ্করের দিকে গম্ভির গলায় বলে, “ওঠ সিট ছেড়ে, বাইরে আয় তোর সাথে কথা আছে।”
তিস্তার অগোচরে ওর পিঠের পেছনে যে এত কান্ড ঘটে যায় সেটা তিস্তার খেয়াল নেই। আমার দিকে, দেবব্রতর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে তিস্তা। তিস্তা জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
তিরথাঙ্কর অকাঠ মিথ্যে কথা বলে তিস্তা কে, “আরে বাবা, কিছু হয়নি, আমি তোমার পিঠে হাত রাখতে গিয়েছিলাম আর হয়ত মিতার পিঠে হাত লেগে গেছে।”
আমি ওর মিথ্যে কথা শুনে রেগে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরি, “আমি আর সিনেমা দেখব না, আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
দেবব্রত গর্জে ওঠে তিরথাঙ্করের দিকে, “এই শুয়রের বাচ্চা, বেড়িয়ে আয় তারপরে তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
দানিস দেবব্রতর পাশেই বসে ছিল। দেলিসা আর দানিস আমাকে ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে আমি জানাই যে আমার শরীর খারাপ লাগছে তাই আমি বাড়ি যেতে চাই। দেবব্রত রেগে ফেটে পড়েছিল। তিরথাঙ্করের হাত ধরে সিট থেকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “সেই শুয়োরের বাচ্চা, তুই বের হবি হল থেকে না এখানে তোকে মেরে ফেলব।”
তিস্তা হাঁ করে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
আমি তিস্তাকে বলি, “আমি বাড়ি যাচ্ছি রে, শরীর ভালো লাগছে না।”
আমি হল ছেড়ে বেড়িয়ে আসি। দেবব্রত আর রজত আমার পেছন পেছন হল থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু আমি শুধু জানাই যে আমার শরীর ভালো লাগছে না। রাগে অপমানে আমার গাঁ হাত পা কাঁপছিল। চোখে জল এসে গেছিল, আমি ওদের নজর লুকিয়ে চোখের কোল মুছে ফেলি কিন্তু দেবব্রত সেটা লক্ষ্য করে ফেলে। কিছু পরে দেলিসা আর দানিস বেড়িয়ে আসে হল থেকে। দানিস আমাকে সেই এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। দেবব্রত দানিস কে তিরথাঙ্করের আচরনের কথা জানায়, সেই শুনে দানিস রেগে যায়। কিছু পরে তিস্তা পুস্পাঞ্জলিকে সাথে নিয়ে হল থেকে বেড়িয়ে আসে। তিস্তা কে দেখে আমি রাগে ফেটে পরি।
দেবব্রত তিস্তা কে দেখে জোর গলায় বলে ওঠে, “তুই কুত্তা, তোর কুকুরটাকে বেঁধে রাখ না হলে কোন দিন আমার হাতে মারা পড়বে।”
তিস্তা দেবব্রতর কথা শুনে রেগে গিয়ে বলে, “একদম মুখ সামলে কথা বলবি তুই।”
আমি থাকতে না পেরে তিস্তা কে বলি, “ওই জায়গায় তুই থাকলে তোর কেমন লাগত সেটা একবার ভেবে দেখিস।”
তিস্তা বলে, “না না, ও ইচ্ছে করে করেনি, হয়ত হটাত করে হাত লেগে গেছে।”
রাগে আমার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল, আমি ঠোঁট মুছে ওর দিকে রেগে বলি, “তুই ভালো করে জানিস তুই কাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিস।”
তিস্তা আমার হাত ধরে অনুনয় করে, “প্লিস রাগ কোর না। যদি ও কিছু করে থাকে তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে, আমি ওর সাথে কথা বলে নেব এই ব্যাপারে, কিন্তু একটি বার ভেতরে চলো।”
আমার আর সিনেমা দেখার মন ছিল না, আমি ওকে জানাই, “না, আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমার ছোটমা আমাকে বলেছিলেন যে, এই জগতে প্রকৃত বন্ধু পাওয়া দুস্কর, তোদের সাথে মেশার আগে আমাকে ভেবে দেখা উচিত ছিল রে।”
আমরা দুজনে বুঝতে পারি যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরেছে। আমি ওর দিকে ব্যাথা ভরা চাহনি নিয়ে তাকাই।
দেলিসা আমাকে বলে, “ছাড় ওর কথা।”
তিস্তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, “তোর স্বভাবের জন্য একদিন তুই পস্তাবি। তোর স্বভাবের জন্য তোর আশেপাশের বন্ধু বান্ধব তোকে ছেড়ে চলে যাবে একদিন।”
দেলিসার কথা শুনে তিস্তা কেঁদে ফেলে।
দানিস আমার কাছে এসে বলে, “আপা, ওকে ছেড়ে দাও। চল আমার বাড়ি চল, আমার বড়দি, তিন বছর হল বাড়ি আসেনি আম্মি তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে।”
দেলিসাও আমাকে অনুরধ করে ওর শ্বশুর বাড়ি যেতে।

শ্বেত পাথরের মূর্তি (#02)
আমি বললাম যে আমাকে বাবুর অনুমতি নিতে হবে। আমি ফোন করে বাবুকে জানিয়ে দিলাম যে আমার ফিরতে দেরি হবে। বাবু অনুমতি দিয়ে দিলেন কিন্তু প্রত্যকে স্নেহভরা পিতার মতন মেয়েকে সাবধান করে দিলেন যে আমি যেন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসি। মাঝে মাঝে ছোটমা আর বাবুকে বুঝতে আমার বড় কষ্ট হত।
হল থেকে বেড়িয়ে এলাম আমরা। তিস্তা হলের সামনে চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
দেবব্রত দানিস কে ওর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে, দানিস জানায় যে ওর বাড়ি খিদিরপুরে। দেলিসা দেবব্রত কে মজা করে বলে, “তুই আসছিস নাকি আমাদের সাথে? তোকে ত আমরা নেমন্তন্ন করিনি।”
দেবব্রত হেসে উত্তর দেয়, “না রে আমার আজকে আর ভালো লাগছে না, অন্য কোনদিন যাবো।”
আমি দেলিসা আর দানিস ট্যাক্সি চেপে খিদিরপুরের দিকে রওনা দিলাম। যাত্রাপথে আমি দানিসকে জিজ্ঞেস করি যে আমাকে বাড়ি ছেড়ে কে আসবে। দানিস উত্তর দেয় যে ওর দাদার গাড়ি নিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। বিকেল হয়ে এসেছিল। খিদিরপুরে গাড়ি ঢুকে পরে। একটা ছোটো গলির শেষে ওর বাড়ি। বাড়ির দরজা ছোটো, কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি বাড়িটা বেশ বড় আর সুন্দর সাজান।
এক মধ্য বয়সি ভদ্রমহিলা এসে দেলিসাকে দেখে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে। দানিসের মা, নিজের হবু বউমাকে দেখে খুশি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপরে দেলিসাকে জিজ্ঞেস করে আমার কথা।
দেলিসা জানায়, “ও শুচিস্মিতা আমার বান্ধবী, আমার সাথে কলেজে পরে।”
আমি ঝুঁকে পা ছুঁয়ে প্রনাম করি, দানিসের মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “তোমাকে দেখে আমার সায়মার কথা মনে পরে গেল, সায়মা, দানিসের দিদি, দুবাইয়ে থাকে। অনেক দিন মেয়েকে দেখিনি, শুধু ফোনে কথা হয়, মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে।”
দানিসের মা আমাকে হালিম খেতে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম বার আমি ওই রকম কোন মাংস খাই, মাংসের সাথে দাল দিয়ে তৈরি, একটু মিষ্টি একটু ঝাল, খুব ভালো খেতে। এর মাঝে বাবু ফোন করে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরে মনে হল যেন দেরি হয়ে যাবে। আমি দানিস কে অনুরধ করি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। বাড়ি ফেরার আগে দানিসের মা আমাকে একটা রুপোর কয়েন দিয়েছিলেন, সেই কয়েনে আল্লহার নাম লেখা ছিল।
পুরো দিনের ঘটনার জন্য আমার মন খুব বিচলিত ছিল, আমার মনের দন্দ আমার মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাতে খাওয়ার সময়ে ছোটমা আমার মুখ দেখে বুঝতে পেরে যান যে আমার সাথে কিছু অঘটন ঘটে গেছে। ছোটমা বার বার জিজ্ঞেস করেন কিন্তু আমি চুপ করে থাকি। খাওয়ার পরে আমার ঘরে ঢুকে ছোটমা আমাকে বলেন, “তোর সাথে কে কি করেছে?”
আমি ছোটমায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যাই, মায়ের চোখ ফাকি দেওয়া যায় না। আমি কেঁদে ফেলি, ছোটমাকে সব ঘটনা জানিয়ে দেই। ছোটমা আমাকে সাবধান করে বলেন, “দেখ মা, তোকে বার বার বলেছিলাম যে এখানে বন্ধু পাওয়া অনেক মুশকিল, এর পর থেকে সাবধানে চলা ফেরা করিস।”
আমি ছোটমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। ছোটমা আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, “চিন্তা করিস না, এর পর থেকে মানুষের সাথে একটু বুঝে শুনে মেলামেশা করিস যেন।”
দিন যায়, আমার চারপাশের ছোটো ঢেউ আর যেন আমাকে ছুঁতে পারেনা। আমি এক অন্য শুচিস্মিতা হয়ে গেছিলাম। তিস্তার সাথে আমার ব্যাবধান বেড়ে চলে। সাথে সাথে দেলিসা, পুষ্পাঞ্জলি সবাই তিস্তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
সামনে হোলি। ঠিক এক বছর আগে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম যে পরের হোলি তে ওর সাথে রঙ খেলবো, কিন্তু বিধি বাম। আমি চেয়েছিলাম আমাদের প্রথম হোলি খেলা স্মরণীয় হয়ে থাক, কিন্তু সেদিন আমার জীবনে আসে না। প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন আমি সকাল বেলা স্নান সেরে পুজো দিয়ে ছিলাম। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার কোন বন্ধু বান্ধবী আসবে কি না। আমি জানাই যে আমার সেই রকম কোন বন্ধু বান্ধবী নেই যে কিনা আমার সাথে রঙ খেলবে। আমি বাবুর পায়ে ছোটমায়ের পায়ে রঙ মাখিয়ে দেই। ছোটমা আদর করে আমাকে আশীর্বাদ করেন। সারাদিন কাজের ছলে কেটে যায়, আমার জীবনের রঙ যেন সাদা আর কালো, আর যেন কোন রঙ আমার জীবনে ছিল না।
পরের দিন কলেজে গেলাম। সবার গায়ে রঙের দাগ। কলেজের বান্ধবীরা আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমার হোলি খেলিনি? আমি জানায় যে আমার রঙ্গে এলারজি আছে তাই আর হোলি খেলিনি। কলেজ শেষে আমি করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম।
ঠিক সেই সময়ে দেবব্রত এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “সেই প্রথম দিন থেকে তোমাকে লক্ষ করছি, তুমি বাকিদের থেকে অনেক আলাদা। অনেক দিন ভেবেছি তোমাকে তাঁর কারন জিজ্ঞেস করি, কিন্তু প্রতি বার তুমি উত্তর এড়িয়ে চলে যাও।”
আমি ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “কিছু নারে বাবা, রঙ্গে আমার এলারজি তাই আমি হোলি খেলিনা।”
দেবব্রত, “আমি হোলির রঙের কথা জিজ্ঞেস করিনি। সেদিন তুমি চিঠি নিয়ে নিলে তারপরে তুমি কেমন যেন হয়ে গেলে।”
আমি ওকে বলি, “আমি চেষ্টা করছি দেবব্রত, সেই শামুকের খোল ছেড়ে বেড়িয়ে আসার জন্য। কিছু দিন আগে আমার বড় বৌদি মারা গেছেন তাই এই বারে আমার হোলি খেলা হয়নি।”
দেবব্রত শয়তানি হেসে বলে, “আমি তোমাকে সেই শামুকের খোল থেকে যদি বের করে নিয়ে আসি?”
হটাত করে আমার মুখের ওপরে আবির মাখিয়ে দেয় দেবব্রত। আমি রেগে যাই ওর আচরনে। না, আমার গায়ে রঙ মাখানোর এক মাত্র অধিকার ওর, ও ছাড়া আমার জীবনে কেউ রঙ আনতে পারেনা।
আমি জোর গলায় ওকে বকে দিয়েছিলাম, “কি করছিস? আমাকে ছেড়ে দে।”
আমার গালে হাত বুলিয়ে দেয়, সারা গালে মাথায় লাল রঙ। চোখ ফেটে জল চলে আসে আমার। দেবব্রত মজা করে বলে, “মিতা, আজ হোলি, সবাই সবাইকে রঙ লাগায়।”
আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “প্লিস এই রকম আচরন আর কখন আমার সাথে করবি না।”
আমার কাঁপা গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পরে দেবব্রত।
আমার দুচখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার ভেতরে ওই চোখের পেছনে কিছু লুকিয়ে আছে, আমি একদিন সেই মিতার ভেতর থেকে শুচিস্মিতাকে ঠিক বের করে আনব।”
আমি মাথা দোলাই, আমার ভেতরের শুচিস্মিতাকে কেউ বের করে আনতে পারেনা। এই মিতা সেই মিতাই থেকে যাবে যতদিন না ও এসে হাথ ধরে পরীকে টেনে বের করে আনবে। আমি ওকে জিগেছ করেছিলাম, “আমি কি কিছু জিজ্ঞেস করেতে পারি?”
দেবব্রত, “আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি আছি মিতা।”
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা একটা কথা বল আমাকে, তুমি কলেজে থাকতে তিস্তাকে প্রোপস কেন করলে না?”
আমার প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যায় দেবব্রত। আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার মুখে এই প্রশ্ন আশা করিনি, আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্য কিছু জিজ্ঞেস করবে।”
আমি মাথা নাড়াই, আমি জানতাম দেবব্রত আমার মুখ থেকে কি আশা করেছিল। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম যে দেবব্রত আমার প্রতি একটু ঝুঁকে পড়েছে। আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এতই যদি ভালবাসতিস ওকে তাহলে প্রোপস করতে বাঁধা কোথায় ছিল?”
দেবব্রত মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “না সেই সব কথা, অতীত। তিস্তা কোনদিন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারেনি। তিস্তা শুধু দেখেছে আমার বন্ধুত্ত।”
আমি জিজ্ঞেস করি, “তাঁর মানে এখন তোর মনের ভেতরে ওর প্রতি একটু ভালোবাসা বেঁচে আছে তাই ত।”
দেবব্রত, “ছাড়ো ওই সব কথা। সেইসব দিন ত আর আমি ফিরে পাবো না। আমি খোলা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে চলি।”
আমার কাজল কালো দুচখের দিকে অকেন ক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে দেবব্রত। শেষ পর্যন্ত আমার কাছে ওর আচরনের জন্য ক্ষমা চেয়ে মুখ ধুয়ে নিতে বলে। আমি মুখ ধুয়ে নিয়েছিলাম, আমার দেহে ওর রঙ ছাড়া আর কারো রঙ দেবার অধিকার নেই।
বসন্ত শেষে গ্রীষ্ম কাল এসে দাঁড়ায় আমার দোরগোরায়। আমি একা একা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রোজ হেঁটে যাই, সাথে কেউ নাই। তপ্ত বালুচর পায়ের তলায়, মাথার ওপরে একটু ছায়া নেই। ঠিক এক বছর আগে আমি কোলকাতার বাড়িতে এসেছিলাম, ওর বন্ধনের মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম। ছোটমায়ের সাথে সেই যে আসা, সেই দিন আমি ভাবিনি যে কয়েক মাস পরেই আমাদের জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ভেঙ্গে পড়ে যাবে আমাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ।
কলেজ শেষ, আমি একা একা কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গলি দিয়ে হাটি বাড়ি ফেরার জন্য। চারপাসে অসংখ্য বইয়ের দোকান। একা একা হাঁটতে হাঁটতে সেই কথা মনে পরে যায়, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে যে এখানে কত গুলো বইয়ের দোকান আছে। আমাকে উত্যক্ত করার জন্য উত্তর দিয়েছিল, “আট হাজার, ছয়শ বাইস খানা বইয়ের দোকান।”
আমি ওর কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম এমন বোকা মেয়ে। সেই কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেলি আমি।
আনমনে রাস্তা পাড় করতে যাই ঠিক সেই সময়ে কী আমার হাত ধরে টেনে ধরে। আর ঠিক সামনে দিয়ে একটা বাস চলে যায়। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পরি।
দেবব্রত আমাকে জোর গলায় বকে দেয়, “হাঁটার সময়ে মন কোথায়, এখুনি বাসের নিচে পড়তে তুমি।”
আমার সামনে দিয়ে বাস চলে যাওয়ার পরে আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, হয়ত এখুনি বাসের তলায় পরে মারা যেতাম কিন্তু আমার ভাগ্য যে অত ভালো নয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে উত্তর দেই, “আমি অত ভাগ্য করে আসিনি রে।”
আমার বাজু ধরে টেনে ফুটপাথে উঠিয়ে আমাকে বলে, “আজ আমি তোমাকে ছারব না, তোমার সব কথা শুনতে চাই আমি।”
আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কি জানতে চাস তুই? তোর কাছে আমার বলার কিছুই নেই। কেন আমাকে একা ছেড়ে দিতে পারিস না।”
আমার বাজু ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, “আমি কি তোমার কেউ নই, এমন কি একটা ভালো বন্ধুও না?”
আমি ওকে বলেছিলাম, “দেখ দেবব্রত, তুই আমার ভালো বন্ধু, কিন্তু তাও আমি বলছি যে তোকে আমার বলার কিছু নেই।”
আমার দিকে ব্যাথিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। আমি আমার বুকের বেদনা লুকানোর জন্য ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। ফাঁকা বুকে বেজে ওঠে কান্নার সুর, সেই বেদনা বুকে ছাড়িয়ে চোখে চলে আসে, আমি নজর লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলি। গভীর শ্বাস টেনে সেই ফাঁকা বুক ভরে নিতে আপ্রান চেষ্টা করি আমি। আমি দিনে দিনে বুঝতে পারি যে দেবব্রত আমার প্রতি আকৃষ্ট হয় যায়। প্রতিপদে আমার ম্লান ঠোঁটে হাসি ফোটানোর আপ্রান চেষ্টা করে কিন্তু আমার ভাঙ্গা বুকে কারুর জন্য কোন জায়গা নেই। আমি নিজেকে সেই সব হাতছানির থেকে দুরে সরিয়ে রাখি, চারদিকে উঁচু দেওয়াল তুলে নিজেকে ভালোবাসার হাতছানি থেকে দুরে করে নিয়েছিলাম। বুকের মাঝে পুরানো ভালোবাসা ছাড়া কোন নতুন কাউকে আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবতে পারিনা আমি।
মে মাসের একদিন, গরমের ছুটির কয়েক দিন আগের ঘটনা। আমি এক রাতে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে সুপ্রতিমদাকে ফোন করেছিলাম। বুকের মাঝে এক আশা বেঁধে, যদি ও সুপ্রতিমদাকে ফোন করে কিছু জানিয়ে থাকে, সেই ভেবে। রিতিকা আমার ফোনের উত্তর দিয়েছিল।
রিতিকা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি খবর? আমি খবর পেলাম যে তোমার নাকি বিয়ে?”
ওর কথা শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠি আমি, “না, মিথ্যে কথা, বাবু তোমাদের দুরে রাখার জন্য সেই খবর ছড়িয়েছে।”
আমি বুকের মাঝে শক্তি সঞ্চয় করে দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ও কি ফোন করেছিল? কিছু খবর দিয়েছে?”
রিতিকা, “হ্যাঁ কিছু দিন আগেই ফোন করেছিল। এখন ও ইস্রায়েলে।”
আমার বুকের মাঝে যেন হাজার ঘোড়ার দৌরের শব্ধ ছনা যায়, আমার গলা ধরে আসে আমি জিজ্ঞেস করি, “আর কি বলেছে ও?”
আমি ঠোঁট চেপে ধরি, চোখে বুজে থাকি ওর খবর পাওয়ার আশায়।
রিতিকা জানায়, “ও জানিয়েছে যে তোমাকে কিছু করে হোক খবর পাঠাবে। একবার তোমার ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে পারেনি, এবারে ও অন্য কিছু করে তোমার সাথে সম্পর্ক করবে। পরের বার যদি আমাকে ফোন করে তাহলে আমি তোমার ফোন নাম্বার দিয়ে দেব আমি।”
রিতিকার কথা শুনে আমার চোখে জল চলে এসেছিল। আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত জিতে গেল, আমার ওপরে বিশ্বাস হারায়নি তাহলে, বাবুর কথা তাহলে ও বিশ্বাস করেনি।
রিতিকা আমাকে বলে, “পরী কাঁদে না। তোমার বাবুর কথা ও এক বিন্দু বিশ্বাস করেনি। কিন্তু যাওয়ার সময়ে খুব ভারাক্রান্ত মনে দেশ ছেড়ে গেছে। পরী একবার ওর দিক ভেবে দেখ, তোমার বাবু এত বড় দুঃসংবাদ জানালে ও আর কি করতে পারে বলো? ইস্রায়েল থেকে একবার মাত্র ফোন করেছিল অভি, জানিনা আবার কবে ফোন করবে।”
আমি ফোনে চুমু খেয়ে ওকে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রিতিকা।”
ওর কথা আরও জানতে ইচ্ছে করছিল তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা একটা কথা বলতে পার আমাকে, ও এখন কি করে?”
রিতিকা, “ও এখন একটা আইটি কম্পানিতে চাকরি করছে। সেই কম্পানি থেকে ওকে কাজের সুত্রে বাইরে পাঠিয়েছে। খুব খাটতে পারে তোমার অভিমন্যু, অনেক বড় হবে দিনে দিনে।”
রিতিকার কাছে ওর সংবাদ পেয়ে ফাঁকা বুকের মাঝে যেন শীতল হাওয়া বয়ে যায়। মন যেন পেখম তোলা ময়ুরের মতন নেচে ওঠে। আমি চোখ খুলে দেখি যে ও আমার সামনে দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি দৌড়ে ওর কোলে গিয়ে মাথা রেখে শুয়ে পরি।
আমি সুন্দর স্বর্গোদ্যানে একা একা ঘাসের বাগানের মাঝে ঘুরে বেড়াই। আমার চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। আকাশে বাতাসে গোলাপের গন্ধ, পায়ের তলার ঘাস শিশিরে ভেজা। গাছের ডালে ছোটো ছোটো পাখীর অতি মুধুর সঙ্গিত মৃদু মলয় কে মুখরিত করে তোলে। সেই বাগানের মাঝে একটা সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসে। আমার পরনে দুধ সাদা মখমলের পোশাক, মাথায় ফুলের মুকুট, হাথে ফুলের চুড়ি। আমার মাথার লম্বা ঘন কালো চুল বাতাসে ওড়ে। আমার পিঠের পেছনে ঝিল্লি সুতোর বোনা বিশাল রঙ্গিন পাখা। আমি উড়তে চেষ্টা করি, প্রানপন শক্তি দিয়ে পাখা মেলে ধরি। কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে মাটির সাথে টেনে ধরে থাকে। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি যে আমার পায়ে ঘাসের দড়ির বেড়ি বাঁধা। সেই দুধ সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসে। আমি সেই সাদা ঘোড়ার কাছে কাতর মিনতি করে বলি আমাকে ঘাসের বেড়ি থেকে মুক্ত করতে। আমি চেঁচিয়ে উঠে বলি, “সাদা ঘোড়া, আমাকে ছাড়িয়ে দাও, আমি তোমার সাথে উড়ে যেতে চাই।”
চিৎকারে নিজের ঘুম ভেঙ্গে যায়, বুকের মাঝে উত্তাল ঢেউ বয়ে চলে। আমি যে একটা স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম এতক্ষণ। আমি আবার চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের শেষ দেখতে চেষ্টা করি, কিন্তু সেই স্বপ্ন হারিয়ে যায় খোলা চোখের আড়ালে।
ছোটমা আমার চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে আমার দরজা ধক্কা দেয়, “সোনা মা কি হয়েছে?”
আমি হাঁপাচ্ছিলাম, আমি উড়তে পারছিলাম না কিছুতেই। ছোটমায়ের গলার আওয়াজ শুনে যেন বুকে শান্তি ফিরে আসে। আমি দরজা খুলে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, “কিছু না ছোটমা আমি একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ছোটমা আঁচল দিয়ে আমার মুখ, কপাল মুছিয়ে দেন। ঘুম জড়ানো চোখের মাঝেও ছোটমায়ের স্নেহ ভালোবাসা যেন কমে না। আমাকে বলেন, “তোকে কত বার বলেছি দরজা খুলে শুতে।”
সকালের আলো জানালার কাছে এসে যায়।
আমি আবার বিছানায় শুয়ে সকালের সেই স্বপ্নের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। স্বপ্নের মানে বুঝতে পেরে আমার সারা গায়ে ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আমি শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন ঠায় বসে থাকি বিছানার ওপরে, পায়ের কাছে সকালের রোদ খেলা করে। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, মনে হয় যেন ঘাসের দড়ির বেড়ি আমার পায়ে বাঁধা। পরী উড়ে যেতে চায় প্রাণপণে কিন্তু সেই বেড়ির বাঁধনের ফলে সুন্দরী পরী উড়তে পারেনা। স্বপ্নের শেষ দেখতে পারিনি আমি, জানিনা সেই সাদা ঘোড়া তাঁর ভালোবাসার পরীকে বাঁধন মুক্ত করতে পেরেছিল কিনা। আমি কোনদিন হয়ত জানতে পারবোনা, যে সেই স্বরগদ্যানের পরী শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছিল কি না।
বুকের মাঝের ছোটো হৃদয়, গড়িয়ে যায় ঘাসের মাঠের ওপরে, গড়িয়ে চলে নদীর তীরে, গড়িয়ে চলে পাহাড়ের প্রান্তে, ঢালাও প্রান্তে, কখন উঁচু গাছের উপরে উঠে পরে, কখন নদীর অতল তোলে তলিয়ে যায়। গড়িয়ে চলে আমার ছোটো ব্যাথিত হৃদয়, থেমে থাকলে যে হৃদয়ে ভাঙ্গন ধরে যাবে সেই ভয়ে।

সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#01)
সামনে গরমের ছুটি। একদিন রাতে খাওয়ার সময়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “আমি ভাবছিলাম এই গরমের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গেলে ভালো হয়, এই কোন পাহাড়ি জায়গায়। পরী কোথায় যেতে চাস, বল?”
আমি বড় শ্বাস নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি কোন পাহারে ঘুরতে যেতে চাই না।”
বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কেন, তুমি ত পাহাড় ভালোবাসো, হটাত কি হল?”
আমি সত্যি পাহাড় ভালোবাসি, আর সেই পাহাড় ওই আমাকে চিনিয়েছিল। সাথে যদি ভালোবাসার লোক না থাকে তাহলে পুস্প শয্যাও কণ্টকময় হয়ে ওঠে। আমি বাবুকে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি ভাবছিলাম গরমের ছুটিতে মায়ের কাছে যাবো।”
ছোটমা মাথা নেড়ে বলেন, “ঠিক আছে এই বার না হয় তুই গ্রামের বাড়ি যা, কিন্তু পরের বছর আমরা সবাই মিলে কোন পাহাড়ে বেড়াতে যাবো, এই ধর নৈনিতাল বা কৌসানি।”
আমি মনের ব্যাথা লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমাকে কি পরের বছর তোমাদের সাথে যেতেই হবে?”
আমি মজা করে বলি, “তোমাদের বয়স হয়েছে, তোমরা এখন ঘুরতে যাও একা একা।”
বাবু বললেন, “তুমি এখন আমাদের একমাত্র সন্তান, তোমাকে একা ছেড়ে কি করে যাই?”
বাবুর কি গলা ধরে এসেছিল সেই কথা বলার সময়ে, হয়ত হ্যাঁ, ঠিক বুঝতে পারিনি আমি। বাবু, “তুমি যদি আমাদের সাথে না যেতে চাও তাহলে আমরা কোথাও যাবো না।”
ডাইনিং টেবিলের আবহাওয়া কেমন ভারী হয়ে ওঠে ঘুরতে যাওয়ার কথা বার্তা নিয়ে। আমি ওকে ছাড়া পাহাড়ে ঘুরতে যাবার ইচ্ছে নেই, ওদিকে বাবু আর ছোটমা আমাকে ছাড়া ঘুরতে যাবেন না।
আমি শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া সামাল দিয়ে বলি, “ঠিক আছে ছোটমা, পরের বছর আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাবো।”
ছোটমা আমার মুখে হাসি দেখে খুশি হন। আমি ছোটমায়ের কাছে আব্দার করি, “ছোটমা আমার একটা ওয়াকম্যান চাই।”
বাবু আদর করে বললেন, “ওয়াকম্যান কেন সোনা মা, ওয়াকম্যান অনেক ছোটো। তোমার গান শুনতে ইচ্ছে হলে আমি তোমাকে পরের জন্মদিনে একটা হাজার ওয়াটের সোনির একটা বড় মিউসিক সিস্টেম কিনে দেব।”
আমার মনে হয়েছিল যেন বাবু কে জড়িয়ে ধরে টাকে চুমু খাই। বাবু বুঝে যান আমার মনের কথা আর হেসে ছোটমাকে বলেন, “দেখেছ আমার মেয়ে আবার হাসছে।”
দিনে দিনে আমার খুশি যেন বেড়ে চলে, একদিকে ওর কাছ থেকে সংবাদ পাওয়ার আশায় একদিকে ছোটমায়ের কাছে পাওয়া ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য। দিন যায়, কিন্তু ওর কাছ থেকে কোন সংবাদ আসে না। আমি আশা ছেড়ে দেই না, বুকে আশা বেঁধে রেখেছিলাম ও যখন বলেছে তখন একদিন না একদিন কোন সংবাদ নিশ্চয় আসবে।
গরমের ছুটিতে বাবু আমাকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসেন। বাবু বলেন যে অনেকদিন বাবু আমাদের গ্রামের বাড়িতে যায়নি তাই একবার মায়ের সাথে দেখা করতে চান। বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন কিন্তু বাবুর সাথে যেতে হবে শুনে কেমন মনে হয়, কেননা মাঝে মাঝে বেশ ভয় করতাম বাবুকে। সারা রাস্তা গাড়িতে বাবু খুব চুপচাপ ছিলেন। আমি বাবুর গম্ভীর মুখ দেখে অনুধাবন করতে চেষ্টা করি যে মনের মাঝে কি চলছে কিন্তু পেরে উঠিনা।
বিকেল বেলায় আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছাই। মা বাবুকে দেখে অবাক হয়ে যান, সাধারণত আমাকে ছাড়তে ছোটমা আসেন। বাবুকে দেখে মা তৎপর হয়ে ওঠেন কি করে কি করবেন। বাবুর আগমনে বাড়ি যেন মুখর হয়ে ওঠে। মৈথিলী আর মেঘনা বৌদি কি করে বাবু কে অভ্যর্থনা জানাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। আমি ওদের তৎপরতা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম।
আমি মাকে বলেছিলাম, “মা, এত তৎপর হয়ে উঠছ কেন, ইনি আমার বাবু, তুমি যেমন রাখবে সেই রকম থাকবেন।”
মা বলেন, “না তোর বাবু অনেক বড়লোক।”
আমি, “আমি জানি মা।”
মা, “তোর বাবু অনেক দিন পরে আমাদের বাড়ি এসেছেন।”
বাবু মা’কে দেখে বললেন, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
বাবুর কথা শুনে হটাত করে আমার চেহারার রক্ত উবে যায়। আমি বাবুর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করি, “বাবু দয়া করে আমার জীবন নরক বানিয়ে দিও না।”
আমি মায়ের হাত চেপে ধরে কানে কানে জিজ্ঞেস করি, “মা তোমরা কি নিয়ে কথা বলবে?”
মা আমাকে আসস্থ করে বলেন, “চিন্তা করিস না, তোর বাবু তোর ভালর জন্যই এসেছেন।”
মা সুমন্তদা আর শশাঙ্কদা কে ডেকে নিয়ে ঘরে চলে যান।
মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী বাবুকে অরুনয় করে বলে, “কাল সকালেও ত কথা বলা যেতে পারত।”
বাবু বলেন, “না মায়েরা। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, এখানে ত আমি রাত কাটাব না।”
বাবুর কথায় মা একটু আহত হয়ে বলেন, “অর্জুন, ওই কথা বলো না। আমরা কাল সকালেও কথা বলতে পারি।”
বাবু বললেন, “কাল সকালে আমার কিছু কাজ আছে তাই আজ রাতেই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।”
সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন বাবু। আমার বুকের মাঝে ঝড় শুরু হয়ে যায়। বাবু কি শেষ পর্যন্ত আমার বিয়ের কথা বলতে এসেছেন না মাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাতে এসেছেন। আমি আমার ব্যাগ নিয়ে আমার ঘরে চলে যাই। বিছানার ওপরে চুপ করে বসে থাকি, জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
এমন সময়ে মৈথিলী দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, “আমি ভেতরে আসতে পারি?”
অনেক অনেক দিন পরে মৈথিলী আমার সাথে সেই প্রথম কথা বলেছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ওকে ঘরের মধ্যে আসতে বলি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছো?”
মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আমি ভালো আছি, তুমি তোমার খবর বল?”
আমি আমার মনের ভাব লুকিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমার খবর খুব ভালো, কলেজ ভালো চলছে, পড়াশুনা ভালো চলছে।”
মৈথিলী আমার পাসে বসে আমার গালে হাথ দিতে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার কলেজের কথা জিজ্ঞেস করছিনা পরী।”
আমি ওর মুখের দিকে তাকাই। ওর চোখে সেই পুরানো অপমানের প্রতিশোধের ছায়া ছিলনা, সেই চোখে কেমন এক মমতা মাখা ছিল। ওর চোখের চাহনি আমার সব ব্যাথা ভুলিয়ে দিয়েছিল, আমার বুক কেঁপে উঠেছিল আনমনে।
আমি ওকে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করি, “কি জানতে চাও তুমি?”
গালে হাত বুলিয়ে আদর করে মৈথিলী, ওর হাতের ছোঁয়ায় যেন গলে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ও কেমন আছে?”
আমি ওকে উত্তর দিয়েছিলাম, “ভালোই আছে, আজকাল দিল্লীতে চাকরি করছে।”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম বটে, মন জানত যেখানেই থাক, ভালো যেন থাকে। সেই সময়ে আমি মৈথিলীর আচরনে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি, কি চায় ও, সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। মৈথিলী কি আমার সাথে আবার কোন খেলা খেলছে? আমরা দুজনে অনেক গল্প করেছিলাম, প্রায় এক বছর পরে আমরা দুজনে প্রান খুলে কথা বলেছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু আমি নিজের বুকের ব্যাথা ওর সামনে মেলে ধরতে পারিনি ওর সেই পুরাতন আচরনের কথা ভেবে।
কিছু পরে মা আমাকে ডাক দিয়ে বলেন যে বাবু বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আমি নিচে এসে দেখি যে বাবুর খাওয়া শেষ। বাবু আমাকে জানালেন যে গরমের ছুটির পরে ছোটমা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি বাবুকে পায় হাথ দিয়ে প্রনাম করি।
আমি বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি মাকে কি বলেছ?”
বাবু আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, “যা কিছু বলেছি, সেটা তোমার ভালোর জন্যে বলেছি। তোমার মা তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলে দেবে, চিন্তা করোনা।”
রাতের খাওয়ার পরে মা পান নিয়ে বসেছিলেন, আমি মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মা বাবু কি বলে গেলেন?”
মা পান মুখে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোর বাবু তোকে খুব স্নেহ করেন তাই না?”
আমি মাথা নাড়াই, “হ্যাঁ তা করেন।”
মা, “অর্জুন জানতে চেয়েছিলেন যে আমাদের বাড়ির ভাগ করা হয়েছে কি না, আর সেই ভাগের মধ্যে তোর কোন ভাগ আছে কি না।”
মায়ের কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে যায় প্রথমে, বাবু কি চান, বাবু ত আমার বাবা নন যে আমাদের বাড়ির ভাগে আমার অংশ আছে কি না জানতে চাইবেন। আমি মনের রাগ লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বাড়ির অংশ নিয়ে বাবু কি করবেন?”
মা বলেন, “অর্জুন জানাতে এসেছিলেন যে, তোর অংশ বিক্রি করে সব টাকা তোর নামে ফিক্সড ডিপসিট করে দিতে চান, যাতে ভবিষ্যতে তোর পড়াশুনা বা বিয়ের পরে তোর কাজে লেগে যায়। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অর্জুন এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবেছেন।”
আমার বুকের ওপরে থেকে যেন একটা বিশাল পাথর সরে যায়। মাঝে মাঝে ছোটমা আর বাবুকে বুঝতে বড় কষ্ট হয় আমার, সত্যি কি দিয়ে তৈরি এই দুজন মানুষ, হয়ত সব বাবা মা তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ঠিক এই রকম চিন্তা করে থাকেন, কিন্তু…?
আমি আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমার ঘরে ঢুকে পরে। আমার দিকে একটু অভিমান ভরে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর গালে আদর করি। আমার ওপরে যেন ওর অভিমান কমেনা, আমাকে জিজ্ঞেস করে, “অভি কাকু কেন আসেনি?”
আমি ওর চুলে বিলি কেটে উত্তর দিয়েছিলাম, “ও বাঃবা, সেই জন্য এত রাগ।”
দুষ্টু, “হ্যাঁ আমি তোমার ওপরে রেগে আছি। আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”
আমি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলাম, “এত রাগতে নেই। আমিও ভালো ভালো রাজা রানীর গল্প জানি।”
দুষ্টু শিশুসুলভ গলায় আমাকে বলে, “রাজা রানীর গল্প আমি জানি, আমি নতুন গল্প শুনতে চাই।”
আমি নিজের মনকে শান্তনা দিয়েছিলাম, আমিও যে নতুন গল্প শুনতে চাই দুষ্টু। আমি কি করে তোর অভি কাকুকে তোর কাছে নিয়ে আসি বলত, আমি নিজেই যে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
পরদিন সকালে আমি কল্যাণীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমি কল্যাণীর কাছে সেই “অপটিক্স নোটবুক” ফিরে চেয়েছিলাম। কল্যাণী আমাকে দেখে অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কবে এলি বাড়িতে? তোকে দেখে অনেক আলাদা লাগছে এবারে, কি ব্যাপার অভিমন্যুর খবর পেয়েছিস নাকি?”
আমি খুশিতে নেচে উঠেছিলাম প্রায় আমি কি বলে ওকে আমার মনের ভাব বুঝাব সেটা ভেবে পাইনা। আমি সংবাদ পেয়েছিলাম যে ও আমার সাথে কোন ভাবে সম্পর্ক করবে। আমি ওর হাত দুটি ধরে একটু নেচে উঠে বলি, “আমি রিতিকাকে ফোন করেছিলাম। ও রিতিকাকে ফোন করে জানিয়েছে যে বাবুর কথা এক বিন্দুও বিশ্বাস করেনি। ও আমার সাথে কিছু করে হোক সম্পর্ক করবে। আমি খুব খুশি জানিস আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে। ও যে আমার ওপরে বিশ্বাস হারায়নি সেটা যেনে আমি খুব আনন্দিত কল্যাণী।”
কল্যাণী আমার কথা শুনে খুব আনন্দিত হয়েছিল। ওর চোখ দুটি চকচক করে উঠেছিল।
কল্যাণী, “হ্যাঁরে শয়তান মেয়ে, তুই খুব ইমসানাল। সত্যি তোর জীবন দেখে মনে হয় যেন এক বিশাল ঘূর্ণিবার্তা।”
আমি ওর হাথ থেকে “অপটিক্স নোটবুক” নিয়ে বুকের ওপরে চেপে ধরেছিলাম। মনে মনে ওই পাতার প্রত্যেক অক্ষর বুকের রক্তের সাথে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমি। কল্যাণী আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই এই ডায়রি নিয়ে কি করবি?”
আমি ওকে জানাই, “আজ থেকে আমি এই ডায়রি লিখব, আমার কথা লিখব।”
সেইরাত থেকে আমি আমার কথা লেখা শুরু করি। ও ইংরাজিতে ভালো, আমি বাংলায় আমার মনের কথা লিখতাম। ও চলে জোয়ার পরে আমার দিন দমদমের বাড়িতে কেমন কেটেছে সেই সব লিখতাম। কেমন আমার কলেজের দিন কেটেছে সেইসব স্মৃতি লিখেছিলাম আমি। সারা রাত জেগে আমি গত এক বছরের সব স্মৃতি লিখে ফেলি আমি। প্রত্যেক বাক্যের পরে আমি নিজেকে বলেছিলাম যে যখন আমাদের বয়স হবে তখন আমরা দুজনে মিলে এই ডায়রির পাতা একসাথে বসে পড়ব। লিখতে লিখতে আমি আমার টেবিলের অপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে দরজায় একটা টোকা শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি চোখ খুলে দেখি যে আমি টেবিলে শুয়ে। তাড়াতাড়ি করে ডায়রি আমি লুকিয়ে ফেলেছিলাম। আমি চাইনি কেউ আমার মনের কথা জেনে ফেলুক আর আমাদের ভালোবাসার মাঝে এক নতুন বাঁধা হয়ে আসুক।
পার্বতী বৌদি চলে যাবার পরে সুমন্তদা একদম অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। খুব কম কথা বলতেন দাদা। দাদার কোন সন্তান ছিল না তাই ছোটবেলা থেকে দাদার সব ভালোবাসা দুষ্টুর ওপরে কেন্দ্রীভূত ছিল। প্রত্যেক দিন বিকেলে মাঠের থেকে ফেরার সময়ে সুমন্তদা দুষ্টুর জন্য ফল নাহয় মিষ্টি নিয়ে ফিরতেন। মাঝে মাঝে কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে আসতেন মাঠের দিকে।
একরাতে আমি আমার ঘরে বসে কলেজের পড়াশুনা করতে ব্যাস্ত ছিলাম সেই সময়ে দাদা আমার ঘরে এসে ঢোকেন। দাদার হাতে একটা কাঠের বাক্স। আমি সেই বাক্স চিনতে পেরে যাই, বড় বউদির গয়নার বাক্স।
আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এটা কি?”
দাদা আমকে বলেন, “তোর বৌদি এটা তোকে দিতে বলেছিলেন।”
আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রাখে দাদা, চোখের কোলে জল এসে গিয়েছিল দাদার, নজর লুকিয়ে জল মুছে আমার হাথে ওই বাক্স ধরিয়ে দেন।
আমি অনাকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি খুব ক্লান্ত দাদা, তুমি এখন কি করবে?”
দাদা মাথার ওপরে ঘুরন্ত পাখার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলেন, “জানিনা এখন তবে একটা কিছু ভেবে রেখেছি, তোর বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছি তারপরে দেখি কি করি।”
আমি দাঁতে পেন ধরে দাদার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি যে দাদা কি করবেন, বাঁ কি ভেবে রেখেছেন নিজের জন্য।
দিন যায়, প্রায় প্রত্যেক দিন মা আমাকে ওর কথা জিজ্ঞেস করে। একদিন আমি আর থাকতে না পেরে মাকে জিজ্ঞেস করি মা এত কেন বিচলিত ওকে নিয়ে। মা উত্তর দিয়েছিলেন, “কেন আমি ওর জন্য চিন্তা করতে পারি না? আমার নাতি হয়। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছিনা, যত বার আমি ওর কথা তোকে জিজ্ঞেস করি ততবার তুই আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাস, কেন বলত? সত্যি করে বল, অভি কোথায় আছে?”
আমি মায়ের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “ও এখন দিল্লীতে চাকরি করে।”
আমি খুব বিরক্ত বোধ করতাম যখন কেউ আমাকে বারে বারে ওর কথা জিজ্ঞেস করত। আমি কি করে জানব আমার ভালোবাসা কোথায়, আমি নিজেই ওকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াই আমার চারপাশে।
মা আমকে বললেন, “অনেক দিন ছেলেটার গলার আওয়াজ শুনিনি, মন কেমন করে ওঠে আমার। একবার ফোন করে দেখ না ওকে, আমি একটু কথা বলব?”
আমি ধন্ধে পরে গিয়েছিলাম, কি বলব মাকে, ধিরে ধিরে মায়ের দিকে জল ভরা চোখে তাকাই। মায়ের তীক্ষ্ণ নজর আমার হৃদয় ভেদ করে দেয়। আমি মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে উত্তর দিয়েছিলাম, “আসলে, মা, ও এখন দেশের বাইরে।”
আমার বিচলিত চোখমুখ দেখে মা আমার গালে হাত দিয়ে বলেন, “তুই সত্যি বলছিস না আমার কাছে কিছু লুকিয়ে রাখছিস।”
আমি প্রায় কেঁদে ফেলি, কিন্তু মন শক্ত করে নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “না মা, আমি সত্যি কথা বলছি। পরের বার আমাকে যখন ফোন করবে আমি ওকে জানিয়ে দেব তোমাকে ফোন করতে।”
আমি সেইদিন জানতাম না, যে আদৌ ও আমার সাথে আর কোনদিন কথা বলবে কি না। আমি জানতাম না কি করে আমার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চলেছে। আমার সব থেকে বড় ভয় মায়ের প্রতিক্রিয়া কি হবে যখন মা জানতে পারবেন আমাদের ভালোবাসার সংবাদ, আমার মা কি আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না ছোটমায়ের মতন আমার ভালোবাসা প্রত্যাখান করে দুরে সরিয়ে দেবেন। এই সময়ে ও যদি আমার কাছে থাকত, তাহলে নিশ্চয় কিছু না কিছু উপায় ভেবে আমাকে সাহায্য করত, কিন্তু বিধি যে বাম, ও যখন আমার পাশে নেই তখন আমাকেই ওর মতন ভেবে কাজ করতে হবে। আমার প্রশ্ন একটু ঘুরিয়ে করতে হবে যাতে আমি মায়ের মনের ভাব বুঝতে পারি। বুকের মাঝে দুকদুক করতে শুরু করে, আমি মাকে জড়িয়ে ধরি দুহাতে।
মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কিরে তুই কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাস?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম, “হ্যাঁ মা।”
মা আমার মুখের পানে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তোর বাবুর সাথে অভিমন্যুর কি কোন কথা কাটাকাটি হয়েছে?”
মায়ের মুখে সেই প্রশ্ন শুনে আমি থমকে যাই, সত্যি তাহলে কি বাবু মাকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছে?
বুকের মাঝে হৃদপিণ্ড যেন থমকে দাঁড়িয়ে পরে, আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, “এই রকম প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করছ?”
মা, “অর্জুন কে আমি অভিমন্যুর কথা জিজ্ঞেস করাতে, তোর বাবু আমাকে ঠিক করে উত্তর দিল না। শুধু মাত্র আমাকে বলে যে অভি দিল্লীতে চাকরি করতে গেছে।”
আমি শ্বাস রুদ্ধ করে মায়ের কথা শুনি, কান লাল হয়ে ওঠে আমার। মনের উত্তাল তরঙ্গ কোন রকমে চেপে আমি মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেই, “না মা, বাবুর সাথে ওর কোন ঝগড়া হয়নি। গ্রাজুয়েশানের পরে দিল্লীতে চাকরি খুঁজতে চলে গেছে।”
মুখে পান নিয়ে মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কিন্তু কোলকাতায় চাকরি করতে পারত, দিল্লী কেন যেতে গেল?”
আমি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “ওসব তুমি বুঝবে না মা। কোলকাতায় কোন আইটি কম্পানি নেই তাই দিল্লী গেছে চাকরি খুঁজতে।”
আমার গালে হাত বুলিয়ে মা জিজ্ঞেস করেন, “তুই আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবি বলছিলি?”
আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, আমি এমনি মাকে জিজ্ঞেস করি, “মা ও তোমাকে শেষের দিনে কি বলে গেছিল?”
মা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “সে কথা তুই জেনে কি করবি?”
আমি মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম, বুকের মাঝে ধুকধুক করে ওঠে প্রবল ভাবে। মা আমার চিবুকে হাত রেখে মাথা উঁচু করে ধরেন নিজের দিকে, আমি নিজের চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম, চোখের পাতা জলে ভিজে গিয়েছিল। মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “সত্যি করে বলত আমায়, অভি শুধু মাত্র চাকরির খোঁজে দিল্লী চলে যায়নি তাই তো।”

সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#02)
বুকের মাঝে সযত্নে লুকিয়ে রাখা বাঁধ ভেঙ্গে যায়, বুক কাঁপিয়ে কান্না বেড়িয়ে আসে চোখের কোল থেকে। মায়ের চোখের আড়াল করে কোন সন্তান তাঁর দুঃখ লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমি ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আমার বুকের বেদনা ধরে রাখতে পারিনা আমি। আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম মায়ের মতামত জানার জন্য। মা আমার মাথায় হাত স্পর্শ করেন আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমার বুকের কান্না মায়ের কাছে আমার ব্যাথার কাহিনী ব্যক্ত করে দেয়। মা চুপ করে থাকেন, আমি কাঁদতে থাকি। মা আমাকে সেইরাতে নিজের কাছে শুতে বলেন। আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরি।
মা আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেন, “জগতের অনেক কিছু আছে যে গুলো মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমি সর্বদা তোর হাসি মুখ দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই খুশি যে এইরকম ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের সমাজে অনেক নিয়ম কানুন আছে, তাঁর মধ্যে অনেক কিছু আছে যে গুলো সমাজ মেনে নিতে পারেনা।”
আমি কেঁদে জিজ্ঞেস করি, “আমি কি করব মা?”
মা, “সময়ের ওপরে ছেড়ে দে, পরী। সময় বড় বলবান।”
আমি ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, “কেন মা কেন? আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যা এসেছে তাই আমি মুখ বুজে মেনে নিয়েছি, আমি তোমাকে বা দিদিদের কোনদিন প্রশ্ন করিনি যে কেন তোমরা আমাকে ঠিক ভাবে দেখনি।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে মা উত্তর দেন, “পরী, আমাকে কিছু সময় দে ভাবার জন্য। এখুনি আমার মাথায় কিছু কাজ করছে না, আমার কিছু সময় চাই।”
আমি প্রায় বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, “না মা, আমি এখুনি জানতে চাই যে আমি এখন কি করব?”
মা আমাকে শান্ত করে পাশে শুয়ে পড়েন। বিছানার একপাসে আমি, অন্য পাশে মা। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মায়ের কাছেও আমাদের সম্পর্কের কথা আর লুকিয়ে থাকে না। আমি ভেবে কুলকিনারা পাইনা যে মায়ের উত্তর কি হবে, মা কি মেনে নেবেন আমাদের সম্পর্ক না মা ছোটমায়ের মতন এবারে আমাকে বহিস্কার করে দেবেন। সারা রাত মা ঘুমাতে পারেন না, সারা রাত দুজনে ঘুমানোর ভান করে নিজের নিজের চিন্তায় ডুবে ছিলাম।
সকাল বেলার রোদ পুব আকাশে উঁকি মারে। মা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তুই সারা রাত ঘুমোস নি।”
আমি শান্ত গলায় বলি, “কি করে ঘুম আসে, মা।”
মা বিছানায় উঠে আমার দিকে ফিরে বললেন, “আমার মনে হয়, তোর ছোটমা আর বাবু এই ঘটনায় খুব মর্মাহত হয়েছেন। তারা দুজনেই অনেক রেগে আছেন এখন।”
দুরে আম গাছের বাগানের পেছন থেকে নবীন ঊষার আলো উঁকি দিচ্ছে। মা বললেন, “আগে তোর এমএসসি শেষ হোক, অভিমন্যু তোর সাথে যোগাযোগ করুক। আমাকেও কিছু সময় দে আর তোর ছোটমা আর বাবুকেও কিছু সময় দে। সময় যে বড় বলবান, সব ঘায়ের মলম সময়। সময়ের সাথে সাথে সবার রক্ত, সবার রাগ কমে আসবে। তুই ও বুঝতে পারবি তোরা কি করেছিস, তোর ছোটমাও বুঝতে পারবে ধিরে ধিরে। তোর ছোটমা, তাঁর একমাত্র ছেলেকে এই পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছে, তাঁর বুকের বেদনা একটু বুঝতে চেষ্টা করে দেখ, তুই যাতে বড় হতে পারিস সেই জন্য তোর ছোটমা এই সব করেছে। সঠিক সময়ে সব কিছু সঠিক হবে।”
আমি শান্ত গলায় উত্তর দেই, “ছোটমা আর বাবু আমাকে খুব ভালবাসে আর সেই কথা আমি মনে প্রানে জানি। কিন্তু আমার মন রাখার জন্য ছোটমা কোনদিন নিজের আত্মসন্মান বলিদান দেবেন না।”
বুকের মাঝে ধরে রাখা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা আমাকে বলেন, “পরী, সময়ের চেয়ে বলবান কোন ওষুধ আজ পর্যন্ত জগতে নেই। সময় সব ব্যাথা বেদনার মলম, সেটা মনের হোক বা শরীরের হোক। আমাকে কথা দে, যে তোর এমএসসি শেষ হওয়া পর্যন্ত তুই এই নিয়ে কারুর সাথে কোন কথা বলবি না। আমরা আমাদের ভবিতব্য বদলাতে পারিনা পরী, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তোর এমএসসি শেষ হোক আগে, অভি দেশে ফিরে আসুক। অভিকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস, তারপরে আমি দেখি কি করতে পারি।”
আমি মাকে দুহাতে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমার মা আমাদের ভালবসার প্রতি বিরূপ না হয়ে মেনে নেন, সেটাই আমার সব থেকে বড় সম্বল ছিল। মা আর আমি দুজনেই কেঁদে ফেলেছিলাম। মা আমাকে বললেন, “আমার সেদিন বুঝে নেওয়া উচিত ছিলরে, ওইদিন পুজোর ঘরে আমার কাছে আমার খেলার পুতুল চেয়েছিল।”
আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে হেসে বলেন, “এবারে খুশি? এবারে হাস, আর কথা দে পরশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই কথা আর মুখে আনবি না।”
আমি সেদিনের পর থেকে অনেক খুশি, আমার মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেন। মনের মধ্যে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়, আমি যেন সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। চোখের দুষ্টুমি ফিরে আসে, গালের লালিমা ফিরে আসে, একবার মনে হয় যেন সেই পুরানো পরী ফিরে এসেছে আমার মধ্যে। বুকের মাঝের সেই অনন্ত কালো শূন্যতা যেন ভরে যায় মায়ের কথায়।
একদিন আমি বাড়ির পেছনের বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে জাছচিলাম মাথের দিকে। গ্রীষ্ম কালের পড়ন্ত রোদ পশ্চিম আকাশে, আমের বাগানে মাএর গন্ধে মম মম করছে, কাঁঠাল গুলো গাছের গুঁড়ির সাথে ঝুলে আছে, লিচু গাছে লাল লাল লিচু ভর্তি। ফলের গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা তার সাথে আমার মনের আমেজ মাতোয়ারা। আমি পুকুর পাড়ের সেই ওর পোঁতা আমের গাছের দিকে হেঁটে গিয়েছিলাম। সেই আম গাছের গুঁড়ি ছুঁতেই এক দমকা হাওয়া এসে আমার মুখে লাগে, আমার যেন মনে হয় ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার গালে হাত রেখে। আমি আম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি, কাঁচা পাকা আমে ভর্তি সেই আমের গাছ।
আমি গাছ খানা জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বলেছিলাম, “তোর মনের মানুষ তোর জন্য আসছে একটু সবুর কর।”
আমার হৃদয় সপ্তম আসমানে ছিল, মা আমার ভালোবাসার প্রতি বিরূপ হননি। কিন্তু মায়ের সাবধান বানী আমার কানে বাজে, এমএসসি শেষ করার আগে যেন আমি আমার মনের ভাব কাউকে খুলে না জানাই। আমি সেই মিলন বেলার অধির প্রতীক্ষা করেছিলাম। মৈথিলী বুঝতে পারে আমার গালের লালিমা ফিরে এসেছে।
একদিন বিকেলে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আম খাচ্ছিলাম, এমন সময়ে মৈথিলী এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমার দিকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “খুব খুশি মনে হচ্ছে?”
আমি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করি, “কেন, আনন্দে থাকা কি পাপ, আমি আমার বাড়িতে অনেক দিন পড়ে এসেছি তাই আমি খুশি।”
মৈথিলী, “হুম, মনে হচ্ছে অভিমন্যুর খবর এসেছে, তাই না।”
আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম সেদিন, “হ্যাঁ, এসেছে।”
মৈথিলী, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি কি?”
অনেক দিন ধরেই আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই প্রশ্নের, আমি মাথা নাড়াই, “জিজ্ঞেস করো।”
মাথা নিচু করে, পায়ের নখে ছাদের মেঝে খুঁটতে খুঁটতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ওকে একবার জিজ্ঞেস করত ও কি চায় আমাদের কাছ থেকে?”
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “কেন, তুমি ভালো করে জানো ও কি চায় আবার সেই প্রশ্ন কেন? যাই হোক, এখন ও দেশের বাইরে, যখন আমাকে ফোন করবে আমি জিজ্ঞেস করে নেব।”
মাথা নাড়ায় মৈথিলী, “ঠিক আছে।”
আমি ওকে আশস্ত করে বলি, “পরের বার ফোন করলে আমি বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়ে দেব, তুমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলে নিও।”
আমার বুকের মাঝে এক নতুন সাহস জেগে ওঠে, আমি যেন সেইসময়ে অপরাজিতা ছিলাম।
এক রাতে আমি বিছানায় শুতে যাবো, এমন সময়ে দুষ্টু এসে বায়না ধরে পিসি একটা গল্প বলো। বেশির ভাগ দিন আমি ওকে ডায়রিতে লেখা ওর কবিতা গুলি দুষ্টুকে পড়ে শুনাতাম, অনেক কবিতার কোন মাথা মুন্ডু থাকত না, পড়তে পড়তে দুজনেই হেসে ফেলতাম। দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করত, যে এই সব গালগল্প কে লিখেছে। আমি ওকে বলতাম যে ওর অভি কাকু যখন ছোটো ছিল তখন এই সব গালগল্প লিখত।
দিন কেটে যায়, গরমের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসে। এর মাঝে ছোটমা ফোন করে জানায় যে ছুটির শেষে আমাকে নিতে আসবে। ছোটমায়ের কথা শুনে একটু মন খারাপ হয়ে যায়, আবার মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “মা এবারে আমার সাথে ওই বাড়ি চলো।”
মা আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোর কাছে তোর ছোটমা আছে কিন্তু সুমন্তর এই জগতে আর কেউ নেই, আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে রে, তাই আমি কোথাও যেতে পারিনা।”
দমদমের বাড়িতে ফিরে যাবার ঠিক একদিন আগের রাতে, দুষ্টু আমার কাছে এসে গল্প শোনার বায়না ধরে। আমাকে আদর আর অভিমান করে জিজ্ঞেস করে, “পরের পুজোতে অভি কাকুকে বাড়িতে আসতে বলবে।”
আমি ওর দিকে মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক আছে বলে দেব, কিন্তু একটা সর্তে।”
আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দুষ্টু। আমি ওকে বলি, “তুই আমাকে তোর অভির কাকুর শুনান গল্পটা যদি বলিস তাহলে।”
আমার গালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে শয়তান ছেলে আমাকে বলে, “ও ওই গল্পটা, সে গল্পত আমি ভুলে গেছি।”
আমি ওর দিকে মৃদু অভিমান করে তাকিয়ে বলি, “তাহলে তোর অভি কাকুকে সঙ্গে নিয়ে আসছি না।”
এই বলে আমি ওকে কাতুকুতু দিতে শুরু করি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে দুষ্টু, শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই গল্প বলে। আমার বাম হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে গল্প শুরু করে।
“অনেক অনেক দিন আগের কথা, এক দূর দেশে এক পরীর দেশের রানী থাকতেন। তাঁর কুঠিরের চারপাশ অনেক উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা আর একপাসে অনন্ত ঘাসের মাঠ। পরীরানীর কুঠিরের পেছনে একটা ছোট্ট জলাশয় ছিল, সেই জলাশয়ে পদ্ম শালুক আরও অনেক জলের ফুল ফুটে থাকতো। কুঠিরের সামনের ফুলের বাগানে অনেক রঙ বেরঙের ফুল ফুটে থাকে, সেই ফুলের মধু খেতে রোজ নানান রঙের পাখিরা উড়ে আসত আর তাঁর সাথে নিয়ে আসত মৌমাছি আর ভ্রমর। একদিন সেই জলাশয়ে পরী রানী লক্ষ্য করেন যে একটা ছোট্ট পদ্মের কুঁড়ি ফুটে আছে। বেশ কিছু দিন যায়, সেই পদ্মের কুঁড়ি আর ফুলে পরিনত হয় না। অনেক ভেবে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি নিজের কুঠিরে নিয়ে আসেন আর একটা কাঁচের গামলায় জল দিয়ে রেখে দেন। রোজ সকালে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ির ওপরে শিশিরের জল, মিষ্টি মধু আর দুধ ঢেলে দিতেন যাতে সেই কুঁড়ি একদিন ফুলে পরিনত হয়ে উঠতে পারে।”
“এইভাবে দিন কেটে যায়। একদিন সকাল বেলা পরী রানী ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে কাঁচের গামলায় সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি আর নেই, সেই জায়গায় একটা ছোট্ট মিষ্টি পরী শুয়ে সকালের মিষ্টি রোদের সাথে খেলা করছে। ত্বকের রঙ দুধে আলতা, মাথায় ঘন কালো চুল। পিঠের ওপরে ছোটো ছোটো দুটি রঙ বেরঙের পাখনা। ছোট্ট দশ আঙুল দিয়ে সেই ছোট্ট পরী কাঁচের গামলা আঁচরে দেয়, বার বার সেই কাঁচের গামলা ছেড়ে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। ছোট্ট দুটি নীল চোখে আসে পাশের নতুন পৃথিবী দেখে জুলু জুলু করে। পরী রানী আনন্দে কেঁদে ফেলে। তাঁর সযত্নে রাখা পদ্মের কুঁড়ি একটা ছোট্ট পরী হয়ে গেছে। পরী রানী সেই ছোট্ট পরীকে কাঁচের গামলা থেকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরী রানী রোজ দিন সেই ছোট্ট পরীকে মধু আর শিশিরের জল খেতে দিতেন, তার সাথে দিতেন নানান মিষ্টি ফল।”
“দিনে দিনে সেই ছোট্ট পরী বড় হয়ে এক সুন্দরী পরী হয়ে যায়। সেই সুন্দরী পরীর ডানা অনেক বড় আর প্রচুর রঙ্গে মাখা। ঝলমলে ডানা যেন সাত রঙের রামধনু নিয়ে আসে সেই কুঠিরে। কিন্তু পরীর ডানা বড় হলেও ওর উড়ে যাওয়ার মতন শক্তি ছিলনা। পরী রানী পরীকে উড়তে শেখায় না কোনদিন। পরী রানী চাইতেন না, যে পরী তাকে ছেড়ে চলে যাক। সেই সুন্দরী পরী কুঠিরের সামনের মাঠে খেলা করত সূর্যের আলোয় স্নান করত। সামনের ফুলের বাগানে ফুলের দেখাশুনা করত। রোজ সকালে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরের জল নিয়ে খেত আর বাগানের মিষ্টি ফল খেত। মৌমাছিরা ওই পরীর জন্য দূর দুরান্ত থেকে মধু যোগাড় করে নিয়ে আসত। দিনে দিনে সেই সুন্দরী পরীর মাথার ঘন কালো চুল কাঁধ ছাড়িয়ে মাটিতে নেমে আসে। বাগানের ফুল গেঁথে পরী নিজের গলার মালা আর হাতের বাজু বানিয়ে নিজেকে সাজিয়ে রাখত।”
“একরাতে পরী রানী কোন এক কাজে কুঠির ছেড়ে বাইরে চাঁদের আলোয় ঘুরতে গিয়েছিলেন। সুন্দরী পরী, কুঠিরে একা, রাতে ঘুম আসেনা দুই কাজল কালো চোখে। জানালার ধারে বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল পরী। ঘন নীল আকাশের বুকে শত সহস্র তারা উঁকি মেরে ওকে যেন ডাক দেয়। এমন সময়ে কোন আওয়াজ শুনে সুন্দরী পরীর ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আসেপাসে তাকিয়ে দেখে কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পায়না। চুপিচুপি দরজা খুলে বাইরে তাকায় পরী, দরজার সামনে একটা অতি সুন্দর শ্বেত শুভ্র ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ঘোড়া দেখে অবাক হয়ে যায় সুন্দরী পরী, ভেবে পায়না কি করা উচিত। সুন্দরী পরী সেই ঘোড়ার কাছে এসে ওর ঘাড়ে হাত রেখে আদর করে দেয়। ঘোড়া ওকে দেখে চিঁহি করে ডাক ছাড়ে, ডাক শুনে ভয় পেয়ে যায় পরী, পেছনে সরে আসে। কিন্তু সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া সুন্দরী পরীর গালে নিজের ঘাড় ঘষে আসস্থ করে যে ওর কোন ভয় নেই। সুন্দরী পরী ঘোড়াটাকে কুঠিরের ভেতরে নিয়ে আসে। ঘোড়ার দিকে দীর্ঘকাল ধরে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুন্দরী পরী। একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।”
“সকাল বেলার প্রথম সূর্যের আলো সুন্দরী পরীর পায়ের কাছে এসে লুটপুটি খায়, পায়ে নতুন ঊষার আলোর উষ্ণতা পেয়ে জেগে ওঠে সুন্দরী পরী। কাজল কালো চোখ মেলে দেখে একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে ওর কাছে আর সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া কুঠিরের ভেতরে নেই। সেই সুদর্শন যুবক কে দেখে ভয় পেয়ে যায় পরী, ভয়ে চিৎকার করতে চেষ্টা করে, ঠিক সেই সময়ে সেই যুবক পরীর ঠোঁট চেপে ধরে চিৎকার করতে বারন করে। ভয়ে জড়সড় হয়ে কুঠিরের এক কোনে বসে থাকে পরী, ভেবে পায়না, কি করে সেই ঘোড়া উধাও হয়ে গেল আর তার জায়গায় এই সুদর্শন যুবক কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করল।”
“সেই সুদর্শন যুবক পরীকে জানায় যে ও একটা তস্কর, পরী রানীর কুঠিরে পরী রানীর জাদুর পুতুল চুরি করার জন্য এসেছিল। কিন্তু জানালা দিয়ে সুন্দরী পরীকে দেখে সেই জাদু পুতুলের কথা ভুলে যায়। রুপ বদলে এক শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। সুন্দরী পরী ওই সুদর্শন যুবকের কথা মন দিয়ে শোনে। সুদর্শন যুবক সুন্দরী পরীকে জিজ্ঞেস করে যে পরী উড়তে চায় কিনা। উড়ে ওই উঁচু গাছের জঙ্গল পেরিয়ে দূর দেশে পারি দিতে চায় কিনা, শুনতে চায় কি ভাবে নদী নিজের খেয়ালে গান করে আর নেচে নেচে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলে? সুন্দরী পরী সেই সুদর্শন যুবকের গুরু গম্ভির গলার স্বর শুনে মোহিত হয়ে যায়। পরী মৃদু মাথা নাড়িয়ে নিজের ইচ্ছে প্রকট করে, উড়ে বেড়াতে চায়।”
“সেই সুদর্শন তস্কর পরীকে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়ে কুঠিরের মেঝে খুঁড়তে শুরু করে। খুঁড়ে চলে তস্কর, সেই বিশাল ঘাসের ময়দানের নিচ দিয়ে, সেই ঘন জঙ্গলের নিচ দিয়ে। এক সময়ে জঙ্গল অতিক্রম করে অন্য পাশে বের হয় যায় দুইজনে। সামনে উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সুন্দরী পরী।”
“সুদর্শন তস্কর সুন্দরী পরীকে কে জিজ্ঞেস করে ও উড়তে চায় কি না? সুন্দরী পরী মাথা নাড়ায়, কিন্তু জানায় যে ও উড়তে জানেনা। সুদর্শন তস্কর পরীকে কোলে নিয়ে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়, পরী প্রাণপণে ডানা মেলে ধরে, বারেবারে পাখনার ঝাপটা মেরে উড়তে চেষ্টা করে, কিন্তু উড়তে সক্ষম হয় না। পরী পরে যায় আর সুদর্শন তস্কর ওকে মাটিতে পড়ার আগেই কোলে ধরে ফেলে। কিছু পরে সুদর্শন তস্কর আবার পরীকে কোলে করে নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দেয়, এইবারে পরী নিজের পাখা মেলে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে অনেক উপরে উঠে যায় সুন্দরী পরী, নিচে তাকিয়ে দেখে সেই সুদর্শন তস্কর রুপ বদলে শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে ঘাসের মাঠের ওপরে দিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। পরী উড়তে উড়তে সেই বরফ ঢাকা পাহারে চলে যায় আর সেই শ্বেতশুভ্র তস্কর পরীর ছায়া অনুসরন করে পাহাড়ে দিকে চলে যায়।”
গল্প শেষ করে দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করে, “গল্প এখানে শেষ, তুমি জানো এরপরের ওদের কি হয়?”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন, গল্প কি এখানে শেষ?”
মাথা নাড়ায় দুষ্টু, “হ্যাঁ, অভি কাকু এই পর্যন্ত গল্প শুনিয়েছে।”
আমি গল্পের কথা ভাবি, এই গল্প আমার হৃদয় তস্করের, সেই তস্কর পরী রানীর কাছ থেকে সুন্দরী পরীকে চুরি করে সুদূর পাহাড়ে চলে যায়। সেই তস্কর পরীকে উড়তে শেখায়। হ্যাঁ, পরী তারপরে উড়তে শেখে, কিন্তু উড়তে উড়তে একসময়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে সেই তস্কর আর নেই। একবার ভাবে সেই তস্কর হয়ত ওর জন্য খাবার আনতে গেছে, অপেক্ষা করে পরী, কিন্তু সেই তস্কর ফেরে না।
আজও অপেক্ষা করে আছে সেই সুন্দরী পরী তার প্রানের সুদর্শন তস্করের জন্য।
আমি দুষ্টুর টোপা গাল টিপে বলেছিলাম, “এখন ঘুমিয়ে পর, আমি অভি কাকুকে বলে দেব, পরের বার এসে ও যেন তোকে বাকি গল্প টুকু বলে দেয়।”

গল্পটি কেমন লাগলো ?

ভোট দিতে স্টার এর ওপর ক্লিক করুন!

সার্বিক ফলাফল 5 / 5. মোট ভোটঃ 1

এখন পর্যন্ত কোন ভোট নেই! আপনি এই পোস্টটির প্রথম ভোটার হন।

Leave a Comment