লেখকঃ Daily Passenger
৪৫
মিস্টার খান বললেন “কাল স্পার্ম …” মিস্টার বেরা বিরক্ত হয়ে বললেন “ধুসস। তোমার মনে হয় ওখানে কোনও ম্যাচ পাওয়া যাবে। ওই টেস্ট ছাড়ো। ওটা এই সংকেতের স্পার্ম নয়। সেটা এখনও বুঝতে পারোনি? ও জেনে বুঝে আরেকটু টাইম বাই আউট করল। তাছাড়া আর কিছুই না। ওই টেস্টের রেজাল্ট ভুলে যাও। অন্য জিনিস গুলো ফলোআপ করো। ওর মর্নিং ওয়াকের প্লেসে কুকুর পাঠাও, মানে ওই লেকের ধারে। সব কিছু খুঁটিয়ে দেখো। এইবার এসো। বাই।” আসর ভেঙ্গে গেল।
নিজের পেগ শেষ করে এক মাথা চিন্তা নিয়ে মিস্টার বেরা একটা খালি লকআপের ভেতর ঢুকে মেঝেতেই শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর উনি ঘুমিয়ে পড়লেন বটে, কিন্তু ঘুমের মধ্যেও ওনার মাথার ভেতরে নানান চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে চলল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই দুটো গোয়েন্দা কুকুর এসে হাজির হল। একদল পুশিল কুকুরদুটোকে নিয়ে সেই লেকের ধারে গিয়ে হানা দিল। আরও কিছু জিনিস মিস্টার বেরার কথামতন পালন করা হয়েছে। মিস্টার বেরার বাড়ির চারপাশে একদল পুলিশ প্লেন ড্রেসে ক্যামেরা অন করে বসে আছে। দুজন অফিসার চলে গেছে মিস্টার বাড়ির পেছনের বস্তিটাতে। ১৪-১৫ ই আগস্ট রাতের ব্যাপারে খোঁজ খবর করা হয়েছে। আমার ছবিও দেখানো হয়েছে। একটা পুলিশের জিপ অবশ্য ভোরের আলো ফোটার আগেই গোপালবাজারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়েছে। কালো রঙের স্যান্ট্রোর রহস্যের মোটামুটি একটা সমাধান হয়ত করা গেছে। তবে প্রত্যক্ষ প্রমান এখনও হাতে আসেনি। দুজন দুঁদে অফিসারকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে উকিল সত্যজিৎ ধরের পেছনে। তার পুরো ঠিকুজি কুষ্ঠী বের করা হচ্ছে। সবার ফোন এখন ট্যাপ করা হচ্ছে। কিছু তথ্য জানাও গেছে। আশা করা যাচ্ছে যে সময়ের সাথে আরও বেশ কিছু তথ্য হাতে এসে যাবে এই ফোন ট্যাপ করার ফলে। আরও বেশ কিছু ব্যাপার ঘটে গেছে সেগুলো সব সময়ে প্রকাশ পাবে।
মিস্টার বেরা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চায়ের কাপ হাতে যখন কন্ট্রোল রুমে গিয়ে বসলেন তখনও ঘর প্রায় খালি। টেবিলের ওপর রিপোর্টের স্তূপ জমা করা আছে। উনি একে একে রিপোর্টের ওপর চোখ বোলানো শুরু করলেন। ঘড়ির কাঁটা বলছে ৮ বেজে ১৫ মিনিট। সংকেত কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। তার কিছুক্ষনের মধ্যেই মিসেস বেরা বেরিয়ে গেলেন গাড়ি চড়ে। সংকেতের পেছনে পুলিশের দল শিকারি কুকুরের মতন লেগে আছে সারাক্ষন। এসবই কন্ট্রোল রুমে বসে মিস্টার বেরা সচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন। ধীরে ধীরে রুমে এসে হাজির হলেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রাহা। মিস্টার খানও এসে হাজির হয়েছেন। উনি জানালেন ওনার নাকি এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি চিন্তায়। রবিন দাস ইত্যাদিও এসে হাজির হয়েছেন। সব শেষে এসে হাজির হলেন মিস্টার লাহিড়ী। মিস্টার লাহিড়ী গোয়েন্দা বিভাগের লোক নন। তার স্বাভাবিক ভাবেই ওনার হাব ভাবে একটা ঢিলে ঢালা ভাব লক্ষ্য করা যায়। স্বভাবের দোষ আর কি। কিন্তু ওনার চোখ মুখ দেখেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে উনিও ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। মিস্টার বেরা রিপোর্টের তাড়াটা নিয়ে উঠে পড়লেন। আরিফ খান, রবিন বাবু, আর রাহা দম্পতি কে নিয়ে উনি পাশের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বলে দিয়ে গেলেন “সংকেত বেপরোয়া কিছু করলেই ওর পায়ে গুলি করবে। তারপর যা হয় দেখা যাবে। আর এখন কিছুক্ষণ আমাদের কেউ বিরক্ত করবে না। আমরা কিছুক্ষণ গোপনে আলোচনা করতে চাই। “
মিটিং ভাঙল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর। বাইরে বেরিয়ে এসেই মিস্টার খান একদল পুলিশকে কন্ট্রোল রুমে ডেকে পাঠালেন। মিস্টার বেরা কন্ট্রোল রুমে ঢুকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন “সংকেতের লোকেশন কি?” জবাব এলো, “সংকেত ক্লাস করছে। ওর মোবাইল লোকেশনও তাই দেখাচ্ছে।” মিস্টার বেরা বললেন “ক্লাসের বাইরে একাধিক লোক রেডি রেখো। ক্লাস থেকে বেরোলেই ওকে উঠিয়ে নেবে। তবে অযথা সিন ক্রিয়েট করতে যেও না। চুপ চাপ উঠিয়ে নেবে। বেশী লোক জানাজানি করার দরকার নেই। মনে রেখো আমাদের লোক যেমন সংকেতের ওপর নজর রেখেছে, ওই দিকে সংকেতের লোকও সংকেতের ওপর নজর রেখেছে। ওকে গ্রেফতার করার সাথে সাথে কিছু জিনিস আমাদের উদ্ধার করতে হবে ওর লোকের কাজ থেকে। “ ওপর প্রান্ত থেকে জানিয়ে দেওয়া হল যে ওরা প্রস্তুত। নির্দেশ মতন কাজ হয়ে যাবে।
মিস্টার বেরা বললেন “আমি ১৫ মিনিটের জন্য হেঁটে আসছি। এসি ঘরে বসে বসে মাথা কাজ করছে না। জানলাটা খুলে দাও কালকের মতন। সিগারেটে টান না দিলে আমার মাথা খোলে না। আমি সিগারেট কিনে নিয়ে আসছি। বাই দা ওয়ে, স্পার্ম ম্যাচ করেছে?” মিস্টার খান বললেন “ বিকালের আগে জানা যাবে না। আমি আবার তাড়া দিচ্ছি।” মিস্টার বেরা বললেন “ কোনও কিছু গোলমাল দেখলেই আমাকে কল করবে। আমি থানার আসে পাশেই থাকব। “ বেশ কয়েকজন পুলিশ এসে ইতি মধ্যে হাজির হয়েছে কন্ট্রোল রুমে। মিস্টার খান ওনাদের হাতে মিস্টার বেরার দেওয়া লিস্টটা তুলে দিলেন। “এদের সবাইকে নিয়ে আসতে হবে ১২ টার পর। জিপে করে নিয়ে আসবে পার্সোনালি। সংকেতকে তোমাদের আনতে হবে না। ওর জন্য অন্য ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু খেয়াল রাখবে কোথাও কোনও রকম সিন ক্রিয়েট করবে না। চুপ চাপ কথা বলে উঠিয়ে নিয়ে আসবে। “ এরপর আরও কিছুক্ষণ বেশ নির্বিঘ্নে কেটে গেল। লাঞ্চ আওয়ার শুরু হবে আর কিছুক্ষনের মধ্যেই…কেটে গেল আরও বেশ কিছুক্ষণ। ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন অফিসার ঘন ঘন নিজেদের ঘড়ি দেখে চলেছেন। রিভলবারের সেফটী ক্যাচ অফ করে ওনারা রেডি। আর ১০ মিনিটও নেই। তারপরই শিকার এসে ফাঁদে পা দেবে। সময় যে আর কাটতে চায় না।
এইবার যা হল তার কিছুটা আমি নিজের মুখেই বলি, কেমন? মিস্টার বেরা তো আমার মুখোশ খুলেই ফেলেছেন। এখন আর নাটক করে কি লাভ। তবে এখনও পুরোটা খুলতে পারেননি। তাছাড়া, একটা জিনিস ওনাকে জানানো আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেটা না বললে ওনাকে চিট করা হবে। যাই হোক। লাঞ্চ আওয়ার শুরু হতে এখনও ১০ মিনিট বাকি। ১০ মিনিট মানে ৬০০ সেকন্ড! বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন অফিসার যেমন বার বার নিজেদের ঘড়ি দেখে চলেছেন, আমিও ঠিক তেমনই বার বার নিজের ঘড়ি দেখে চলেছি। তবে মোবাইল ঘড়ি নয়। বুক পকেটের ঘড়িটা। এইবার সময় এসেছে। আর ঠিক মিনিট দুয়েকের অপেক্ষা। সেকন্ডের কাঁটাটা টিকটিক করে ঘুরে চলেছে… ব্যস সময় শেষ। এইবার।
ক্লাসের বাইরে বিনা মেঘে যেন বাজ পড়ল, একবার নয়, পরপর দুই বার। কয়েক মুহূর্তের জন্য আবার সব চুপ। তারপর আবার পরপর কান ফাটানো দ্রুম দ্রুম শব্দ। আর সাথে সাথে আমাদের ক্লাসের ভেতরে ছোট একটা জিনিস এসে পড়ল মেঝের ওপর। পড়ার সাথে সাথে সেটা বার্স্ট করল, আবার ভয়ানক কান ফাটানো শব্দ। আর সেই সাথে ঘন ধোঁয়ায় ক্লাসরুম ভরে গেল নিমেষে। প্রাণবন্ত ক্লাস রুমটা এক নিমেষে কালো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল। প্রায় কিছুই দখেয়া যাচ্ছে না। আমি একটা চাপা চশমা চড়িয়ে নিলাম। আমার সিটের নিচেই আঠা দিয়ে আটকানো ছিল। ক্লাসের ভেতরে বাইরে, সব জায়গায় একসাথে হইচই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাস থেকে, পাশের ক্লাস থেকে, নিচের ফ্লোর থেকে, ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র ছাত্রীরা ছুটে এলো আমাদের ক্লাসের দিকে। প্রফেসর সহ সবাই ছুট মেরেছে বাইরের দিকে। একমাত্র আমিই স্থির হয়ে বসে আছি। ম্যাদা মারা কুন্তলকেও উত্তেজিত দেখাচ্ছে। ও সিট ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে চোখ ডলতে ডলতে আমাকে জিজ্ঞেস করল “ কিরে? গিয়ে দেখবি না কি হয়েছে?” আমি ধীরে ধীরে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম “ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর দৌড়াদৌড়ি করে কি লাভ। আমাকে বরং একবার বাথরুমে যেতে হবে।”
বাইরে বেরনোর জো নেই। সবাই এর ওর ঘাড়ের ওপর চড়ে বসেছে। বলাই বাহুল্য চারটে প্রাণহীন রক্তাক্ত মৃতদেহকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ওই যে অবশিষ্ট একজন অফিসার ছুটে আসছে জটলার দিকে। একে সরু প্যাসেজ, তার ওপর এতগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে জমায়েত হয়ে চেঁচামেচি করে চলেছে। অফিসার নিজের আই কার্ড দেখিয়ে ওদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন, কিছু জিজ্ঞেস করে চলেছেন ওদের বারবার, কিন্তু এই উত্তেজনা আর চিৎকারের মাঝে ওনার কথা কেই বা শুনবে। কোনও মতে ভিড় ঠেলে আমি ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে এগিয়ে চললাম। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। তাছাড়া আমার হাতে আর কিছুই নেই। একটু হালকা হয়ে নেওয়া দরকার। তবে হাতে সময় বেশী নেই। তাই এই ফ্লোরের বাথরুমে না গিয়ে ইচ্ছে করেই নিচের ফ্লোরের বাথরুমে চলে গেলাম। জানি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই বাইরে আরেকটা রেসকিউ টিম এসে হাজির হবে আমাকে ধাওয়া করে। কিন্তু তার আগেই আমাকে বিদায় নিতে হবে। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ছে। নিচে নামার আগে একবার পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম। সেই অফিসার ভিড়ের ভেতর হারিয়ে গেছেন। কয়েক সেকন্ডের ভেতর ভিড় যেন আরও বেড়ে গেছে। ভিড়ের ভেতর একবার রাকাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেলাম না। থাক সে সব পরেই হবে। নিচের ফ্লোর পুরো খালি। সেটাই স্বাভাবিক। উপরের ফ্লোর এখন লোকে লোকারণ্য। কিন্তু নিচের সব কটা ক্লাস খালি। বাথরুমের কাজ সারতে ১৫ মিনিটের মতন লেগে গেল, বা তার কিছু বেশী।
করিডোরের অন্য দিক থেকে আবার সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরের ফ্লোরে গিয়ে হাজির হলাম। সিঁড়ির ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই অফিসার। কানে মোবাইল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি সব বলে চলেছেন। আমি ওনাকে ক্রস করার আগেই আমার একটা হাত চেপে ধরে বললেন “ বিশ্রী ব্যাপার হয়েছে। এই বয়সে আপনার ওই দিকে যাওয়া ঠিক নয়। আর প্রচণ্ড ধোয়া। আপনি ওই লিফটে করে নিচে নেমে যান। “ এই লিফট সাধারণ ছাত্র ছাত্রিদের ব্যবহারের জন্য নয়। শিক্ষক আর ডিফারেন্টলি চ্যালেঞ্জড ছাত্র ছাত্রিদের জন্য এই লিফট। ওনার কথা মতন আমি ধীরে ধীরে ওই লিফটের দিকে এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষনের মধ্যে খালি লিফট এসে হাজির হল। আমি নিচে নেমে চললাম। রেসকিউ টিম এখনও এসে পৌঁছায়নি। “গাড়ি” চড়ে কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে “আমাদের” কোনও বেগ পেতে হল না। বেশ কয়েকটা জায়গা আমাদের কভার করতে হবে। আর করতে হবে ভীষণ দ্রুত। শুধু একটা জায়গা কভার করা যাবে না। তবে সেটা নিয়ে এত চিন্তা করার কিছুই নেই।
৪৬
এর পর প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় কেটে গেছে। কলেজের ক্যাম্পাস এখন অনেক শান্ত। ক্যাম্পাসের ভেতর পুলিশের ছড়াছড়ি। ১২ জন পুলিশের ডেড বডি চালান করার বন্দবস্ত হচ্ছে। সেই অবশিষ্ট অফিসারকে আর দেখতে পেলাম না। এইটা আমার জানার কথা নয় এই রিয়েল টাইমে। কিন্তু এই ব্যাপারে এখন আমি বলতে পারছি কারণ সেই “আমাদের” আমি এখন বসে আছি কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে। “আমাদের” বাকিরা নিজেদের গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে পড়েছে। কলেজের মেইন গেটের বাইরে যে বড় ভাত খাওয়ার হোটেলটা (হোটেল না বলে বড়সড় ঝুপড়ি বলা যেতে পারে এটাকে) আছে সেটার ভেতরে কলেজের দিকে মুখ করে বসে আমি আমার লাঞ্চ সারছি। মেনু? ভাত, ডাল, আলুভাজা, ডবল ডিমের অমলেট, মাছের ডিমের বড়া, আর পাবদা মাছের ঝাল, তাও আবার একটা নয় দুটো পাবদা নিয়েছি আজকে। কে জানে, এই খাবার খাওয়ার সুযোগ এরপর কবে পাওয়া যাবে! সুতরাং এই লাস্ট লাঞ্চটা একটু রাজকীয় ভাবে করা যাক। হোক না একটা শস্তা ঝুপড়ি, কিন্তু বৌদির রান্নার হাত খুব ভালো। তেল মশলা দিয়ে মন্দ রাঁধেন না। এই হোটেলের লোকজনের মধ্যেও ভীষণ হইচই পড়ে গেছে। ভাত দেওয়ার জন্য, ডাল দেওয়ার জন্য, ঝোল দেওয়ার জন্য বার বার ডাকতে হচ্ছে। আমার দিকে কারোর কোনও খেয়ালই নেই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর আবার প্রবেশ করলাম। শেষ বারের মতন।
ওই তো রাকা। ওকে একটা পুলিশের জিপে ওঠানো হচ্ছে। ও বারবার ব্যাকুল ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ও কি নিজের গাড়ি অব্দি পৌঁছাতে পেরেছিল? ঠিক আছে। সেসব বোঝার উপায়ও আছে। ধীরে ধীরে ওর গাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলাম। ওর গাড়ির দিকে কারোর নজর নেই। সামনের ড্রাইভিং সিটের ওপর একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। নাহ। ও নিজের গাড়ি অব্দি এসে পৌঁছাতে পারেনি। তার আগেই ওকে পুলিশের জিপে তুলে নেওয়া হয়েছে। তাহলে এইবার? এইবার, যবনিকা পতনের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে।
মিস্টার বেরার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী সবাইকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে পুলিশের জিপে। শুধু মাত্র একজন সেখানে অনুপস্থিত। আমি। আবার আমি ঘটনাগুলো রঙ্গমঞ্চে ঘটে যাওয়া নাটকের মতন বর্ণনা করব। কারণ এই নাটকে আমি নিজে অনুপস্থিত। মিস্টার লাহিড়ীর ঘর এখন ভর্তি। তিল ধারনের জায়গা নেই। মিস্টার লাহিড়ীর সিটে বসে আছেন স্বয়ং মিস্টার বেরা। বাকি অফিসারদের জন্যও গাদাগাদি করে কোনও মতে চেয়ার এনে রাখা হয়েছে ঘরের ভেতর। মিস্টার বেরার মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। ওনার চোখদুটো কেমন জানি ছল ছল করছে। হাতে তিনটে সাদা রঙের লম্বা ফুল স্কেপ কাগজ ধরা আছে। সেই পাতাগুলোয় কালো কালিতে ছোট ছোট হরপে যে লেখাগুলো লেখা আছে তার ওপর বার বার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন উনি। যত সময় যাচ্ছে, ওনার হতাশা ততই যেন বেড়ে চলেছে। অবশেষে, পাতাগুলোকে একটা ব্রাউন খামের মধ্যে ভরে রেখে উনি চারপাশের লোকজনের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। ঘরে পুলিশের বা গোয়েন্দা বিভাগের লোক ছাড়া আরও অনেকে আছে। তাদের ব্যাপারে সংক্ষেপে লিখে দেওয়া ভালো।
১। মিসেস বেলা মুখার্জি।
২। মিসেস সুধা সান্যাল।
৩। মালিনী।
৪। রনি। (মালিনীর বর। ধন্যি ছেলের অধ্যাবসায়। একেও কাঁথি থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে লোক লাগিয়ে।)
৫। দোলন।
৬। রাকা।
৭। কুন্তল।
৮। মিসেস সঞ্চিতা বেরা।
৯। চন্দন নস্কর। (শ্যামা নস্করের বর।)
১০। মিস্টার অবিনাশ সান্যাল। (এনাকে ধরে আনা হয়নি। ইনি নিজে এসে হাজির হয়েছেন।)
১১। মিস্টার সত্যজিৎ ধর। (উকিল)
১২। ডঃ অরুপ চক্রবর্তী।
১৩। মিসেস রমা ব্যানার্জি। (ইনি মালিনীর সহকর্মী। একই হোটেলে কাজ করেন)
১৪। ব্লু রিসোর্টের ম্যানেজার মিস্টার বসন্ত মল্লিক।
১৫। ব্লু রিসোর্টের মালিক মিস্টার দত্ত।
১৬ মিস্টার মেহেরা আর ওনার দুজন বডি গার্ড।
১৭। টেবিলের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল ব্লু রিসোর্টের ১০৭ নম্বর রুমের রুমবয় বাবুয়া!
এছাড়া এই মুহূর্তে আরেকজন আছে এই ঘরে। তাকে অবশ্য উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়নি। সে এসেছে পেটের দায়ে। বা বলা ভালো তলপেটের দায়ে। গরীব বয়স্ক চা ওয়ালা। এই মুহূর্তে সে সবার হাতে হাতে চায়ের গ্লাস তুলে দিচ্ছে। কাপ নয়, গ্লাস। কাঁচের গ্লাসে চা যেমন হয় আর কি! ঘরে জমায়েত সবার হাতে হাতে চায়ের গ্লাস তুলে দিয়ে মিস্টার লাহিড়ীর হাত থেকে চায়ের দাম বুঝে নিয়ে সে বেরিয়ে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল সশব্দে। ঠিক তার পরের মুহূর্তেই আবার খুলে গেল। মিস রাকা সান্যাল ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কি ব্যাপার? ওনার পেছনে একজন মহিলা পুলিশ। মিস সান্যাল টয়লেটে যাবে। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই মহিলা অফিসার। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার মিস সান্যাল সেই বদ্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল সেই মহিলা অফিসারের সাথে। দরজা আবার বন্ধ হল। ভেতর থেকে লক করে দেওয়া হল।
মিস্টার বেরা সোজা হয়ে বসে শুরু করলেন। “ সভা আরম্ভের আগে আপানাদের কেন এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে সেই ব্যাপারে কিছুটা বলে দেওয়া দরকার। নইলে খামোকা আপনারা ভুল জিনিস নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করবেন। ইনি মিস্টার মেহেরা। সরি ডঃ মেহেরা। ডবল পি এইচ ডি। বিশাল বড় সাইন্টিস্ট। নিউক্লিয়ার আর্মসের ব্যাপারে ইনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন এই দেশ আর দেশবাসীর জন্য। আগের সরকার আর এই সরকার, দুই দলেরই প্রিয় পাত্র এই মিস্টার মেহেরা। এই ছোট খাটো গোবেচারা লোকটা। ইনি একজন স্টলওয়ার্ট। মনীষী ব্যক্তি। এনার ট্র্যাক রেকর্ড দেখে এইটুকু বলতে পারি ইনি আজ অব্দি টাকার জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য, বা অন্য কোনও কারণে আমাদের দেশের বা দশের কোনও ক্ষতি করেননি। সারা জীবন উনি শুধু দেশের ভালোই করে এসেছেন। আরেকজন আছেন আমাদের তদন্তের আওতায়। আর তাকে নিয়েই এই কেস।
মিস্টার রঞ্জন মুখার্জি। সবাই তার নাম জানেন। সবাই তাকে চেনেন। আমাদের এক্স মিনিস্টার। কিন্তু আগে ভাগেই জানিয়ে রাখি যে এখানে আমরা বৈজ্ঞানিক রঞ্জন মুখার্জির ব্যাপারে কথা বলতে বসেছি। মিনিস্টার বা রাজনৈতিক নেতা রঞ্জন মুখার্জির ব্যাপারে নয়। আমাদের তদন্তের বিষয় এই দুজন মনীষীকে নিয়ে। মিস্টার মুখার্জিও নিজের গবেষণা আর নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন দেশের জন্য। আর ওনারও প্রিয় বিষয় ছিল আর্মস। মডার্ন আর্মস। বরং বলা ভালো নিউক্লিয়ার আর্মস। মিস্টার মেহেরার মতন ইনিও নিজের ব্যক্তিগত জীবনে যাই করুন না কেন, বৈজ্ঞানিক জীবনে দেশের সাথে কোনও রকম বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বরং উনি জীবনের শেষ দিন অব্দি আমাদের সবার ভালোর জন্য যুদ্ধ করে গেছেন। ভূমিকা শেষ।
এইবার কাজের কথা শুরু করছি। আমি একা নই এই টিমে, বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানি মিস্টার রাহা আর ওনার স্ত্রীও এখানে উপস্থিত। আমি কারোর সাংবিধানিক অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করছি কিনা সেটা দেখার জন্য এখানে উপস্থিত আছেন মিস্টার সান্যাল। ওনাকে আমি ডাকিনি বিশেষ কারণে। কিন্তু আদালতের একজন এত বড় সেবক যখন আমাদের মধ্যে উপস্থিত তখন সাংবিধানিক অধিকারের দিকটা দেখার ব্যাপারে ওনাকেই আমি …মানে উনি যদি এই ছোট দায়িত্বটা নেন তো আমি এবং আমার টিম খুবই বাধিত হবে। তবে আবারও বলছি। কেসটা দেশের আর দশের ব্যাপারে। তাই আমি সবার সহযোগিতা পাওয়ার আশা করেই এই সভা শুরু করছি। তবে মিস্টার সান্যাল কোথাও বাধা দিলে আমরা পরের আলোচনার দিকে এগিয়ে যাব।” মিস্টার সান্যাল বললেন “আপনি শুরু করুন। আমি দেশের আইন মোটামুটি জানি।”
মিস্টার বেরা উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে একটা বাও করে শুরু করলেন নিজের প্রারম্ভিক ভাষণ। “আমাদের দেশের সরকার একটা অন্য ধরণের নিউক্লিয়ার ডিভাইস, অর্থাৎ অস্ত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় গোপনে। রিসার্চ শুরু হয় কয়েক বছর আগে। মিস্টার মুখার্জি আর মিস্টার মেহেরা সেই রিসার্চের পার্ট ছিলেন। এরপর নানা কারণে মিস্টার মুখার্জি রাজনৈতিক ভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অতএব গোটা জিনিসটার সাথে ওনার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিকরা মিলে মোটামুটি পুরো জিনিসটা তৈরি করে ফেলেছিলেন। তার ডিসাইন প্রস্তুত করে ফেলা হয়। কিন্তু জিনিসটা কাজে আসে না কারণ ওই জিনিসটা চালনা করার জন্য একটা বিশেষ ধরণের ফিউসের দরকার। সেটা তৈরি করতে না পেরে দেশের সরকার আর মিস্টার মেহেরা, আবার মিস্টার মুখার্জির সাথে কন্ট্যাক্ট করেন। উনি ছিলেন বিশাল মনের মানুষ। উনি এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও আবার সেটা নিয়ে কাজ করতে রাজি হন। মিস্টার মেহেরার ভাষায়, এই কাজের সাথে উনি আগে থেকেই জড়িত ছিলেন, সেই জন্য সেই সেন্টিমেন্টও কাজ করেছে ওনার মধ্যে। মোটের ওপর উনি রাজি হন। গবেষণা করেন। উনি সফল হন সেই গবেষণায়, সব তৈরি হয়। কিন্তু দেশের কোনও কাজে আসে না সেই জিনিস। বরং… সে কথায় পরে আসছি। তার আগে এটা বলে দেওয়া ভালো যে আপনারা যারা এই ঘরে বসে আছেন তারা নিশ্চই এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গেছেন যে এই জিনিস ভুল লোকের হাতে পড়লে আমাদের … আপনারা বুদ্ধিমান আপনারাই বুঝে নিন, আপনার আমার কতটা ক্ষতি হবে। সেটা নিয়েই এই কেস। কোনও মেয়ে, ছেলে বা কোনও রাজনৈতিক নেতার খুনের ব্যাপারে আমাকে নিয়োগ করা হয়নি। কিন্তু কিছু জিনিসের সাথে নিজেকে না জড়িয়ে আমি থাকতে পারিনি। এই ব্যাপারেও আমি পরে আসব। আপাতত, দুই একটা তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ফিউস তৈরির আগে অব্দি যা কিছু হয়েছে তার সমস্ত তথ্য, ডিসাইন আমাদের সরকারের কাছে আছে। মিস্টার মুখার্জি ফিউস তৈরি করার ডিসাইন তৈরি করেন গোপনে। তার দুটো ফাইল ছিল। একটা তার বাড়িতে, গোপন একটা সেফে। আর একটা তিনি মিস্টার মেহেরার হাতে তুলে দেন। ওনার ডিসাইন অনুযায়ী একটা রিয়েল ফিউস তৈরি করে আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা। সেটাও তুলে দেওয়া হয় মিস্টার মেহেরার হাতে। এইবার একটা জিনিস বলে রাখি, ফিউস ছাড়া এই যন্ত্র, আর যন্ত্র ছাড়া এই ফিউস, কোনওটাই কোনও কাজে আসবে না। এইবার এক কথায় বলে রাখি, দুটো ফাইল , মানে যন্ত্র আর ফিউসের ফাইল দুটো চুরি গেছে। যন্ত্রের ফাইলের কপি আমাদের কাছে আছে, কিন্তু ফিউসের ফাইলের কপি আর নেই। মিস্টার মুখার্জির বাড়িতে এর একটা কপি রাখা ছিল, সেটাও চুরি গেছে। সেই সাথে, ফিউসের মডেলটা, যেটা আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা বানিয়েছিল, সেটিও চুরি গেছে। অর্থাৎ ফিউস সম্পর্কে আমাদের হাতে কিছুই নেই। বাই দা ওয়ে, ওই ফিউসের ডিসাইনের একটা কপি ছিল মিস্টার মেহেরার হাতে। সেটা চুরি গেছে বলেই বলছি যে আমাদের হাতে আর কিছুই নেই। উপরন্তু, মিস্টার মুখার্জি, মানে যিনি এটার স্রস্টা তিনিও ইহ লোক ত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ এই ব্যাপারে আমাদের হাতে আর কিছুই নেই। উনি জীবিত থাকলে নিশ্চই আবার আরেকটা ডিসাইন তৈরি করে ফেলতেন। কিন্তু উনি চলে যাওয়ার পর আমাদের দেশ এখন পঙ্গু। এইবার আশা করছি কেসের সিরিয়াসনেসের ব্যাপারে আপনাদের বোঝাতে পেরেছি। এইবার কাজের কথায় আসছি। “
“কিছুটা আমি বলব, কিছুটা ফিল ইন দা গ্যাপ করতে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। সেই আশা নিয়েই এই সভা শুরু করছি। সবাই রাজি তো?” মিস্টার সান্যাল বললেন “আপনি শুরু করুন মিস্টার বেরা…” মিস্টার বেরা শুরু করলেন “ এই তথ্য গুলো কোনও ভাবে বাইরে জানাজানি হয়ে যায়। একটা বিশাল বড় সমাজবিরোধী সংস্থার পক্ষ থেকে একটা অ্যাসাসিন গ্রুপ কে এই ব্যাপারে নিযুক্ত করা হয়। আমাদের গল্পের নায়ক, বা খলনায়ক, যাই বলুন না কেন, সে একটা ছাত্রের মুখোশ পরে এসে হাজির হয় কোলকাতার বুকে। ওরা জানত গোটা ব্যাপারটা ঘটবে গোপনে একটা বেসরকারি হোটেলের রুমে। হোটেলের নাম ব্লু রিসর্ট। মিস্টার মেহেরা রুম বুক করার সাথে সাথে আমাদের নায়কও নিজের নামে একটা রুম বুক করে সেই একই হোটেলে, একই ফ্লোরে। ওর ঘরটা ছিল মিস্টার মেহেরার ঘরের থেকে একটা ঘর পরে।“
কথাটা বলেই উনি মালিনীর মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। মালিনীর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হাসিমুখে উনি মালিনীর বর রনিকে জিজ্ঞেস করলেন “ আপনার কাছে আমার একটা সামান্য প্রশ্ন আছে। কথা দিচ্ছি। আপনার উত্তর এই চার দেওয়ালের বাইরে যাবে না। এই কেস কোনও দিন আদালতে উঠলে আলাদা করে আপনার জবানবন্দি নেওয়া হবে তখন। আপাতত শুধু সত্য উদ্ঘাটন করার তাগিদে আপনাকে প্রশ্নটা করছি। ” রনি বলল “বলুন।” “ আপনি কি সংকেত বলে কাউকে চেনেন?” রনি এই কথার কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই মিস্টার বেরা বললেন “ আপনি যদি মনে করতে না পারেন তাহলে আমি আপনাকে এই ব্যাপারে অবশ্যই সাহায্য করব। ওই হোটেলের চার তলার ঘরে এক উইকএন্ডে একটা ইয়ং ছেলে আপনার আর আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে আসে। অনেকক্ষণ ছিল সে ওই ঘরে। এইবার মনে পড়েছে?” রনি বলল “ হ্যাঁ ভালো ভাবেই মনে আছে। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?”
মিস্টার বেরা বললেন “ব্যাপার তো বলবেন আপনি। আমরা সবাই মিলে শুনব। একবার বলবেন রাত প্রায় আড়াইটা অব্দি আপনারা তিন জন মিলে ওই ঘরের ভেতরে বসে কি এমন গভীর আলোচনা করছিলেন? আর ওই ছেলেটাকে আপনি চেনেনই বা কি করে?” প্রশ্নটা করেই উনি একবার মালিনীর মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন। মালিনীর ফ্যাকাশে মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। রনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই এর উত্তর দিল। “আমরা সেদিন তিনজনে মিলে পার্টি করছিলাম। ওই ছেলেটাই পার্টি থ্রো করেছিল ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার খুশিতে। ওই ছেলেটা মালিনীর কলিগ। অনেক দিন ওরা একসাথে কাজ করছে ওই হোটেলে। ও এসেছিল আমাদের সাথে, সরি আমার সাথে সেলিব্রেট করতে। “ মিস্টার বেরা বললেন “তারপর কি কি হল পার্টিতে যদি একটু বিস্তারিত ভাবে বলেন।” রনি বলল “ অনেক আগেই মালিনীর হাত দিয়ে একটা হার্ড ড্রিংকের বোতল ও ওই ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে আমি একাই খাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ও এসে হাজির হল। আমি তখনও ঠিক জানতাম না যে এই পার্টিটা ওর তরফ থেকে থ্রো করা হয়েছে। মালিনী গোটা ব্যাপারটা গোপন রেখেছিল। পরে অবশ্য ছেলেটার মুখ থেকেই গোটা ব্যাপারটা জানতে পারি। যাই হোক। ছেলেটা কখন এসেছিল সঠিক বলতে পারব না কারণ ততক্ষণে আমার বেশ ভালো নেশা হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা আসার পর আমাদের মধ্যে কিছু গল্প গুজব হয়। তবে স্যার সত্যি কথা বলছি, আমার সেদিন এত নেশা চড়ে গেছিল যে কি কথাবার্তা হয়েছে সঠিক বলতে পারব না। কিছুই মনে নেই। একবার বমি করে আউট হয়ে যাই। পরে ওরা ধরাধরি করে আমাকে বিছানায় শুয়ে দিয়েছিল। ব্যস এর থেকে বেশী আর কিছুই জানি না। কটার সময় আমি আউট হয়ে গিয়েছিলাম, সেটাও বলতে পারব না। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই, মানে ঠিক হুঁশ ছিল না আমার। “
হোটেলের ম্যানেজারের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে রনির উত্তর শুনে। মিস্টার বেরা সরাসরি হোটেলের ম্যানেজারকে প্রশ্নটা করলেন “ সংকেত আপনাদের এমপ্লয়ী ছিল সে কথা আগের দিন তো আমাদের সামনে স্বীকার করেননি।” ম্যানেজারকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে পরের প্রশ্নটা উনি ছুঁড়ে দিলেন মালিনীর উদ্দেশ্য, “ আপনার স্বামীর সামনে সংকেতকে নিজের কলিগ বলে মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার পিছনে কোনও বিশেষ কারণ? “ মালিনী মুখ নিচু করে বসে আছে। মিস্টার বেরা বললেন “আমাদের এখন সময় নষ্ট করার মতন ফালতু সময় একেবারে নেই, তাই আমি এগিয়ে চললাম। মালিনী দেবী আপনি যে ঘন ঘন সংকেতের ঘরে যাতায়াত করতেন সেটার ব্যাপারে আপনার পিছনে হোটেলে অনেক রকম কথা চালাচালি শুরু হয়েছিল। আপনাকে আপনার ম্যানেজার এই নিয়ে জিজ্ঞেসও করেছিলেন, কিন্তু আপনি বলেছিলেন যে সংকেত আপনার ভাইয়ের বন্ধু। তাই আপনার ভাইয়ের ব্যাপারেই ওর সাথে কথা বার্তা বলার জন্য আপনি ওর ঘরে যেতেন। “ মালিনী ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
মিস্টার বেরা সহজভাবেই বললেন “ এইবার একটা কথা বলবেন যে আপানার ভাইয়ের ব্যাপারে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল যেটা বলার জন্য আপনাকে ওর ঘরে এত ঘন ঘন যেতে হত? আর প্রায় প্রত্যেকদিনই ঘণ্টা খানেক ধরে বন্ধ ঘরের মধ্যে চলত আপনাদের এই মিটিং? আর সময়টা হচ্ছে গভীর রাত। হোটেলের কোনও কর্মচারী কোনও বোর্ডারের রুমে এত রাতে যায় না, সেটা নিশ্চই আপনার অজানা নয়। উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। আমরা এখানে আপনার পার্সোনাল কেচ্ছা নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি, তবে এইটুকু বলতে পারি যে, আমি জানি সংকেতের সাথে আপনার রোজ শারীরিক সম্পর্ক হত। আপনি ওর সাথে সহবাস করতে যেতেন আর তাই আপনাদের এতটা সময় লাগত! “ মালিনী ফ্যাকাশে মুখ নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল। “আপনি কোনও রকম প্রমান ছাড়া সবার সামনে আমার নামে যা খুশি…।”
মিস্টার বেরা অম্লান বদনে বললেন “এত উত্তেজিত হবেন না। হোটেল ছাড়ার আগে এবং পরে আপনাদের মধ্যে অসংখ্য বার মেসেজ আদান প্রদান হয়েছে। আপনাদের মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল সেটার প্রমান এই মেসেজের আদানপ্রদান। তাছাড়া…আপনার সেই প্রিয় বন্ধুটি আপনাদের সমস্ত গোপন মুহূর্তের ভিডিও ইন্টারনেটে আপলোড করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার মানুষ দেখে ফেলেছে সেই ভিডিও। অবশ্য বিপুল টাকার বিনিময়ে। সহবাসের সময় আপনাদের মধ্যে কি কি কথা হত সেসবও আমি মোটামুটি শুনেছি। সেদিন চার তলার ঘরে ও গিয়েছিল আপনার নেশাগ্রস্ত বরের সামনে আপনাকে ভোগ করার প্ল্যান নিয়ে। আপনি সেটা আগে থেকেই জানতেন। আপনাদের ভেতর এই অশ্লীল প্ল্যান নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনাও হয়েছিল। দুটো ভিডিও আছে, যেগুলোতে আপনাদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, এই প্ল্যান নিয়েই আপনাদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল, আপনাদের দুজনকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভিডিওতে। আপনার বেহুঁশ বরের সামনে ও আপনার মাথায় সিদুর পরিয়ে আপনাকে নিজের স্ত্রী বানায়, এবং আপনার বরের সামনেই আপনার সাথে সহবাস করে, সারাক্ষন ধরে আপনার বরকে ও অশ্রাব্য ভাষায় তিরস্কার করে চলে, আর আপনি সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে সব কিছু উপভোগ করলেন। আপনাদের ভাষায় বলতে গেলে সেদিন আপনার বরের সামনেই আপনাদের ফুলশয্যা হয়েছিল। সব ধরা আছে ভিডিওতে। কিন্তু এই নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যথা নেই। আমার যেটা নিয়ে মাথা ব্যথা সেটা নিয়ে সরাসরি একটা প্রশ্ন করছি এইবার। তবে তার আগে একটা কথা আপনাদের সবাইকে বলে দিই যে আমি হাওয়ায় কথা বলছি না। আমার হাতে প্রমান না থাকলে কোনও বাজে প্রশ্ন আমি করব না। আপনি সংকেতের কাছে শারীরিক সুখ পাওয়ার জন্য একটা সময়ের পর থেকে ব্যাকুল হয়ে থাকতেন। এই সময় আপনি কি কোনও কারণে, বা বলা ভালো কোনও অসতর্কতার মুহূর্তে সংকেতের সামনে এটা বলে ফেলেছিলেন যে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা মিস্টার মেহেরার জন্য বন্ধ করা হয়েছে গোপনে? খুব ভেবে চিন্তে কথাটার উত্তর দেবেন। এটা দেশের সিকিউরিটির ব্যাপারে কথা বলছি, আপনার কেচ্ছার ব্যাপারে নয়।”
মালিনীর বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগল নিজেকে সামলে নিতে। অবশেষে ভাঙা গলায় বলল “ ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা নিয়ে ওর সাথে আমার কোনও দিনও কোনও কথাই হয়নি। ও আমাকে এই ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি কোনও দিন, আর আমিও আগ বাড়িয়ে এই নিয়ে কোনও কথা বলিনি ওর সামনে। কিন্তু …” মিস্টার বেরা বললেন “কিন্তুটাই শোনার জন্য আমি মুখিয়ে আছি। “ মালিনী বলল “ আমাদের হোটেলে একজন সিকিউরিটিকে ও পিটিয়েছিল। আপনি বোধহয় জানেন না।” মিস্টার বেরা বললেন “আমরা সব জানি। তারপর?” মালিনী বলল “ আমি ওকে সেই ব্যাপারে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম একান্তে। আমি জানতাম এটা ওরই কীর্তি। ও নিজের মুখে সেটা স্বীকারও করেছে। কিন্তু স্বীকার করার সময় ও বারবার যেভাবে আমাকে, মানে আমাদের হোটেলকে ফুটেজ দেখিয়ে পুরো ব্যাপারটা প্রমান করতে বলছিল, সেটা থেকে আমার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল তখন যে ও ক্যামেরার ব্যাপারটা কোনও ভাবে জেনে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এই ব্যাপারে ওর সামনে কিছুই বলিনি। “