Written By pinuram
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১৩)
বেশ কিছুক্ষণ সত্যজিতের মিশনে কাটিয়ে রাতের খাবার একে বারে সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। গত রাতে ঘুম হয়নি তাঁর ওপরে আবার সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলাম দুইজনেই। হোটেল ঢুকে হাত পা ধুয়ে বিছানায় পড়তেই আমার শরীর ছেড়ে দিল কিন্তু মন ওদিকে কিছুতেই মানছে না। পাশে প্রেয়সী, এক বিছানায় একসাথে ঘুমাবে একটু আদর একটু সোহাগ।
আমি কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পরে আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম আর ছন্দাকে ঘুর ঘুর করতে দেখলাম। কামরায় ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল। পরনে একটা গোলাপি রঙের পাতলা রাত্রিবাস, দেখলেই বোঝা যায় যে তাঁর নিচে কোন অন্তর্বাস নেই। আমার দিকে চোখ কুঁচকে ভ্রুকুটি নিয়ে তাকিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিল, ঠোঁটে মাখা দুষ্টুমি ভরা হাসি যার অর্থ আমি যাই করি না কেন ওকে ছুঁতে পারবো না কিছুতেই। আমি ওর ওই পোশাক দেখে চট করে গেঞ্জি খুলে ফেললাম আর সেই দেখে ছন্দার চক্ষু চড়ক গাছ।
আয়নার সামনে বসে প্রসাধনি সারতে সারতে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললো, “গেঞ্জি খুললে কেন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে।”
উত্তরে আমি বললাম, “তোমাকে এই পোশাকে দেখে গরম লেগে গেল।”
চশমা খুলে মুখে প্রলেপ লাগানোর সময়ে আমাকে বললো, “তাহলে আরো একবার স্নান করে এস সব গরম নেমে যাবে।”
প্রসাধনি সেরে বিছানার পাশে এসে নিজের বালিশ খাটের একপাশে টেনে নিয়ে মিচকি হেসে বললো, “এই দুরত্ব যেন একফোঁটা কম না হয়। আমি কিন্তু রামপুরি চাকু সাথে এনেছি, ধরতে এলেই কিন্তু চেঁচামেচি করে লোক জড় করে ফেলবো।”
একটাই লেপ সেটাই নিজের দিকে টেনে নিয়ে আমাকে দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, “এবারে লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো।”
আমি ওর দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ আমি যেন এইখানে ঘুমাতে এসেছি।”
লেপের মধ্যে ঢুকে আমার গালে একটা চাঁটি মেরে বললো, “কি করতে এসেছ শুনি?”
আমি ওর হাত নিজের গালে চেপে ধরে বললাম, “একটু আদর।”
আমার গালে আদুরে চিমটি কেটে বললো, “হয়েছে অনেক প্রেম দেখান হয়েছে, এবারে লাইট নিভিয়ে দাও।”
আমি আলো নিভিয়ে ছোট হলদে রঙের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলাম, ছন্দা চশমা খুলে বিছানার একপাশে রেখে লেপখানা বুক পর্যন্ত টেনে শুয়ে পড়ল, আমি ওর পাশে শুয়ে পড়লাম কিন্তু কিছুতেই আমাকে লেপ দিতে চায় না। কাক চড়াইয়ের মারামারি শুরু হল। ওর নরম তুলতুলে শরীর নিয়ে খেলতে আমার বড় ভালো লাগছিলো, বারে ওর নরম কুঁচ যুগল আমার প্রশস্ত বুকের ওপরে পিষে যাচ্ছিল আর সেই সঙ্গে আমার রক্ত আমার উত্তেজনার পারদ চড়তে লাগলো। ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম যে ভালোবাসার অগ্নিবীণা ওর হৃদয়ে রিনিঝিনি করে বাজতে শুরু করেছে। আমি ওকে টেনে আমার দেহের ওপরে উঠিয়ে নিলাম। বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে আমাদের মধ্যে একটা ব্যাবধান রেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলতো করে গোলাপি জিবটা বের করে নিচের ঠোঁটের ওপরে বুলিয়ে নেয় ছন্দা। সুন্দর ওই চেহারা লাল হয়ে গেছে লজ্জায় চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে আমার আগুনে চাহনির সামনে।
আমার নাকের ওপরে তর্জনী দিয়ে আঁকি কেটে সোহাগ ভরা কণ্ঠে বললো, “তোমার নাকি ঘুম পাচ্ছিল, গা ম্যাজ ম্যাজ করছিলো? কোথায় গেল অইসব?”
ওই কুহুডাক শুনে আমি আর শান্ত থাকতে পারলাম না, দুই বাহু দিয়ে ওর নরম দেহ পিষে নিলাম বুকের ওপরে আর ওর আঙ্গুল কামড়ে বললাম, “পাচ্ছিল বটে তবে একটা সুন্দরী জল পরী এসে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল এবারে একটু আদর না করলে আর থাকতে পারছি না সোনা।”
আমার লুঙ্গি আর অন্তর্বাস ফুঁড়ে আমার কঠিন পুরুষাঙ্গ ওর নরম পেটের ওপরে বিঁধে গেল।
আমার নাকের ডগায় একটা ছোটো চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো সুন্দরী ললনা, “আমাকে ছাড়া কোন মেয়ের দিকে তাকালে চোখ দুটো অন্ধ করে দেব।”
আমি ওর নরম গালে গাল ঘষে বললাম, “ওপেন হার্ট সার্জারি করে দেখে নাও কে আছে এই বুকে।”
আমার অন্তরবাসের ভেতরের সিংহটি বারেবারে প্রবল ভাবে হুঙ্কার ছেড়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে। ওর নরম তুলতুলে পেটের সাথে চেপে গেছে একেবারে। শরীরের উত্তাপ দুই শরীরে ছড়িয়ে পড়তে দেরি লাগলো না। আমি ছন্দাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়িয়ে গেলাম। নরম বিছানায় চিত হতে শুতেই আমার গলা জড়িয়ে ধরলো ছন্দা, পরনের পাতলা রাত্রিবাস স্থানচ্যুত হল, সুগোল বক্ষ যুগল আমার চোখের সামনে উন্মচিত হয়ে গেল, উদ্ধত কুঁচ শৃঙ্গের মাঝের কালোচে বৃন্ত দুটি যেন আমার পানে চাতকের ন্যায় চেয়ে রয়েছে একটু ঠোঁটের ছোঁয়া পাওয়ার আকুল আকাঙ্খায়।
আমার দৃষ্টি আটকে যায় ওর কুঁচ শৃঙ্গ দেখে। ছন্দার প্রতি নিঃশ্বাসে কামনার আগুন, প্রেমের আবেগে নয়ন জোড়া সিক্ত নয়নে হয়ে ওঠে আর ঝরে সোহাগের প্রবল কামনা। আমার লুঙ্গির গিঁট কখন খুলে গেছে সেটার খেয়াল নেই, ওর রাত্রিবাস আমাদের কামকেলির ফলে প্রায় কোমরে কাছে উঠে এসেছে। ছন্দা কোন অন্তর্বাস পরেনি সেটা আমার পুরুষাঙ্গের ছোঁয়ায় বুঝতে পারলাম। আমাদের মিলিত শরীরের আনাচে কানাচে থেকে আগুনের ফুলকি নির্গত হচ্ছে থেকে থেকে। নিঃশ্বাস নেওয়ার ফলে, বুকের ওপরে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে।
আমি ওর মুখখানি আঁজলা করে তুলে ধরে বললাম, “তুমি অনেক দুষ্টু মেয়ে, এবারে তার শাস্তি দেব।”
আমি জিব বের করে ওর নাকের ওপরে আলতো করে চেটে দিলাম। ছন্দা আর থাকতে না পেরে দু’হাত দিয়ে আমার চুল আঁকড়ে ধরে টেনে নেয় নিজের ঠোঁটের ওপরে, চেপে ধরে কোমল অধর ওষ্ঠ। গোলাপি জিব বের করে বুলিয়ে দেয় আমার পুরু ঠোঁটের ওপরে দুই জোড়া অধর ওষ্ঠ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
ছন্দার পেলব জঙ্ঘার ওপরে আমার ক্ষিপ্ত পুরুষাঙ্গ বারেবারে অস্তিত্বের জানান দেয়। আমার ডান পা ওর জঙ্ঘা পায়ের মাঝে ভাঁজ হয়ে ঢুকে যায়, নগ্ন কঠিন জঙ্ঘার ওপরে ছন্দার সিক্ত নারীত্বের অধর পিষ্ট হয়ে যায়। ছন্দা থরথর করে কেঁপে ওঠে আর আমার ঠোঁট কামড়ে ধরে। প্রতিনিয়ত ঘর্ষণের ফলে সিক্ত নারীত্বের অধর হতে ফল্গুধারা অঝোর ঝরনা ধারায় পরিণত হয়। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয় আমার ঠোঁট, গাল, থেকে থেকে কামড়ে ধরে ঠোঁট। প্রেম উন্মাদিনী আমার মাথার চুল, দশ আঙ্গুলে খামচে ধরে।
মাথা ছেড়ে ওর হাত চলে আসে আমার পুরুষালি কাঁধের ওপরে, আমি ওর নরম গোলাপি ঠোঁট ছেড়ে নিচের দিকে মুখ নামিয়ে আনলাম, ধীরে ধীরে ওর গালে, চিবুকে, গলায় অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলাম। প্রশস্ত বুকের নিচে পিষ্ট হয়ে সমতল হয়ে যায় ছন্দার কোমল তুলতুলে কুঁচ যুগল। ছন্দা চোখ দুটি বন্দ করে নেয়, ধিরে ধিরে আমার ঠোঁট নেমে আসে ওর কোমল বক্ষের ওপরে। একটা কুঁচ মুখের মধ্যে নিয়ে আলতো করে কামড়ে দিলাম ওর ফুটন্ত বৃন্ত। সারা শরীরের প্রতিটি রোমকূপ আমাদের আসন্ন মিলনের প্রতীক্ষায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
কামড় দিতেই কেঁপে উঠলো ছন্দা, “শয়তান এই ছিলো তোমার মনে? আমাকে একেবারে পাগল করে দিচ্ছ যে……”
নিঃশ্বাসে প্রেমাগ্নি অঝোরে ঝড়ে পড়ছে। আমার কাঁধে এক হাত রেখে আমার মাথা চেপে ধরে নিজের বুকের ওপরে। আমার সর্বাঙ্গে শতশত ক্ষুদ্র পতঙ্গ যেন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠোঁট নামিয়ে আনলাম ওর বক্ষ বলয়ের নিচে। ডান হাত নেমে আসে ছন্দার জঙ্ঘা মাঝের কোমল অধরে। ছন্দা নারীত্বের কোমল অধরে আমার কঠিন আঙ্গুলের পরশ পেতেই টানটান হয়ে যায়। সেই প্রথম কোন সম্পূর্ণ নারীকে আস্বাদন করতে চলেছি, আমার শয়তান আঙ্গুল ওর শিক্ত অধর ওষ্ঠদ্বয় নিয়ে এক উন্মাদের খেলায় মেতে উঠলো।
দুই চোখের পাতা শক্ত করে বন্ধ, ওর ঘাড় বেঁকে গেল পেছন দিকে, বালিশের ওপরে মাথা চেপে ধরে মিহি শীৎকার করে ওঠে ছন্দা, “উমমমমম আর পারছি না যে সোনা, তুমি আমাকে পাগল করে দিলে একেবারে……”
দু’হাত দিয়ে সারা শরীরের শেষ শক্তি টুকু নিঙরে আমার চুল আঁকড়ে ধরে টেনে নেয় নিজের বুকের ওপরে। ছন্দার অঙ্গে অঙ্গে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে বেড়ায়। আমি মধ্যমা আর অনামিকা ওর জঙ্ঘা মাঝের অধরে প্রবেশ করিয়ে দিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে নিচের ঠোঁটটি কামড়ে ধরে ছন্দা। আমার দুই আঙ্গুল ভিজে গেল, ওর নারীত্বের গহ্বর যেন এক উষ্ণপ্রস্রবণ। ওর সারা শরীর ধনুকের মতন বেঁকে যায় গেল কেউ যেন ওর মাথা থেকে কোমর অবধি ছিলা দিয়ে টেনে বেঁধেছে।
অস্ফুট শীৎকার করে ওঠে আমার হৃদ সুন্দরী, “মেরে ফেললে যে…… সোনা”
শরীরের শেষ শক্তি টুকু গুটিয়ে নিয়ে দু পা দিয়ে চেপে ধরে নিজের ওপরে টেনে নেয় আমাকে। আমি আঙ্গুল সঞ্চালনের গতি বাড়িয়ে দিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিলা ভঙ্গ ধনুকের মতন টঙ্কার দিয়ে নেতিয়ে পড়ল ছন্দা, সেই সাথে বুকের ওপরে আমাকে চেপে ধরলো। আমার আঙ্গুল ভিজে গেল, বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতন শত ধারায় সুধা ঝরে পড়লো। সেই ধারার যেন কোন অন্ত নেই অবিশ্রান্ত অবিরাম। আমার পেশি বহুল দেহের নিচে ঝরা পাতার মতন নেতিয়ে পড়লো ছন্দা।
বেশ কিছুক্ষণ পরে পদ্ম পাপড়ির মতন চোখের পাতা খুলে দুষ্টু মিষ্টি হাসি মাখিয়ে দিল আমাকে, চোখের কোলে টলটল করছে এক বিন্দু খুশীর জোয়ার। দুই হাতে অঞ্জলির মতন আমার মুখ ধরে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি দেখছ এমন ভাবে?”
মৃদু প্রেমের বকা দিল আমাকে, “আমি আমার ভালোবাসা দেখছি তাতে তোমার কি?” বলেই আমার নাকের ওপরে আলতো করে নাক ঘষে দিল, “তুমি খুব শয়তান ছেলে, বলেছিলাম লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়তে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে পাগল করে দিয়েছ একেবারে।”
আমি আমার অন্তর্বাস খুলে নগ্ন হয়ে গেলাম। আমার দন্ডায়মান পুরুষাঙ্গ ছন্দার সিক্ত নিম্ন অধরের দোর গোরায় কড়া নেড়ে নিজের অস্তিত্তের জানান দিয়ে দিল। ছন্দার উত্তপ্ত নারীত্বের ছোঁয়া পেয়ে আমি ব্যাকুল হয়ে গেলাম শেষ বাধা টুকু কাটিয়ে দেহের মিলনের আকাঙ্খায়। দেহ জোড়া যেন আর আমাদের বশে নেই, দুই কাতর কপোত কপোতী মেতেছে নরনারীর আদিম মিলনের খেলায়। ছন্দা ওর কোমর উপরের দিকে ঠেলে ধরে, নিজের নিম্ন অধর চেপে ধরে আমার পুরুষাঙ্গের ওপরে। লজ্জাবতীর লজ্জা নেই, নেই পিছিয়ে যাওয়ার পথ। ওর শিক্ত নারীত্বের ছোঁয়ায় আমার পুরুষাঙ্গ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আমি মিলন আখাঙ্খায় উন্মাদ হয়ে গেলাম, হৃদয় সঙ্গিনীর জঙ্ঘার মাঝে নিজেকে হারিয়ে দিতে উন্মুখ হয়ে উঠলাম।
আবেগ ভরা কণ্ঠে ওকে বললাম, “এবারে কিন্তু আর আঙ্গুল যাবে না সোনা।”
ওর শরীরে ভর দিয়ে এলো প্রচন্ড কামিনী শক্তি, আমাকে ঠেলে ওপরে উঠেতে চায় ছন্দা, নিজের নারীত্বের অভ্যন্তরে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে নিতে চায় আমাকে। মিহি শীৎকারে আমাকে আহবান জানায়, “আমি তোমার, পার্থ, আমাকে নিজের করে নাও একেবারে।”
আমি ওর মাথার নিচে হাত দিয়ে ওর মাথা উঠিয়ে দিলাম আর ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দিলাম। সেদিনের আগে পর্যন্ত মিলনের সুখের আনন্দ যে কতটা চরম হতে পারে সেটা আমাদের অজানা ছিলো। আমার কটিদেশ নেমে আসতেই ওর নারীত্বের দ্বার খুলে যায়। কখন যে আমি ওর মধ্যে প্রবেশ করলাম তার বোধ রইলো না, ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলাম দুইজনে। শৃঙ্গারে রত কপোত আমি, আমার সুন্দরী কপোতীর কোমল শরীর নিয়ে আদিম ক্রীড়ায় মেতে উঠলাম। মন্থনের গতি কখন ধীরে, কখন তীব্র। আমার দেহের নিচে পিষ্ট হয়ে যায় সঙ্গিনী। চূড়ান্ত শৃঙ্গ মাঝে মাঝে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়, দুরে নয় বেশি, তবুও সেই শৃঙ্গ অধরা রাখতে প্রবল প্রচেষ্টা চালায় দু’জনেই। কেউ চাইছিলাম না এই রাত শেষ হয়ে যাক। সেই ঠাণ্ডায় আমাদের কেলির ফলে ঘেমে গেলাম, ললনার শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম নির্যাস মিশে যায় আমার গায়ের ঘাম। অনাবিল আনন্দের সমুদ্র সৈকতে বয়ে গেলাম দুইজনে, ঢেউয়ের তালে তালে নেচে উঠলাম পরস্পরের দেহ নিয়ে।
অবশেষে আমার ফুটন্ত লাভা মোহনার পানে ধেয়ে যায়, ছন্দার নারীত্বের বারিধারার সাথে মিলিত হবার জন্য। শরীরের শেষ শক্তি টুকু গুছিয়ে নিয়ে চেপে আমি আমার প্রানের কপোতীকে নরম বিছানার সাথে চেপে ধরলাম। ছন্দা কোমল বাহু দিয়ে শেষ শক্তিটুকু উজাড় করে পেঁচিয়ে ধরে আমার শরীর, দুই পায়ে আঁকড়ে ধরে আমার কোমর। আর আমরা দুটি আলাদা প্রাণ রইলাম না, সব বন্ধন কাটিয়ে পরস্পর মাঝে বিলীন হয়ে গেলাম।
মিলন শেষে আমার প্রশস্ত বুকের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে প্রশ্ন করলো, “চিরদিন আমাকে এই ভাবে ভালোবাসবে?”
ওর শরীরে মাদকতাময় সুবাস বুকের মধ্যে টেনে ওকে বললাম, “কালো কে দেখছে সোনা, তবে আগামি প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে এই ভাবে ভালোবাসব। কাল এক নতুন সকাল হবে, এক নতুন দিনে আবার নতুন করে তোমাকে ভালোবাসবো।”
ছন্দা আলতো করে চুমু খায় আমার বুকে, ওর বুকটা এক অনাবিল ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরে যায়, চোখের কোলে অশ্রু দানা দেখা দেয়। দুইজনে কখন যে পরস্পরকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরেছিলাম সেটা আর খেয়াল নেই।
দুইদিন ছিলাম দেওঘরে, পরের দিন আর ম্যাসাঞ্জর দেখতে যাওয়া হয়নি। দিনের আলোতে ছন্দা আমার কাছে আসতে নারাজ তাও আমরা দুষ্টুমি করেছিলাম।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১৪)
এম টেক প্রায় শেষ হতে চললো, রিসার্চ করবো না চাকরি করব সেই নিয়ে একটু দোটানায় পড়লাম। একবার ছন্দার সাথে আলোচনা করেছিলাম, ছন্দা আমাকে বলেছিলো যে রিসার্চ করতে।
সেদিন ছন্দার অফিসের পরে আমরা ফ্লুরিসে বসে কেক আর চা খাচ্ছিলাম। ছন্দা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি নিয়ে রিসার্চ করবে কিছু ঠিক করলে?”
আমি তখন পর্যন্ত সেই রকম কিছু ভাবিনি কিন্তু বড় ইচ্ছে ছিলো থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, আমি সেটাই ওকে জানালাম। ছন্দা চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বললো, “এখানে না বিদেশে?”
আমি ওকে হেসে বললাম, “থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে করব এই টুকু জানি, এখানে না বিদেশে সেটা এখন ভাবিনি। তবে জি আর ই দেওয়ার ইচ্ছে আছে সেটা অনেক কঠিন ব্যাপার তারপরে দেখা যাবে।” কিছুক্ষণ থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মাসিমাকে আমাদের ব্যাপারে কিছু বললে কি?”
ছন্দা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিচকি হেসে বললো, “নিজেই নিজের বাড়িতে কিছু বলেনি আর আমাকে আগে বলতে বলছে। যাই হোক আমি মা’কে তোমার ব্যাপারে একটু খানি বলে রেখেছি, মা তোমাকে এই রবিবার বাড়িতে ডেকেছে।”
আমি হেসে বললাম, “বাপ রে একদম শাশুড়ির সামনে যেতে হবে? এযে বাঘের মুখে পড়ার চেয়েও সাঙ্ঘাতিক।”
আমার হাতের ওপরে চাঁটি মেরে বললো, “তুমি না একদম যাঃতা আমার মা মোটেই রাগি নয়। আর তোমাকে দেখে গলে যাবে দেখ। এম টেক করা জামাই তার ওপরে আবার রিসার্চ করবে সে তো বিশাল ব্যাপার।”
আমি ওর হাত চেপে প্রশ্ন করলাম, “তোমার অমত নেই তো?”
হাতের তালুতে চিমটি কেটে বললো কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “হ্যাঁ খুব আছে, রবিবার যদি না আস তাহলে আর বিয়েই করবো না।”
সেই রবিবার দুপুরের আগেই আমি ছন্দার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। তার আগের রাতে আমার ঘুম হলো না, কি ভাবে কি কথা বলবো। এদিকে নিজের বাড়িতে কিছুই জানানো হয়নি, এমত অবস্থায় ছন্দার মায়ের সামনে কি বলবো। ওর বাড়িতে ঢোকার আগে আমার ঘাম ছুটে গেল, মনে হল বুকের ওপরে শক্তিশেল বিদ্ধ হয়েছে।
কলিং বেল বাজানোর আগে আমি বার কয়েক বড় বড় শ্বাস নিলাম। কলিং বেল বাজাতেই ছন্দা এসে দরজা খুলে দিল, প্রেম করার পরে সেই প্রথমবার ছন্দার বাড়িতে পা রাখলাম। ছোট দুটো কামরার ঘর আর একটা ছোট বসার ঘর, ছোট হলেও বেশ সুন্দর করে সাজানো। আমি ওকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার, চোখের ইশারায় আমাকে উত্তরে বললো যে সব ঠিক আছে শুধু আমি যেন ঠিক থাকি। কিছু পরে ছন্দার মা, যূথিকা দেবী ঘরে ঢুকলেন। আমি উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম। আমার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া। আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করে দিল, ছাগল কাটার আগে যেমন তাকে খাইয়ে পড়িয়ে পুজো করা হয় নিজেকে ঠিক তেমন মনে হল। আমি যদিও বেশি খেতে ভালোবাসি না তাও মাসিমা অনেক কিছু রান্না করেছিলেন।
খেতে বসে এটা খাও সেটা খাও আর ছন্দা মাসিমা কে বারন করে বলে, “আরে মা ওকে অত কিছু দিও না, ওকে শুধু ডাল ভাত আলু ভাজা দিও তাতেই খুশি। হ্যাঁ ইলিশটা আর মিষ্টিটা একটু ভালো খায়, তোমার খরচ বেঁচে যাবে।”
সেই কথা শুনে মাসিমা হেসে ফেললেন, “প্রথম বার এসেছে একটু খাবে না?”
আমিও মন রক্ষার্থে অনেক কিছু খেয়ে ফেললাম আর বললাম, “আপনার মেয়ে কি সত্যি রান্নাবান্না পারে না?”
মাসিমা হেসে বললেন ওকে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি তবে মাঝে মাঝে নিজে থেকে কিছু করতে চেষ্টা করে। আমি বললাম যেদিন ওর হাতের রান্না খেতে হবে সেদিন আমাকে হস্পিটাল যেতে হবে। ছন্দা ওর মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ ভেঙ্গিয়ে জানিয়ে দিল, যে পরে আমাকে দেখে নেবে।
খাওয়ার পরে মাসিমা আমাকে বাড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তরে বাবার নাম বললাম, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে সব কিছু জানালাম, আমি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, আমাদের বাড়ির সাথে অনুসুয়ার বাড়ির যোগাযোগ ইত্যাদি সব কিছু খুলে জানালাম।
সবকিছু শোনার পরে মাসিমা আমাকে বললেন, “শোন বাবা, আমরা পূর্ব বঙ্গের মানুষ।” আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে ছন্দা আমাকে ওর ইতিহাস আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছে। মাসিমা মেয়ের হাতখানি নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আমাকে বললেন, “আমার একটাই মেয়ে, বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলে আমার চেয়ে ওর বেশি কাছের ওর পড়াশুনা সবকিছু এই করেছে। অনেক কষ্টে একে আমি এই পর্যন্ত এনেছি বাকিটা ওর হাতে আর তোমার হাতে। আমার অমত নেই তবে তুমি নিজের বাড়িতে একবার এই বিষয়ে বিস্তারে কথা বল। তোমরা পশ্চিম বঙ্গের আদি বাসিন্দা তাঁর ওপরে ব্রাহ্মণ পরিবার, কথা বলে দেখ তাদের কি মতামত।”
আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ছন্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে মাসিমার কথা শুনে ওর চোখ ছলছল করছে। আমি মাসিমার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, “আমি ঠিক সময়ে সব কিছু ঠিক করে দেব।”
এর মাঝে একদিন বউবাজার গিয়ে ওর জন্য একটা সোনার হার কিনলাম। সেই হার গলায় পরে খুব খুশি, আর আমার খুশি ওর ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে। হার কেনার সময়ে আমাকে বকা শুনতে হয়েছিলো, ছয় মাসের স্টাইপেন্ডের টাকা জমিয়ে ওকে ওই সোনার হার কিনে দিয়েছিলাম।
জানিনা কি করে কি ঠিক করব তবে সেদিন মাসিমার সামনে কথা দিয়ে এসেছিলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলাম কি করা যায়। ভাবতে ভাবতে সকালের দিকে পথ খুঁজে পেলাম, নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাতে হবে যে বাড়ির কেউ আমার কথা ফেলতে পারবে না। ঠিক করলাম যে এম টেক করার পরে জি আর ই দেব আর বিদেশ যাবো রিসার্চ করতে। জ্যাঠা বাবা সবাই একবার বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে, সেই চুড়ায় আমাকে পৌছাতেই হবে।
এরপরে একদিন আমি সবকিছু খুলে বললাম ছন্দাকে। আমার কথা শুনে ছন্দা বেঁকে বসল, কিছুতেই আমাকে বিদেশে ছাড়বে না। আমি নাকি বাইরে গেলে ওকে ভুলে যাবো। একদিকে আমার প্রেম আমার ভালোবাসা আর অন্যদিকে আমার পড়াশুনা। আমি ছন্দাকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না যে রিসার্চ সেরে আমি দেশে ফিরে আসব। ছন্দার এক কথা, আমি বিদেশে গিয়ে অইখানকার মেয়েদের দেখে ওকে ভুলে যাবো আর সেখানেই থেকে যাবো। ছন্দা আমার সাথে দেখা করা এমনকি কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিল।
একদিন বিকেলে ফ্লুরিসে বসে ওকে বললাম, “এই সব আমি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য করছি, সোনা। আমাকে সেই চুড়ায় পৌছাতেই হবে। তুমি সোজা পথে কোনোদিন ভাবতে চেষ্টা কর না তাই না?”
ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি দুই বছরের জন্য বাইরে চলে যাবে, কোন বড় একটা ইউনিভার্সিটি থেকে এম ফিল করার পরে কি কেউ দেশে ফিরে আসে? তুমিও আসবে না আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি।”
আমি ওর হাত ধরে কাতর মিনতি করে বললাম, “ছন্দা, তুমি আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে এই বুকে কোনোদিন ঠাঁই দিতে পারবো না।”
ছন্দা ধরা গলায় বললো, “তারমানে তুমি এই বলতে চাও যে বিয়ে করে আমি তোমার সাথে বিদেশ চলে যাবো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “যদি আমি বিদেশে থেকে যাই তাহলে সেটাই।”
ছন্দা মাথা দুলিয়ে বললো, “না সেটা কখনই সম্ভব নয় পার্থ, আমার ভাই এখন অনেক ছোট ওর পড়াশুনা আছে, মাকে দেখার আছে, আমি তোমার সাথে কখনই বিদেশ যেতে পারবো না।”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি চাও আমি তাহলে কি করবো?”
ছন্দা চশমা খুলে আঁচলের খুট দিয়ে চোখ মুছে আমাকে অবাক করে বললো, “তুমি আমাকে ভুলে যাও, পার্থ!”
আমাকে কিছু বলার অবকাশ দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে আমার দেওয়া গলার হার দেখিয়ে বললো, “আমার কপাল খালি থাকবে তোমার জন্য, যদি তুমি ফিরে আস তাহলে এই কপালে সিঁদুর পড়িও, না হলে….. এটাই আমার সর্বস্ব এটাকে সম্বল করেই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।”
আমি স্থানুবত ওই খানে অনেকক্ষণ বসে রইলাম, বসে বসে আমার জেদ চেপে গেল আমি জি আর ই দেব আর বাইরে যাবো। আমি আলবাত ফিরে আসব আর ওকে দেখিয়ে দেব যে আমার ভালোবাসা ফেলনা নয়, মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম ওই ফ্লুরিসে বসে।
আমার ইচ্ছে ছিলো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, এম টেক শেষ করে আমি জি আর ই দিলাম আর সেই ছাড় পত্র পেয়েও গেলাম। আমার সাথে সাথে নবীন ও জি আর ই দিয়েছিলো, জার্মানির খুব নামকরা একটা ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করার ছাড় পত্র পেয়ে গেল।
দুই বছরে অনু শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছে তাই কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারল না আর না পারাটাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিলো যাতে ওর বাড়ি থেকে বিয়ের ব্যাপারে চাপ না দেয় আর ততদিনে যাতে দেবু একটা ভালো চাকরি পেয়ে যায়। এম টেক করার পরে কলেজের লেকচারার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল দেবু। দেবুর লেকচারার হওয়াতে অনু আহ্লাদে আটখানা এবারে ওদের বিয়ে করাতে বিশেষ অসুবিধে হবে না।
ছন্দার সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ কোন কথাবার্তা হল না, রোজ রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার বিনিদ্র রজনী কাটত, ভাবতাম আমি যে পথে যাচ্ছি সেটা ঠিক না ভুল, উত্তর হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার জি আর ই পাওয়ার খবর ছন্দাকে অনু দিয়েছিলো, ছন্দা তার উত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দেখে অনু বিস্মিত হয়েছিলো। আমি ওর বিস্ময় দূর করে ওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিলাম এবং এও বলেছিলাম যে ছন্দাকে আর কিছু যেন না বলে। আমি ওকে বলেছিলাম সব কিছু যেন সময়ের অপরেই ছেড়ে দেয়।
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১৫)
বহুদিন পর সেদিন নবীন, দেবু আমি আর পচা একসাথে আড্ডা মারলাম। পচা চাকরি করে ফুলে গেছে, গুজরাটে গিয়ে এক গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে তার নাম সঞ্জনা। নবীন বেশ ভারিক্কি হয়ে গেছে, তবে আগে মদ খেত না এখন মাঝে মাঝেই মদ খায়। দেবু চাকরি পাওয়ার পরে বেশ খোশমেজাজে ছিলো। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে বসে চারজনে হুইস্কি গিললাম আর পুরানো দিনের কথা মনে করলাম। মন বড় বলছিলো যে যদি ছন্দা অনু আর শ্যামলী পাশে থাকত তাহলে আমাদের সেই পুরানো দিন এক বিকেলের জন্য ফিরে আসত। তিন মেয়ের মধ্যে শুধু অনু হয়ত আসতে পারতো, কারন ছন্দার সাথে আমার অনেকদিন কথাবার্তা নেই। এর মাঝে ওর অফিসে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার সাথে কথা বলেনি ঠিক করে, দূর থেকে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সি করে বেরিয়ে গেল, আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এই সব ঘটনা আর ওদের বললাম না। দেবু আমাকে বললো যে এবারে বিয়ে করতে চায়, নিজের বাড়িতে বলেছে এই ব্যাপারে, ওর মা এক কথায় রাজি, বি টেক করা সুন্দরী বৌমা কে হাত ছাড়া করতে চায়, ওর বাবা হ্যাঁ না কিছু বলেনি তবে রাজি হয়ে যেতে পারেন। ওদিকে অনু তখন কিছু বাড়িতে বলেনি, আমি যত বার বলি এই বারে বাড়িতে বলে দে, ওর কালোঘাম ছুটে যায় আর আমাকে ঠেলে দেয়। আমি নিজেও বাড়িতে ছন্দার ব্যাপারে কিছুই বলিনি, আগে লন্ডন থেকে ফিরি তারপরে বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম। নবীন কে জিজ্ঞেস করাতেই কথা এড়িয়ে গেল, ছন্দা ওর মনের কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো তাই আর ওকে বেশি ঘাঁটালাম না।
সন্ধে নাগাদ বাড়িতে পা রাখতেই ভিরমি খেলাম। আমাদের বৈঠকখানা লোকে লোকারণ্য, না না, বাইরের লোকজন নয় সবাই বাড়ির। কিন্তু দুই বাড়ির বাবা কাকা জ্যাঠা, মা জেঠিমা কাকিমা, ওদিকে দেখি বড়দি আর বড় জামাইবাবু, অনুর বড় পিসি পিসেমশায়, ওর মামা রা, এদিকে বড় মামা মামি আমার মামা মামি সব মিলে প্রায় জনা ত্রিশ জন। বৈঠকখানা ভরে সবাই বসে হাসাহাসি গল্পে মেতে। মামা পিসিদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম না হটাত করে এই বাড়িতে আবার কোন উতসব লাগতে চললো।
বড় জামাইবাবু মানে সমীরণদা আমাকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠলো, “ঐ যে পুটু এসে গেছে।”
আমি ত্রস্ত পায়ে বৈঠক খানায় ঢুকে সবার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে রইলাম। সমীরণদা আমার পাশে এসে বললো, “এই যে শালা তোমার বিয়ের কথা হচ্ছিল এখানে।”
ওই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, বলা নেই কওয়া নেই হটাত করে কেউ ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেয় নাকি? আমি অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিদ্ধার্থ জ্যাঠা মানে অনুর বাবা, আমাকে বললেন, “আমার পুরানো বন্ধু, অধিরের নাম শুনেছিস ত? ওর মেয়ে, বৈশাখী, ইংলিশে বি এ পড়ছে। ওর কথা ভেবেছি তোর জন্য।”
আমি বার কয়েক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম, “আমার বিয়ে মানে এখুনি, কেন?”
বাবা বললেন, “তুই লন্ডন চলে যাবি, অইখান থেকে যদি বিলিতি মেম ধরে আনিস সেই ভয়ে আগে ভাগেই তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
বাবার কথা শুনে সবাই হেসে দিল আর আমার চক্ষু চড়ক গাছ। গলা শুকিয়ে গেছে, কান মাথা ভোঁভোঁ করছে, চোখের সামনে হটাত করে সব কিছু ঘুরতে শুরু করে দিল।
আমার ছোট কাকা বললেন, “তোদের দুইজনের একসাথে বিয়ে। মানে অনু আর তোর, অধির বাবুর একমাত্র ছেলে, অনিন্দ্য ডিভিসিতে ইঞ্জিনিয়ার। আমরা ভাবলাম এই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে যখন যাবে তখন ওই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে এই বাড়িতে আসুক।”
আমি ছাদের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, ছাদ খানা অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে আর একটু হলে আমাকে পিষে মেরে ফেলবে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে বললাম, “অনু জানে এই ব্যাপারে?”
আমার মা হেসে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ জানে, ওর অমত নেই। তোর ঘরে মানুর সাথে বসে আছে।”
ওই কথা শুনে আমি কি বলব ভেবে পেলাম না, অনু কি করে মেনে নেয় এই কথা? ওর আর দেবুর প্রেম কি সত্যি পুতুল খেলা ছিলো? না হতে পারে না। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায় কি বলা যায় কোথা থেকে কথা শুরু করা যায়। অইদিকে দরজা দিয়ে ভাই বোন গুলো সব উঁকিঝুঁকি মারছে। একটু পরে দেখলাম ভাই বোনের ভিড়ের পেছনে অনু আর ছোড়দি। কেঁদে কেঁদে অনুর চোখ জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গেছে, ছোড়দিকে ওকে জড়িয়ে ধরে আমাকে ইশারা করলো ওই বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে আসতে। আমি মাথা নিচু করে বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে এলাম।
আমি বের হতেই ছোড়দি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গেল আর অনু ভেঙ্গে পড়লো, “আমি দেবু কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না, আমাকে অন্য কারুর সাথে বিয়ে দিলে আমি বিষ খেয়ে মরবো।”
আমি কি করবো কিছু বুঝে পাচ্ছি না, ছোড়দি আমাকে বকা দিয়ে বললো, “তুই কেন তোর কথা আমাকে জানাস নি? একসাথে দুই দিক কি করে সামলাই বল। শ্বশুর মশায় আর বাবা কাকে নিমতন্ন করবে, কি কি খাওয়ানো হবে সেইসব নিয়ে ফর্দ বানাতে বসে গেছে, বড় কাকা তো খুশিতে পাগল, রাঙ্গা কাকা বলছে…..”
আমি ওকে থামিয়ে বললাম, “থাম দিকি, কে কি আটঘাট বাঁধছে সেই শোনার সময় নেই আমার কাছে।”
ছোড়দি রেগে গিয়ে আমাকে বললো, “তোমরা দুইজনে লুকিয়ে প্রেম করবে আর ম্যাও সামলাতে আমাকে ঠেলে দিবি?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি করব, আমি ভাবলাম বড়দা আর তোর সময়ে কোন অসুবিধে হয়নি তাই আমাদের সময়ে হবে না। তা বিশুদা কোথায়?”
ছোড়দি বললো, “আমি তোর বড়দাকে ফোন করে দিয়েছি, হস্পিটাল থেকে বেড়িয়ে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। ওই সব ঠিক করে দেবে বলেছে, তুই শুধু এই এক ঘণ্টা ওদের কিছু একটা বলে ক্ষান্ত রাখ।”
এমন সময়ে অনুর মা আর আমার মা ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। তাঁদের বের হতে দেখেই ছোট ভাই বোন গুলো দূরে সরে গেল। আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অনুর কান্নার কারন, আমি একবার ছোড়দির দিকে তাকালাম একবার অনুর দিকে তাকালাম তারপরে চোখ বন্ধ করে বোমা ফাটিয়ে দিলাম, “এই বিয়ে হতে পারে না।”
সেই কথা শুনে অনুর মা হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলছিস তুই? কেন বিয়ে হতে পারে না? তুই আর অনু কি…..”
ছোড়দি তেড়ে উঠলো অনুর মায়ের দিকে, “কি যে বল না তুমি, বলার আগে একবার ভাববে না কি বলছো?”
আমার মা আমাকে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে অনু ওই ভাবে কাদছে কেন আর তুই ওই ভাবে দাঁড়িয়ে কেন?”
আমি দেখলাম এবারে কিছু না বললে নয়, খাঁড়া একদম গলার কাছে নেমে এসেছে। আমার হয়ে ছোড়দি বললো, “ভেতরে চল কথা আছে।”
অনুর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল আমি পেছন পেছন গেলাম। সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে নিজের প্রেমের বক্তব্য রাখা খুব বড় ব্যাপার। ছোড়দি খানিকক্ষণ চুপ থেকে সবার দিকে তাকিয়ে বললো, “এই বৈশাখীর সাথে পুটুর আর অনিন্দ্যর সাথে অনুর বিয়ে অসম্ভব।”
সিদ্ধার্থ জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন কি অসুবিধে? অনু আর পুটু কি পরস্পরকে…..”
ছোড়দি আবার তেড়ে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল, শ্বশুর মশাইয়ের সামনে শান্ত কণ্ঠে বললো, “না ওইসব কিছু না। অনুর একজন কে পছন্দ হয়েছে আর পুটু একজন কে ভালোবাসে।”
সবার চাহনি দেখে মনে হল ঘরে বোমা ফেটেছে আর তারপরেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। এত চুপ যে বেড়াল চলে গেলে তার পায়ের শব্দ শোনা যেতে পারে। আমি নিজের বুকের ধুকপুকানি শুনতে পেলাম, হাতুড়ির মতন বারেবারে বাড়ি মারছে ফুসফুসে। বড় কারুর দিকে তাকাবার একটুও সাহস নেই, সবাই যেন আমাদের দিকে ক্ষুধার্ত বাঘের মতন তাকিয়ে, পারলে এখানেই খেয়ে ফেলবে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে উঁচু গলায় কথা বলা অথবা প্রেম ভালোবাসার কথা ব্যাক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো, কি করে কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু একটা বিহিত করতেই হবে।
বাবা আমার দিকে বাঘের মতন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যাপার এইসব?”
আমি চোখ বন্ধ করে দেখলাম যে হাসি কান্না মিশিয়ে আমার সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে, মনের কথা না বললে আমার ভালোবাসা চিরদিনের মতন চলে যাবে। আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে সাহস জুগিয়ে নিজের কথা না বলে আগে অনুর ব্যাপারে বললাম, “অনু একজন কে ভালোবাসে, আমাদের কলেজের বন্ধু।”
সিধু জেঠা গম্ভীর কণ্ঠে অনুকে জিজ্ঞেস করলো, “কি নাম কি করে কোথায় থাকে?”
অনু ধরা গলায় আমতা আমতা করে কিছু একটা বললো কিন্তু কেউ শুনতে পেল না। ওর হয়ে ছোড়দি বললো, “ছেলের নাম দেবশিস রায়, একসাথে এরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। দেবাশিস ধানবাদ থেকে এম টেক করেছে, বর্তমানে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে লেকচারার।”
কথা শুনে মনে হল সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন, বাবা আমাকে জিজ্ঞস করলেন, ২আর তোর কি ব্যাপার?”
আমি বার কতক ঢোঁক গিলে কোন রকমে বললাম, “আগে অনুর ব্যাপারে বলি তারপরে আমার কথায় আসছি। আগে বল কি বলতে চাও তোমরা? দেবাশিস ভালো বাড়ির ছেলে। তোমাদের পছন্দ করা ছেলের চেয়েও বেশি ভালো, অনু কোন ভুল পথে যায়নি।”
সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন হুঙ্কার পাড়লেন, “প্রেম করেছে আর ভুল পথে যায়নি? কি সব আবোল তাবোল কথাবার্তা।”
ওই হুঙ্কার শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল, অনু ডুকরে কেঁদে উঠলো, “আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।”
দুই জ্যাঠা মিলে আমাদের দিকে প্রায় তেড়ে আসে, কিন্তু ছোড়দি মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লো আর আমাদের বাঁচিয়ে দিল। ছোড়দি মাঝে দাঁড়াতেই আমার জেঠু বললেন, “তোর ব্যাপার আলাদা, বিশুকে ছোট বেলা থেকে চিনি আর এখানে? কাউকেই চিনি না কাউকেই জানি না, কি বৃত্তান্ত কি ব্যাপার।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে, আমি দেবাশিস কে ডেকে নিচ্ছি পরিচয় হয়ে যাবে।”
সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন শুধু মাত্র একটা শব্দ করলেন, “হুম”
বাবা গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “ওর ব্যাপার বুঝলাম আর তোর কি ব্যাপার সেটা শুনি?”
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আর তখন আমার জেঠিমা আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ধীর পায়ে জেঠিমার কাছে যেতেই আমার কান ধরে টেনে বললেন, “তোর কি মধুছন্দাকে পছন্দ?”
আমি ওই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম, আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ মানে তুমি কি করে জানলে?”
জেঠিমা কান টেনে লম্বা করে বললেন, “এমনি এমনি চুল সাদা হয়নি রে আমার পুটু। আকাশের বিয়েতে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘোল পাকিয়েছিস তোরা।”
বাবা আমাকে প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে দিলেন, “কি নাম মেয়ের, কি বৃত্তান্ত, বাবা কি করেন একটু শুনি।”
দেখলাম এবারে না বলে কোন উপায় নেই, হাড়ি ভাংতেই হবে, “না মানে আমার কলেজের বান্ধবী, মধুছন্দা সমাদ্দার। বর্তমানে পার্ক স্ট্রিটে একটা বড় রঙের কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবা নেই, মা এস এস কে এম হস্পিটালে নার্স।”
জ্যাঠা আঁতকে উঠলেন, “সমাদ্দার? মানে পূর্ব বঙ্গের? না না এই হতে পারে না, সমাদ্দার জাতে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট। তুই কি না শেষ পর্যন্ত আমাদের কুলের নাম ডুবাবি? আমরা ব্রাহ্মণ পরিবার সেটা জেনে বুঝে তুই এই করলি?”
বাবা কাকা সবাই এক কথায় নারাজ, “পূর্ব বঙ্গের মেয়ে বাড়িতে আনা চলবে না তার ওপরে আমাদের চেয়ে নিচু জাতের।”
সেকালে হোক কি একালে হোক, এই বৈষম্য এখন আছে, সেই একটা ব্যাপারে কোলকাতা কেন সারা পৃথিবী আজও একত্র।
আমি দেখলাম আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এই সময়ে বুকের পাটা চুপসিয়ে গেলে হবে না, “অতীতে তোমাদের কুল যে ব্রাহ্মণ ছিলো তাঁর কি প্রমান?”
জ্যাঠা বাবা প্রায় তেড়ে ওঠেন আমার ওপরে, “কি বলছিস তুই, আমরা চট্টোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ। সেই সুতানটির সময় থেকে এইখানে বাস আমাদের।”
হঠাৎ কি যে হয়ে গেল আর আমি বলে ফেললাম, “ছোট বেলায় বায়লজি টিচার আমাদের পড়িয়েছিলো যে আমরা সবাই নাকি বাঁদর গোস্টি থেকে উদ্ভুত। সেটা ঠিক না ভুল?”
অনেকেই আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন কিন্তু জ্যাঠা মশায় , সিধু জ্যাঠা বাবা তেড়ে উঠলেন, “বড় বাড় বেড়ে গেছিস, বাপ ঠাকুরদার নাম ডুবিয়ে দিলি শেষ পর্যন্ত।”
মানা না মানা, কথা কাটাকাটি আরও বেশ কিছুক্ষণ চলল এই ভাবে, জ্যাঠা বাবা কিছুতেই মানতে রাজি নয় ছন্দার ব্যাপারে। মা কাকিমা জেঠিমা এর মাঝে তর্ক জুড়ে দিলেন, বৈঠকখানা মাছের বাজারের মতন হয়ে গেল। অনু কান্না থামিয়ে চুপচাপ ছোড়দির হাত ধরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমিও সমান তালে বচসা করলাম বুঝাতে চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ ধরে যে এই জাতপাত নিয়ে কি হবে, কে পূর্ব বঙ্গের কে পশ্চিম বঙ্গের, কি হয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম যে যখন তিনি অপারেশান থিয়েটারে অপারেশান করেন তখন কি অন্য জাতের মানুষের রক্ত নীল রঙের দেখতে পান? আমি অনড় যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে ওই মধুছন্দাকেই করব নচেত আর কাউকে নয়। কথাবার্তা শুনে মনে হল দেবুর আর অনুর ব্যাপারে বিশেষ অসুবিধে হবে না। আমি বারেবারে দরজার দিকে তাকাই এবারে যদি বিশুদা এসে কিছু করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত আমার জেঠিমা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি একটা কথা বলি, আগে এই দেবাসিশ কে ডাকা যাক তারপরে পুটুর ব্যাপারে কথা বলছি।”
অনু এক দৌড়ে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। জেঠিমা ওকে সান্তনা দিয়ে বললো, “আচ্ছা বাবা আগে তোর ওই দেবাসিশ কে দেখি আমরা তারপরে বাছ বিচার করবো।”
সিধু জ্যাঠা আমাকে বললেন, “দেবাসিশকে ডাক।”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “এখুনি?”
বাবা বললেন, “হ্যাঁ এখুনি। আর তারপরে তোর বিচার হবে।”
জেঠিমা বাবাকে বললেন, “গগন, মধুছন্দাকে আমার পছন্দ, মানুর বিয়েতে, আকাশের বিয়েতে তোমরা সবাই ওকে দেখেছ। বি টেক করা চাকরি করা বৌমা, এর পরে আর কারুর কিছু কি বলার আছে?”
জেঠিমার ওই কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ কিছুপরে আমার মা হেসে সিধু জ্যাঠাকে বললেন, “তাহলে অধির কে একটা ফোন করে দিন, ওদের আসতে বারন করে দিন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে, ওদের নিজেদের পছন্দ অপছন্দ আছে। বিয়ের তারিখ একটু দেখে শুনে করতে হবে তাহলে। এই বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে আর ওই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা, ঢাক ঢোল একটু বেশি না বাজলে কি করে হবে।”
আমাদের বাড়ির কোন বিয়েতে ঢাক ঢোল কম বাজে না, এর মধ্যে তিন তিনখানা বিয়ে হয়ে গেছে, বড়দির বিয়ে, ছোড়দির সাথে বিশুদার বিয়ে আর একবছর আগেই মেজদার বিয়ে। এতক্ষণ বুকের মাঝে বেঁধে থাকা স্বস্তির শ্বাস বেড়িয়ে এলো, শেষ পর্যন্ত তাহলে সবার মতামত আছে, যাক তাহলে সব মিটমাট হয়ে গেল।
ঠিক সেই সময়ে বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে দুম করে বললে ফেললো, “না না অনুর বিয়ে হতেই পারে না। আমি সব বলছি আগে আমার কথা শোনা হোক…..”
বড়দার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো আর ছোড়দি এক ধমক দিয়ে বললো, “তুমি থামো তো। শেষ পাতে শুক্তো দিয়ে আর মুখ মারতে হবে না। তোমার আশায় বসে থাকলে এদের এতোক্ষনে বিয়ে হয়ে যেত!”
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১৬)
এই সবে অনেক সময় চলে গেল। জেঠিমা আমাকে বললেন দেবুকে ফোন করে দিতে। আমার আগেই অনু দেবুকে ফোন করে জানিয়ে দিল সব কথা, সেই শুনে দেবুর চক্ষু চড়ক গাছ। এতো লোকের সামনে তাকে কাটা হবে শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর, আমি ওকে বললাম যদি এখন না আসে তাহলে যেন অনুকে ভুলে যায়। অনু ওকে এক ধ্যাতানি দিয়ে বললো যদি আধ ঘন্টার মধ্যে না আসে তাহলে ফিনাইল খাবে। দেবু বেচারা আমাদের বাড়ির উদ্দশ্যে রওনা দিল।
ওদিকে মা জেঠিমা ছন্দার মা’কে ফোন করে দিল আমার কিছু বলার আগেই, সাথে এও জানাল যে পরের দিন বাড়ির সবাই ছন্দাকে দেখতে আসবে আর সেই সাথে আশীর্বাদ করে যাবে। মাসিমা সব শুনে আঁতকে উঠলেন, এত তাড়াতাড়ি এক রাতের মধ্যে এত সব কি করে হবে। আমাদের আবার পঙ্গপালের পরিবার আশীর্বাদ করতে বাবা কাকা জ্যাঠা, মামা মাসি পিসি আর এই গুটি কতক ভাই বোন মিলে জনা পঞ্চাশ যাবে। সেই শুনে মাসিমা হার্ট ফেল করার যোগাড়, এত লোক তো বর যাত্রী হয়। অনুর মা আমাদের পরিবারের ব্যাপারে বুঝিয়ে বললেন আর বললেন যে সবাই বাড়ির লোক কেউ বাইরের নয় সব কাজ হাতেহাতে করে নেবে। জেঠিমা বড়দা মেজদাকে আর শুভকে বললেন আশীর্বাদের জন্য ছন্দার বাড়ির সব কিছু ব্যাবস্থা করতে। কি কি কেনা হবে তাঁর ফর্দ বানানো হয়ে গেল। মেজদা আর শুভ জিনিস পত্র কিনতে বেড়িয়ে গেল।
আমি অনুর বাড়ি গিয়ে ছন্দাকে ফোন করলাম কারন আমাদের বাড়ি তখন হরিশার হাটের মতন অবস্থায় ছিলো। আমার ফোন পেয়েই তেড়ে ফুড়ে উঠলো, “যাও তোমার সাথে একদম কথা বলবো না।”
অভিমানিনীর ওই সুর অনেকদিন শুনিনি, আমার দুকানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিল। ছন্দা চেঁচিয়ে উঠলো অইপাশ থেকে, “তোমার কোন আক্কেল নেই? এই রাতে বলছ ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে? আমি তোমাকে বলেই দিয়েছি যে বিয়ে করবো না।”
আমি আর কি বলি, “তুমি যে আমার সাথে এতদিন কথা বলোনি, তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম একে বারে বিয়ে করেই লন্ডন যাবো।”
ছন্দা আবেগে কেঁদে ফেললো, “বড্ড শয়তান ছেলে তুমি, একবার হাতের কাছে পাই এমন মারবো না…..”
আমি উত্তরে বললাম যে কিছুক্ষণের মধ্যে আমি, বড়দা আর মেজদা সব কিছু কেনা কাটা সেরে ওদের বাড়ি যাবো আর সব ব্যবস্থা করে দেবো। সেই শুনে একটু ক্ষান্ত হল ছন্দা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবু এসে পৌছাল, ওর অবস্থা আমার চেয়েও সঙ্গিন। আমি আর অনু ওকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে সব কিছু পাখি পড়ার মতন বুঝিয়ে দিলাম আর বললাম যে সবাই ঠিক আছে শুধু ও যেন বেঠিক না হয়ে যায়।
দেবু বৈঠকখানায় ঢুকে অত লোকজন দেখে চমকে গেল। বাবা জ্যাঠা দেবুকে রিতিমত সি বি আইয়ের মতন প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে দিলেন। কি করো, বাড়িতে কেকে আছেন, কোথায় বাড়ি বাবা কি করেন, কয় ভাইবোন ইত্যাদি। আমি আর ছোড়দি দুর থেকে ওকে দেখে হাসি থামাতে পারলাম না ওদিকে অনুর গলা শুকিয়ে আমাদের বকাঝকা শুরু করে দিল।
আমার ছোট পিসেমশায় বড় মজার লোক, এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, দেবুর ওই অবস্থা দেখে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বললেন, “এই যে দেবশিস, একবার কান ধরে উঠ বস কর তো।”
তাঁর কথা শুনে দেবু হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না, ছোট পিসে মশায় গম্ভির কণ্ঠে বললেন, “বাড়ির দুই জামাই যখন মেয়ে দেখতে এসেছিলো ওদের কিন্তু কান ধরে উঠ বস করিয়ে ছিলাম এটা আমাদের বাড়ির রীতি। জামাই কে আগে আমরা কান ধরে উঠবস করাই। যদি ভালো করে, তবেই মেয়ে নিয়ে যেতে দেই নচেত নয়।”
অত গুলো লোকের সামনে ওই কথা শুনে দেবুর হার্ট ফেল করার যোগাড়, সবাই হেসে ফেললো দেবুর অবস্থা দেখে। শেষ পর্যন্ত বিশুদা ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলো ঐইখান থেকে। অনুর মায়ের জামাই দেখে কত খাতির, এটা খাও সেটা খাও। অনু লাজুক হেসে ছোড়দির পেছনে দাঁড়িয়ে দেখে গেল। ঠিক হলো যে বাড়ি গিয়ে দেবু বাবা মায়ের সাথে কথা বলে আমাদের জানাবে সেইমতন আমার জ্যাঠা আর সিধু জ্যাঠা ওর বাবার সাথে কথা বার্তা বলবেন।
শুভ আর মেজদা বাজার করে আসার পরে আমার ছোট কাকিমা আর ভাইদের নিয়ে আমরা গাড়ি করে চলে গেলাম ছন্দার বাড়িতে। আমাদের পৌঁছানর খবর মা আগে থেকেই মাসিমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। অনুর দুই ভাই আর আমার দুই ভাই মিলে ঘর সাজাতে লেগে গেল, বড়দা আর মেজদা জিনিস পত্র বুঝিয়ে দিল সেই সাথে রান্নার ঠাকুরের ব্যাবস্থা। ছোট কাকিমা আর মাসিমা পরের দিনের ব্যাবস্থায় লেগে গেলেন। সব যেন যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় ঘটে গেল। ছাড়পত্র পেয়ে গেছিলাম তাই ছন্দাকে নিয়ে একটু আড়ালে বসার অবকাশ পেয়ে গেছিলাম।
ছাদে উঠতেই ছন্দা আমাকে কষে এক চাঁটি লাগিয়ে দিল আর বুকের ওপরে ঝাপিরে পড়লো, “যাও তোমার সাথে একদম কথা বলব না। বলা নেই কওয়া নেই, এই ভাবে কেউ বিয়ে করতে আসে নাকি?”
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললাম, “কি করি সোনা, নাহলে কোন উদো পাড়ার বৈশাখিকে আমার গলায় বাঁধতে চলেছিলো।”
ছন্দা বুকের ওপরে আঁকিবুঁকি কেটে বললো, “এতোদিন কথা বলোনি কেন?”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “আমি কথা বলনি না তুমি কথা বলনি? কত বার তোমার অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছি। তুমি বের হতে আর আমাকে দেখেই ট্যাক্সি নিয়ে নিতে।”
ঠোঁট কামড়ে ধরে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বললো, “বাস ধরলে তো জানতাম যে তুমি আমার পেছন পেছন বাসে চাপবে তাই ট্যাক্সি নিতাম। এবারে ওই চারদিনের ট্যাক্সি ভাড়া দাও?”
আমি আমার মানিব্যাগ ওর হাতে সঁপে দিয়ে বললাম, “আগে হৃদয় নিয়েছিলে আজকে এই পকেট তোমার।”
মানিব্যাগ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “মনে থাকে যেন এই কথা।”
আমি ওর নাকের ডগায় নাক ঘষে বললাম, “লন্ডন তাহলে একসাথেই যাচ্ছি?”
মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো, “হ্যাঁ, তবে এত তাড়াতাড়ি ভিসা পাবো কি করে?”
আমি বললাম যে সেই চিন্তা জ্যাঠা মশায়ের, কাস্টমসে চাকরি করেন দুতাবাসের অনেক লোক জন তাঁর চেনাজানা। ওই নিয়ে বিশেষ অসুবিধে হবে না।
সব কিছু ঠিক ঠাক হয়ে গেল, একে একে সবার আশীর্বাদ হয়ে গেল, প্রথমে ছন্দার তারপরে অনুর তারপরে দেবুর শেষে আমার। দুই সপ্তাহ পরেই অনুর বিয়ে আর তার চার দিন পরে আমার। বাড়িতে সাজ সাজ রব, কেনা কাটা, বাজার করা ম্যারাপ বাঁধা সবকিছু যুদ্ধ কালিন ততপরতায় শুরু হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম কথাবার্তা ঠিক হয়ে যাবার পরে ছন্দার সাথে একটু নিরিবিলিতে কথা বলতে পারবো, সেই কবে থেকে কত কথা জমে আছে বুকের মধ্যে অইদিকে ছন্দার অবস্থা আমার মতন। ওর পেট প্রায় ফেটে যাচ্ছিল, এর মাঝে কোন রকমে একবার দেখা পেয়েছিলাম সেদিন আমাকে খুব মেরেছিলো আর বুকে মুখ লুকিয়ে এক ঘন্টা ধরে কেঁদেছিলো। কিন্তু ওই পর্যন্ত, তারপরে আর ছন্দাকে একা পাওয়া গেল না। রোজ দিন কেউ না কেউ ওকে নিয়ে বিয়ের কেনা কাটা করতে বেড়িয়ে যায় আমি কিছুতেই সাথে থাকতে পারি না। ধীরে ধীরে অনুর বিয়ের দিন কাছে চলে এলো।
অনুর বিয়ের দুই দিন আগেই মা জেঠিমা ছন্দাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলো। উঠতে বসতে ছন্দা, বাবা জেঠার “বৌমা” ডাকে সাড়া দিতে শুরু করলো। এক বেলার মধ্যেই বাড়ির বড় বৌমা হয়ে উঠলো, সবার চোখের মণি, ভাই বোনেদের বড় বৌদি আর মায়ের চেয়েও কাকিমার বড় আদুরে হয়ে গেল। সব থেকে অবাক করে দিল আমাকে, “পার্থ” ছেড়ে “ওগো, হ্যাঁ গো” শুরু করে দিল, আমি ওই ডাক শুনে হেসে আর কুল পাই না।
এর মাঝে আমরা নবীনকে একদম ভুলে গেছিলাম। সন্ধের দিকে ছন্দা আমাকে নবীনের কথা মনে করিয়ে দিতেই আমার মাথায় হাত। আমি আর ছন্দা সেদিন বিকেলে নবীনের বাড়িতে গেলাম। নবীন যে বদলে গেছে সেটা আর বলে দিতে হল না।
আমাদের দেখে হেসে বললো, “তোদের বিয়েতে আমি থাকতে পারবো না রে।”
আমরা দুইজনেই অবাক হয়ে গেলাম, ছন্দা ওকে জিজ্ঞেস করলো, “কেন, তোর তো ফ্রাঙ্কফুর্ট যেতে তো অনেক দেরি আছে, তাহলে?”
নবীন বাঁকা হেসে বললো, “না রে, আমি কাল দিল্লী চলে যাচ্ছি, ওইখানে কিছুদিন থাকবো তারপরে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলে যাবো।”
ছন্দা আর আমি পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাম, ছন্দা আক্ষেপের সুরে বললো, “অনুকে জানিয়েছিস যে তুই চলে যাচ্ছিস? ও শুনলে কিন্তু খুব দুঃখ পাবে।”
নবীন কাষ্ঠ হেসে বললো, “না রে, ওর সাথে দেখা করার আর সময় পাই নি। এক বার ভেবেছিলাম যে তোদের বাড়ি যাবো কিন্তু তোরা এসেছিস তাই আর যাবো না।”
ছন্দা ওকে চেপে ধরলো, “তোর নিশ্চয় এখন কোন বিশেষ কাজ নেই আর কাজ থাকলেও পরে করা যাবে। এখুনি চল অনুর সাথে দেখা করবি।”
নবীন বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপরে ওকে বললো, “না রে ছন্দা আমি আর যাবো না ওর সামনে।”
ছন্দা ছাড়তে নারাজ, “কেন যাবি না? তোরা নাকি ছোট বেলার বন্ধু আর আজকে এত আনন্দের দিনে তুই ওর সাথে দেখা না করেই চলে যাবি?”
নবীন চুপ, ছন্দা ওকে চেপে ধরলো, “যতক্ষণ না আসল কথা খুলে বলছিস ততখন আমি এখান থেকে যাবো না।”
নবীন ওর আলমারি থেকে একটা পুরানো জুতোর বাক্স এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি বাক্স খুলে দেখলাম ওর মধ্যে একটা অতি পুরাতন মাটির পুতুল। পুতুল দেখে আমার পুরানো দিনের কথা মনে পরে গেল। আমার বেশ মনে আছে ওই পুতুল বড়দা অনুকে চড়কের মেলায় কিনে দিয়েছিলো। আমরা তখন অনেক ছোট, ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। এক বিকেলে আমি নবীন পিতু বিষ্টু সবাই মিলে উঠানে ডাঙ্গুলি খেলছিলাম আর অনু ওই পুতুলকে শাড়ি পড়াচ্ছিল বারান্দায় বসে। আমাদের ডাঙ্গুলির গুলি গিয়ে লাগে ওর পুতুলে আর পা ভেঙ্গে যায়, আমি অনুর ওপরে খুব তোরবাড় করেছিলাম কিন্তু নবীন ওই পুতুল নিয়ে বলেছিলো যে পুতুলের পা জোড়া লাগিয়ে দেবে। তারপরে আমি আর খোঁজ নেইনি পুতুলের কি দশার হয়েছিলো।
ছন্দা আমার দিকে একবার তাকালো তারপরে নবীনকে বললো, “তুই এতদিন কেন চুপ ছিলিস, কেন বলিসনি যে অনুকে তুই ভালোবাসিস।”
নবীনের কাষ্ঠ হেসে জবাব দিল, “কে বলেছে আমি অনুকে ভালোবাসি?”
ছন্দা ছাড়ার পাত্রী নয়, “তোর চোখ তোর সাড়া শরীর চেঁচিয়ে বলছে যে তুই ওকে ভীষণ ভালোবাসিস আর তাই ওকে না জানিয়ে চুপিচুপি চোরের মতন পালিয়ে যাচ্ছিস। তুই কি ভাবিস আমাদের চোখ নেই?”
ছন্দা আমার হাত থেকে জুতোর বাক্স নিয়ে ওকে ধরা গলায় বললো, “এতোদিন এই মাটির পুতুল অতি সযত্নে রেখেছিস কেন? চার বছর আগের ষষ্টির রাতের কথা মনে আছে তোর? অনু তোকে বারেবারে জিজ্ঞেস করেছিলো যে তোর কিছু বলার আছে কি না, তুই তাও চুপ করেছিলি, কেন? আমি সেদিন পার্থকে বলতে গিয়েও বললাম না, ভেবেছিলাম কোনোদিন তোর মনের কথা বলবি কিন্তু….. ছাড়, আর কিছু বলার নেই আমার রে।”
নবীন ধরা পরে গেছে শেষ পর্যন্ত মনের কথা খুলে বললো আমাদের কাছে, “আমি কালো কুতসিত দেখতে ছন্দা, এই চেহারা নিয়ে কি ওর মতন সুন্দরীকে ভালোবাসা যায় বল? আমার চেহারায় পক্সের দাগ, ছোট বেলা থেকে রোগা পটকা ছিলাম। ভেবেছিলাম বড় হলে মনের কথা বলব কিন্তু যত বড় হলাম পেঁচি অনু তত সুন্দরী হয়ে উঠলো। আমার মতন কুতসিত দেখতে একটা ছেলে ওর পাশে বড় বেমানান দেখাবে তাই সরে এলাম। দেবু আমার চেয়ে দেখতে শুনতে ভালো, ওদের দুইজনের জুটি একদম হর পার্বতীর।”
একটু থামলো নবীন, ছন্দা আর আম্মি মন দিয়ে ওর কথা শুনে গেলাম। নবীন বলে চলে, “আমি ইচ্ছে করেই দিল্লীতে এম টেক নিলাম যাতে আর ওর সামনে না থাকতে হয়। ভেবেছিলাম যে দেবু হয়ত বাইরে চলে যাবে কিন্তু দেবু যখন গেল না তখন আমাকেই যেতে হবে তাই ফ্রাঙ্কফুর্ট চলে যাচ্ছি চিরদিনের জন্য। আমি বাড়িতে বলিনি তবে তোদের বলছি আমি কোনোদিন দেশে ফিরবো না। এখানে আর কিছু নেই আমার জন্য…..”
কথাটা আর শেষ করতে পারল না নবীন, ছন্দার হাত ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নবীন, “এইসব অনুকে দয়া করে বলিস না তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব না। শুধু এই বাক্সটা আমাকে দিয়ে দে এটাই আমার অনুসুয়া। আমার হয়ে প্লিস দেবুকে বলিস কোনোদিন যেন অনুকে কষ্ট না দেয় তাহলে আমি কিন্তু ওকে মেরে ফেলবো।”
আমরা ওকে কি সান্তনা দেব ভেবে পেলাম না, অনু কি সত্যি এতদিনে বোঝেনি যে নবীন ওকে ভালোবাসে? আমরা বেশ কিছুক্ষণ ওর সাথে বসলাম আর তারপরে চলে এলাম। ছন্দার মন ভারি হয়ে গেছিলো, সারাটা সময় আমার হাত শক্ত করে ধরেছিলো। দুইজনে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। নবীনের ওই কথা কোনোদিন অনুকে আমরা জানাই নি।
অনুর বিয়ের দিন কাক ভোরে নবীন দিল্লী চলে গেছিলো আমি ওকে কোলকাতা এয়ারপোর্টে ছাড়তে গিয়েছিলাম। ছন্দা যেতে পারেনি। নবীন, ছন্দাকে একটা দামী সোনার হার উপহার দিয়েছিলো আর আমার জন্য একটা রোলেক্সের ঘড়ি।
ঘটা করে অনুর বিয়ে হলো আর তারপরের দিনেই ছন্দাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল মা। ওর বাড়ির বিয়ের ব্যাবস্থা মেজদা আর আমার দুই ভাই মিলে করেছিলো। বউভাতের পরের দিনেই দেবু আর অনু বাড়িতে এসে গেছিলো। বিয়ে ভালো ভাবেই মিটে গেছিলো। আমাদের ভিসা পেতে বিশেষ বেগ হয়নি, তবে একমাসের মতন লেগেছিলো আর আমাদের লন্ডন যাওয়া এক মাসের মতন পিছিয়ে গিয়েছিলো। যাওয়ার দিনে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছন্দা আর অনুর কি কান্না, দেবু অনেকক্ষণ আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো।
প্লেনে উঠে অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো ছন্দা মন বড় কেঁদে উঠেছিলো ওর সেইসাথে আমার। আমার হাত খানি ধরে দিল্লী পর্যন্ত চুপ করে চোখ বন্ধ করে ছিলো। গভীর রাতে দেশ ছাড়লাম, ছেড়ে গেলাম রোদে ভেজা কল্লোলিনী সাথে রইলো আমার তিলোত্তমা যাকে নিয়ে ওই রোদে কতবার ভিজেছি।
আপাতত এখানেই শেষ, পরে হয়তো আবার আসবো এই কাহিনী নিয়ে।