Written By pinuram
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০১)
তুমি কি রোদে ভিজতে পারো? আমরা কিন্তু রোদে ভিজেছিলাম। সেসময়ে কলকাতা, কল্লোলিনী তিলোত্তমা ছিলো আজকের মতন ব্যাঙের ছাতা হয়ে যায়নি। ময়দানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলে গঙ্গার জলো বাতাসে বুক ভরে উঠতো। আউট্ট্রাম ঘাট তখন বাঁধানো ছিলো না, গঙ্গার পাড়ে সোঁদা মাটির ওপরে বসে চিনে বাদাম কিনে চিবোতে চিবোতে দু পায়ের নিচে দোল খেত গঙ্গার জল। ভিক্টরিয়ায়র সামনে থেকে দোতলা বাসের সামনের সিটে চেপে সোজা শ্যামবাজার আসার একটা আলাদা মজা ছিলো। রাজাবাজার ট্রামডিপো থেকে দৌড়ে ট্রাম ধরে কলেজস্ট্রীট যাবার এক আলাদা আনন্দ ছিলো সেই সময়ে। মোড়ের মাথার চায়ের দোকানের জায়গা নিল রকমারি কেক প্যাস্ট্রির দোকান। প্রেসিডেন্সির ঠিক সামনে ফুচকাওয়ালার হাতের ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা হত। বই কিনতে সবাই বই পাড়ায় যেত, আজকের দিনের মতন মোবাইলে ইন্টারনেট খুলে বই অর্ডার করতো না। বই পাড়ায় ঢুকলেই নতুন বইয়ের গন্ধ হারিয়ে গেছে আজ। কাকভোরে বাড়ির চাকর হরি কাকা বেরিয়ে পড়তো হাতে থলে নিয়ে দুধ আর রাজারহাটের ভেড়ি থেকে তুলে আনা রুই কাতলা শোল মাগুর কিনে আনতো। সেই কাঁচের বোতলের হরিণঘাটার দুধ হারিয়ে গেছে। আজ নিউটাউনের তলা থেকে সেই রুই কাতলার আর্তনাদ শয়ে শয়ে গাড়ির আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেছে। মনে আছে সেবার বর্ষা কালে যদুবাবুর ঘাটে এক জেলের জালে এক জোড়া ইলিশ উঠেছিলো, একশো টাকা দাম চেয়েছিলো, খবরের কাগজে সেই ছবিও এসেছিলো। ছোটকাকা পরের দিন হেসে বাবাকে বলেছিলো – “তোমাকে বলেছিলাম এবারে এই গঙ্গায় ইলিশ উঠবে।” সেই ইলিশের আর দেখা মেলে না, সবুজ রঙের জল ধীরে ধীরে কালো রঙ নিয়েছে।
মনে আছে একবার দুর্গাপুর থেকে হাওড়া নেমে দেখি হাওড়া ব্রিজে বিশাল জ্যাম, হেঁটে হেঁটে হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে চিতপুর রোডে এসে টানা রিক্সা ধরলাম শিয়ালদা আসার জন্য। আজ সেই টুং টাং বেজে ওঠা টানা রিক্সা হারিয়ে গেছে তার জায়গা নিয়েছে অসঙ্খ্য তিন চাকা ছোট ছোট আটো। বাতাসে শ্বাস নেওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন সময়ে খুব ভোরে ছোট পিসিমাকে নিয়ে শ্যামবাজারের মঙ্গলার হাটে যেতাম। ভোরে আলো ফোটার আগেই সেই হাট বসে যেত, দূর দূর থেকে লোকে আসতো কেনা বেচা করতে। ছোট পিসিমার টাকা থাকলেও একটা বাই ছিলো কমদামে ভালো জিনিস কেনার। পিসেমশাই আর বাবা খুব বকতো, তাও পিসিমা ছাড়তো না, মাসে একবার মঙ্গলার হাটে গিয়ে জামা কাপড় কেনা চাইই চাই। চলত গেঞ্জির দোকানির সাথে বচসা, দশ টাকায় দুটো গেঞ্জি। পিসিমা অনড়, কুড়ি টাকায় সাতখানা নিয়েই ছাড়তো। হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ মাথার মোড়ে চলে যেতাম। ঠিক কোনায় একটা চায়ের দোকান ছিলো, পিসিমা আমাকে চার আনা দিয়ে বলতো “যা পুটু, বাড়িতে তোর বাবা চা খেতে দেবে না ওই দোকানে খেয়ে আয়।” সেই চার আনায় এক খুড়ি ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের চুমুকের আনন্দ হারিয়ে গেছে সিসিডি, বারিস্তার মাঝে। পিসিমার সাথে সাথে সেই মঙ্গলার হাটের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। শনিবারের দুপুরে মা কাকিমা জেঠিমা উঠানে বসে রেডিওতে যাত্রাপালা শুনতো, “শনিবারের বারবেলা……” শয়ে শয়ে মাল্টিপ্লেক্স আর ডিশ টিভির আড়ালে সেই বারবেলা হারিয়ে গেছে। দুপুরে এক ফেরিওয়ালা আসতো ঠিক বাড়ির সামনে এসে হেঁকে যেত, “হরেক মাল পাঁচ সিকা…..” বাড়ির মগ বালতি রুটি সেঁকার জালি সব ওর কাছ থেকেই কেনা হত। দু’কান আর্তনাদ করে আবার সেই ডাক শোনার জন্য, সেই আওয়াজ আজ হারিয়ে গেছে।
মহালয়ার পরেই পাড়ার কর্তারা ধর্না দিত কুমোরটুলিতে, কত দূর হল দুর্গা মায়ের মূর্তি। আজকের দুর্গা হারিয়ে গেছে কর্পোরেট কালোচারে, সেই টানাটানা চোখের মাতৃময়ী মূর্তির জায়গা নিয়েছে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। ষষ্টির বোধনের আগে মায়ের চক্ষু দান, তার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখ থাকত কাপড়ে ঢাকা। আমি, নবীন, পিতু, অনু, সুকন্যাদি, ছোড়দি সবাই রাত জেগে বসে থাকতাম, কখন নন্দন পাল এসে সেই চক্ষু দান করবে। বুড়ো নন্দন পালের সাথে সাথে সেই চক্ষু দানের অধির হয়ে বসে থাকা হারিয়ে গেছে। সেই সময়ে পাড়ায় পাড়ায় পুজোর সময়ে গায়ক গায়িকারা আসতো, ষষ্টি থেকে বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে যেত। নন্দ কাকিমা, সেন কাকিমা, জ্যেঠিমা আর মায়ের হাতে রান্নার ভার পড়ত। একসাথে বসে পুজোর মাঠের ওপরে রঙ্গিন সামিয়ানার নিচে বসে পাত পেড়ে খাওয়া দাওয়া চলতো দশমী পর্যন্ত। আজ ভিড় হয় শয়ে শয়ে গজিয়ে ওঠা ৩৬ বালিগঞ্জ প্যালেস, ওহ ক্যালকাটা, ভজ হরিমান্না ইত্যাদি। মা জেঠিমার হাতের রান্না হারিয়ে গেছে এই বাঙ্গালির মুন্সিয়ানা বাঙালি রেস্টুরেন্টের মাঝে।
বাড়ির পেয়ারা গাছে পেয়ারা হতো, গলির মুখের সেনদের আম গাছে আম হতো, তার পাশের বাড়ির নন্দদের বাড়িতে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ ছিলো। আজ সেই সবুজে ঢাকা পাতা ভরা গাছ গুলো নেই, ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা রক্ত মাংসহীন সারি সারি বহুতল দাঁড়িয়ে। নীল আকাশ দেখা বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কল্লোলিনীর বুকে। সে সময়ে আগমনীর সুরের আগেই বৃষ্টি থেমে যেত, আজকের দিনের গ্লোবাল ওয়ারমিং তখন এই কল্লোলিনীকে ছুঁতে পারে নি। শরতের নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াতো, আজকের দিনের মতন কালো বরষার মেঘের ঘনঘটা ছিলো না। পুজোর বাজার করতে মা মাসি পিসিরা সবাই এক না হয় শ্যামবাজার না হয় হাতিবাগান না হয় গড়িয়াহাট যেত আজকের দিনের ব্যাঙের ছাতার মতন গজানো এক হাজার এক শপিং মলে যেত না। বিয়ের শাড়ি কিনতে সবাই কলেজ স্ট্রীট যেত। ধীরে ধীরে জামা কাপড়ের দোকান বুটিক হয়ে গেল, নাপিত হয়ে গেল হেয়ার ড্রেসার, আর দরজি গুলো ফ্যাশন ডিজাইনারের তকমা লাগিয়ে নিল গায়ে। স্কুলের ছোট ছেলেরা ছাড়া কেউ হাফ প্যান্ট পরে বাইরে বের হত না। ছোট মেয়েদের ফ্রক হাঁটু পর্যন্ত থাকলেও বড় মেয়েদের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা থাকতো। বিয়ের পরে মেয়েরা সে সময়ে জিন্স প্যান্ট পরে বের হতো না খুব একটা, বের হলেও সবার চক্ষু লজ্জা বলে একটা ভাব থাকতো মনের মধ্যে। বরের সাথে দূর দেশে ভ্রমনে গিয়ে হাফ প্যান্ট পরার শখ, জিন্স প্যান্ট পরার শখ মিটাতো বাঙালি মেয়েরা। আজকের মতন পাছার একটু নিচে এসে তাদের স্কার্ট থেমে যেত না। ছেলেরা বাড়িতে লুঙ্গি ছেড়ে বারমুডা পরা শুরু করে দিল, এমন কি বাজারে যেতে হলেও বারমুডা হাফ প্যান্ট। সেই চেক কাটা সাদা কালো নীল রঙের লুঙ্গি হারিয়ে গেল। আজ কাউকে লুঙ্গি পড়তে দেখে লোকে নিম্নবিত্তের মানুষ বলে। বসিরহাটের লাল সাদা ডোরা কাটা গামছার জায়গা নিল রকমারি রঙের তোয়ালে। ছেলেদের জিন্স নিচে নেমে এসে পাছার খাজের নিচে, দুই হাতে, কাঁধে পিঠে রঙ বেরঙের উল্কি আকা। মেয়েদের স্কার্ট দুধ খাওয়া বাচ্চার প্যান্টের চেয়ে একটু ছোট, ঝুঁকলেই দেখা যায় সত্যি কিছু পরেছে নিচে না একদম খালি।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়ে আমি, দেবু আর পচা মিলে খান্নার কাছে একটা গলির মধ্যের মদের দোকান থেকে মদ কিনে খেয়েছিলাম। ভয়ে সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারিনি তিন বন্ধু, বরানগরের কাছে কুটির ঘাটের পোড়ো মন্দিরের চাতালে ঘুমিয়ে কাটিয়ে ছিলাম। সকালো বেলায় ওই গঙ্গার ঘাটে হাত মুখ ধুয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। সে সময়ে মোবাইল ছিলো না তাই মিথ্যে বলতে বিশেষ অসুবিধে হতো না, সবাই সমস্বরে বলেছিলাম শিবপুরের সমরের বাড়িতে রাতে ছিলাম। আজকের কোলকাতা বাড়িতে বসে মদ গেলে, শহরের আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠেছে বার আর মদের দোকান। মদ খাওয়া আজকের কলকাতার আধুনিকতা বড়লোকি মুন্সিয়ানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা ছেলে একসাথে বসে মদ খায় আজকের কল্লোলিনীর বুকে। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ত, বাপরে, বিরাট বড় অপরাধ বলে মনে করা হতো! প্রেম যে লুকিয়ে চুরিয়ে করিনি সে নয়, সবাই একটু আধটু করেছে তবে হাতে হাত দিয়ে বাড়ির আগের স্টপেজ পর্যন্ত দৌড় ছিলো সেই সময়ে, পাছে পাড়ার কেউ দেখে নেয় আর বাবার কানে খবর চলে যায়। আজকের কল্লোলিনী হাতে হাত কেন, কোমরে হাত দিয়ে বাড়ির নিচে ছেড়ে গালে চুমু খেয়ে বলে, “ডার্লিং, রাতে কাপড় খুলে জেগে থেকো আমি ফোন করবো।” ঘুলঘুলির মতন ফ্লাটের, এক চিলতে বারান্দা দিয়ে কেউ দেখলো কি দেখলো না, সেই নিয়ে এই কোলকাতার কোন মাথা ব্যাথা অথবা ভ্রূক্ষেপ নেই।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০২)
আজও মনে হয় এই যেন গতকালের কথা। আমি আর নবীন একটু তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে বেরোবো ভেবেছিলাম, প্রিয়াতে “গুরুদক্ষিণা” দেখতে যাবার কথা। পচা, দেবু আর অনুসুয়াকে জানানো হয়নি, ওরা জানতে পারলে আর আস্ত রাখবে না আমাদের। আসল কথা, সেদিন নবীনের ছোট মামা ওকে দশ টাকা দিয়েছিলো, আর সেই টাকাতেই ওই সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা।
নামতে গিয়েই সিঁড়িতে মধুছন্দার সাথে ধাক্কা খেলাম। এমনিতে খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে মধুছন্দা, কিন্তু একবার খোঁচা মারলে যেন বোলতার চাকের মতন তেড়ে ওঠে। পড়াশুনায় বরাবর ভালো, গত দুই বছরে মেয়েদের মধ্যে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিবীনার মতন ঝাঁঝিয়ে উঠলো মধুছন্দা, “কি রে, দেখে চলতে পারিস না? ঠ্যালা দিয়ে মেরে দিবি নাকি?”
বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে আমাকে দেখে মুখ চুপসে গেল, কেন জানি না। উজ্জ্বল ত্বকের সাথে সেদিনের হালকা গোলাপি শাড়িটা বেশ মানিয়েছিলো। টিকালো নাকের ওপরে চশমাটা একটু ঠেলে দিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলো কিছু উত্তরের জন্য। ওই চোখের আগুনের পেছনে উত্তরের উতসুকতা দেখেছিলাম কিন্তু গলা শুকিয়ে এসেছিলো ওই চাহনি দেখে। কেমিস্ট্রি ল্যাবের সব কেমিক্যাল যেন আমার মাথার ওপরে কেউ ঢেলে দিয়েছিলো বলে মনে হয়।
মাথা চুলকে বিড়বিড় করে কিছু বলার আগেই নবীন ওর ওপরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “এই সিঁড়ি তোর কেনা নাকি যে সারা সিঁড়ি জ্যাম করে নামছিস? মুটকি শ্যামলীকে দ্যাখ, ওই তো সিঁড়ির অর্ধেক জায়গা নিয়ে নামে, বাকিরা নামবে কি করে?”
বলতে বলতে ঝগড়া লেগে যায় নবীন আর শ্যামলীর মধ্যে, “আমি অন্তত তোর মতন হাড়গিলে নই, আমার বাবা খেতে পড়তে দেয়। তোকে দেখে মনে হয় যেন একটা হ্যাঙ্গারে একটা শার্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।”
নবীন একটু রোগা গঠনের, শ্যামলীর ওই উক্তির পরে আরো রেগে ওঠে নবীন, “তোর বাপ কি তোকে হাতির খোরাক দেয়?”
পাশেই দাঁড়িয়ে অনুসুয়া, সঙ্গে সঙ্গে নবীনের কলার ধরে বলে, “একদম বাপ তুলে কথা বলবি না। ওর বাপ ওকে কি খেতে দেয় না দেয় তাতে তোর দেখার কি দরকার।”
আমি নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, “অনু প্লিস এখন ছাড়, সিনেমা দেখতে যাবো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সঙ্গে সঙ্গে মধুছন্দার চেহারার আদল বদলে গেল, বড় বড় চোখ করে উৎসুক হয়ে আমার দিকে প্রশ্ন করে, “কোথায় যাচ্ছিস রে তোরা, কি সিনেমা?”
ওই বড় বড় চোখ দুটো দেখলেই আমার মনের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠতো। মিচকি হেসে উত্তরে বলেই ফেললাম, “প্রিয়াতে গুরুদক্ষিণা চলছে, দেখতে যাবি?”
অনুসুয়া প্রায় আমাকে তেড়ে মারতে আসে, “কলেজ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া হচ্ছে? দাঁড়া কাকিমাকে বলে দেব।”
আমার আর নবীনের ওপরে অনুসুয়ার একটু বেশি জোর খাটে। এক পাড়ায় আমাদের বাড়ি, ছোট বেলা থেকে এক স্কুলে পড়েছি তিনজনে। নবীনের ছোট কাকিমা অনুসুয়ার ছোট মাসি হয়, ওদিকে অনুসুয়ার বাবা আর আমার জেঠুর গলায় গলায় বন্ধুত্ত, দুইজনে ক্যালকাটা পোর্টট্রাস্টে কাস্টমসে চাকরি করেন। বছর পাঁচেক আগে অনুসুয়ার বড়দা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছে, আমার বাবাও ডাক্তার আর বিশ্বজিৎদা বাবার খুব প্রিয় ছাত্র। সব মিলিয়ে তিন বাড়ির মধ্যে অবাধ যাতায়াত। আমাদের বাড়ি আর অনুসুয়ার বাড়ি একান্নবর্তি পরিবার, জেঠা বাবা কাকা সবাই একসাথে থাকে। পুজো পালা পার্বণে একসাথে খাওয়া দাওয়া এমনকি দুই বছর অন্তর বেড়াতে গেলেও একসাথে দল বেঁধে যাওয়া হয়। এক বাস লোক ভর্তি করে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ আলদা।
পেছন থেকে পচা মানে পরাশর চেচিয়ে ওঠে, “”শালা, তোরা দু’জনে নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিলি?”
নবীন চেঁচিয়ে ওঠে আমার দিকে, “মুটকি যখন আমার কলার ধরলো তখন মুখে বুলি ফোটেনি। আর যেই ন্যাকা সুরে ডাক দিল, কি সিনেমা অমনি সুর পালটে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবি? বাড়ি চল শালা, তোর গাঁড়ে আস্ত শাল না ঢুকিয়েছি আমার নামে কুত্তা পুষিস!”
অনুসুয়া কাছে এগিয়ে মিচকি হেসে কানেকানে ফিসফিস করে বলে, “কি রে পুটু, কিছু চলছে নাকি?”
আমি মাথা নেড়ে জানালাম কি বলছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না, যদিও সব কিছু জলের মতন ঘোলাটে আমার সামনে। অনু একবার আমার মুখের দিকে তাকায়, একবার মধুছন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে দেয়। মধুছন্দার কান লাল হয়ে যায় সেই চোরা হাসি দেখে।
ওদিকে দেখলাম এ যে বড় বেগতিক নবীনকে কিছুতেই খোঁচানো যাবে না। সেই মদ খাওয়ার দিনে আমাদের দেখে ফেলেছিলো, সেই থেকে আমাকে আর পচাকে ব্লাকমেল করে রোজ এক প্যাকেট চারমিনার কেনে। লুকিয়ে চুরিয়ে বিড়ি সিগারেট খাওয়ার অপরাধ সেইসময়ে মার্জনা করে দিতেন বাড়ির বড়রা। কিন্তু মদ গেলা, গাঁজা টানা নৈব চ নৈব চ, একবার বাবা জেঠার কানে কথা গেলে পিঠের ছাল গুটিয়ে খোল বানিয়ে তবে ছাড়বে। ভাগ্য ভালো যে সেই মদের কথা অনুসুয়ার কানে যায়নি না হলে আমরা আর আস্ত থাকতাম না। তখন আমাদের ক্ষমতা ওই বিড়ি থেকে চারমিনার পর্যন্ত ছিলো তাই নবীন ওর ওপরে কোনোদিন ওঠেনি।
ওদিকে শ্যামলী আর অনুসুয়া বেঁকে বসে, দেবাশিসের সাথে কিছুতেই সিনেমা দেখতে যাবে না। বেশ কয়েকদিন আগে দেবাশিস অনুসুয়াকে ডাকতে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে আর তাতে ওর শাড়ির আঁচল একটু খসে যায়। ধুন্ধুমার কান্ড শুধু ঘটতে বাকি ছিলো সেইদিন যদি না ওই মধুছন্দা এসে মধ্যস্থতা করতো, শ্যামলী আর অনুসুয়া মিলে দেবুর কাপড় খুলিয়ে ছেড়ে দিত।
তালে বেতালে ঝগড়া কথা কাটাকাটিতে সেদিন আর সিনেমা দেখা হলো না। শেষ পর্যন্ত সবাইকে বাঁচিয়ে অনু প্রস্তাব দিল কফিহাউসে যাওয়ার। মেয়েদের দলের মধ্যে আর ছেলেদের দলের মধ্যে ওই একমাত্র যোগসূত্র। যেমন কথা তেমনি কাজ, বাসে চেপে সেই যাদবপুর থেকে সোজা কলেজ স্ট্রিট। মাঝে মধ্যেই একটা ঝগড়া লাগতো। এক না হয় পচার সাথে শ্যামলীর না হয় দেবুর সাথে অনুসুয়ার, আমাকে আর নবীনকে সামাল দিতে হতো, আর মধুছন্দা চুপচাপ একদিকে দাঁড়িয়ে মিচকি হাসতো ওদের কান্ডকারখানা দেখে। কলেজের বাইরে হোক কি ভেতরে হোক, বিশেষ মিশুকে না হলেও ওকে সবসময়ে সঙ্গে রাখত অনুসুয়া। তবে আমাদের ঝগড়াঝাটি কোনোদিন কলেজ চৌহিদ্দির বাইরে যায়নি, কলেজের গেটের বাইরে এই সাত জনের এক অন্য রুপ। তার মূলে অবশ্য আমি আর অনুসুয়া, কিছু না কিছু করে সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম। দেবু, অনুসুয়ার সাথে আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে ওস্তাদ, জানে শুধু ঝগড়ার মাধ্যমে ওর সাথে কথা বলতে পারবে কিন্তু মনের কথা বলার সময়ে ওর হাঁটু কাঁপতো। মাঝে মাঝেই আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতো ওই সুন্দরী অনুসুয়ার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। গতবারে স্বরস্বতী পুজোর সময়ে একটা ছোট হাতির দাঁতের লকেট কিনেছিলো ভেবেছিলো অনুসুয়াকে দেবে। শেষ পর্যন্ত নিজে হাতে দিতে পারলো না, আমার হাত দিয়েই দেওয়া করিয়েছিলো। সেই হাতির দাঁতের লকেট পেয়ে বড় বড় চোখে কটমট করে তাকিয়েছিলো অনুসুয়া।
আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “কেন তোর এত রাগ ওর ওপরে একবার খুলে বলতো?”
অনুর উত্তর, “দূর শালা, সবসময়ে কেমন ভাবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।”
আমি বললাম, “কেন তাকাবে না বল? তুই ক্লাসের সেরা সুন্দরী, তোর দিকে সবার নজর। আর আমাদের ব্যাচে কটা মেয়ে বলতো? কড় গুনে সাতজন।”
ঠোঁট উলটে নাক বেঁকিয়ে হেসে বলে, “খুব সুন্দর হয়েছে লকেটটা ওকে বলে দিস। আর হ্যাঁ, তুই কবে কাকে দিচ্ছিস এই রকম একটা লকেট?”
আমি উত্তরে জিজ্ঞেস করি, “কাকে দেওয়া যায় বলত এই রকম লকেট? তোকে একটা দিলে কেমন হয়?”
ঠোঁট কামড়ে উত্তর দেয় অনুসুয়া, “আমাকেই দিস একটা, তোর হয়ে মধুছন্দাকে দিয়ে দেবো।”
বর্তমানে অনুসুয়া, দেবুর অফিস ফেরার পথ চেয়ে অধির আগ্রহে বসে থাকে, সেই গল্প আলাদা। সে নিয়ে পরে অবশ্য আমরা অনেক হাসাহাসি করেছি প্যারিসে দেবুর বাড়িতে বসে। পচা এখন বোর্দে থাকে, মাঝে মাঝেই হানা দেয় দেবুর বাড়িতে। সময় পেলেই নবীন ফ্লাইট ধরে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে চলে আসে দেবুর বাড়িতে। দামী চুরুটের পাতা ছিঁড়ে সেই কল্লোলিনীর চারমিনারের স্বাদ খুঁজতে চেষ্টা করি সবাই। একসাথে বসলেই শ্যামলীকে ফোন করা হয় আর ওন্টারিও থেকে ফোনে আমাদের মুন্ডপাত করে। কোন কোন মাসে লন্ডনের ব্রিক লেনে আমার বাড়িতে আড্ডা বসে। কখনো থেমসের জল দেখে, অথবা রাইন, অথবা গারননের জল দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যাই সবাই, সবার বুকে যে গঙ্গা আঁকা সেই মাধুর্য নেই এই জলে।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৩)
সেই সময়ে হাত খরচ বাবদ প্রতিদিনের বরাদ্দ ছিলো পাঁচ থেকে সাত টাকা। যদিও অনুসুয়ার বাড়িতে আর আমাদের বাড়িতে দুটো করে গাড়ি কিন্তু সেই গাড়ি আমাদের জন্যে নয়। ট্যাক্সি চাপার বাহুল্য আমাদের কপালে ছিলো না তাই বাসে চেপে যাওয়া হল কফি হাউসে। আমি বারেবারে আড় চোখে মধুছন্দার দিকে তাকাই। চশমার আড়ালে ওই দুই উজ্জ্বল চোখের থেকে চোখ ফেরানো বড় কঠিন। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সামনে পুজো তাই আকাশ বেশ পরিষ্কার আর সেই মৃদু রোদে ওর ত্বক যেন আর শত গুন ঝকমক করছে। মাঝে মাঝেই ওর চোখের সাথে আমার চোখ মিলে যেত আর ভুরু কুঁচকে মৃদু এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত আমার দিকে, “কি দেখছিস ওই ভাবে?”না, কোন উত্তর নেই আমার কাছে। কি করে বলি ওই দুই উজ্জ্বল চোখের হাতছানিতে ভেসে যাওয়ার কথা।
পুজোর গল্পে, গরমের ছুটিতে আমরা সবাই মিলে দেরাদুন মুসৌরি ঘুরতে গেছিলাম সেই গল্পে, কলেজের প্রফেসারদের মুন্ডপাত করা এই সবে কখন যে দুই ঘন্টা কেটে গেল ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। দুই ঘন্টা টানা আড্ডা মেরে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে পচা আর দেবু বাসে চেপে চলে গেল, ওদের বাড়ি বেলুড়। শ্যামলী সেই সময়ে থেকেই লুকিয়ে প্রেম করতো মেকানিকালের ফাইনাল ইয়ারের ঋতুরাজের সাথে। একটু পরে যথারীতি ঋতুরাজের বাইকে চেপে বাড়ি উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল শ্যামলী। আমার আর নবীনের বাড়ি ফেরার বিশেষ ইচ্ছে ছিলো না, ভেবেছিলাম হাওড়া ব্রিজের তলায় বসে একটু গাঁজার কলকেতে টান দেব। অনুসুয়াকে বললাম যে আমাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।
সেদিন আবার অনুসুয়ার মনে বান্ধবী প্রীতি জেগে ওঠে আর মধুছন্দাকে নিজের বাড়ি ডাকে। মধুছন্দার বাড়ি বেহালা আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। প্রথমে বেশ ইতস্তত করে মধুছন্দা, সন্ধ্যে হলে কি করে বাড়ি ফিরবে, বাড়িতে বলা নেই, মা চিন্তা করবে ইত্যাদি। অনুসুয়া ওকে বুঝিয়ে বলে যে বাড়ি গিয়ে ওর বাড়িতে একটা ফোন করে দিতে তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেই শুনলাম যে মধুছন্দা অনুর সাথে যাবে অমনি আমার কলকে সেবনের কথা মন থেকে উধাও হয়ে গেল। একসাথে এক বাসে যাওয়া যাবে সেই ভেবেই যেন মন নেচে উঠলো। নবীনকে বলে কয়ে রাজি করালাম যে গাঁজা অন্য দিনে টানা যাবে। অনুসুয়া আমার মনের অভিপ্রায় ধরে ফেলেছিলো আর তাই হেসে বললো চলে আসতে।
বাসের জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে চারজনে, বারেবারে চার চোখ এক হলেই চোরা হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে মধুছন্দা। অনুসুয়া বললো যে অনেকক্ষণ ধরে আমরা দাঁড়িয়ে, একটা ট্যাক্সি করে গেলেই ভালো হয়। মধুছন্দার সাথে এক ট্যাক্সিতে যাবো, আমার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। নবীন মাথা চুলকে জমানো দশ টাকা বের করে দিল, সেই সাথে আমিও পাঁচটাকা বের করলাম। চারজনের কুড়িয়ে বাড়িয়ে পঁচিশ কি ত্রিশ টাকা জমা হল। যথারীতি ট্যাক্সিতে চাপা হল, পেছনের সিটে অনুসুয়া, মধুছন্দা আর নবীন। আমি ইচ্ছে করেই আর পেছনের সিটে বসিনি, কিঞ্চিত দ্বিধায় কিঞ্চিত কাষ্ঠতায়। কফি হাউসে বসে যেমন আমাদের দুইজনের মধ্যে সরাসরি কোন কথাবার্তা হয়নি তেমনি ট্যাক্সিতেও হল না। মাঝে মধ্যে অনুসুয়ার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ, না বলি।
যেতে যেতে মধুছন্দা অনুকে প্রশ্ন করে, “তোদের বাড়ির মধ্যে তোদের এই মেলামেশা নিয়ে কোন অসুবিধে নেই?”
অনু হেসে জবাব দেয়, “কি যে বলিস না তুই। আমাদের তিন বাড়ির মধ্যে অন্য এক যোগসুত্র আছে, নবীনের কাকিমা আমার ছোট মাসি হয়। আমার দাদা ডাক্তার, পুটুর বাবার ছাত্র। সেই ছোট বেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি তিন জনে। একসাথে ঘুরতে যাওয়া, একসাথে ওঠা বসা। পুটুর বাড়ির পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে খাওয়া থেকে সেনেদের বাড়ির আম গাছ থেকে আম চুরি করে খাওয়া, সব একসাথে করেছি। শীত কালে ওর জেঠিমা ছাদের ওপরে আচার বানিয়ে রাখত আমি আর ওর ছোড়দি মিলে অর্ধেক আচার উড়িয়ে দিতাম।”
কলেজের কেউ জানতো না যে আমার বাড়ির নাম পুটু, সুতরাং মধুছন্দার প্রশ্ন, “এই পুটু কে?”
অনু আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “পার্থর বাড়ির নাম পুটু, আবার কলেজে গিয়ে ঢাক পিটিয়ে দিস নে যেন।”
মধুছন্দা আমার দিকের পেছনে বসেছিলো, সামনে একটু ঝুঁকতেই ওর গায়ের গন্ধে কেমন যেন মাতাল হয়ে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোকে দেখে তো বোঝা যায় না যে তুই এত বাঁদর ছেলে?”
আমি হেসে জবাবে বললাম, “তুই মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করিস না তাই জানতে পারিস নি।”
অনুসুয়ার হাত খানি হাতের মধ্যে নিয়ে লাজুক হেসে জবাব দেয়, “কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আর তোদের মধ্যে থাকলে স্বস্তি পাই তাই।”
অনুসুয়া ওকে বলে, “”এক কাজ করিস এইবারে, পুজোতে আমাদের এখানে চলে আসিস। এখানেই খাওয়া দাওয়া সবকিছু। সব থেকে বড় ব্যাপার, অষ্টমীর রাতে যাত্রা পালা এবারে মন্টু গুপ্ত আসতে পারে।”
মন্টু গুপ্তের কথা ঠিক কানে পৌঁছাল না মধুছন্দার, ওর মাথায় বাড়ি ফেরার চিন্তা ভর করে আসে। তাই অনুকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে আমি বাড়ি কি করে যাবো?”
অনু উত্তর দেয়, “সে নিয়ে তোর এতো চিন্তা করতে হবে না। নবীন না হয় পুটু তোকে দাদার বাইকে করে ছেড়ে আসবে।”
নবীনকে একটা গুঁতো মেরে অনু জিজ্ঞেস করে, “তোর মনে হয় সময় হবে না তাই তো? বাড়ি ফিরে তো টিউশানি করার আছে।”
বুঝলাম ইচ্ছে করেই অনুসুয়া আমার পথ পরিস্কার করে দিল, যাতে সন্ধ্যেবেলায় মধুছন্দাকে নিয়ে বাইকে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি। বড় রাস্তায় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। অনু আর মধুছন্দা মিষ্টির দোকান থেকে বাঁক নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একবারের জন্য আমার মনে হল যেন মধুছন্দার ঠিক ইচ্ছে নেই অনুর বাড়ি যাওয়ার, থমকে গিয়ে কি আমার দিকে পেছন ঘুরে তাকিয়েছিলো না আমার চোখের ভুল?
অনু আমাকে বললো, “এই, তুই সাতটা নাগাদ চলে আসিস ততক্ষণে দাদা বাড়ি ফিরে আসবে।”
আহ্লাদে আটখানা কি করে মানুষে হয় সেদিন বুঝেছিলাম। বাড়ি ফিরে সময় যেন আর কাটে না। আমার ঘর তিনতলায়, খাটে শুয়ে লুকিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে বিকেলের কথা, ট্যাক্সিতে আসার কথা আর সাতটা কখন বাজবে সেই চিন্তায় ডুবে গেলাম। এর মাঝে বার দুই ছোট বোন এসে ডাক দিয়ে গেল, কারুর কথার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারুর কথাই মাথায় সেদিন আর ঢোকেনি। মাথায় শুধুমাত্র একটাই চিন্তা কখন সাতটা বাজবে আর আমি একদৌড়ে সোজা অনুর বাড়িতে যাবো। ঘড়ির কাটা পৌনে সাতটা ছুঁতে পারেনি কি জামা গলিয়ে জেঠিমাকে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। মা কাকিমার হাতের সামনে পড়লে শত প্রশ্ন আমাদের সাত ভাই বোনেদের একমাত্র সম্বল জেঠিমা। জেঠিমা নিজে স্কুলের গন্ডি পার হয়নি সেই একটা দুঃখ ছিলো তাই মা’কে আর কাকিমার পড়াশুনা করাতে ছাড়ায়নি। মা একটা মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আর কাকিমা কলেজের কেমিস্ট্রির লেকচারার। বাড়িতে দুই শিক্ষিকা থাকলে যা হয় বাড়িটাও কয়েদ খানার মতন মনে হয় তবে ওই জেঠিমার জন্য কয়েদখানা থেকে সব ভাই বোনেরা রেহাই পেয়ে যেতাম।
যাবার আগে সাবধান বাণী শুনিয়ে দিলেন, “বেশি রাত করিস নে, যেন তাহলে কিন্তু সামলাতে পারবো না।”
আমি বললাম, “আরে না না, বেশি রাত করবো না। তাড়াতাড়িই চলে আসবো।”
এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে অনুর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ির উঠানে মোটর সাইকেল দেখে বুঝতে পারলাম যে বিশ্বজিৎদা বাড়িতে আছে, তার মানে মধুছন্দাকে নিয়ে অনায়াসে বাইকে চেপে কালিন্দি থেকে বেহালা পাড়ি দেওয়া যাবে। মনের মধ্যে যেন উত্তম সুচিত্রার “এই পথ যদি না শেষ হয়…..” বেজে উঠলো।
অনুর বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার তাই সোজা ওর ঘরে যেতে কোন অসুবিধে হলো না। পর্দা সরিয়ে একটু উঁকি মেরে দেখালাম দুই বান্ধবী বিছানার ওপরে আধাশোয়া হয়ে গল্পে মশগুল।
মধুছন্দার পিঠ দরজার দিকে, উপুড় হয়ে বুকের নিচে একটা বালিশ দিয়ে শুয়ে। হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করার ফলে শাড়ির পাড় গুটিয়ে হাঁটুর কাছে চলে এসেছে। ফর্সা পায়ের মসৃণ গুলি দেখে বুকের রক্তে হিল্লোল লেগে গেল। ক্ষুধার্ত বাঘের মতন লোলুপ দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইলাম ওই মসৃণ পায়ের গুলির দিকে। পাতলা শাড়ির পরতে ঢাকা নধর দেহ পল্লব যেন ঢেউ খেলে বিছানার ওপরে মেলে রয়েছে জল থেকে সদ্য ওঠা কোন এক অচিনপুরের জলপরী।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৪)
আমি বেশ কিছুক্ষন ওইখানে দাঁড়িয়ে মধুছন্দার অপরূপ মাধুর্য দুই চোখে আকণ্ঠ পান করে গলা খাঁকড়ে জানান দিলাম যে সারথি প্রস্তুত। আমার চোখের রক্তিম আভা দেখেই মনে হয় মধুছন্দা বুঝতে পেরে গেছিলো যে আমি ওইখানে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করে গেছি। আমার গলার আওয়াজ শুনেই ধড়মড় করে উঠে বসে শাড়ি ঠিক করে নিল সেই সাথে অনু নিজের বেশভূষা ঠিক করে নিল।
অনু আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, “কি রে কখন এলি?”
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম, “এই তো, এক্ষুনি এলাম।”
অনু আমাকে নিচে বসতে বললো আর বললো যে কিছুখনের মধ্যে মধুছন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আমি জানি কাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে আর সেই পূণ্য কর্মের জনেই আমার প্রত্যাবর্তন। নিচের বসার ঘরে বসে কাকিমার হাতের চা খেতে খেতে উৎকণ্ঠায় শুধু ঘড়ির দিকে দেখি, কখন যে মধুছন্দা বের হবে আর খালি রাস্তা দিয়ে আমরা দুইজনে বাইকে করে যাবো। দিদিদের নিয়ে বাইকে যাওয়া অথবা অনুকে নিয়ে বাইকে যাওয়া আলাদা কথা, সেই প্রথম সত্যিকারের কোন বান্ধবীকে বাইকে বসিয়ে যাওয়া ভাবতেই যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ার যোগাড়।
নিচে নেমেও যেন ওদের গল্প আর শেষ হয় না, কিছু বলতেও পারছি না শুধু মাত্র আড় চোখে দুইজনের দিকে মাঝে মাঝে তাকাই। পাঁচ মিনিট করতে করতে প্রায় আধা ঘন্টা পরে অনু মধুছন্দাকে ছাড়ল। বাইকের পেছনে বেশ আড়ষ্ট হয়ে একটু তফাৎ রেখে বসল। বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে অনু আমাকে সাবধান বাণী শুনিয়ে তবে ছাড়লো। আমাকে ইশারায় জানিয়ে দিল যে এর ঘুষ দিতে হবে। আমিও মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলাম যে দিতে প্রস্তুত আমি।
গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত বেশ আস্তে আস্তে চালালাম, ইট পাতা রাস্তা বাইক নিয়ে চলা একটু মুশকিল। তাও বেশ সামলে চলতে হল কারন পেছনে যে বসে তাকে বেশি ঘাঁটানো যাবে না পাছে কি ভাবতে কি ভেবে বসে। বড় রাস্তায় বাইক চড়াতেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। সিট ধরে বসে থাকা হাত খানি আমার ডান কাঁধে উঠে এল। খোঁপা খুলে এলো চুল আমার ঘাড়ের ওপরে এসে দোল খেতে লাগলো।
কিছু মনে হয় বললো, কারন আমার কাঁধের ওপরে থাবা বেশ জোড়ালো হয়ে গেল। গাড়ি একটু ধীরে করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? ফিসফিস জড়ানো কণ্ঠে আমাকে একটু ধীরে চালাতে অনুরোধ করলো। আমার যেমন এই প্রথম কোন বান্ধবীকে নিয়ে বাইকে চাপা তেমনি মধুছন্দার সেই প্রথম কারুর সাথে বাইকে চাপা। দুইজনের মধ্যেই কেমন একটা আড়ষ্টভাব প্রতি নিয়ত ফুটে উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে উঠলাম।
কানে ভেসে এল দূর থেকে এক নারীর কণ্ঠস্বর, “তুই কি এর পরেও পড়াশুনা করবি না চাকরি করবি?”
ঠিক শুনতে পারিনি ওর কথা তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কি বলছিস?”
মধুছন্দা জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি এম টেক করবি না এর পরে চাকরি করবি?”
উত্তরে বললাম, “না রে এখুনি চাকরি করার কোন মতলব নেই আমার। বি টেক করার পরে এম টেক, পি এইচ ডি রিসার্চ যা আছে সব করব আর বাড়ির অন্ন ধ্বংস করব। বাবা জেঠার এত পয়সা খাবে কে? তুই কি করবি?”
মিহি কণ্ঠে উত্তর এলো, “না রে, এই ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যন্ত আমার দৌড় এর পরে আমাকে চাকরি করতে হবে। মা অনেক কষ্টে এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর টাকা যোগাড় করেছে। এর পরে বাড়ির দায়িত্ত, ছোট ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ত আমাকেই সামলাতে হবে। দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, বাড়িতে টাকা দেয় না।”
বুঝতে পারলাম যে মধুছন্দার বাবা গত হয়েছেন, কণ্ঠে একটা না বলা অব্যক্ত বেদনা ফুটে উঠলো ওর, বেশ কিছু দূর দুইজনেই চুপচাপ থাকলাম।
গাড়ির গোঁগোঁ আওয়াজ বড় একঘেয়ে লাগছিলো তাই আবার আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পুজোতে আমাদের এখানে আসবি? আমাদের এখানে যাত্রা নাটক হয়”
উদাসিন কণ্ঠের উত্তর, “জানি না রে। ভাবছিলাম মামাবাড়ি যাবো, অনেকদিন যাওয়া হয়নি।”
প্রশ্ন করলাম, “তোর মামাবাড়ি কোথায়?”
উত্তর এলো, “জলপাইগুড়ি।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুই নাটক যাত্রা পালা এই সব দেখিস?”
উত্তরে জানালো, “নাহ সেই সময় কোথায় আমার। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে একগাদা টিউশন থাকে নিজের পড়াশুনা থাকে এই সবে সময় চলে যায়।২
প্রশ্ন করলাম, “আজকে টিউশন ছিলো না?”
উত্তর এলো, “তোর আর অনুর টানাটানিতে আজকে আর হল না, শনিবার ওদের পড়িয়ে দেব খানে।”
সেই সময়ে মেয়েদের সামনে গোঁফে তা দিয়ে সিগারেট খাওয়া খুব বড় ব্যাপার। মনের এক কোনে সেই অভিপ্রায় জেগে উঠলো তাই বাইক দাঁড় করালাম একটা পানের দোকানের সামনে। বাইক থামাতেই মধুছন্দা কারন জিজ্ঞেস করলো, আমি জানালাম যে একটা সিগারেট ধরাবো। পকেটে দুটি চারমিনার পরে আছে একটা বের করে ধরাতে যাবো তখন মধুছন্দা আমাকে চারমিনার খেতে বারন করলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল, তুই ও কি আমাকে সিগারেট খেতে দিবি না?”
হেসে জবাব দিল, “আমি না বললে তুই শুনবি না, তবে ওই সাদা কাগজে মোড়া বিড়ি ধরাস না, ওর গন্ধ বড় বিটকেল। এই নে এক টাকা, অন্য কোন সিগারেট নিয়ে আয়।”
আমার চক্ষু চড়ক গাছ, “তুই আমাকে সিগারেট খাবার পয়সা দিবি!”
হেসে জবাব দিল, “জানি জানি তোদের বরাদ্দ বাবদ কত হাত খরচ। আজকে পার্স ঝেড়ে পাঁচ টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়েছিস, তোর পকেটে কোন পয়সা নেই সেটা জানা আছে।”
অনু আর ছোড়দি আমার ব্যাঙ্ক কিন্তু সেই কথাও যে অনু ওকে বলে দেবে সেটা ভাবিনি। আমি মনে মনে অনুর মুন্ডপাত করলাম কিন্তু ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিগারেট খাব সেটা ঠিক মনে ধরলো না। তাই ওই চারমিনার ধরালাম।
ওর একটু অভিমান হলো আর অভিমানিনী কণ্ঠে আমাকে বললো, “অনুর কাছ থেকে টাকা নিতে তোর বাধে না, তাহলে আমার কাছ থেকে কেন বাধে?”
কি করে ওকে বুঝাই, অনুসুয়া আর ওর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। অনু আমার বান্ধবী, আমার দিদি, আমার বোন আমার অনেক কিছু, আর মধুছন্দা এখন পর্যন্ত ঠিক কোন পর্যায় এসেছে সেটার ঠিক নেই।
আমি হেসে জবাব দিলাম, “আজকে ট্যাক্সিতে তোর টাকাও গেছে, কালো তোর পয়সায় আমাকে সিগারেট খাওয়াস।”
উত্তরে বললো, “না অনু আমাকে পয়সা দিতে দেয়নি।” ঘড়ির দিকে দেখে আমাকে বললো, “এবারে একটু তাড়াতাড়ি চল, বাড়িতে মা একা চিন্তা করবে।”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “মাসিমাকে ফোন করে দিয়েছিস তাহলে এত চিন্তা কেন?”
আমার মাথার পেছনে আলতো চাঁটি মেরে জবাব দিল, “তাই বলে কি এই কোলকাতার রাস্তায় তোর সাথে রাত কাটাবো?”
আমি ওকে হেসে বললাম, “এবারে বুঝলি তোর আর অনুর মধ্যের তফাৎ। আমি নবীন অনু যদি কোথাও এক রাত কাটিয়ে আসি অথবা এক বিছানায় শুয়ে থাকি তাহলেও ঘুম ছাড়া গল্প ছাড়া কিছু হবার নেই অথবা কেউ আমাদের দিকে আঙ্গুল পর্যন্ত তুলবে না।”
আমি বাইকে বসে পড়লাম, এবারে আগের সেই জড়তা ভাব কাটিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বসল। ওই চাঁপার কলি আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমার শরীরের সহস্র ধমনীতে রক্ত প্রবাহ শত গুন বেরে গেল। বাইক চালিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে গান বেজে উঠলো।
আমি ওকে বললাম, “মামাবাড়ি না গেলে চলে আসিস আমাদের এখানে। অনু তো থাকবেই, তোর কোন অসুবিধে হবে না।”
মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ অনু থাকবে, ভয় তো আর ওকে নিয়ে নয়। ভয় অতি অচেনা একটা বাঁদরকে নিয়ে। হঠাৎ করে যদি আমাকে খামচে দেয় তাহলে কি হবে?”
এই মস্করার একটা যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আর হচ্ছে না। আমি ওকে বললাম, “বাঁদর কে খোঁচালে তবেই বাঁদর কামড়ায়, হঠাৎ করে কোন জড় বস্তুর ওপরে বাঁদর আচমকা হামলা করতে যাবে কেন?”
খোঁচাটা বেশ হয়েছে তাই খিল খিল করে হেসে বলে, “কে বলেছে আমি জড় বস্তু?”
আমি উত্তরে বললাম, “কলেজে তো সাত চড়ে রা করিস না।”
উত্তরে বললো, “আমি ওই রকম বেশি কথা বললে বাচাল বলে মনে হয়। তাই নিয়ে মামাবাড়িতে আমাকে সবাই নাক উঁচু বলে ভাবে। কিন্তু কি করার আছে বল?”
এর উত্তরে কিছু বলার নেই আমার। বেহালা, শখেরবাজার চলে এল, বড় রাস্তায় নামিয়ে দিতে হল ওকে বাড়ির সামনে যদি বাইক থেকে নামে তাহলে আবার পাড়ার কেউ দেখে ফেলতে পারে আর সেই নিয়ে কথা শোনা। আমিও বেশি জোর করলাম না ওকে। যাই হোক দুইজনের মধ্যের জড়তা একটু কেটেছে, আষাঢ়ের মেঘ কেটে শরতের পরশ লেগেছে। চলে যাবার আগে বেশ কিছুক্ষণ আমার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। কিছু শোনার অপেক্ষায় না কিছু বলার অপেক্ষায়?
আমি তাও আগ বাড়িয়ে বললাম, “এই টুকু ছেড়ে দিলে হতো না? রাত নটা বাজে একা একা যেতে পারবি তো?”
মিষ্টি হেসে জবাবে বললো, “এই টুকু যাবার ক্ষমতা আছে। এই সময়ে তোর সাথে বাড়ির সামনে নামলে অনেকের ভুরু কুঁচকাতে পারে। আর হ্যাঁ, কালোকে ইনরগ্যানিকের নোটস দিস তো।”
“ঠিক আছে” বলে দাঁড়িয়ে থাকলাম যতক্ষণ না সাপের মতন বেনুনি দুলিয়ে ওই গলির বাঁকে হারিয়ে গেল মধুছন্দা।