রোদে ভেজা তিলোত্তমা [২]

Written By pinuram

রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৫)
সকালে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অনুর প্রশ্ন, “কি ব্যাপার, সব ঠিকঠাক? রাতে ঘুম হয়েছে?”
না, সেই রাতে আমার দুই চোখে ঘুম আসেনি, সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়েছিলাম। আমার সারা গায়ে যেন মধু মধু গন্ধ মিশে ছিলো। ডান কাঁধে যেখানে হাত রেখে সারা রাস্তা এসেছিলো মনে হচ্ছিল এখন পর্যন্ত সেইখানে ওই কাঁধে চাঁপার কলি আঙ্গুল রাখা।
দিন যায় আর ভোরের ফুটন্ত শিউলির মতন ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে কবে দুইজনে বেশ মিশে গেলাম সেটার ঠিক নেই। সবার চোখের আড়াল হলেও অনু ঠিক বুঝেছিলো আমাদের দুইজনের মাঝের ওই অদৃশ্য বন্ধন। সর্ব সমক্ষে চোখে চোখ রেখে কথা বার্তা বলতে সাহস পেত না মধুছন্দা তবে ওই কলেজের মধ্যে একটু দেখা একটু কথা বলা অথবা বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে একটু গল্প করা পর্যন্ত আমাদের সময় সীমা সীমিত ছিলো। কোনোদিন যদি বলতাম আজকে একটু দেরি করে বাড়ি গেলে হয় না? হেসে জবাবে বলতো বাসে চেপে বাড়ি পর্যন্ত যেতে। আর তার ফলে যাদবপুর থেকে বেহালা বাসে চেপে যাওয়া আর গল্প করা। কিছু একটা অছিলায় অনুকে ক্ষান্ত করতে হতো, কিন্তু ওর শ্যেন নজর এড়ান বড় মুশকিল। কিছুতেই সময় করে মধুছন্দাকে একা পাওয়া যায় না, অনু না হয় শ্যামলী না হয় বনানী কেউ না কেউ ওর সাথে সবসময়ে থাকে। কলেজ শেষ হলেই সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বুঝি এই বয়সে মাথায় অনেক চিন্তা আর সেই কারনে ওকে কোনোদিন জোর করার ভাবনা আমার মাথায় আসেনি।
দেখতে দেখতে কাছে এসে গেল বিশ্বকর্মা পুজো। আমিও ছোড়দির পার্স ঝেড়ে কুড়ি টাকা জমিয়ে ফেললাম, এবারে একান্তে কোথাও একটা যেতেই হবে ওকে নিয়ে।
কলেজের পরে মধুছন্দাকে এক দিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম, “বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে বেড়াতে যাবি?”
প্রশ্ন করলো রমণী, “কে কে যাবে?”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, আমি কিনা ওকে নিয়ে একা কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই, ওদিকে মধুছন্দা সবাইকে নিয়ে যেতে চায়। বার কয়েক ঢোঁক গিলে ওকে বললাম, “শুধু আমি আর তুই।”
চশমার আড়াল থেকে বড় বড় কাজল টানা চোখে আমার দিকে শ্যেন দৃষ্টি হেনে বললো, “মোটেই নয়। অনু, দেবাশিস, পরাশর সবাইকে ডেকে নিলেই হয় সবাই বেশ মজা করতে করতে যাবো। সবাই যদি যায় তাহলে যেতে রাজি আছি।”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “এ কিরে সবাই কেন?”
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিচকি হেসে বললো, “ওই যে বলেছিলাম না, একটা বাঁদর কে ভরসা করা বড় দুস্কর সেই কারনে।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “একা অনু যেতে পারে অন্য কেউ নয়।”
মুখ খানি লাল করে হাসি চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “থাক আর ওই বেচারাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?” কাছে এসে বাজুর ওপরে চিমটি কেটে বললো, “সবার কাছ থেকে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কিছু করার মতলব নেই তো তোর?”
খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে ওইখানে জরিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলি, লুকিয়ে রাখবো বুকের মধ্যে কারন তুই অমূল্য। ওর দিকে ঝুঁকে বললাম, “অনেক দূরে কোথাও যাবো, তবে এখন ঠিক করিনি কোথায়।”
ওর চোখ দুটো ভাসা ভাসা হয়ে উঠলো পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বললো, “তুই থাকবি পাশে তাহলে যেতে রাজি।”
সেদিন ওকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু বাসে চেপে ওর বাড়ি পর্যন্ত সারা রাস্তা একদম চুপচাপ। ওর বাড়ির বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। সন্ধে তারার সাথে সাথে একে একে রাস্তার বিজলী বাতি জ্বলে উঠলো। সময়টা যদি দাঁড়িয়ে যেত সেদিন তাহলে বড় ভালো হত।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করলো, “শাড়ি পরবো না সালোয়ার কামিজ?”
আমি একটু ওর দিকে ঝুঁকে গেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ও পেছনে সরে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নাকে ভেসে এলো ওর গায়ের মিষ্টি গন্ধ সেই গন্ধ বুক ভরে টেনে নিয়ে বললাম, “কাপড়ে কি আসে যায় তুই যা পরবি তাতেই সুন্দরী দেখাবি।”
হাত বাড়ালাম ওর হাতের দিকে কিন্তু এপাস অপাস দেখে হাত টেনে মিষ্টি হেসে বললো, “আজ আসি, পরশু তাহলে ন’টায় এস্প্লানেড ট্রাম ডিপোর সামনে দেখা হচ্ছে।”
দুইদিন পরে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বাড়িতে বললাম যে বন্ধুদের সাথে মায়াপুর ঘুরতে যাচ্ছি। জেঠিমা জিজ্ঞেস করেছিলো যে অনু নবীন যাচ্ছে কি না। আমি বলেছিলাম যে না ওরা যাচ্ছে না তবে অন্যরা যাচ্ছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে সেটা জানিয়ে দিলাম। অনু আর নবীন জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে। ঠিক ঘড়ি দেখে সাড়ে আটটা নাগাদ এস্প্লানেড বাস স্টান্ডে পৌঁছে গেলাম। জানি আধা ঘন্টা আগেই পৌঁছেছি তাও মন মানে না, একটু কি তাড়াতাড়ি আসতে পারে না? এই ভেবে ট্রাম ডিপোর কাছে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।
ঠিক তখন কাঁধে হাত পড়লো, “সেই চারমিনার? আমার সাথে থাকলে ওই চারমিনার ছাড়তে হবে। ওর গন্ধ মোটেই আমার ভালো লাগে না বলে দিচ্ছি।”
পেছন ঘুরে দেখি মধুছন্দা একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে সেই সাথে কপালে ছোট সবুজ রঙের টিপ আঁকা। আমি দাঁড়িয়ে থ বনে গেলাম।
আমার থ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জায় পড়ে গেল, “কি হলো? সব ঠিকঠাক না কিছু বলবি?”
আমতা আমতা করে আধা পোড়া সিগারেটে শেষ টান মেরে বললাম, ” মানে চল।”
আমার বাঁ পাশ ঘেঁসে রাস্তা পার হয়ে হাঁটার সময়ে চাঁপার কলি নরম আঙ্গুলে ছোঁয়া লাগলো। সেই মুহূর্তে একটা ট্যাক্সি ধাঁ করে সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। আচমকা ট্যাক্সি এসে যাওয়াতে আমি ওর হাত ধরে আমার পেছনে করে দিলাম আর ও আমার জামা খামচে ধরলো ভয়ে।
দাঁত কিড়মিড় করে ট্যাক্সির মুন্ডপাত করতে করতে বললো, “এই পাঞ্জাবী ট্যাক্সিওয়ালা গুলোকে না মারতে ইচ্ছে করে।”
আমি ওকে শান্ত করে বললাম, “ছাড় ওই ট্যাক্সিকে। বল এখন কোথায় যাবি?”
হাত উলটে উত্তর দিল, “আমি কি জানি কোথায় যাবো, তুই কোথায় নিয়ে যাবি?”
বাস স্টান্ডে সবুজ রঙের সারি সারি সরকারি দূরপাল্লার বাস দাঁড়িয়ে। এদিক অদিক তাকিয়ে মাথা চুলকে বেশ খানিক্ষন ভেবে বললাম, “গঙ্গা অনেক দেখলাম, এবারে ইচ্ছামতি দেখলে কেমন হয়?”
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে ইচ্ছামতি নদী কোথায়?”
উত্তর দিলাম, “বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে হাসনাবাদ, যাবি?”
ক্ষণিকের জন্য মধুছন্দার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, গাঢ় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, “না, ইছামতী নদী দেখার কোন শখ নেই আমার। তুই যদি অন্য কোথাও নিয়ে যাস তাহলে যেতে রাজি না হলে আমি বাড়ি চললাম।”
ওর সুন্দর মুখের হঠাৎ পরিবর্তনের কারন ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু দুই ফর্সা কান লাল হয়ে উঠলো সেই সাথে নাকের ডগা লাল হয়ে উঠলো। আমি এই টুকু বুঝলাম যে ওই ইছামতী নদীর সাথে ওর পুরানো কোন ব্যাথা জড়িয়ে। আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না।
বললাম, “আরে না না একবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছি এখুনি বাড়ি ফিরলে মুশকিল হয়ে যাবে। তোর যখন ইচ্ছে নেই তাহলে মায়াপুর নবদ্বীপ ঘুরে আসি।”
চুপচাপ আমার পেছন পেছন বাসে উঠে পড়ল। বাস ছেড়ে দিল, কিন্তু মধুছন্দা মুখ নিচু করে জানালার পাশে বসে রইলো। দুই চোখ ছলছল দেখে আমার বুকের ব্যাথা শত গুন বেড়ে গেল।
কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে তোর, হঠাৎ এমন থম মেরে গেলি যে?”
কালো মেঘের ছায়া সরিয়ে মিষ্টি হেসে জবাব দিল, “কই কিছু না, কিছুই হয়নি।”
বাস ততক্ষণে মধ্যমগ্রাম ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে। জানালা থেকে মিষ্টি রোদে ওর সারা মুখ ভিজে গেল, এক অনাবিল স্বাধীনতার আনন্দে চিকচিক করে উঠলো ওর চোখ দুটো।
আমার পাশ ঘেঁসে বসে মিহি কণ্ঠে বললো, “এতদিন পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজকে খুব ভালো লাগছে।”
আমি ওকে বললাম, “তোকে একা পাওয়া খুব দুষ্কর সবসময়ে কেউ না কেউ তোর চারপাশে মাছির মতন লেগে থাকে।”
উত্তর এলো, “কার কথা বলছিস, অনু?”
আমি বললাম, “ওর কথা ছাড় দিকি।”
বারে বারে এক গুচ্ছ চুল ওর মুখের ওপরে এসে দোল খেয়ে যাচ্ছিল আর সেই দুষ্টু চুলের গোছাকে সামলে মিচকি হেসে উত্তর দিল, “ওর নাক কিন্তু বড় কঠিন কিসে না কিসে গন্ধ শুঁকে ঠিক বের করে নেবে যে আমরা মায়াপুর গেছিলাম।”
আমি ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলাম, “অনু জানলে কি কোন অসুবিধে আছে?”
নিজের আঙ্গুল গুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বললো, “না সে নেই, তবে…..”
আমার ভেতরে অট্টহাসির কলরব ফেটে পড়ার জোগাড়, জানি অনুকে একদিন জানাতেই হবে না জানালে আমাদের প্রেমের পরিণতি কি হবে সেটা বলা কঠিন। বাবা জ্যাঠা কাকার সামনে কোন ভাই বোনের আওয়াজ শোনা যায় না, ওদিকে মা কাকিমার সামনে প্রায় এক রকম অবস্থা। একমাত্র যদি জেঠিমাকে হাতে করা যায় আর সেটা সম্ভব ছোড়দি আর অনুকে দিয়েই হবে।

রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৬)
দুপুর নাগাদ কৃষ্ণনগর পৌঁছে গেলাম সেখান থেকে বাস বদল করে মায়াপুর যেতে হবে। গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে গ্রামের লোক বোঝাই বাসে চেপে দুপুরের একটু পরেই মায়াপুর পৌছালাম। বিলিতি মন্দির তখন সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি, ইট কাঠ বালি পাথর বোঝাই মন্দির প্রাঙ্গনে। আশেপাশে অনেক ছোট ছোট মন্দির আমাদের অবশ্য সেই সব দেখার বিশেষ বালাই ছিলো না। দুইজনে শুধু মাত্র কোলকাতার নাগপাশ ছাড়িয়ে নিভৃতে একে অপরের সান্নিধ্য খুঁজতে এসেছিলাম এই গঙ্গাবক্ষে। তাও রমণীর মন্দির দেখা চাই। শেষ পর্যন্ত নৌকায় চেপে গঙ্গা পার করে নবদ্বীপে গিয়ে নিতাই গৌরাঙ্গের মন্দির দেখা হল রিক্সায় চেপে। এই মন্দির দেখা, ঠাকুর প্রনাম করা আমার কোনোদিন পোষাতো না। বাড়িতে কালী পুজো হতো বটে, তবে সবার মান রেখে বিগ্রহের সামনে করজোড়ে বসে থাকতাম। বাঙালির পালা পার্বন প্রত্যেক মাসেই লেগে থাকে আর আমাদের বাড়ি এইসবে খুব মানে। মধুছন্দা সেই রকমের মেয়ে, যেখানে দেখল একটা মন্দির অথবা বটতলায় একটা পাথর আর কিছু ফুল রাখা, সেখানেই দাঁড়িয়ে চটি খুলে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠোকা ওর চাই। সেই সাথে জোর করে আমাকেও করজোড়ে দাঁড়াতে হতো ওর পাশে।
মনে মনে ওর মুণ্ডপাত করতে করতে বললাম, “সবই তো এটম ইলেক্ট্রনের সমাগম, আচার্য জগদিশ চন্দ্র প্রমান করে দিয়েছেন যে গাছের প্রাণ আছে এখন বল তুই কাকে ছেড়ে কাকে প্রনাম করবি।”
জনা কুড়ি মন্দিরে ঢুকে প্রনাম করে কপালে সিঁদুরের টিপ নিয়ে ওর কপাল রক্ত ললাটের মতন দেখাচ্ছিল। কিছুটা সিঁদুর ওর চশমা ওপরে আর ওর নাকের ডগায় পড়েছিলো।
সেই রক্তিম আভাময় মুখ খানি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে এইখানে নিয়ে এলি কেন? অন্য কোথাও যাওয়া যেতে পারতিস, এই ধর কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, রায়চক যেখানে খুশি।”
সত্যি বলতে জানিনা কেন মায়াপুরের কথা মনে হয়েছিলো সেদিন। তবে ওর মুখ খানি দেখে মনে হয়েছিলো যে রায়চক, ডায়মন্ড হারবার না গিয়ে মায়াপুরে এসে ওর যেন বেশি ভালো লেগেছে।
বিকেলের আগেই আমাদের ফিরতে হবে। ফিরে যাওয়ার আগে গঙ্গার পাড়ে দুইজনে একটু বসে পড়লাম। পায়ের নিচে ঠাণ্ডা গঙ্গার জল ছলকে ছলকে উঠলো আর নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। কখন যেন অজান্তেই ওর হাত উঠে এলো আমার হাতের ওপরে, আমার বাম বাজু খানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বাম কাঁধে মাথা রেখে দূর চোখ রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল মধুছন্দা। ওর ওই খেই হারা ভঙ্গিমা ভাঙতে বড় কষ্ট লাগলো আমার।
অনেকক্ষণ না অল্পক্ষণ ঠিক নেই, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা আওয়াজ এলো আমার কানে, “জানিস কেন ইছামতী দেখতে যাই নি।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে কাঁপা গলায় ওর বিগত দিনের কাহিনী শুনলাম, “হাসনাবাদের ওই ইছামতীর ওই পাড়ে আমাদের বাড়ি ছিলো, সাতক্ষীরার এক গ্রামে। পূর্ববঙ্গ তখন জ্বলতে শুরু করেছে দাউদাউ করে। গ্রামের পর গ্রাম রক্তে লাল হয়ে উঠেছিলো ধুসর রঙের মাটি। সত্তরের এক অঘ্রায়নের গভির রাত। একদল মানুষ গভির রাতে আমাদের গ্রামে চরাও হল। আমাদের গ্রামে হিন্দু সংখ্যা যাও ছিলো, তার অনেকেই আগেই এই পাড়ে চলে এসেছিলো। কিন্তু আমাদের গ্রামের আজমল চাচা আমাদের যেতে দিল না, বাবাকে বললো যে এই মারদাঙ্গা কিছু দিনের মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আগুন আর নেভার নাম নিল না প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠলো। সেই রাতে আজমল চাচা আর নজরুল ভাই লাঠি নিয়ে আমাদের বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু ওই দুষ্কৃতির দলকে রোখা গেল না। ওরা জোর করে আজমাল চাচাকে সরিয়ে দিয়ে আমাদের বাড়ি চড়াও হল। ততক্ষণে নজরুল দাদা আমার দাদাকে পিঠে নিয়ে আমাকে আর মাকে নিয়ে বাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে মাঠ ধরে দৌড়াতে শুরু করে দিল। আমি মায়ের কোল জাপ্টে ধরে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম, সুধুমাত্র দূরে হইহই মারামারির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাবা আমাদের সাথে আসতে পারেনি, আজমাল চাচা বাবাকে নিজের বাড়িতে ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলো। অনেক কষ্টে রেল স্টেশানে পৌঁছে দিয়েছিলো নজরুল ভাইজান। তারপরে ট্রেনে করে শিয়ালদা। তিনদিন তিনরাত পেটে এক দানা পড়েনি, শুধু মাত্র কলের জল ছাড়া।”
ওর কথা শুনতে শুনতে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি বড় হয়েছি প্রাচুর্যে, জন্মের পর থেকে সাদা ধবধবে নরম বিছানা আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। নিজে হাতে খেতে শিখেছি অনেক পরে, অনেক দিন পর্যন্ত বড়দি খাইয়ে দিত। রাতের খাওয়ার পরে শেষ পাতে মিষ্টি না হলে আমার খাওয়া শেষ হতো না, সেই জন্য কাকা রোজ দিন অফিস ফেরত রসগোল্লা নিয়ে আসতো আমাদের সবার জন্য।
কাঁপা কণ্ঠে মধুছন্দা ওর গল্প বলে চলল, “চারদিনের দিন ওই খালি পেটে দাদা কয়েক বস্তা মাল বয়ে চার আনা নিয়ে এলো, সেই চার আনায় এক খুড়ি মুরি আর একটু গুড় খেয়ে কাটালাম আমরা। ওই শিয়ালদা স্টেশানে আমাদের মতন অনেকেই ছিলো, বানের জলে ভেসে আসার মতন বর্ডার থেকে যত ট্রেন আসত সব ট্রেনে গরু ভেড়া খেদানোর মতন মানুষে ভর্তি। কারুর মাথা ফেটে গেছে, কারুর বাবা মারা গেছে, কারুর মা বোনের সাথে জোর জবরদস্তি করা হয়েছে। সব মানুষ ভিটে ছাড়া উদ্বাস্তু। সাতদিনের দিন একটা ট্রেনে চেপে আমার বাবা শিয়ালদা পৌছাল। বাবাকে দেখে সেকি আনন্দ, হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেলাম। তারপরে শুরু হল কঠিন জীবন যাত্রা, কোথায় যাই কোথায় ঠাঁই পাবো তার কোন ঠিকানা নেই। স্টেশানের পাশের একটা ক্যাম্পে আমাদের ঠাই হল। রোজ সকালে দাদাকে নিয়ে বেড়িয়ে যেত বাবা, সন্ধ্যে হলে কিছু না কিছু কিনে আনত খাবার জন্য। যা কিছু ছিলো সব এক রাতে খুইয়ে চলে এসেছিলাম তবে আজমাল চাচা বাবাকে বলেছিলো যে দাঙ্গা শেষ হলে ফিরে আসতে। কিন্তু ফিরে আর যাওয়া হলো না আমাদের ভিটে মাটি সাতক্ষীরায়।”
আমি ওর কাঁধের ওপরে হাত রাখতেই আমার দিকে সরে এলো, কাঁধে ওপরে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজতে চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ ধরে। নির্জন এই গঙ্গাবক্ষে ওকে এই প্রশস্ত বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে বড় ইচ্ছে করলো।
আমি ওকে সান্তনা দিয়ে বললাম, “ছাড় ওই সব কথা, অন্য কিছু বল।”
চশমা খুলে চোখের কোল মুছে আমাকে বললো, “তোদের সবার ক্ষোভ যে আমি চুপচাপ থাকি বেশি কথা বলি না। কাকে কি বলব বল? এতদিন চুপচাপ ছিলাম আর চুপ করেই থাকতাম যদি তুই না এসে আমাকে নাড়িয়ে দিতিস।”
ওর মাথার ঘন কালো চুলে নাক ডুবিয়ে একটু ঘষে আলতো চুমু খেয়ে বললাম, “আমি আছি তোর পাশে তুই এত চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমার হাত খানি বুকের কাছে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে নাক ঘষে বললো, “আমার সব থেকে বড় ভয় সেখানেই। শুকনো বালির মতন যেটাকে আঁকড়ে ধরতে যাই তাই আঙ্গুলের ফাঁকা দিয়ে পিছলে যায়।”
আমি ওকে বললাম, “কেন এইসব উল্টো পালটা চিন্তা ভাবনা করছিস? বাড়ি ফেরার ইচ্ছে আছে না নেই।”
আমি মজা করে বলিনি, অথবা আমার কোন শয়তানি অভিপ্রায় ছিলো না ওই বার্তার মধ্যে। কিন্তু মধুছন্দা চোখ মুছে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে তাকিয়ে বললো, “এতো তাড়াতাড়ি এক সাথে রাত কাটাবার ইচ্ছে নাকি শয়তান ছেলে?” দুম করে বুকের ওপরে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, “ধরতে এলে কিন্তু কামড়ে দেব তোকে!”
আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হেসে দিল। সাথে সাথে আমিও উঠে ওর হাত ধরে ফেললাম, “পালাবি কোথায় এখানে আমি আর তুই ছাড়া আর কেউ নেই?”
লজ্জায় লাল হয়ে গেল ওর ফর্সা গোল মুখ। হাত ছাড়ানোর দুর্বল প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল কিছুক্ষণ কিন্তু ততক্ষণে ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এলাম। মিহি কণ্ঠে বারেবারে বলতে লাগলো, “প্লিস ছেড়ে দে।”
আমার শরীরের সহস্র ধমনীতে রক্তের মাতন লেগেছে, সেই সাথে মধুছন্দার তপ্ত শ্বাসের ঢেউয়ে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে। ডান হাতে ওর পাতলা নরম কোমর জড়িয়ে নিবিড় করে কাছে টেনে নিলাম। শরীরের সাথে শরীর মিশে গেল, বুকের ওপরে পিষে গেল দুই নরম কুঁচ। ধীরে ধীরে মুখ নামিয়ে আনলাম ওর মুখ মন্ডলের কাছে। চশমার পেছনে দুই চোখ শক্ত করে বন্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর সারা শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, আমার বাহু পাশে ছটফট করে চলেছে এক সর্পিল কন্যে। আমি তর্জনী দিয়ে ওর থুঁতনি ছুঁয়ে আমার দিকে ওর মুখ উঠিয়ে আনলাম। ওর লাল নরম ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপতে শুরু করে দিল আসন্ন অধর মিলনের আশঙ্কায়। ঠোঁট জোড়া ছুঁতেই ওর ঠোঁট খুলে গেল। ওর হাত উঠে এলো আমার জামার কলারে, প্রাণপণ শক্তি দিয়ে আমার জামার কলার খামচে ধরলো। আর সেই সাথে আমাদের দুই জোড়া ঠোঁট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। এই গঙ্গাবক্ষ আমাদের এই মিলনের সাক্ষী হয়ে রইলো আদি অনন্ত কালের জন্য।
বাকি সারাটা রাস্তা ওর মুখ দিয়ে কোন বুলি ফুটলো না। বাসে উঠে আমার হাত খানা কোলের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এক বারের জন্য আমার দিকে চেয়ে তাকালো না। বুঝতে বাকি রইলো না যে লজ্জায় আর আমার দিকে তাকানোর শক্তি নেই। বাস থেকে নেমে আবার বাসে চেপে ওর বাড়ি পর্যন্ত গেলাম, ততক্ষণে রাত ঘনিয়ে এসেছে কোলকাতার বুকে। এবারে আর বাস স্টান্ড নয়, হাঁটতে হাঁটতে ওদের পাড়ার গলির মুখ পর্যন্ত চলে গেলাম। পাশাপাশি হেঁটে ছিলাম তবে হাত ধরতে পারিনি। গলির মুখে এসে আধো আলো আধো অন্ধকারে আমার মুখের দিকে তাকালো। সারা মুখে রক্তিম প্রেমের আভা সেই অন্ধকার ম্লান করে দিল।
আমার হাতের ওপরে চিমটি কেটে বললো, “কামড়াতে পারলাম না তাই চিমটি কেটে শোধ নিলাম।”
চিমটি খেয়ে সম্বিত ফিরলো। না, যা হয়েচে সেটা সত্যি সত্যি হয়েছে, কোন স্বপ্ন নয়, “উরি বাঃবা, এই ভাবে কেউ চিমটি কাটে নাকি? এক কেজি মাংস তুলে নিলি যে?”
কাছে এসে মিহি কণ্ঠে বললো, “আর তুই আমার সম্মতি না নিয়ে কি করে দিয়েছিস সেটার কি হবে?”
ওর হাত টেনে কাছে আনতে যাবো, কিন্তু সর্ব সমক্ষে সেটা করা ভীষণ বিপদ, তাই একটু তফাতে দাঁড়িয়েই বললাম, “এই চিমটির দাম তোর কাছ থেকে সুদে আসলে উসুল করব কিন্তু।”
দুষ্টু মিষ্টি অনুরাগ দেখিয়ে বললো, “এর পরে আসিস, সত্যি যদি না কামড়িয়েছি তাহলে আমার নাম বদলে নিস।”
আমিও কম গেলাম না, “এখুনি নাম বদলাতে রাজি, ছন্দা।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে লজ্জা সংবরণ করে বললো, “অনেক হয়েছে, এবারে বাড়ি যা। পয়সা আছে না দিতে হবে?”
আমি মিচকি হেসে জবাব দিলাম, “না না আছে।”
ছেড়ে যেতে কিছুতেই ইচ্ছে করছিলো না আমার, তাও রাতের গভীরতা দেখে আমাকে বললো, “আমি আসি তাহলে।”
আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না বাড়ির গেট খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। বাড়ি ফিরলাম এক ঘোরের মধ্যে, চারপাশের সব কিছু কেমন রঙ্গীন, রাস্তার বিজলী বাতি সেদিন যেন বেশি করে জ্বলছে, আশেপাশের সব মানুষ বেশ খুশি, এই পৃথিবীতে দুঃখ কষ্ট যেন সব উধাও হয়ে গেছে। সেই রাতে আমার আর ঘুম হল না, তিন তলার আমার ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখে কাটালাম আর খোলা চোখে দেখলাম এই সুন্দরী জলপরীকে। পরের দুই দিন আমার সাথে ঠিক ভাবে কথা পর্যন্ত বলেনি ছন্দা। কালো ভ্রমরের মতন ওর পেছনে লেগে ছিলাম কিন্তু মুখের বুলি ফুটাতে পারিনি।
দুই দিন পরে আমাকে জানিয়েছিলো যে সেই রাতে ওর ঘুম হয়নি। সারা রাত জেগে আকাশের তারা গুনেছিলো।

রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৭)
যদিও ষষ্টি থেকে কলেজের ছুটি কিন্তু মহালয়ার পর থেকেই আমাদের কলেজে আসা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেল আর সেই সাথে মধুছন্দার সাথে নিয়মিত দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এমন দুষ্টু মেয়ে শেষ দিনে বলে পর্যন্ত গেল না কোলকাতায় থাকবে না জলপাইগুড়ি যাবে। অনু ঠিক শুঁকে শুঁকে গন্ধ পেয়ে গেল আমাদের ব্যাপারে আর তারপর থেকেই আমার পেছনে লাগতে শুরু করে দিল। ওকে জিজ্ঞেস করলেই খ্যাপাতে শুরু করে দেয়, আমি যে ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেয়েছি তাই ছন্দার কোন ব্যাপারে আমাকে কিছুই জানাতে রাজি নয়। ওই পুজোতে আমার ঘাড় ভেঙ্গে এক জোড়া জুতো কিনলো। জুতো কিনতে যাবার দিনেও ওকে কত অনুরোধ করলাম একবারের জন্য ছন্দাকে ডেকে নিতে, কিন্তু শয়তানি হাসি দিয়ে জানিয়ে দিল যে ছন্দার কোন খবর ওর কাছে নেই। আমাদের বাড়িতে একটাই টেলিফোন ছিলো, সেই টেলিফোন আবার এক তলার বৈঠক খানায়। একবার রিং বেজে উঠলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কার ফোন এলো কার ফোন এলো। ওই বারোয়ারি ফোন থেকে প্রেমালাপ করা কেন সামান্য কথা বলা অসম্ভব ব্যাপার। বাবা জ্যাঠা কাকা ছাড়া বিশেষ কারুর ফোন আসতো না। মাঝে মাঝে দুর্গাপুর থেকে বড়দির ফোন আসতো, আর সেই সময়ে বড়দির সাথে কথা বলার জন্য লাইন লেগে যেত।
বাবা জেঠা পুজোর কর্তা, কিন্তু আমাদের মানে আমি, নবীন, বিষ্টু, বাপ্পা এদের মাথায় সব কাজের ভার এসে পড়তো। ডেকোরেটারের কাছে দৌড়ানো থেকে রান্নার লোক খোঁজা। মা জেঠিমার বয়স হয়েছে, রান্নায় যোগদান দিলেও একটু আধটু হাতা খুন্তি নাড়া ছাড়া বিশেষ কিছুই করতে পারে না। মা জেঠিমার পরের প্রজন্মের হাতে তখন রান্নার ভার, কিন্তু আমার কাকিমা হেঁসেলে যায় না বললেই চলে। নন্দ কাকিমা আর অনুর ছোট কাকিমা শ্রেয়সী, আজকাল রান্নার তদারকি করে, তবে জেঠিমার হাতের পায়েস আজও অমৃত। সবাই পাত চেটে খেয়ে যায়।
চতুর্থীর আগের রাতে শিব মন্দির মাঠের পাশের তাল দীঘির ঘাটে আমি নবীন দেবু আর বাপ্পা আয়েশ করে সিগারেট টানছি। মন্দির মাঠের একপাশে দুর্গা মন্ডপ অন্য দিকে যাত্রা পালার জন্য মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। মন্টু গুপ্ত আসতে পারবে না কিন্তু হাতিবাগানের এক নামকরা নাট্য কম্পানি অষ্টমীর রাতে যাত্রা পালা করতে আসছে। ওদিকে দেবুর ঘ্যানর ঘ্যানর আরো বেড়ে গেল।
সিগারেটে টান মেরে দেবু কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে বললো, “প্লিস পুটু, আমার একটা হিল্লে করে দে।”
আমি বললাম, “কি হয়েছে, নিজে থেকে বলতে কেন পারিস না।”
দেবু মিন মিন করে বললো, “কথা বলতে গেলেই তেড়ে আসে যে, কি করে মনের কথা বলি বলতো। অত দামী একটা হাতির দাঁতের লকেট দিলাম, তাও যে সুন্দরীর মন গলাতে পারলাম না।”
নবীন একটু তফাতে বসে ছিলো সেই খান থেকে চেঁচিয়ে বললো, “আমাদের দুইজন কে আমিনিয়ায় ভালো করে খাওয়া তবে ভেবে দেখবো।”
দেবু ওর ওপরে খেপে গিয়ে বলতো, “শুয়োর রোজ দিন এক প্যাকেট চারমিনার মারিস, তাতেও তোর মন ভরে না?”
আমি ওকে বললাম, “এক কাজ করিস, এবারে পুজোতে আমাদের পাড়ায় চলে আসিস। একটা হিল্লে হয়ে যাবে তোর।”
বাপ্পা ওকে জিজ্ঞেস করলো, “শালা পাড়ার মেয়েকে হাতিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে যাবি, আমরা কি পাবো, লবডঙ্কা?”
নবীন হঠাৎ সিগারেট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেবুর দিকে শান্ত অথচ গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে বললো, “শোন দেবু, অনুকে বুঝাতে পারি বলতে পারি এই মাত্র, তবে জোর করবো না। যদি অনু মেনে নেয়, তাহলে বিয়ে পর্যন্ত তোদের পাশে থাকবো, ওর বাড়িকে মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ত আমার আর পুটুর। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস। কোনোদিন যদি অনুর চোখে জল দেখেছি, কাল হোক কি ত্রিশ বছর পরে হোক, যেখানে থাকবি সেখানে গিয়ে তোকে কেটে ওইখানে পুঁতে রেখে আসবো।”
অনু আমাদের চোখের মণি সেটা দেবু সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেল। নবীনের মুখে ওই গুরু গম্ভীর বার্তা শোনার পরে গুম মেরে গেল। আমি ওকে দুইজনকে শান্ত করে বললাম, যে জীবনের এখন অনেক বাকি কে কখন কোথায় কি অবস্থায় থাকবে সেটার ঠিক নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে এখুনি মাথা ব্যাথা করে কোন লাভ নেই, সময়কে তার নিজের প্রবাহে ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
পঞ্চমীর দিন বিকেলেই বড়দি আর ভাগ্নে ভাগ্নি বাড়িতে এসে গেল। বাড়ির সব থেকে ছোট ভাগ্নি, বুবাই থপথপ করে সারা ঘর ময় ঘুরে বেরায়। নবীন আসলেই ওর বেশি মজা কারন নবীন ওকে নিয়ে ঘুরতে যায়, কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে দেয়, কাঁধে করে মেলায় নিয়ে যায়। নৈহাটি থেকে বড় মামা সবার জন্য নতুন কাপড় নিয়ে এসে গেছে, বড় মামা মানে জেঠিমার বড় ভাই, সেই সকলের বড় মামা। নৈহাটিতে খুব বড় কাপড়ের দোকান, আমাদের বাড়ির অধিকাংশ জামা কাপড় মামার দোকান থেকেই আসে, কথায় আছে মামা বাড়ির আবদার সেটাই খাটাই তাঁর ওপরে।
ক্লাস টেনের পরে আর চক্ষু দান দেখা হয়ে ওঠেনি আমাদের। ছোড়দি একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো চক্ষু দান দেখতে যাবো কি না। কিছু একটা ভেবে শেষ পর্যন্ত যাবো বলে ঠিক করলাম।
খাওয়া দাওয়া সেরে রাত এগারোটা নাগাদ মন্ডপের দিকে হাঁটা দিলাম, যাওয়ার আগে নবীন আর বাপ্পাকে ডেকে নিলাম। দুইজনে আমাকে জিজ্ঞেস করলো অনুকে ডাকতে, আমি জানিয়ে দিলাম পাড়ার পুজো ইচ্ছে হলে আসবে না ইচ্ছে হলে আসবে না আমি কারুর পায়ে তেল মাখিয়ে ডাকতে যেতে পারছি না।
ওদিকে নন্দন পাল রঙ তুলি নিয়ে তৈরি, চক্ষু দান দেখতে অনেকেই এসেছে। ধিরে ধিরে কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে নন্দন পাল সরু তুলি দিয়ে চোখ আঁকা শুরু করে দিলেন। প্রায় ছয় বছর পরে মায়ের প্রতিমার চক্ষু দান দেখে মন হারিয়ে গেল, আপনা হতেই মাথা নুইয়ে এলো ওই কাঠ মাটির বিগ্রহের সামনে। মাটির প্রতিমা আর মাটির রইলো না, প্রানবন্ত হয়ে উঠে দশ হাতে নির্মল চোখে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে আশীর্বাদ করছেন।
আলতো হাতের ছোঁয়াতে সম্বিত ফিরে এলো সেই সাথে নাকে ভেসে এলো অতি পরিচিত সুবাস। কানে এল অতি পরিচিত অতি আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বর, “যতই এটম ইলেকট্রন হোক না কেন, এই মাটির বিগ্রহের মহিমা আলাদা, তোর মাথা ঠিক নুয়াতেই হলো।”
আমি অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি ছন্দাকে সাথে নিয়ে আমার পেছনে অনু দাঁড়িয়ে। অমি কিছু বলতে যাবার আগেই অনু আমাকে চুপ করে থাকতে বললো কারন আমার বাবা আর জেঠা মশায় মন্ডপে এসে গেছেন, সেই সাথে বেশ কয়েকজন কর্তা ব্যাক্তি। কালো প্রারম্ভ পুজো শুরু হবে কয়েক ঘন্টা পরেই। আমি এপাশ অপাশ তাকিয়ে চুপচাপ মন্ডপ থেকে বেড়িয়ে এলাম, সবার চোখ আড়াল করে পেছন পেছন ছন্দাও বেড়িয়ে এলো।
আমি ওকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর কি ব্যাপার বলত? বলা নেই কওয়া নেই।”
আমার গালে আলতো চাপর মেরে বললো, “কেমন চমক দিয়েছি বল।”
আমি ওকে কাছে টানতে গেলাম কিন্তু কিছুতেই কাছে আসবে না, না না বলে লাজুক হেসে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বললো, “সেই বিকেলে এসেছি আর অনুর ঘরের জানালা থেকে তোকে শুধু ঘর বাহির করতে দেখে গেলাম।”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “একবার ডাক দিলেই পারতিস, ডাকলি না কেন?”
মিচকি হেসে বললো, “তাহলে এই চমকের কি মানে হতো?”
আমি বললাম, “যদি না আসতাম তাহলে কি করতিস?”
আমার কাছে সরে এসে বললো, “অনু প্লান করেই ছিলো, যদি তুই না আসতিস তাহলে ও তোকে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে আনতো।”
আকাশ পানে তাকিয়ে বললো দুষ্টু মিষ্টি কণ্ঠে বললো, “তোর খুব ইচ্ছে ছিলো একসাথে রাত কাটানোর, দেখ তোর ইচ্ছে পুরন হয়ে গেল। আমি আর তুই একা এই রাতে এই খোলা আকাশের তলায়।”
আমি ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বললাম, “একা যখন তখন নিশ্চয় সংকোচ বোধ চলে গেছে।”
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “মানে?”
আমি ওকে হেসে বললাম, “মানে আর কি, আমি আর তুই একা নির্জনে নিভৃতে কি হতে পারে সেটা বুঝে নে।”
এই বলেই ওর হাত ধরে টেনে আনলাম। টাল সামলাতে না পেরে আমার শরীরের ওপরে ঢলে পরে গেল আর সেই সাথে আমি ওর কোমর জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিলাম। আধো আলো অন্ধকারে ওর চোখ দুটি চকচক করে উঠলো, সেই সাথে আমার মনে হল ওকে পিষে দেই। ওদিকে ঢাকের বাদ্যি বেশ জোরে বেজে উঠলো, মাথা নামাতে গিয়েও আর নামান হল না ঠোঁটের জায়গায় ওর নরম গালের ওপরে চুম্বন এঁকে ক্ষান্ত হতে হলো।
কোনোরকমে আমার বাহুপাশ ছাড়িয়ে আমাকে একটু ঠেলে দিয়ে বললো, “দিনে দিনে খুব শয়তান হয়ে যাচ্ছিস তুই।”
ঠিক সেই সময়ে অনু এসে গেল আর ধড়মড় করে ছন্দাকে ছেড়ে আমি একটু তফাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনু আমাদের দুইজনকে দেখে হেসে বললো, “সারা রাত কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি না বাড়ি যাবার ইচ্ছে আছে? এই ছন্দা, দেড়টা বাজে কিন্তু।”
ছন্দার অবস্থা ত্রিশঙ্কুর মতন। একদিকে আমি মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে, অন্য দিকে অনু ডাক দিচ্ছে বাড়ি ফেরার জন্য। আমার একদম ইচ্ছে ছিলো না যে অনু ছন্দার সাথে চলে যাক আর সেই এক ভাবব্যাক্তি ছন্দার সারা চেহারায় ফুটে উঠেছিলো, বুঝতে পারলাম যে বিধি বাম। আমি অনুকে অনুরোধ করলাম যে পরে ছন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।
ছন্দা মুখ কাচুমাচু করে অনুর কাছে গিয়ে বললো, “দয়া করে কিছু একটা কর।”
অনু ওর গাল টিপে মিচকি হেসে বললো, “বাঃরে, এতদিন গাছে জল দিলাম আমি, বড় করলাম আমি আর একদিনে এসে টুক করে ফল পেড়ে খেয়ে নিলি? ওইসবে ভবি ভুলবে না, কিছু ঘুষ দিতে হবে!”
আমি অনুকে বললাম, “এই মেলা বাজে বকিস না, তোকে জুতো কিনে দিয়েছি আর তুই এইটুকু করতে পারবি না?”
অনু আমাকে বললো, “ঠিক আছে কিন্তু খুব সাবধানে। মন্ডপে কিন্তু বাড়ির অনেকে বসে আছে। একটু পরে কাল প্রারম্ভ শুরু হবে এই ঘাটে কিন্তু জেঠিমা আর মা জল ভরতে আসবে।”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “হুম বড় সমস্যা বটে। তোদের চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে আড্ডা মারা যেতে পারে।”
শেষমেশ তাই ঠিক হলো। ওদের চিলেকোঠা ঘরে আড্ডা মারা যাবে। অনু এক দৌড়ে আমার ছোড়দিকে জানিয়ে এলো যে আমি রাতে ওদের বাড়িতে থাকবো। আমাদের বাড়ির কেউ ছন্দাকে চিনতো না, তাই অনুর সাথে ওদের বাড়ি যাওয়াতে কারুর মনে কোন সন্দেহ হলো না।

রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৮)
অনুর বাড়ির দিকে যেতে যেতে আমি অনুকে বললাম, “তোর সাথে একটু কথা আছে।”
অনু জিজ্ঞেস করলো, “কি কথা?”
আমি ওকে দেবুর ঘ্যানঘ্যানানির কথা, নবীনের সাবধান বাণী সব খুলে বললাম। সব কিছু শুনে অনু চুপ করে গেল, বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না। তারপরে আমাকে বললো একবার নবীনকে ডেকে দিতে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠ্যালা মেরে বললো তাড়াতাড়ি যেতে আর নবীনকে ডেকে আনতে। আমি নবীন কে ডাকতে গেলাম, নবীন কে বললাম যে অনুকে দেবুর কথা বলেছি কিন্তু অনু একবার ওর সাথে দেখা করতে চায়। আমার কথা শুনে নবীন আমাকে জানিয়ে দিল যে যা বলার অনুকে সব যখন আমি বলেই দিয়েছি তাহলে ওর আর কিছু বলার নেই। আমি পড়লাম মহা মুশকিলে, এই দুইজনের মধ্যে আবার কি ফল্গু ধারা চলছে? যাই হোক পেছনে তাকিয়ে দেখি ছন্দা আর অনু দাঁড়িয়ে।
অনু হাজার প্রশ্ন মাখা চাহনি নিয়ে নবীনকে জিজ্ঞেস করলো, “তোর কি কিছু বলার আছে?”
মাটির দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, “পুটুর কাছ থেকে সবই তো শুনেছিস, আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
দুইজনে চুপ, ছন্দা আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে চুপ থাকতে বললো। আমি ওই দুজনার দিকে কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতন চেয়ে রইলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে অনু হেসে ওকে বললো, “তুই নাকি দেবু কে কেটে ফেলবি বলেছিস?”
সেই শুনে নবীন জবাবে বাঁকা হাসি দিল, “আমি চাই তুই ভালো থাক তাই বলেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।”
বুক ভরে শ্বাস নিল অনু, তারপরে ছন্দার হাত ধরে বললো, “চল, বাড়ির দিকে চল।”
নবীন ওইখানে একা দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপরে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
বাড়ির পথে যেতে যেতে অনু, ছন্দাকে জড়িয়ে ওর গালে চুমু খেয়ে আমাকে বললো, “তোদের দেখার পরে জীবনে একবারের জন্য প্রেম করতে বড় ইচ্ছে করছে।”
ছন্দা হেসে ওকে বললো, “তুই কি আর সত্যি আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলি? তোর নিজেরই ঠিক নেই দেবুকে হ্যাঁ বলবি না না বলবি।”
অনুকে কোনোদিন লজ্জা পেতে দেখিনি, কিন্তু ওইদিন মেয়েটা লাজুক হেসে আমাকে বললো, “আগেকার কথা ছেড়ে দে। দেবুর সাথে ঝগড়া করতাম এই কারনে কেননা ওর বুকে সেই পাটা নেই। বিয়ের পরে দেখলাম ওকে আমাকেই খাইয়ে দিতে হচ্ছে।”
কথায় গল্পে অনুর বাড়ি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে এলো। বাড়ি ঢুকতেই অনুর ছোট কাকিমা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো যে আমি রাতে থাকবো কি না। আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে রাতে এই বাড়িতেই থাকবো। ছোট কাকিমা একবার আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বললো যে আমি যেন এক তলার বসার ঘরের পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আমি কিছু বললাম না, আমি কি এখানে ঘুমাতে এসেছি নাকি?
কাকিমা চলে যেতেই অনু আমাকে নিয়ে পা টিপে টিপে দুতলায় উঠে এলো। ওর ঘর দু’তলার বারান্দার একদম শেষে। অনু ছন্দাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল, আর আমাকে বললো ছাদের চিলেকোঠার ঘরে চলে যেতে। আমি ওর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এত রাতে এখানে আমি ঘুমাতে আসিনি ওই দিকে ছন্দা মিচকি হেসে আমার দিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেনুনি দুলিয়ে চলে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় ওই সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম তারপরে চুপচাপ চারতলার চিলেকোঠার ঘরে চলে গেলাম।
এই ঘরটায় কেউ শুতে আসে না, এই ঘরে বরাবর ছেলেদের আড্ডা জমে। বিশ্বজিৎদার বন্ধু, মেজদার বন্ধু, মাঝে মাঝে আমি নবীন পিতু এসে এখানে মেজদার সাথে আড্ডা মেরে বিড়ি খেয়ে যাই। পকেটের শেষ সিগারেটটা ওই মন্ডপে শেষ করে এসেছিলাম। আমি ঘরে ঢুকে এদিক ওদিকে খুজে একটা আধা পোড়া সিগারেট পেলাম আর সেটাকে জ্বালিয়ে ছাদে চলে এলাম। ছাদের কার্নিশে বসে পা দুলিয়ে আয়েশ করে পোড়া সিগারেটে বেশ কয়েকটা টান দিলাম। মাথার ওপরে গাঢ় নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলা, এদিক অদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘের মাঝে হাজার হাজার তারায় আলোকিত আকাশের বুক।
পায়ের শব্দে চোখ তুলে দেখি শাড়ি ছেড়ে অনুর একটা মাক্সি পরে ছন্দা দাঁড়িয়ে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে গেলাম।
একটানে আমার হাতের পোড়া সিগারেট ফেলে দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, “আর যদি এই সব টেনেছিস তাহলে কিন্তু চলে যাবো। শেষ পর্যন্ত কি না পোড়া বিড়ি?”
এমনিতে সাত চড়ে রা কাড়ে না, বন্ধু বান্ধবীদের সাথে থাকলেও বেশি কথা বলে না, নতুন মানুষের সামনে একদম মুখে কুলুপ আঁটা। কিন্তু যদি কেউ আমাদের অইদিন রাতে দেখতো তাহলে বুঝতো যে ছন্দা আসলে কত কথা বলতে পারে। বিগত পাঁচদিনের কথা আর গল্প যেন আর ফুরায় না, ওর পুরানো দিনের গল্প ওর বাড়ির গল্প, যে ছেলে মেয়ে গুলোকে পড়ায় তাদের বাঁদরামোর কথা ওর ভাইয়ের কথা আরও কত নি। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গেল, ওর ভাই, সত্যজিত ওর চেয়ে বছর দশেকের ছোট, পড়াশুনায় খুব ভালো, ভাইয়ের জন্মের এক বছরের মধ্যেই ওর বাবা গত হন। বাবা আগে এস এস কে এম হাসপাতালে কিছু একটা কাজ করতেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মা এস এস কে এম হাসপাতালে আয়ার চাকরি পায়, তারপরে নার্সিং পড়ে সেই হাসপাতালে নার্স হয়ে যান। কতক্ষণ ওই ভাবে দুইজনে গল্প করেছিলাম সে ঠিকানা নেই।
দূর থেকে শাঁখের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম যে কাল প্রারম্ভ শুরু হয়েছে আর একটু পরেই বোধন পুজো শুরু হবে। কিছু পরে চোখ ডলতে ডলতে অনু এসে আমাদের একটু বকাঝকা দিল।
ছন্দার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সারা রাত জেগে ওর চোখ দুটো তখন চকচক করছে আর একটু বসলে কি এমন হয়ে যেত। কিন্তু অনুর জন্য সেখানেই ক্ষান্ত হল আমাদের গল্প। ছন্দা চলে যাওয়ার পরে চিলেকোঠার ঘরের তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে ভাবতে শুরু করলাম যে সব ঠিক কিন্তু বাড়িতে কি করে বলবো যে প্রেম করেছি আর ওই মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে চাই। যাক সে সব না হয় পরে ভাবা যাবে।
সেবার পুজোর সময়ে ছন্দা দুই দিন ছিলো অনুর বাড়িতে। একমাত্র সেই রাতে ছোট কাকিমা ছাড়া আর কেউ আমাদের একসাথে দেখেনি তাই অনু ছোট কাকিমাকে হাতে করে নিয়েছিলো। সর্বসমক্ষে ছন্দা অনুর বান্ধবী আমাদের কেউ নয় আমরা চিনিনা, সুতরাং না আমি না নবীন কেউ দিনের আলোতে ওর সাথে কথা বলতে পারতাম না। অবশ্য দিনের বেলায় অনেক কাজ থাকত আমাদের, পুজোর মন্ডপে বসা, খাওয়া দাওয়া তদারকি করা ইত্যাদি। আগে এই সব বিশ্বজিৎদা, আকাশদা অরা করত এখন আমাদের ঘাড়ে। মাঝে মাঝে ফুলটুসির মতন সেজে গুজে দুইজনে এসে দেখা দিয়ে যেত কিন্তু দিনের আলোতে সেই পর্যন্ত দৌড় ছিলো। রাতের লোকজনের ভিড়ে একটু সময় পেতাম ওর সাথে গল্প করার আর সেই গল্প চলতো অনেক রাত পর্যন্ত। অষ্টমীর দিনে সকালো বেলাতেই মধুছন্দা বাড়ি চলে গেল। নবীন বিশ্বজিৎদার বাইকে করে ওকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসেছিলো।
অষ্টমীর দিনে দেবুকে ডাকলাম, ওকে দেখে অনু এমন ভাব দেখালো যেন ওর জন্য প্রতীক্ষা করেছিলো সারা জীবন ধরে। ওদের কথার শুরু সেই একটা ঝগড়া দিয়েই, কেন দেবু নিজে থেকে বলতে পারেনি এতোদিন সেই নিয়ে ওদের কথা কাটাকাটি। আমি আর নবীন দেখলাম যে এবারে চার চোখ মিলে গেছে, আমে দুধে মিশে গেছে এবারে আঁঠির আর কি কাজ। ষষ্টির দিনে যেমন আমি অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে রাত কাটিয়েছিলাম তেমনি অষ্টমীর রাতে দেবু আর অনুকে নিয়ে আমার ছাদের ঘরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সারা রাত কি করেছিলো জানি না তবে এইটুকু প্রত্যয় ছিলো যে অনু ওকে হাত ধরা ছাড়া বেশি কিছু করতে দেবে না। অনুর আমাদের বাড়িতে থাকা কোন ব্যাপার নয় তবে দেবুকে মাঝরাতে ঘরে ঢুকাতে হয়েছিলো আর সকালেই ওকে নবীনের বাড়িতে পাচার করে দিতে হয়েছিলো। আমি আর নবীন সারা রাত ধরে যাত্রা পালা দেখলাম। আমার বারেবারে শুধু মনে হয়েছিলো ইস যদি ছন্দা থাকতো আমার সাথে, তাহলে বেশ মজা হতো।
পুজো ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। দশমীতে মেয়েদের দেবী বরন, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বিসর্জনের পালা। লরি করে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলো, সেদিন আর বাড়ি ফিরলাম না। সেদিন প্লাস্টিক কিনে সেই গিলে সবাই কুটির ঘাটে রাত কাটালাম। মাঝরাতে মেজদা মানে আকাশদার কি নাচ, সেদিন নবীন কে জোর করে মদ খাওয়ানো হলো। সবাই মিলে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম যে কবে প্রেম করবে, শালা মদে টোল হয়েও মুখ থেকে একটা কথাও বের করলো না।
বেশ কিছুদিন থেকে ছোড়দির জন্য ছেলে দেখা হচ্ছিলো, আর ঠিক কালী পুজোর আগেই বাড়িতে বোমা ফাটালো ছোড়দি। ওর কথা শুনে সবার চক্ষু চড়ক গাছ, এমন কি আমি আর অনু তো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে বিশ্বজিৎদা আর ছোড়দি ডুবে ডুবে এত জল খেয়েছে। বাবার কাছে পড়তে এসে যে একদম ছোড়দিকে হাতিয়ে নেবে সেটা ঠিক কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলো না। যা হোক দুই বাড়ির যেমন আম দুধের সম্পর্ক, তাতে ওদের এই ভালোবাসা মেনে নিতে কারুর কষ্ট হল না।
বড় জামাইবাবু ডিভিসি তে ইঞ্জিনিয়ার, এবারে আরেক জামাই হল ডাক্তার। চাপ পড়ে গেল মেজভাই শুভদিপ আর ছোটভাই অনির্বাণের ওপরে। মেজ ভাই এতদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আগে আমার ওপরে চাপ ছিলো ডাক্তার হও ডাক্তার হও। ঠাকুরদা বড় ডাক্তার ছিলেন, বাবা ডাক্তার আর এই বাড়িতে একজন ডাক্তার হবে না? তবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাওয়ার পরে আমার ওপরে সেই ক্ষোভ একটু কমে গিয়েছিলো।
অনু ছোড়দিকে বললো, “এই ছোড়দি, তোকে কিন্তু বৌদি বলে ডাকতে পারবো না, তোকে ছেদি বলে ডাকবো, চলবে ত?”
শুভ বললো, “এ কি রকম ব্যাপার? বউ কি হেঁটে হেঁটে স্বশুর বাড়ি যাবে নাকি?”
আমি বললাম, “তুই হাগতে আসিস এই বাড়িতে আর ছুঁচাতে যাস ওই বাড়িতে।”
মেজদা মানে আকাশদা বললো, বর যাত্রীর জন্য বাস ভাড়া করতে হবে, কিছু না হোক নৈহাটি মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসবে বাস চেপে। বরযাত্রী কারা হবে, দুই বাড়ির লোকই তো বর যাত্রী আবার কনে যাত্রী দুটোই।
এসব নিয়ে কি হাসাহাসি। বিয়ে ডিসেম্বরে কিন্তু দুই বাড়িতে সাজ সাজ রব পরে গেল। অনু বায়না ধরলো জামদানি দিতে হবে, তার কমে কিছু নয়। দুই বাড়িতে লোক সংখ্যা কম নয়, এক হাঁক পারলেই জনা চল্লিশ লোক জড় হয়ে যাবে শুধু দুই বাড়ি মিলিয়ে।
আমি ভাবলাম যে এই প্রেম ভালোবাসা নিয়ে যখন কারুর অমত নেই তাহলে আমাদের সময় বিশেষ কিছু অসুবিধে হবে না। ছন্দাকে সব খুলে বললাম, সব কথা শুনে ছন্দা হাঁফ ছেড়ে বললো, “তোর বাড়ি যা কড়া তাতে কখন কি হয় বলা একটু মুশকিল আছে। সময় হলে দেখা যাবে তবে বেশি দেরি করিস না যেন।”
আমি হেসে বললাম, “আরে না না, তুই অত চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোড়দির পরে আমার নাম্বার আর তোকে মিসেস চট্টোপাধ্যায় করতে বিশেষ দেরি হবে না।”
আমার কথা শুনে লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে সে আর বুঝে পেল না।

গল্পটি কেমন লাগলো ?

ভোট দিতে স্টার এর ওপর ক্লিক করুন!

সার্বিক ফলাফল 5 / 5. মোট ভোটঃ 1

এখন পর্যন্ত কোন ভোট নেই! আপনি এই পোস্টটির প্রথম ভোটার হন।

Leave a Comment