Written By pinuram
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#০৯)
আমাদের সব বন্ধুদের নিমতন্ন করা হলো, আমার আর অনুর বন্ধু সংখ্যাই কুড়ি ছাড়িয়ে গেল। বিয়ের একদিন আগেই অনু ছন্দাকে ডেকে নিল, অনুর বান্ধবী হিসাবে ছন্দাকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অনু যখন ছন্দাকে মা জেঠিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো, আমি তখন বাড়ির ত্রিসীমানায় ছিলাম না। পরে শুনেছিলাম যে ছন্দাকে দেখে আমার জেঠিমার খুব পছন্দ হয়েছে, সেই কথা শুনে আমি তাধিন তাধিন করে নেচে নিলাম।
ছন্দা আমাকে মজা করে বলেছিলো, “তোদের যা পঙ্গপালের গুষ্টি সবাইকে প্রনাম ঠুকতে ঠুকতে আমার কোমর বেঁকে গেল!”
দুই বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার আর আকাশদার ঘাড়ে। বিশ্বজিৎদা তো মজাসে ছোড়দিকে নিয়ে কেনাকাটা করাতে ব্যাস্ত। ধুর ব্যাস্ত না ছাই, আমি হলফ করে বলতে পারি কেনাকাটার নাম করে অরা ওই কয়দিনে ঘুরে বেড়িয়েছে। কেননা যা কেনার সব আমি আকাশদা নবীন আর অনু মিলে করেছিলাম।
বিয়ের দিনে সাজসাজ রব, এ বাড়িতে ফুল নেই তো ওই বাড়িতে এখন পর্যন্ত বৃদ্ধি পুজোর ঠাকুর মশাই আসেনি। খাবার জায়গা এক জায়গাতেই। দুই বাড়ির মাঝের মাঠেই সামিয়ানা টাঙ্গানো। তখন ক্যাটারার ছিলো না, ঠাকুর মশায় রান্না করতেন আর বাড়ির ছেলেরা পরিবেশন করত। আমাদের মাথা ব্যাথা হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
এর মাঝে ছন্দা এসে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে গেল, “রাতে কোন শাড়িটা পরবো বলে দে।”
বিকেল হয়ে গেছে এদিকে তখন নিরামিষের জন্য ছানা এসে পৌছায় নি। আমি ওকে এক ধ্যাতানি দিয়ে বললাম, “তোর যা ইচ্ছে তাই পরিস এখন আমার মাথা খাস না।”
ব্যাস, অভিমানিনীর মুখ ফুলে লাল, “যা তোকে জিজ্ঞেস করাই বৃথা। আমি সাজবোই না বিয়েতে।”
একদিকে টেনে নিয়ে আবার ওকে শান্ত করলাম, “প্লিস সোনা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এদিকে ছানা এখন আসেনি সেগুলো আনতে নবীন কে পাঠিয়েছি, ওদিকে কয়লা ফুরাতে চলল তার জন্য বাপ্পাকে পাঠালাম আর শালা কোথায় মরতে চলে গেছে। আর এমনিতে তুই যা পরবি তাতেই তোকে সুন্দরী দেখাবে।”
চশমাটা একটু উপরের দিকে ঠেলে দুষ্টুমি ভরা হেসে বললো, “রাতে দেখিস তোকে কি করি।”
যাই হোক সেইসময়ে ওকে ক্ষান্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। সন্ধের পরে যখন বাড়ি থেকে সেজে বের হলো, তখন আমি ওকে দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। ছন্দার পরনে একটা গাঢ় নীল রঙের সাউথ সিল্কের মেখলা। কাঁচুলিটার পিঠে একটা গিট দিয়ে বাঁধা, মেরুদণ্ডর খাঁজ যেন সুগভির কোন নদী। সুউন্নত, সুডৌল কুচ যুগল কাঁচুলির ভেতরে হাঁপিয়ে উঠছে, ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে উদ্যত। সেদিন বেনুনি ছেড়ে খোঁপা বেঁধেছে, খোঁপায় একটা সুন্দর হাতির দাঁতের ক্লিপ। গলায়, হাতে, কানে হায়দ্রাবাদি মুক্তর সেট ঝলমল করছে। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। ডান কব্জিতে সোনার ঘড়ি আর বেশ কয়েক গাছা সোনার চুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও স্বর্গের নর্তকী এই মর্তধামে নেমে এসেছে।
আমি চারপাশে চেয়ে দেখলাম, ওর রুপ আর সাজ দেখে অনেকেরই চোখ ওর দিকে চলে গেল। অনু আমাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কেমন সাজিয়েছে। আমি শুধু বুক চেপে উফ একটা আওয়াজ করে থেমে গেলাম, এর চেয়ে বেশি কিছু বলার উপায় ছিলো না তখন। আকাশদার বন্ধুরা আর বিশ্বজিৎদার বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছন্দা আর অনুকে দেখার জন্য।
বিয়ের সারা সময়ে আমি ব্যস্ত ছিলাম, মাঝে মাঝে ওদের দুইজনের দেখা পাওয়া যেত। দুই ফুলটুসি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেশ মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাওয়ার সময়ে এদিকে লোক ওদিকে লোক, কে খেতে বসলো কে খেয়ে চলে গেল কে নিরামিষ খাবে কার পাতে মাংস পড়েনি, সেই সব নিয়ে হইচই রইরই ব্যাপার। দেবুকে কাজ দিতে গেলেই অনু বলে দেয়, না ও কিছু করবে না। আমি মনে মনে বললাম, আমাদের বাড়ির সব জামাই গুলো কুঁড়ে। বিয়ের দিকে কি হচ্ছে সেসবে আমার মাথা ব্যাথা ছিলো না কারন ছোড়দি তো আর বেশি দূর যাচ্ছে না। আগে রোজ রাতে এ বাড়িতে ঘুমাতো, সেদিনের পর থেকে মাঠ পেরিয়ে ওবাড়িতে ঘুমাবে এই যা তফাৎ।
দুটো ব্যাচের খাওয়ার মাঝে আমি আর নবীন অন্যদিকে গিয়ে সিগারেট টানছিলাম।
এমন সময়ে ছন্দার দেখা। ওকে দেখে নবীন মিচকি হেসে বেড়িয়ে চলে গেল। আমার পাশ ঘেঁসে হাতখানি ধরে বললো, “কি রে কেমন দেখাচ্ছি একবার বলবি না।”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ওর কালো গভীর চোখের তারায় হারিয়ে গেলাম। ওর দেহের থেকে বিচ্ছুরিত অতীব আকর্ষণ আমাকে টেনে আনল ওর কাছে, এত কাছে যে আমাদের শরীরের মাঝে জায়গা ছিলো না। ওর চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো আমার চাহনির বানে। আমার বুকের মাঝে তখন ঝড় উঠেছে, ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরতে যাবো কিন্তু হাত ছাড়িয়ে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে বললো যে ওর সাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমি ওকে বললাম যে এই মন্ডপে বসার ইচ্ছে আছে নাকি। সেই শুনে লাজুক হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় এত তাড়াতাড়ি নয়।
আমি ওকে ফিসফিস করে বললাম, “তুই যে এত সুন্দরী সেটা ধারনা ছিলো না। শাড়ি ছেড়ে মেখলা, আমি তো ভাবতে পারছি না।”
আমাকে বললো, “গত বছর মামা বাড়ি গিয়ে কিনেছিলাম কিন্তু আর পরা হয় নি।”
আমি ওকে বললাম, “তোকে না আমার বুক পকেটে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।”
ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “কি? বুক পকেটে কেন? বুকের মধ্যে আমি ছাড়া আর কে কে আছে?”
আমি ওর নরম গালে টোকা মেরে বললাম, “আরে না রে বোকা মেয়ে, বুকের মধ্যে রাখতে হলে যে ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে। এখন ওপেন হার্ট সার্জারি করার মতন বয়স হয়নি আমার।”
কেন জানি না ওর চেহারা দেখে আমার মনে হল এখন কিছু সাজ বাকি রয়েছে, যদি আমি নিজে হাতে ওকে সাজাতে পারতাম তাহলে হয়ত ওর সাজ সম্পূর্ণ হতো। ওর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তারপরে পকেট থেকে পেন বার করলাম। বাম হাতের তর্জনী দিয়ে ওর থুঁতনি ছুঁয়ে আমার দিকে তাকাতে বললাম। ছন্দা আমার তর্জনীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো, আসন্ন উত্তেজনায় ওর শরীর কাঠ হয়ে গেল। ডিসেম্বরের শীতেও ওর নাকের ডগায় ঘামের বিন্দু দেখা দিল। ওর তপ্ত শ্বাসে আমার মুখ বুক সব ভেসে গেল। আমার দিকে মুখ উঁচিয়ে চোখ জোড়া আধাবোজা করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি পেন দিয়ে ছন্দার থুতনিতে তিনটে ছোটো ছোটো বিন্দু এঁকে দিলাম। লজ্জা ভরা লাল টুকটুকে চেহারা দেখে এবারে মনে হল যেন ওর সাজ সম্পূর্ণ। নিজের অজান্তেই ছন্দার হাত দুটি মুঠি হয়ে যায় গাল, কান গরম হয়ে গেল। ভেজা পায়রার মতন কেঁপে ওঠে ছন্দার পেলব দেহ পল্লব। চোখ বন্ধ করে আমার হাতখানি শক্ত করে ধরে নেয় আর নিজের অজান্তেই ওর গোলাপি নরম ঠোঁট দুটি অল্প ফাঁক হয়ে যায়। পদ্মের পাপড়ির মতন ঠোঁট গুলো কেঁপে ওঠে, যেন দখিনা বাতাসে বইছে। আমি ওর নরম ঠোঁট জোড়া দেখে আর থেমে থাকতে পারলাম না, আমার আঙ্গুল থুতনি ছাড়িয়ে ওর গালের ওপরে চলে গেল। আলতো করে গালের ওপরে আঙ্গুল বুলিয়ে মাথা নিচু করে ওর ঠোঁট ছুইয়ে দিলাম। তীব্র আবেগে বশে আমার ঠোঁট কামড়ে দিল ছন্দা। ঠিক কতক্ষণ ওই ভাবে অধর ওষ্ঠ মিলিয়ে ছিলাম বলা মুশকিল তবে কেউ যেন আমাকে ডাক দিল আর আমাদের গভীর চুম্বনে ছন্দপতন ঘটে গেল।
অনু এদিক ওদিকে খুঁজে আমাদের ওইখানে পেয়ে ঝাঁজিয়ে উঠলো, “তোরা দুইজনে এইখানে কি করছিস? ওইদিকে বিয়ে শেষ হতে চললো।”
অনুকে দেখেই ছন্দাকে ছেড়ে দিয়ে আমি ওকে বললাম, “কি হয়েছে, এতো গরম হয়ে আছিস কেন?”
অনু জানালো যে আগে ছোড়দির ঘরে বাসরের কথা ছিলো, কিন্তু লোক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে নিচের তলার বৈঠকখানায় বাসরের ব্যাবস্থা করতে হবে। তার মানে কাজ বেড়ে গেল, আমি ভেবেছিলাম যে রাতে একটু খালি পাব আর ছন্দার সাথে একটু খানি একলা সময় কাটাতে পারবো কিন্তু অনুর কথা শুনে মনে হল সে গুড়ে বালি। নিরুপায় হয়ে ছন্দা বাঁকা হাসি দিয়ে অনুর সাথে চলে গেল আর আমি আকাশদাকে নিয়ে বৈঠকখানা ঠিক করতে চলে গেলাম।
মেজদাকে জিজ্ঞেস করাতে মেজদা মিচকি হেসে বললো যে অনু আর অনুর বান্ধবী মানে ছন্দাকে দেখে ওর বন্ধুরা আর বড়দার বন্ধুরা রাতে থেকে গেছে। আমি মনে মনে হেসে ফেললাম, তোদের পাতে কাঁচ কলা, ওই দুইজনেই নিজেদের বর আগে থেকেই খুঁজে নিয়েছে। আমি অনু আর ছন্দাকে ওদের অভিপ্রায় জানিয়ে দিলাম, ছন্দা আকাশ থেকে পড়লো, কি হবে এবারে? অনু ওকে ক্ষান্ত করে দিয়ে বললো যে কিছুই হবে না কেউ ওদের টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না।
রাতে মেজদার বন্ধু আর বড়দার বন্ধুদের সাথে অনুর বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে আড্ডা বসলো। মেজদা মদ এনেছিলো। বাড়িতে বসে মদ খাওয়া এক বিশাল ব্যাপার কিন্তু বিয়ের সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে সেইসব করা যেতে পারতো। ওরা সবাই মিলে নবীন আর আমাকে চেপে ধরলো, একবার ছন্দার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। নবীন মদ খেয়ে ওদের সাফ কথায় জানিয়ে দিল যে আমরা কিছু করতে পারবো না, যা করার ওদের নিজেদের করতে হবে। পেছনে এক পয়সার মুরোদ নেই, আবার প্রেমের বুলি গাইছে!
সারা রাত ধরে ছোড়দি আর বড়দাকে ঘুমাতে দেওয়া হলো না, বাড়ি নয় যেন কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্র। একদিকে ছোড়দির বন্ধুবান্ধবিরা দল বাধল অন্যদিকে বড়দার বন্ধুরা দল বাঁধলো, গানের লড়াই হাসি মজা অনেককিছুই হল সেই রাতে। সেই রাতে দেবুও থেকে গেছিলো। ফাঁকতালে ঘুমের আছিলায় আমরা চারজনে ওই বাসর থেকে সরে গেলাম আর অনুর বাড়ির চিলেকোঠা ঘরে গিয়ে আড্ডা দিলাম। সকালো প্রায় হতে যায় তখন আমি আর দেবু বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
ছন্দা বউভাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ছিলো, আর সেবারেও আমি ওকে ছাড়তে যেতে পারিনি। অবশ্য না ছাড়তে যাবার কারন ও বুঝেছিলো, সর্ব সমক্ষে ওর কাছেই যেতাম না। বউভাতের পরের দিন দেবু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলো। অনু তারপরে আমাদের খেপিয়ে বলতো ওই এক মন্ডপে আমাদের বিয়ে করালেই ভালো হত।
ছোড়দির বিয়ের পরে সব থেকে বেশি লোকসান আমার হলো। আগে অনায়াসে ওর পার্স মারতে পারতাম, সেটা বন্ধ হয়ে গেল। ওদিকে অনুর পার্স মারতে গেলেই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু, “প্লিস টাকা নিস না, দেবুর সাথে সিনেমা দেখতে যাবো” অথবা, “ওকে জন্মদিনে একটা শার্ট কিনে দেব তাই টাকা জমাচ্ছি” ইত্যাদি প্রচুর বাহানা।
আর ছন্দা আমাকে বলতো, “তুই কেন এরতার কাছে হাত পাতিস? আমি টিউশানি করি, আমার পার্সে অন্তত তোকে আর আমাকে চালানোর মতন টাকা আছে।”
তবে আমার পকেট কোনোদিন খালি থাকতো না, কারন আমার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার আমার ছোট কাকিমা ছিলেন, যখন যা চাইতাম পেয়ে যেতাম।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১০)
দেখতে দেখতে দুই বছর কেটে গেল, আমাদের কলেজ শেষ হয়ে গেল। ছন্দা আগের থেকে অনেক বদলে গেছিলো। আগে অনেক চুপচাপ লাজুক মেয়ে হয়ে থাকতো, শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরে কোনোদিন কলেজে আসতো না। কিন্তু কলেজ শেষ হতে হতে ও অনেক খোলামেলা হয়ে গেল। অনুর দৌলতে আর আমার চাপাচাপিতে, শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ, লম্বা স্কার্ট শার্ট ইত্যাদি পরা শুরু করে দিল। আগে অনুর আঁচলের পেছনে লুকিয়ে থাকতো, কলেজ শেষ হতে হতে সর্ব সমক্ষে আমার পাশে দাঁড়াতে লজ্জা বোধ করতো না। কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখা, ঝালমুড়ি খাওয়া, ময়দানে ঘোরা, পুজোর সময়ে দল বেঁধে ঠাকুর দেখা, ছুটির দিনে ভিক্টোরিয়া থেকে হেঁটে হেঁটে হাওড়া যাওয়া আর সেখান থেকে বাসে চেপে বাড়ি ফেরা অনেক কিছুই করেছি।
দেবুর সাথে প্রেম করার পরে অনুও অনেক বদলে গেছিলো। আগেকার যে অনু চারদিকে লাফিয়ে খেলে বেড়াতো বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক সংযত হয়ে গেল আর দেবু হয়ে গেল একটা মিনি বেড়াল। দেবুর সাথে ঘন ঘন যুদ্ধ হত সেটা এখন প্রেমের বুলিতে হয়। তার সাথে আরো একটা পরিবর্তন ঘটেছিলো যেটার ব্যাপারে ছন্দা আমাকে দেখালো সেটা হল নবীনের সাথে আগে যেমন খোলা মনে কথা বলতো অনু, সেটা অনেক কমে গেছে। আমি ওকে বললাম যে হয়ত এখন দেবুর সাথে বেশি মেশে তাই আমাদের সাথে ওই রকম ভাবে সময় দিতে পারে না, ছন্দা মিচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিল এর পেছনে অন্য কোন গল্প আছে। তখন ছন্দার কথার আসল অর্থ বুঝতে পারিনি।
আমি আর ছন্দা ওকে দেখে আড়ালে হাসতাম আর অনুকে বলতাম একি করছে। অনু নাক কুঁচকে জবাবে বলতো, বাঃরে প্রেম করেছে বলে কি ওর মাথা কিনে নিয়েছে? ও তো মাঝে মাঝে শুধু একটু আধটু কাজ করিয়ে নেয়। কোথাও দল বেঁধে ঘুরতে গেলে অনু কোনোদিন নিজের ব্যাগ নিজে বইতো না দেবুর কাঁধে চাপিয়ে দিত। একবার সবাই মিলে রায়চক গিয়েছিলাম, সেই খানে গিয়ে অনুর চটি ছিঁড়ে গেল তাই নিয়ে দেবুকে বকাঝকা শুরু করে দিল। দেবু বেচারা থতমত খেয়ে আবার দুই জোড়া চটি কিনে দিল তবে গিয়ে ক্ষান্ত হলো।
দেখতে দেখতে আমরা সবাই যাদবপুর থেকে পাশ করা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলাম। সবাইকে অবাক করে নবীন ব্যাচে টপ করে ফেললো আর ছন্দা সেকেন্ড হল। আমি বেশ ভালো অঙ্কে পাশ করলাম আর শ্যামলী কোন রকমে পাশ করেই খুশি। আমাদের দুই বছর আগেই ঋতুরাজ মেকানিকাল পাশ করে কানাডার অন্টারিওতে চাকরি নিয়ে চলে গেছে, তাই শ্যামলীর পাশ করা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিলো না। জানে পাশ করলেই বিয়ে করে চলে যাবে আমাদের টা টা বাই বাই করে। আর সেটাই হল, কলেজ শেষ হতে না হতেই শ্যামলী টুক করে বিয়ে করে ফেললো। শ্যামলীর বিয়ের দিনে অনু আর ছন্দার কি কান্না, কোথায় কোলকাতা আর কোথায় অন্টারিও হয়ত আর এই জীবনে দেখাই হবে না কারুর সাথে।
আমার চাকরি করার একদম মন ছিলো না। বাবা জেঠার অনেক টাকা, একটু ধ্বংস না করলে হবে কি করে আর পেটের বিদ্যে বাড়াতে অসুবিধে কোথায়। মাস্টার্স করতে চাই, তারপরে রিসার্চ করতে চাই এই খবর পেয়ে বাবা জ্যাঠা আরও খুশি। এইসব ভেবে আমি দেবু আর নবীন গেট পরীক্ষায় বসলাম। আমি আর এম টেক করতে ঢুকলাম যাদবপুরে আর দেবু এম টেক করতে চলে গেল ধানবাদের আই এস এমে। নবীন এম টেক পড়তে চলে গেল দিল্লির আই আই টি তে আর পরাশর গুজরাটের এক বড় টায়ারের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। বিশ্বজিৎদার ঘাড় ভেঙ্গে আমি একটা মোটরবাইক হাতিয়ে নিলাম।
অনু পড়াশুনা করতে নারাজ, ওর কথা, সেই ছোটবেলা থেকে বই পড়া শুরু করেছে আর নয় আবার চাকরিও করতে চায় না, বাড়ি বসে বাবা কাকার অন্ন ধ্বংস করবে। এই শুনে ওর বাড়ির থেকে চাপ দিতে লাগলো যে মেয়ের বাইশ বছর বয়স হয়ে গেছে এবারে বিয়ে দিয়ে দাও। অনু দেবু দুইজনার মাথায় বাজ, কি ভাবে সামলানো যায়, শেষ পর্যন্ত ছন্দা ওকে বুদ্ধি দিল যে ডাব্লু বি সি এস অথবা সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিক তাহলে আর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দেবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ, মেয়ের সুবুদ্ধি হয়েছে দেখে ওর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পড়াশুনা করতো না ছাই, দেবুর সাথে সারা কোলকাতা ঘুরে বেড়াতো।
ছন্দা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কোলকাতার একটা নামকরা রঙের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল, পার্ক স্ট্রীটে ওর অফিস। যেদিন এপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েছিলো সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো। ওই অশ্রু ছিলো আনন্দের, খুশির জীবনের জয়যাত্রার অশ্রু।
কোলকাতায় তিন জন থেকে গেলাম আর বাকিরা ছড়িয়ে গেল। এই বিশাল পৃথিবী মাঝে আমরা ছিলো ছেঁড়া ধনুকের মতন ছিটকে গেলাম।
ছন্দা আর আমার মাঝের “তুই” কখন যে “তুমি” তে পরিনত হয়ে গেছিলো সেটা আর খেয়াল নেই। রোজকারের মতন আমি সকালে কলেজের জন্য বেড়িয়ে যেতাম, বিকেলে কলেজ থেকে বেড়িয়ে সোজা ছন্দার অফিসের তলায় ওর জন্য অপেক্ষা করা। আর সেই সাতজন একসাথে নেই, কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখা নেই, এর মাথায় চাঁটি মেরে ফুচকা খাওয়া নেই, কফি হাউসে বসে আড্ডা মারা নেই। ছন্দা আফসোস করত, কলেজ পালানো কত সোজা কিন্তু অফিস পালানো বড় কঠিন। সাড়ে পাঁচটা বাজলেই পড়িমরি করে ছুটে এসে আমার বাইকের পেছনে বসে পড়তো। পার্ক স্ট্রিটের কোনার রোলের দোকান থেকে দুইজনে দুটো এগ রোল কিনতাম তারপরে সোজা গঙ্গার ঘাটে এসে বসতাম। সারাদিনের অফিসের কথা, কার সাথে কি হল, কে লাইন মারতে চেষ্টা করলো, কে টিটকিরি মারল এইসব নিয়ে হাসাহাসি চলতো। সন্ধ্যের পরে ওকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম।
কলেজ ছাড়ার পরে অনুর হল সব থেকে বেশি অসুবিধে, কার সাথে বেড়াতে যাবে, দেবু ধানবাদে। দেবু কোলকাতা থাকলে আমি ওকে নিয়ে কলেজে চলে আসতাম আর সেদিন দেবুর সাথে ঘুরতে বেড়িয়ে যেত।
সেদিন সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু। ছন্দা সরাসরি কোনোদিন আমার বাড়িতে ফোন করতো না। অনুকে ফোন করতো, আর যা খবরাখবর সেটা অনু আমাকে জানিয়ে দিত। সেদিন অনু আমাকে ফোন করে বললো যে ছন্দা আমাকে দুপুরের পরে ওর অফিসের নিচে থাকতে বলেছে। কপাল খারাপ সেদিনেই আমার বাইক খারাপ হয়ে গেল, কি করি যেতে হবেই ওদিকে মাথার ওপরে কালো মেঘ কিন্তু মেঘের তোয়াক্কা কে করে। আমি কোনোদিন ছাতা নিয়ে বের হতাম না। সেই সময়ে কোলকাতার বাতাসে এত ধুলো বালি ছিলো না তাই আমার ওই বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগতো। বৃষ্টিতে ভিজলে বাড়িতে যত না বকা খেতাম, তার দশগুন মার খেতাম ছন্দার হাতে। ওই নরম হাতের চাঁটি খেতে আমার খুব ভালো লাগতো। ইলশেগুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আর ঠিক লাঞ্চের পরেই ওর অফিসে পৌঁছে গেলাম।
ছাতা বিহীন আমাকে দেখে ক্ষেপে গেল ছন্দা, “তোমাকে কতবার বলি বর্ষা কালে ছাতা নিয়ে বের হবে, কিন্তু তুমি কিছুতেই আমার কথা শুনবে না।”
এদিক ওদিক দেখে আমার বাইক দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করলো, “বাইকের কি হয়েছে? টায়ার পাঞ্চার না ইঞ্জিন গেছে? এবারে কত টাকার ধাক্কা? স্টাইপেন্ড যা পাও সব তো সিগারেটে শেষ করেছো মনে হয়।”
আমি মাথা চুলকে অপরাধীর মতন বললাম, “পেট্রোল ট্যাংকে কিছু প্রবলেম হয়েছে গ্যারেজে দিয়ে এসেছি।”
আমার মাথায় হাত দিয়ে চুলের মধ্যে বিলি কেটে বললো, “কাক ভিজে হয়ে গেছ এ অবস্থায় আর কোথায় যাবে?”
আমি হেসে বললাম, “বাঃ রে এই বৃষ্টিতে তোমার সাথে ভিজবো বলে এসেছি।”
আমার বাজু ধরে মিষ্টি হেসে বলে, “ভিজবো বলেই তো তোমাকে ডাকা। সকালে কালো মেঘের ভেলা দেখে মনে হল দুইজনে একটু ভিজি। ভেবেছিলাম তোমার পেছনে বাইকে বসে সারা কোলকাতা ঘুরবো সেটা তাহলে আর হলো না।”
আমি এদিক ওদিক দেখে টুক করে ওর গালে টোকা মেরে বললাম, “বাইক নেই তো কি হয়েছে, দুই পা আছে আর আছে এই রাস্তা। দুইজনে হেঁটে হেঁটে ভিজবো।”
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এক ছাতার নিচে। পায়ের নিচে ময়দানের সবুজ ঘাসে ঢাকা জাজিম, দুইজনেই জুতো খুলে বৃষ্টির জলে ভেজা মাটির ওপরে ছপাং ছপাং করে হেঁটে গেলাম কিছুক্ষণ। খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বারেবারে পিছিল খাচ্ছিল তাই আমার হাতখানি শক্ত করে ধরেছিলো। একবার টাল সামলাতে না পেরে আমার গায়ের ওপরে পরে গেল আর টুক করে আমি ওর গালে চুমু খেয়ে নিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে মুখ লাল হয়ে গেল আর আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, “এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেল পার্থ, এইভাবে খোলা জায়গায় কেউ চুমু খায়?”
আমি বললাম, “কেউ কি আমাদের দেখেছে চুমু খেতে যে তুমি এত রেগে যাচ্ছ?”
আমার দিকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, “ওই দূরে বাসে বসা লোক গুলো দেখছে আমাদের।”
আমি ওর কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে বললাম, “দেখলো তো কি হয়েছে, আমি কি ওদের বউদের চুমু খেয়েছি নাকি? আমি নিজের প্রেমিকাকে চুমু খেয়েছি তাতে ওরা বলার কে?”
একটা গাছের তলায় একটা চিনে বাদাম ওয়ালা দাঁড়িয়ে ছিলো, তার কাছ থেকে এক ঠোঙা চিনে বাদাম কিনে চিবোতে চিবোতে আউট্রাম ঘাটের দিকে পা বাড়ালাম। পথে যেতে যেতে ছন্দা আমাকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো, আমি বললাম যে সবাই ভালো আছে সেই সাথে অনুর কথা বললাম, ও একদম ঘর বন্দি হয়ে হাঁসফাঁস করছে। তার চেয়ে ভালো হতো যদি আমাদের সাথে এম টেক করতে ঢুকত অথবা কোথাও চাকরি করতো।
আউটট্রাম ঘাটে এসে বসার জায়গা খুঁজে পেলাম না, গঙ্গার পাড় ভিজে, বেঞ্চ ভিজে, ঘাট ভিজে। ছন্দা বায়না ধরলো নৌকায় চাপবে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এই বৃষ্টিতে নৌকায় চেপে কোথায় যাবে? ছন্দা বললো নৌকায় চেপে হাওড়া যেতে চায়, বেশ রোমান্টিক ব্যাপার হবে। ঘাটের কাছে সারি সারি নৌকা বাঁধা, দুই ভিজে কপোত কপোতি দেখে মাঝি দর হাঁকওল দশ টাকা লাগবে। আমি জানতাম কি কারনে মাঝি দশ টাকা হেঁকেছে, জোড় বেঁধে কপোত কপোতি আসে এখানে আর নৌকার ছাউনির তলায় উদোম হয়ে প্রেম লীলা খেলে। ছন্দা ওদের জানিয়ে দিল পাঁচ টাকার এক পয়সা বেশি দেবে না, যাবে তো শুধু এপার থেকে অপার তাতে আবার দশ টাকা কেন? শেষ পর্যন্ত ছয় টাকায় এক মাঝি আমাদের গঙ্গা পাড় করতে রাজি হল। নৌকায় উঠেই ছন্দা ছাতা বন্ধ করে দিল, আমি ওকে জিজ্ঞেস করাতে বললো মাঝ গঙ্গায় নৌকা দাঁড় করিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে।
আমি ওকে বললাম, “যখন আমি ভিজি তখন আমার ওপরে চোটপাট করতে ছাড়ো না এখন কি হয়েছে?”
ছন্দা আমার গলা জড়িয়ে বললো, “উম্মম প্লিস এই রোমান্টিক মুড নষ্ট করে দিও না, তোমার সাথে এই বৃষ্টিতে ভিজতে বড় ভালো লাগছে।”
নিচে ঘোলা জল, মাথার ওপরে কালো মেঘ আর পাশে ভিজে জলপরী। গায়ের শাড়িটা সারা অঙ্গের সাথে লেপ্টে গেছে তাতে ওর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, মাঝ গঙ্গায় নৌকা দাঁড় করিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভিজলাম দুইজনে। আমার সাথে একটা ক্যামেরা থাকলে সেই অপূর্ব দৃশ্য সেদিন ক্যামেরা বন্দি করে রাখতাম তবে হৃদয়ে আঁকা ছবির কাছে সেই ছবি ম্লান।
আমি ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললাম, “সত্যি তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে আজকে।”
আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “হ্যাঁ হয়েছে সত্যি সত্যি আমার মাথা খারাপ হয়েছে। আমি ভালো মেয়েই ছিলাম তুমি এসে আমার যা কিছু ছিলো সব কেড়ে কুড়ে নিয়ে পাগল করে দিয়েছ।”
সেদিনের বৃষ্টি ভেজা আর মাঝ গঙ্গায় নৌকার মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা এখন বুকে আঁকা রয়েছে।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১১)
ভিজে ভিজে ওই পাড়ে গিয়ে বাস ধরলাম বেহালা আসার জন্য। হাওড়া ব্রিজ পার হতেই ছন্দা আমার হাত ধরে বাস থেকে টেনে নামিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার, কি হয়েছে?”
আমার হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ নিজের বুকে চেপে আদুরে কন্ঠে বললো, “আজকে না বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
আমি আঁতকে উঠে বললাম, “তুমি পাগল হয়েছো নাকি? কোথায় যাবে?”
একটু খানি নেচে নিয়ে বললো, “তোমার সাথে এই কোলকাতার রাস্তায় আজ ঘুরে বেড়াবো।”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা এখন কি করতে চাও?”
ও বললো, “হেঁটে কলেজ স্ট্রিট যাই চলো, অনেক দিন কফি হাউসে বসে আড্ডা মারিনি।”
এক ছাতার তলায় হেঁটে হেঁটে বড়তলা স্ট্রিট, চারপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে টানা রিক্সা আর রিক্সাওয়ালা গুলো পাশের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমি ছন্দাকে বললাম যে হেঁটে যেতে, ছন্দা একবার আমার দিকে দেখলো একবার ওই ভিজে রিক্সা গুলোর দিকে দেখে আবদার করলো যে ওই টানা রিক্সায় চাপবে। শেষ পর্যন্ত দুইজনে মিলে টানা রিক্সায় চাপলাম। রিক্সা ওয়ালা ভাড়া চাইল তিন টাকা, ছন্দা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। ভিজে রাস্তার ওপর দিয়ে ভিজতে ভিজতে সেই লোকটা রিক্সা টানতে টানতে আমাদের কলেজ স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত নিয়ে গেল। যাওয়ার পথে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি দেখতে পেয়েই ঢিপ করে একটা প্রনাম ঠুকে নিল।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করাতে উত্তর দিল, “যা বাবা এনাকে ভুলে গেলে কি করে হবে। ওই ছোটবেলার সহজ পাঠের – ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া; এর মধ্যেই ভুলে গেলে? ওই জন্যই আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি।”
আমি হেসে দিলাম, ওর ধরন দেখে, সত্যি মেয়েটা পারেও বটে। রিক্সা থেকে নেমে ছন্দা পার্স থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। লোকটা বললো যে ওর কাছে খুচরো পয়সা নেই, ছন্দা ওকে টাকাটা রেখে দিতে বললো।
আমি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিল, “ওর বাড়িতে নিশ্চয় একটা বৌ আছে আর আছে চার পাঁচটা বাচ্চা কাচ্চা। এই বৃষ্টিতে এরপরে আর কোন যাত্রী পাবে কিনা সন্দেহ আছে। ওর ছেলে মেয়েরা নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে কখন ওদের বাবা আসবে আর ওদের জন্য কিছু নিয়ে আসবে। আমি ওই বাচ্চাদের মনের কথা বুঝি কারন এক সময়ে আমিও আমার বাবার জন্য ওই রকম হাপিত্যেস হয়ে বসে থাকতাম।”
কথাটা আমার বুকে বড় বেজে উঠলো, নারী তোমার এই অঙ্গে কত রুপ। ছন্দা হারায়নি তবে এই তিলোত্তমা হারিয়ে গেছে!
কফিহাউসে বসেই আমাদের ভিজে কাপড় শুকিয়ে গেল। তারপর ছন্দাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে এলাম।
কোলকাতায় আমরা শুধু তিনজনে পড়ে রইলাম, বাকিরা সব দূরে দূরে। দেবুর সাথে মাসে একবার দেখা হত, কোন মাসে হত না। দিল্লী যাওয়ার পরে নবীনের সাথে বার তিনেক দেখা হয়েছিলো, ও আর সেই আগেকার রোগা পটকা নবীন নেই, দিল্লী গিয়ে বেশ ফুলে গেছে। পচার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত গুজরাটে গিয়ে কোন গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে, শ্যামলীর বিয়ের পরে ওর সাথে একবার শুধু মাত্র কথা হয়েছিলো আর হয়নি। কে আই এস ডি করবে আর গল্প করবে?
কফি হাউসে বসে ছন্দা বললো একবার কোথাও বেড়াতে গেলে কেমন হয়? হঠাৎ ওর ভাবের এই পরিবরতনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে চায়। চাকরি পাওয়ার পরে ওর ভাইকে দেওঘরের বেশ নামকরা এক মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো, সেখানে যেতে চায়। আমি বলাম বেশ, কিন্তু ওই বৈদ্যনাথ ধামের কথা শুনেই একটু বেঁকে গেলাম, সেই মন্দির আর মন্দির আর ছন্দার চটি খুলে ঢিপ করে প্রনাম করার কথা মনে পড়ে গেল। আমার চেহারা দেখে মনের ভাব বুঝতে ওর একটুকু সময় লাগলো না। আমি এই ভেবে রাজি হয়ে গেলাম যে এবারে একসাথে বেশ কয়েকদিন একসাথে কাটান যাবে। তখন বাঙালির বেড়াতে যাওয়া মানে দার্জিলিং, সিমলা কুল্লু মানালি, সমুদ্র সৈকত বলতে পুরী মাড্রাস কন্যাকুমারী, আমি কোনোদিন দেওঘর যাইনি ছন্দার দৌলতে যাওয়া।
ঠিক হল যে পুজোর ছুটির পরে নভেম্বরের মাঝের দিকে আমরা দেওঘর বেড়াতে যাবো। নভেম্বরে কোলকাতায় বিশেষ ঠাণ্ডা না পড়লেও দেওঘরে বেশ ঠাণ্ডা পরে। ওইদিন কফিহাউসে বসে পরিকল্পনা করার পর থেকে আমার চোখে আর ঘুম নেই, যখনি ছন্দার সাথে দেখা হয় তখনি ওকে শয়তানি করে বলি, এক কামরায়, এক বিছানায় এক লেপের নিচে ওকে আমি ছিঁড়ে খাব। সেই শুনে বলতো যে একটা রামপুরি চাকু সাথে নিয়ে যাবে নিজের আত্মরক্ষা করার জন্য। প্রেমের আগুন দুইদিকেই সমান ভাবেই লেগেছিলো। ছন্দার বিশেষ অসুবিধে হল না, বাড়িতে বললো এক বন্ধুর সাথে ভাইয়ের কাছে যাবে। আমিও সেই মতন বাড়িতে জানালাম যে কয়েক দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে যাচ্ছি, কার সাথে যাচ্ছি সে সব আর বলার দরকার পড়লো না।
ট্রেন রাত দশটায়, আমি আটটায় হাওড়া পৌঁছে গেছিলাম, কথা ছিলো বড় ঘড়িটার নিচে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো। একটা সিগারেট ধরালাম আর চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রঙ বেরঙ্গের শাল সোয়েটার জ্যাকেট পরা মানুষ এদিক ওদিকে চলাফেরা করছে। একটু বাদে ছন্দাকে দেখলাম, শালোয়ারের ওপরে একটা লম্বা সোয়েটার আর গলায় একটা শাল জড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আমি কাছে গিয়ে ওর হাতের থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। আমার কাছে একটা ছোট ব্যাগ ছিলো দুই জোড়া জামাকাপড় আর দুটো জ্যাকেট কিন্তু মেয়েদের ব্যাগে পুরো সংসার যায় তাই ছন্দার ব্যাগের আকার আমার চেয়ে তিনগুন বড়।
লোকের ভিড় ঠেলে ব্যাগ কাঁধে প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলাম। বিহারের ট্রেন, প্লাটফরম যেন জনসমুদ্র। ট্রেন দিতে না দিতেই ঠ্যালা ঠেলি শুরু, এটা অবশ্য আমার পক্ষে নতুন নয়। ছন্দা গজগজ করতে করতে আমার পেছনে কোন রকমে লুকিয়ে পড়ল। সেই সময়ে খুব বড়লোক ছাড়া মধ্যবিত্তরা এসি তে উঠতো না, আমরাও সেকেন্ড ক্লাসে রিজার্ভেশান করিয়েছিলাম। আমি ওকে বললাম যে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়াবে, ভিড় কমার পরে আমরা ট্রেনে উঠলাম। উঠে দেখি প্রায় পঙ্গপালের মতন একটা পরিবার আমাদের সিট দখল করে বসে, একটা বুড়ো, একটা মাঝ বয়সি লোক তার বউ, চারখানা বাচ্চা কাচ্চা। ওদের সঙ্গের মালের কোন সিমানা নেই, তিনটে বস্তা, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, দুটো কাপড়ের পুটুলি মার্কা ব্যাগ। আমি আমাদের সিট দেখিয়ে বললাম যে এই দুটো আমাদের সিট। বৌটা একটু সরে গিয়ে ছন্দাকে বসতে জায়গা দিল, যেন আমরা ওদের কাছে সিটে বসার জন্য ভিক্ষে চেয়েছি। ওই দেখে ছন্দার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে তেড়ে উঠলো, “এই সিট আমাদের হ্যায়, পয়সা দেকে রিসার্ভ করা হ্যায় বিনা পয়সায় জাতা নেহি।”
বউটা কি বুঝলো কি বুঝল না জানিনা হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছন্দা এক টানে সিটের ওপর থেকে ওদের মালপত্র গুলো নিচে ফেলে দিল সঙ্গে সঙ্গে সাথের যে লোকটা ছিলো সে তেড়ে ফুঁড়ে উঠলো। আমি লোকটাকে ওর টিকিট দেখাতে বললাম, লোকটা টিকিট দেখালো। ওদের জেনারেল কম্পার্টমেন্টের টিকিট। আমি ওদের ওইখান থেকে নেমে যেতে বললাম। সে লোক কিছুতেই বুঝতে চায় না, টিকিট কেটেছে আলবাত যাবে।
ছন্দা ওকে তেড়ে বললো, “তুম লোগ কে মুন্ডি মে কিছু নেই, খোট্টার জাত এখুনি না নামলে আমি টিটি বুলায়গা।”
আমি বুঝতে পারলাম যে এদের সাথে বচসা করে লাভ নেই। রাগে গজগজ করতে করতে বৌটাকে ঠেলে দিয়ে ছন্দা জানালার কাছে গিয়ে বসে পড়ল আর আমাকে টেনে ওর পাশে বসিয়ে দিল। ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়ল আর বর্ধমানে টিটি উঠলো।
ছন্দা তো টিটিকে তেড়ে ওঠে, “যাত্রী ওঠানোর সময়ে আপনাদের দেখা উচিত কার রিজার্ভেশান আছে আর কার নেই। এখুনি ওদের নামিয়ে দিন না হলে আমি স্টেসান মাস্টারের কাছে যাবো।”
টিটি হেসে বললো, “ম্যাডাম এত লোকের টিকিট চেক করে তো আর ওঠানো যায় না, তাহলে ট্রেন ছাড়তেই সকাল হয়ে যাবে।”
ওদেরকে বর্ধমানে নামিয়ে দিল টিটি। বর্ধমান ছাড়ার পরে দেখলাম যে ট্রেন বেশ খালি, কম্পারট্মেন্টে লোকজন বিশেষ নেই। আমাদের ওই ছয়জনার কুপে শুধু মাত্র দুইজনেই ছিলাম, তাতে আমাদের বেশ সুবিধে হল একটু একত্রে থাকার। ছন্দা বেশ কয়েকবার দেওঘর গেছে আর প্রত্যেক বার এই রকম কিছু না কিছু ঘটেছে। ট্রেন দুলকি চালে চলতে শুরু করলো। ছন্দা বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে এনেছিলো লুচি আর আলুর তরকারি, খবরের কাগজ পেতে খাওয়া দাওয়া সেরে বার্থ নামিয়ে শুয়ে পড়লাম। আসানসোল থেকে আরও কয়েকজন উঠলো।
আমি চোখ বন্ধ করতে যাবো কি ছন্দা ধড়মড় করে আমাকে উঠিয়ে বললো একটু পরেই নাকি জসিডি এসে যাবে। যাঃবাবা যাও বা একটু চোখ লেগেছিলো তাও কেটে গেল।
সূর্যি মামা পুবদিক থেকে কোন রকমে উঁকিঝুকি মারছে আর সেই সময়ে আমরা নেমে পড়লাম জসিডিতে। জসিডিতে নামতেই ছ্যাক করে ঠাণ্ডা আমাদের চেপে ধরলো। আমি আমার জ্যাকেটটা আরও জড়িয়ে ধরলাম আর ছন্দা শালটা বার করে ওর সোয়েটারের ওপরে চাপিয়ে নিল। ছন্দা জানাল সেখান থেকে কয়লার ইঞ্জিনের ছোট লাইনের অন্য একটা ট্রেন ধরে দেওঘর যেতে হবে। ওই ছোট ট্রেনে উঠলাম, সেখানে রিসারভেসানের কোন বালাই নেই, বেশির ভাগ যাত্রী বিনা টিকিটের। যাই হোক ঠেলে মেলে জায়গা করে সেই ছোট ট্রেন করে দেওঘর যাওয়া হল। স্টেসানে নামতেই এক গাদা হোটেল অয়ালা, টাঙ্গা ওয়ালা আর বৈদ্যনাথ ধামের পান্ডা ছেঁকে ধরলো। ছন্দা পটীয়সী মহিলার মতন আমার হাত ধরে ওদের বাঁচিয়ে বেড়িয়ে চলে এলো।
একটা এক ঘোড়া টানা টাঙ্গায় চেপে একটা হোটেলের নাম করে বললো সেখানে নিয়ে যেতে। সে এক অদ্ভুত অনুভুতি, ভোরের আকাশ হালকা রোদে মাখা, খালি রাস্তা আর চারপাশে কুয়াশা ভরা সকালো আর আমার কোল ঘেঁসে ছন্দা বসে। কোথাও বেশ কয়েকজন লোক আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছে, সেই কাঠের ধুয়োর গন্ধে এক অদ্ভুত গন্ধ। পথের দুপাশে উঁচু উঁচু সারবাঁধা ইউক্যালিপ্টাস গাছ, নিম গাছ ইত্যাদি।
পথে যেতে যেতে আমাকে বললো, “ভাইয়ের স্কুলে গেস্ট হাউস আছে, তবে সেখানে একসাথে থাকাটা একটু দৃষ্টি কটু লাগবে। তাই আমরা একটা হোটেলে উঠবো।”
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললাম, “মা তারা তুমি আমাকে যেখানে ফেলবে সেখানেই দেহ রাখবো।”
আমার ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললো, “ছিঃ দেহ রাখার কথা একদম বলতে নেই।”
শহরের ভিড় ছাড়িয়ে একটু তফাতে এক নিরিবিলি জায়গায় আমাদের হোটেল। খুব বড় না হলেও বেশ ছিমছাম, হোটেল দেখে ছন্দা বেশ খুশি, কিন্তু বাঙালি মেয়ে একটু খুঁতখুঁতে না হলে চলে না। রুমে ঢুকেই ছেলেটাকে বললো যে বিছানার চাদর বদলে দিতে। ছেলেটা যত বুঝাতে চায় যে বিছানার চাদর পরিষ্কার কিন্তু ছন্দা সে কথা মানতে নারাজ। একটানে চাদর সরিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে বললো এখুনি যদি চাদর না বদলায় তাহলে হোটেল থেকে চলে যাবে। অগত্যা কি করে একটা নতুন চাদর এনে পেতে দিল। সেই সাথে বালিশের অয়ার বদলে দিল। আমি চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে শুধু ছন্দাকে দেখে গেলাম।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১২)
ছেলেটা চলে যেতেই দরজা বন্ধ করে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেকদিন পরে কাছে পেয়েছি তাও আবার একেবারে নিজের করে, এখানে বাধা দেওয়ার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই শুধু মাত্র দুইজনে এক কামরায়।
ছন্দা আমার হাতের ওপরে হাত রেখে আলিঙ্গন আরও নিবিড় করে সোহাগ ভরা কণ্ঠে বললো, “প্লিজ ছেড়ে দাও না হলে কিন্তু কামড়ে দেব, সত্যি বলছি।”
আমিও বদমাশি করে ওর নরম গালে আমার না কামানো গাল ঘষে দিলাম, “উম্মম এবারে সম্পূর্ণ ভাবে একা পেয়েছি আর ছাড়ছি না কোন মতেই।”
এই ঠাণ্ডার মধ্যেও আসন্ন উত্তেজনায় বুকের রক্ত চনমন করে ওঠে ছন্দার। আমি দুইহাতে ওর পেলব দেহ পল্লব জড়িয়ে ধরলাম, মনে হল যেন ও গলে যাবে আমার বাহু বেষ্টনীর মাঝে। ছন্দা কেঁপে উঠলো আমার প্রগাড় আলিঙ্গনে, ধীরে ধীরে আমার বাঁ হাত ওর সুগৌল উদ্ধত কুচের নিচে উঠে এলো আর আর ডান হাতটি নেমে গেল নরম গোল তলপেটের ওপরে। ঠোঁট নামিয়ে আনলাম ওর মসৃণ মরালি গর্দানে, আলতো করে ভিজে ঠোঁট ছুইয়ে দিতেই কেঁপে উঠলো ললনা। আমার ধমনীতে লেগেছে প্রেমের আগুন আর সেই অগুন ওর শরীরে ছড়াতে বেশি সময় নিল না। এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় ছন্দার সারা শরীরে। দুই হাত আমার হাতের ওপরে দিয়ে বাহুবেষ্টনীকে আর চেপে দেয় নিজের শরীরের ওপরে। আমি ওর কামিজের ওপর দিয়েই অল্প অল্প করে নাভির নিচের নরম নারীমাংসে আদর করতে শুরু করে দিলাম। নিজের অজান্তেই আমার বাহু বেষ্টনী বজ্র কঠিন হয়ে গেল, এইবারে দুই হাতে যেন পিষে ফেলবে ওকে। নভেম্বরের ঠাণ্ডা আর দুই তৃষ্ণার্ত কপোত কপোতী কে আলাদা করে রাখতে পারেনা। ছন্দার বুকের মাঝে, হারিয়ে যাওয়ার এক লেলিহান শিখা ধিকি ধিকি করে জ্বলে ওঠে। মাথাটা পেছনের দিকে হেলিয়ে দেয়, আমার দাড়ি না কামানো গালে গাল ঘসতে থাকে। প্রেমের ঘর্ষণে নরম গালে অগ্নিস্ফুলিঙ্গর আবির্ভাব হয়। আমাদের মাঝে একটি সর্ষে দানা রাখলে যেন তেল বেড়িয়ে আসবে, এমন ভাবে এক জন আর এক জনের সাথে আঠার মতন মিশে গেলাম।
আধবোঝা নয়নে, প্রেমঘন কাঁপা গলায় ছন্দা বলে ওঠে, “জানো আমি ভাবতে পারছি না যে আমরা সত্যি এখানে একসাথে।”
সত্যি সেটা আমিও ভাবতে পারছিলাম না যদি না ও আমার গালে একটা হালকা আদরের কামড় বসিয়ে দিত। আমি ওর ঘাড়ে গর্দানে কানের লতিতে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলাম। ছন্দার বুকের উষ্ণ রক্ত ত্বকের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়ার ফলে ওর দুই বুকে অন্তহীন সমুদ্রের ঢেউ খেলতে শুরু করে।
প্রেমঘন আপ্লুত কণ্ঠে বললাম, “ছন্দা আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
গালে গাল ঘসতে ঘসতে, ছন্দা মিহি স্বরে জিজ্ঞেস প্রেম নিবেদন করলো, “তোমাকে ছাড়া আর কোথায় যাবো সোনা? জানো কফি হাউসে বসে প্লান করার পরের দিন থেকেই আমার রাতের ঘুম ছিলো না, কবে তোমার কাছে যাবো এই ভেবে।”
উত্তেজনায় আমার সিংহ কেশর ফুলিয়ে দিল আর নিটোল নিতম্বের খাঁজের মাঝে আমার সিংহের স্পর্শের অনুভুতি পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে ছন্দা। ক্ষিপ্ত সিংহ কেশর ফুলিয়ে কোমল নিটোল নিতম্ব মাঝে বিঁধে গেছে।
আমি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কিছুতেই তোমাকে ছারছি না, এবারে পিষে ফেলব।”
আমার পৌরুষত্তের ছোঁয়া পেয়ে কিঞ্চিত উত্তেজিত হয়ে উঠলো সেই সাথে সেটা দমিয়ে নিয়ে বললো, “আমার ওপরে একটু দয়া করবে না? সারা রাত ট্রেনে এসে জামা কাপড় নোংরা হয়ে গেছে দয়া করে স্নান সারতে দাও।”
ধীরে ধীরে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আর হটাত দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল আমার বুকের ওপরে। তারপরে খিলখিল করে হেসে উঠে আমার বাহুপাশ ছাড়িয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে নিজের জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। অগত্যা আর কি করি, একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রেমিকার অপেক্ষা করতে থাকলাম।
স্নান সেরে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বেড়িয়ে এলো, আমি ওর ওই রুপ দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। ছন্দা বড় লজ্জা পেয়ে আমাকে বকা দিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিতে বললো। ওর দিকে দুই পা এগোতেই পালিয়ে গেল। আমি দাড়ি কাটার রেজর ব্লেড আর আমার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। বাথরুমে আলো কম তাই দাড়ি কাটার সময়ে আর দরজা বন্ধ করিনি।
আমি দাড়িতে সাবান লাগিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করলাম কি করছে। স্নান সেরে ললনা নীলাম্বরী হয়ে সেজে, পরনে হাল্কা নীল রঙের শাড়ি। ভিজে চুল পিঠের ওপরে এলো করা, সারা দেহ থেকে এক মিষ্টি গন্ধ নির্গত হচ্ছে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমার খালি ছাতি দেখে থমকে আমার দিকে চেয়ে রইলো ক্ষণিকের জন্য তারপরে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। আমি ওকে দেখে চোখ মেরে ইশারায় বললাম যে একদম মার কাটারি লাগছে, পথে বের মানুষ ওকে দেখবে আর হোঁচট খাবে। আমি ওর কাছে এসে দুষ্টুমি করে ওর নাকের ওপরে ফেনা মাখিয়ে দিলাম।
একটু রাগের ভান করে ছন্দা বললো, “ধুত, কি যে কর না তুমি, সাজ টাই নষ্ট করে দেবে।”
এই বলে নাকটা আমার অনাবৃত বাজুর ওপরে মুছে দিল। নাক মুছতে গিয়ে নিজের অজান্তে, সুগৌল উদ্ধত কোমল বক্ষ আমার বাজুতে লেগে গেল। আঁচলে ঢাকা নরম কুচের স্পর্শে আমার শরীর গরম হয়ে যায়। ছন্দা, আমার দেহের বেড়ে ওঠা উত্তাপ বুঝতে পেরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কোমরে একটা দুলুনি দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার দিকে চলে যায়।
যাবার আগে আমার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয় “কালকেই তো দাড়ি কেটে বেরিয়েছ, এখন আবার দাড়ি কামাতে গেলে কেন?”
আমি ও কম যাই না, সুন্দরী কপোতীর উত্তর জুতসই দিতে হয়, “তোমার ওই গোলাপি গালে গাল ঘষে মনে হল তোমার কিছুটা আমার গালে লেগে গেছে তাই সেগুলো উঠানোর জন্য দাড়ি কামাচ্ছিলাম।”
লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় ছন্দার, “এক চড় মারবো এবারে, তাড়াতাড়ি স্নান করো মন্দির যেতে হবে।”
উফফফ বাঃবা আবার সেই মন্দির। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বেড়িয়ে এলাম। ছন্দা ততক্ষণে গায়ের ওপরে একটা গাঢ় নীল রঙের ওভারকোট চাপিয়ে নিয়েছে আর সেই সাথে গলায় একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছে। আমি জামা কাপড় পরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে হবে এবারে। ছন্দা বললো, বৈদ্যনাথ ধামের মন্দিরে আগে পুজো দেবে তারপরে খাওয়া দাওয়া করবে। সেখান থেকে অনুকুল ঠাকুরের আশ্রম দেখতে যাবো এবং বিকেলে সত্যজিতের স্কুলে যাবো।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে আবার সেই টাঙ্গা চেপে মন্দিরের কাছে এলাম। দেওঘরে প্রচুর সঙ্খ্যখ বাঙালি একসময়ে মধুপুর, দেওঘর, রাঁচি এইসব জায়গায় বড় লোক বাঙালিদের বাগান বাড়ি থাকত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেই বাগান বাড়ি গুলো অনেকে বিক্রি করে দিয়েছে অথবা বেহাত হয়ে গেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। সরু অলিগলি পেরিয়ে লোকজনের ভিড় ঠেলে মন্দিরে পৌছালাম। বিশাল মন্দির প্রাঙ্গন লোকে লোকারণ্য, শিবের মন্দিরে দর্শন করার জন্য লম্বা লাইন। লাইন দেখে আমি ভিরমি খেলাম, লাইন দিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে রাজি, যাত্রা পালা দেখতে রাজি কিন্তু….. ছন্দা চোখ পাকিয়ে আমাকে চুপচাপ ওর পাশে দাঁড়াতে বললো। এর মাঝে আবার পাণ্ডাদের উৎপাত, পুজো করিয়ে দেবে একদম সাক্ষাৎ বিগ্রহ দর্শন করিয়ে দেবে।
ছন্দা ওদের কথায় কোন কান দিল না, ওদের বললো, “ঠাকুর পুজো আমি দেব আমার মতন করে, সেখানে মন্ত্রের কি দরকার, কারুর মধ্যস্ততার করার কি দরকার?”
প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করে শেষ পর্যন্ত দর্শন মিলল। একটা অতি ক্ষুদ্র দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম একটা অতি ক্ষুদ্র গর্ভ মন্দিরে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে শিবের মূর্তি কোথায়? ছন্দা আমাকে মেঝের মাঝে একটা কালো পাথর দেখিয়ে বললো, “ওই যে শিব লিঙ্গ।”
চারপাশে যা লোকের ভিড় আর চিৎকার চেঁচামেচি তাতে কি আর শান্তি করে পুজো দেওয়া যায়? কিন্তু ছন্দার দেওয়া চাই, আমি ওকে দুই হাতে আগল করে একপাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। ডালিতে আনা ফুল বেল পাতা জল দিয়ে পুজো দিল। এর মাঝে একটা পান্ডা আবার আমার কপালে আর ছন্দার কপালে সিঁদুরের তিলক কেটে দিল।
ওইখান থেকে কোন রকমে বেঁচে বেড়িয়ে ওকে বললাম, “আর যদি কোন মন্দিরে আমাকে ঢুকিয়েছ…..”
হেসে আমাকে বললো, “দেখে শুনে প্রেম করতে পারতে! তাহলে এই সমস্যা হতো না।”
আমি বললাম, “কলেজে পড়ার সময়ে জানতাম না যে তুমি পাথর দেখলেই পেন্নাম ঠুকবে।”
অভিমানিনীর মানে লেগে গেল, “এখন সময় আছে, অন্য মেয়ে খুঁজে নিতে পারো।”
আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, “যা বাবা, এইটুকু ঠাট্টা করতে পারবো না?”
আমার বাজুতে চিমটি কেটে বললো, “যা খুশি নিয়ে ঠাট্টা করো, কিন্তু আমার ঠাকুর আমার বিশ্বাস নিয়ে একদম নয়।”
সেদিনের পর থেকে কোনোদিন ওর পুজো অর্চনা নিয়ে কিছু বলিনি। সেদিনের কথায় আমি বুঝেছিলাম কারুর বিশ্বাসে কোনোদিন আঘাত হানতে নেই। বিশ্বাসের জোরে এই পৃথিবী চলে, মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে। তারপরে ছন্দা অবশ্য আমাকে, প্রনাম করতে অথবা মন্দিরে যেতে বিশেষ জোরাজুরি করত না তবে ওর মন রাখতে আর বিশ্বাসের জন্য ওর সাথে যেতাম।
মন্দির প্রাঙ্গনে আরও দেব দেবীর ছোট ছোট মন্দির, সব বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে প্রনাম করলো। পুজো সেরে মন্দির থেকে বের হতে আমাদের দুপুর হয়ে গেল। ছন্দা বললো আর অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমে যাবে না, খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে ভাইয়ের স্কুলে যেতে হবে।
মন্দির থেকে বেড়িয়ে অলিগলি পেড়িয়ে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এসে বললো, “এখানের রসগোল্লা খেয়ে দেখ, ওই কোলকাতার রসগল্লাকেও হার মানিয়ে যাবে।”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাই নাকি?”
অবন্তিকা নাম ছিলো ওই মিষ্টির দোকানের, আজও আছে ওইখানে দাঁড়িয়ে, পুরানো নতুন যারাই যায় একবার অবন্তিকার রসগোল্লা খায়। আমরাও পুরি আর ছোলার ডাল খেয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হোটেলে যাওয়ার পথে দেওঘরের ইতিহাস আমাকে শুনাল, অত ধার্মিক আমি কোনোদিন ছিলাম না তাই মন দিয়ে শুনলাম ওর গল্প। ভাইকে ভর্তি করতে এসে নন্দন পাহাড়, ত্রিকুট পাহাড়, তপোবন আরো অনেক জায়গা ঘুরে এসেছে। কিন্তু সব জায়গায় মন্দির তাই ছন্দা আর আমাকে জোর করলো না। তবে আমরা ঠিক করলাম যে একবার দেওঘরের আশেপাশের জায়গাও ঘুরে দেখে নেব, পারলে ম্যাসাঞ্জোর ড্যাম দেখে আসা যাবে।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের আগেই আমরা রওনা দিলাম মিশন স্কুলের দিকে। পথে যেতে যেতে সেই মিশনের কথা আমাকে বললো। বিশাল লোহার গেটের সামনে আমাদের নামতে হল। গেটের ভেতরে ঢুকতেই মনে হল এক অন্য জগতে এসে গেছি। সোজা একটা রাস্তা সদর গেট থেকে মন্দির পর্যন্ত, একটু ভালো ভাবে তাকালে এমন কি মন্দিরের ভেতর পর্যন্ত দেখা যায়। চারপাশে বড় বড় খেলার মাঠ, এক পাশে স্কুল, আর মন্দিরের চারদিকে ছড়িয়ে ছেলেদের থাকার ধাম। আমরা যখন স্কুলে পৌঁছেছিলাম তখন ওদের স্কুলের ছুটি হয়েছিলো। এক রঙের ড্রেস পরা অত গুলো ছেলে কিলবিল করে স্কুল থেকে বেড়িয়ে এল। আমি ভাবলাম এদের মধ্যে ছন্দার ভাইকে কি করে খুঁজে পাওয়া যাবে। ছন্দা ঠিক ওর ভাইকে খুঁজে বের করলো আর দিদিকে দেখে সত্যজিত দৌড়ে এলো। সেই প্রথম ওর সাথে দেখা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো। ঠিক যেমন ভাবে বড়দি আমাকে স্কুল যাওয়ার আগে জামা প্যান্ট ঠিক করে মাথা আঁচরে দিত ঠিক সেই ভাবে ওর ওই চুলের মধ্যে আঙ্গুল ডুবিয়ে আঁচরে দিল।
ছন্দা আমাকে সত্যজিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এত দুষ্টু ছেলে, মিচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি তো টুক করে দিদিকে নিয়ে পালাবে আর আমি কি করবো?”
ছন্দা ওকে মৃদু বকে বললো, “হ্যাঁ তুই খুব পেকে গেছিস তাই না।” ব্যাগ খুলে ওর জিনিসপত্র দিয়ে বললো ওই গুলো রেখে আসতে।
আমি ছন্দার দিকে দেখে ওকে বললাম, “আমি যেখানে যাবো তোকে সঙ্গে নিয়ে যাবো চিন্তা নেই।”
আমরা ঘুরে ঘুরে মিশন দেখলাম, বিকেলের প্রার্থনা দেখলাম, বিশাল মন্দিরের নাট মন্দিরে সাড়ে তিনশ ছেলের একসাথে বন্দনা গান। সেই সব শুনে অবাক হয়ে যেতে হয় আমি যেন অন্য এক আধ্যাত্মিকতায় বিচরন করছিলাম সেই সময়ে।