Written by Pinuram
রিশু প্লেন থেকে নেমে বাড়ির দিকে রাওনা দিয়েছে খবর পেতেই পীয়ালির বাড়িতে খুশির আমেজ ছড়িয়ে যায়। সোমনাথ আর পীয়ালি কি ভাবে রিশুকে এই রাতে আপ্যায়ন করবে ভেবেই কূল কিনারা পায় না। আম্বালিকার বড় ছেলে সেই সাথে আবার বেশ বড় ডাক্তার, তাল ঠিক রাখতে পারে না পীয়ালি।
আম্বালিকার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে মানে তোর ছেলে কি খেতে ভালোবাসে?”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “তুই এত উত্তেজিত কেন হচ্ছিস? এত রাতে আবার রান্না করতে যাস নে।”
সোমনাথ কি করবে ভেবে পায় না, “না মানে প্রথম বার আসছে তাও আবার এই ভাবে, মানে কি করব ঠিক ভেবে পাচ্ছি না।”
পিয়ালী তাও নাছোড়বান্দা, ফ্রিজে একটু কাঁচা চিকেন ছিল সেটা বের করে বলে, “চিকেন আর লুচি বানিয়ে দেব?”
আম্বালিকা ওদের শান্ত হতে বলে, “কিচ্ছু করতে হবে না। এত রাতে হয়ত কিছু খাবেই না।” বলেই হেসে ফেলে। কিছুক্ষন থেমে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পীয়ালিকে বলে, “তুই যা একবার ঝিনুকের কাছে, ওর সাথে কথা বল।”
সোমনাথ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “না মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আপনার ছেলে শুধু একবার হ্যাঁ বললেই ব্যাস। ঝিনুকের মতামত নিয়ে কোন কাজ নেই, আমি যেখানে বলব সেখানেই ওকে বিয়ে করতেই হবে।”
আম্বালিকা সোমনাথ কে শান্ত করার জন্য বলে, “দেখুন, বিয়ে এমন ভাবে হয় না। দুইজনের অমত থাকলে এই বিয়ে হবে না, অথবা যদিও বা একজন মত দেয় আর অন্যজন বেঁকে বসে তখন জোর করে বিয়ে দিলেও ওদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখকর হবে না। তবে হ্যাঁ, আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে পড়েছি, তাতে এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের সামনে।” পিয়ালীর দিকে দেখে বলে, “ঝিনুকের সাথে কথা বল, ওকে সবকিছু বুঝিয়ে বল। আমার যা মনে হয় ও বুদ্ধিমতী মেয়ে সব কিছু বিচার বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। হ্যাঁ ঝিনুক হয়ত একটু জেদি কিন্তু বিপথে যাওয়ার থাকলে এতক্ষনে নিশ্চয় চলেও যেত। আজকাল চারপাশে যা শুনি তাতে ত মাঝে মাঝে আমার দিয়াকে নিয়েই ভয় হয়।”
মাথা দোলায় সোমনাথ, কথাটা সত্যি। পীয়ালির দিকে দেখে বলে, “যাও মেয়ের সাথে কথা বল।”
বুক ভরে শ্বাস নেয় পীয়ালি, আম্বালিকা ওর হাতে হাত রেখে বলে, “আমার ছেলে আসুক আমি কথা বলি তারপরে দুইজনকে সামনা সামনি বসিয়ে সব কিছু খুলে বলা হবে। আমি আমার ছেলেকে যথাসাধ্য বুঝাতে চেষ্টা করব, আমার ছেলে, এই টুকু ভরসা আমি দিতে পারি।”
পিয়ালী ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে, “তুই সত্যি মহামায়া রে, তুই না থাকলে এই যাত্রায় আমাদের কেউই উদ্ধার করতে পারত না।”
বান্ধবীর হাতের ওপরে হাত রেখে প্রবোধ দেয় আম্বালিকা, “সব ঠিক হয়ে যাবে, বিশ্বাস রাখ ভগবানের ওপরে। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন।”
ঝিলিক দিয়ার সাথে বেড়িয়ে গেছে এয়ারপোর্ট দিয়ার দাদাকে আনার জন্য। ঘরের ভেতরে বসে বসার ঘরের সব আলাপ আলোচনা ওর কানে গিয়েছিল। দিয়ার দাদাকে আনতে যাওয়ার আগে ঝিলিক ওকে জানিয়ে দিয়েছিল যে আম্বালিকা আন্টির বড় ছেলের সাথে ওর বিয়ের কথা চলছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানার এক কোনায় কুঁকড়ে বসে পরে ঝিনুক। বারং বার নিজেকে প্রশ্ন করে, কেন পার্থ ওর সাথে এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করল, মন প্রান দিয়ে ভালবেসেছিল ছেলেটাকে। পার্থের প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বাবা মায়ের অনুযোগ একবারের জন্যেই কান দেয়নি। মানুষ চিনতে এত ভুল করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ঝিনুক, মানুষ যে সব সময়ে এক মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সেটা এতদিন শুধু সিনেমায় গল্পেই পড়েছিল। অকাঠ সত্যটা যে এমন ভীষণ ভাবেই ওর সামনে এসে ওকে এক ধাক্কায় এইভাবে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে সেটা একদম ভাবতে পারেনি।
যে আসছে সেই বা কেমন হবে জানা নেই, তবে একটাই ভরসা এখানে, আম্বালিকা আন্টি মায়ের ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী আর সেই সাথে দিয়া আর ঝিলিক ও কাকতালীয় ভাবে স্কুলে বন্ধুত্ত হয়ে গেছে। মায়ের কাছেই শোনা যে আম্বালিকা আন্টির বড় ছেলে এমেসের অরথপেডিক সার্জেন। সব ডাক্তার কি ভালো মানুষ হয় নাকি? পড়াশুনা করলেই কি ভালো মানুষ হওয়া যায়? বাবা ভীষণ ভাবেই আহত এবং ক্রুদ্ধ, বিয়ে করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে ওর। যদি এখন বিয়েতে মত না দেয় তাহলে কেউই ওর কোন কথা শুনবে না। বাবা জোর করেই ওকে এবারে বিয়ে দেবে। মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস ওর চলে গেছে। আর নয়, এই পৃথিবীতে আর বাঁচতে চায় না…
দরজা ভেজান ছিল, পীয়ালি আলতো ধাক্কায় ঝিনুকের ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করে, “অন্ধকারে কি করছিস রে?”
গায়ের চাদর বেশি করে গায়ের ওপরে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ায় ঝিনুক, নরম গলায় উত্তর দেয়, “কিছু না।”
পিয়ালী মেয়ের পাশে বসে ঝিনুকের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মাতৃ স্নেহে বলে, “দ্যাখ মা, ভুল মানুষের হয়। তাই বলে সেই ভুলটাকে আঁকরে ধরে বসে থেকে লাভ কি বল। তুই ত আমার সোনা মেয়ে রে…”
মাকে জড়িয়ে ধরে ঝিনুক, “না মা, আমি তোমার খারাপ মেয়ে মা। তোমাদের কোন বারন শুনিনি, তোমাদের কোন কথায় কান দেইনি, সেই পাপের ফলে আমার আজকে এই অবস্থা।” বলেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে।
মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “না রে, ছোট বেলায় দুষ্টুমি সবাই করে, বাবা মায়ের অবাধ্য হয়, সেটা ঠিক সময়ে বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নেওয়াটাই আসল কথা, তুই কোন পাপ করিসনি।” চোখ মুছিয়ে হাতে গালে হাত বুলিয়ে বলে, “আমার সোনার টুকরো মেয়ে তুই, ইসসস কি ভাবে নিজেকে খামচে একাকার করেছিস।”
কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঝাঁকিয়ে মাকে বলে, “মা গো আমি বিয়ে করব না, প্লিজ মা।”
পীয়ালি ওকে আদর করে বুঝিয়ে বলে, “দ্যাখ ঝিনুক, যদি আম্বালিকা এগিয়ে না আসত তাহলে কি হত বলত? আমাদের মান সন্মান সব জলে ধুয়ে মুছে যেত। সবাই এটাই বলত, ওই ত সোমনাথের বড় মেয়ের শেষ পর্যন্ত বিয়েই হল না। পাড়ার লোকের মুখ কি আর চুপ করে থাকত নাকি? তোর বড় পিসি এই পার্থের সাথে বিয়ে হবে বলে কত খোটা দিয়ে কথা শুনিয়েছে সেটা জানিস। ব্যাবসায়ি বাড়ির ছেলে, তার ওপরে ওর বাবা আবার এই প্রমটারিতে বিনিয়োগ করেছে কত কথা সেই নিয়ে, প্রমোটার দের স্বভাব একদম ভালো হয় না।” ঝিনুক চুপ করে মায়ের কথা শুনে যায়, ওর যে করার আর কিছু নেই সেটা বুঝে যায়। পীয়ালি বলে, “অম্বরীশ ভালো ছেলে, এমসের ডাক্তার, অরথপেডিক সার্জেন, আমরা খুঁজলেও হয়ত অমন ছেলে পেতাম না তোর জন্য, সব থেকে বড় কথা আম্বালিকা আমার ছোটবেলার বান্ধবী, আমার প্রিয় বান্ধবী, আমরা একসাথে কলেজে পড়েছি একসাথে মাস্টারস করেছি। এখানে কেউ অচেনা নয় রে।”
কথা শুনে মাথা দোলায় ঝিনুক, সত্যি কথা, যদি বিয়েটা না হত তাহলে আত্মীয় সজ্জন সবাই বলাবলি করত, যে শেষ মুহূর্তে যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কোন কারনে ছেড়ে দিয়েছে। সঠিক কারণ বের করার কারুর মাথা ব্যাথা নেই সবাই নিজের মনে একটা কারণ বের করে সেই গুজব বদনাম চারদিকে রটিয়ে দিত। হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে ঝিনুক যে এক শয়তানের রক্ত পার্থের ধমনীতে সেই রক্ত এক সময়ে মাথা চাড়া দিয়ে জাগত, সময় থাকতেই সেটার হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে ঝিনুক।
চোখের জল মুছে সোজা হয়ে বসে ঝিনুক, মাকে জিজ্ঞেস করে, “ওরা কি এসে গেছে?”
পিয়ালী একবার দরজার দিকে দেখে বলে, “এখন আসেনি হয়ত তবে একটু পরেই চলে আসবে। চোখের জল মোছ, হাতে গালে ক্রিম মাখ, নিজেকে ঠিক কর, ভালো একটা সালোয়ার কামিজ পর। এইভাবে যাবি নাকি ওর সামনে?” একটু থেমে মেয়ের মুখের দিকে দেখ বলে, “তোকে আরো কিছু কথা বলার আছে।” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। পিয়ালী একটু থেমে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, “রিশু কিন্তু আম্বালিকার চোখের মনি। আমার বান্ধবী বলে বলছি তা নয়, তবে আম্বালিকা সাক্ষাৎ মহামায়ার রূপ। তুই আমাকে কথা দে, যে তুই কোনদিন কোন পরিস্থিতিতে আম্বালিকার সাথে কোন দুরব্যাবহার করবি না।”
মাথা নোয়ায় ঝিনুক, মায়ের কথা অবশ্য ঠিক, আম্বালিকা আন্টিকে দেখলেই বোঝা যায়, দেবী দুর্গার মতন রূপ আন্টির, ওই চোখে যেমন আগুন আছে ঠিক তেমনি ভালোবাসা আছে। বুক ভরে শ্বাস নেয় ঝিনুক, এই ওর কপালে লেখা, একেবারে অজানা অচেনা একজনের সাথে বাকি জীবন কাটাতে চলেছে। যার সাথে বিয়ে হবে তাকে কোনদিন দেখেওনি, কথা বলা চেনা জানা হওয়া ত দুরের কথা। এই মানসিক অবস্থায় বিয়ে করতে অনিহা কিন্তু বাবা মায়ের মুখ চেয়েই বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ঝিনুক। মাকে জানিয়ে দেয় যে ওর এই বিয়েতে অমত নেই, কিন্তু মনের গভীরে প্রচুর সংশয়, কেমন হবে ওর এই অচেনা জীবনসঙ্গী।
আলমারি খুলে একটা নতুন সালোয়ার কামিজ বের করে নেয়, তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। আয়নায় নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ব্যাথা পায়। কেঁদে কেঁদে চোখ জোড়া লালচে হয়ে গেছে, যার জন্য এত কান্না সেই মানুষটা প্রতারক, তার জন্য আর চোখের জল ফেলে লাভ কি। গালে বাজুতে বুকের ওপরে নখের আঁচর দেখে নিজেই লজ্জায় পরে যায়। চোখ মুখ ভালো ভাবে জল দিয়ে ধুয়ে নেয়, সালোয়ার কামিজ পরে বাথরুম থেক বেড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পরে প্রসাধনের জন্য। ততক্ষণে মা চলে গেছে ওর কামরা থেকে। গালের আঁচড়ের দাগের ওপরে ক্রিম মাখতে মাখতে নতুন এক জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। জানা নেই এই জীবনে ওর কপালে কি লেখা আছে। নতুন করে কোন স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় ওর ছোট্ট হৃদয়। ঠিক সেই সময়ে ঝিলিক এসে পৌঁছাতেই ওর হৃদপিণ্ড এক লাফে গলার কাছে এসে আটকে যায়, এসে গেছে সেই অচেনা মানুষ, যার সাথে বাকি জীবন ওকে কাটাতে হবে।
ঝিলিক দিদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই আমার সোনা দিদি।”
বুক ভরে শ্বাস নেয় ঝিনুক, ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন দেখলি?”
দিদির গালে গাল ঠেকিয়ে চোখ মেরে মুচকি হেসে বলে, “জিজু দারুন হ্যান্ডসাম রে।”
বাজুতে ক্রিম মাখতে মাখতে ছোট উত্তর দেয়, “আচ্ছা!”
দিদির গলা জড়িয়ে বলে, “দিদি, সত্যি বলছি এই তোকে ছুঁয়ে। ওদের ভাই বোনেদের মধ্যে এক অন্য ধরনের সম্পর্ক যেটা না দেখলে তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। দিপের হাত ভেঙ্গেছে শুনেই কিন্তু ওর দাদা এই রাতে এখানে এসেছে।”
যে আসছে সে কি তাহলে নিজেও জানে না যে তার বিয়ে? ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে, “মানে?”
ঝিলিক উত্তর দেয়, “দিয়ার সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, ওর দাদার নাকি একদম ইচ্ছে নেই বিয়ে করার। কিন্তু এখানে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত আম্বালিকা আন্টির হাত বাঁধা ছিল। প্রথমেই বিয়ের কথা শুনলে ওর দাদা বেঁকে বসত কিছুতেই আসত না। শেষ পর্যন্ত দিপ হাত ভাঙ্গার ভান করে কেঁদে কেটে ওর দাদাকে ফোন করে, শুধু মাত্র ভাইয়ের হাত ভেঙ্গেছে শুনে ওর দাদা এত রাতে প্লেনে করে দিল্লী থেকে কোলকাতা এসেছে।” কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় ঝিনুক, এমন মানুষ হয় এই পৃথিবীতে। ঝিলিক আরো বলে, “তুই জানিস, দিয়ার দাদা এত ব্যাস্ততার মধ্যেও দিয়ার কি হোমওয়ার্ক সেটা মনে রাখে, দিপের কোনদিন কোন পরীক্ষা সেই খবর ওর দাদার কাছে আছে। সত্যি বলছি, দেখে একদম মনে হয় না যে ওর দাদা নাম করা এক মেডিকেল কলেজের অরথপেডিক সার্জেন।”
রিশু গাড়ি থেকে নেমে দেখে যে দরজায় ওর মা দাঁড়িয়ে। আম্বালিকা মাতৃ স্নেহে বড় ছেলের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ফ্লাইটে কি একটু ঘুমিয়েছিলিস?”
হেসে ফেলে রিশু, “তোমাদের জ্বালাতনে কি আর ঘুম হয়?”
সেই সাথে বাকি সবাই হেসে ফেলে। পেছনে নীলাদ্রি দাঁড়িয়েছিল, মাথা নুইয়ে আদর সম্ভাষণ জানায় রিশু। এই বাড়ির সবাই অচেনা, পিয়ালীর কথা মনে নেই ওর। বসার ঘরে মায়ের পাশে চুপচাপ বসে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে। এটা একটা ফ্লাট ওদের বাড়ির মতন বড় নয় তবে বেশ ভালো। কয়েকদিন পরেই বিয়ে তাই ঘর ভর্তি লোকজন। সোমনাথ ওকে দেখে এগিয়ে এসে হাত মেলায়, আম্বালিকা ইশারা করে প্রনাম করতে। রিশু ভুরু কুঁচকে একবার মায়ের দিকে তাকায়, মা আর পাপা আর কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া আজ পর্যন্ত অচেনা কারুর পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করেনি।
রিশুর ইতস্তত ভাব দেখে সোমনাথ নিজেই হেসে বলে, “না না এখন মডার্ন যুগ, এখন কি আর কেউ কারুর পায়ে হাত দেয় নাকি।” রিশুর হাতের ওপরে আলতো চাপ দিয়ে বলে, “আসতে কষ্ট হয়নি ত?”
মায়ের চোয়াল একটু কঠিন হয়ে গেছে বুঝতে পেরে রিশু সোমনাথের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে উত্তর দেয়, “না, তেমন কিছু নয়।”
পিয়ালী ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরে, কি করবে ঠিক ভেবে পায় না। একটা কাঁসার থালায় ফুল প্রদীপ ধুপ ইত্যাদি সাজিয়ে রিশুকে বরন করতে আসতে দেখেই আম্বালিকা একটু বিব্রতবোধ করে।
আম্বালিকা পিয়ালীকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “এসব কি করছিস তুই?”
আমতা আমতা করে পিয়ালী উত্তর দেয়, “না মানে এই প্রথম বার বাড়িতে এলো তাই আর কি।”
আম্বালিকা পিয়ালীর চোখে চোখ নিবদ্ধ করে বলে, “এসবের কোন দরকার নেই।” ওর কন্ঠের স্বর দৃঢ়, “আমি আগেই বলেছি, আগে আমি রিশুর সাথে কথা বলব তারপরে বাকি কথা।”
পিয়ালী বুঝে যায়, এই সেই আম্বালিকা বহু বছর আগে যে রিশুকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে সেই ভীষণ দুর্ঘটনার রাতে ওর জন্মদিন পালন করেছিল। কেউ সেদিন টলাতে পারেনি ওর সিদ্ধান্ত, ওর কন্ঠে সেই দিনের দৃঢ়তা।
পিয়ালী নিজের ভুল বুঝতে পেরে রিশুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমাকে সেই একদম ছোট বেলায় দেখেছিলাম তোমার দি…” বলতে গিয়েও থেমে যায় আম্বালিকার চোখের দিকে তাকিয়ে, “তোমার মায়ের কোলে।”
রিশু একটু হেসে মাথা নুইয়ে প্রনাম জানায়। আম্বালিকা পিয়ালীকে অনুরোধ করে ওদের একটু একা ছেড়ে দিতে। পিয়ালী ওদের একটা ঘরে বসতে বলে, সেই সাথে জিজ্ঞেস করে রিশুর খাওয়ার জন্য কি কিছু নিয়ে আসবে? রিশু মাথা দোলায়, এখুনি নয়, প্লেনে এক কাপ কফি খেয়েছিল। পিয়ালী বেড়িয়ে যাওয়ার পরে আম্বালিকা ঘরের দরজা বন্ধ করে রিশুর পাসে এসে বসে।
ছেলের মাথায় গালে হাত রেখে আদর করে জিজ্ঞেস করে, “কিছুই ত খাস নি খাবি কিছু?”
রিশু হেসে উত্তর দেয়, “যা বাবা, ডিনার করে ঘুমাতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তোমাদের জ্বালায় ঘুম আর হল কই।”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “কি করব বল। সব মায়ের ইচ্ছে হয়, চোখ বন্ধ করার আগে…”
মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এইসব একদম বলবে না।”
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আচ্ছা বাবা বলব না। তবে সত্যি কথা বলছি, তোর বয়স বাড়ছে, ইচ্ছে ত হয় বাড়ির বড় ছেলে একটা টুকটুকে বৌমা বাড়িতে আনুক, আমিও একটু নাতি নাত্নির সাথে খেলা করি।”
রিশু মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে, “একা আছি ভালই ত আছি। এই যে তুমি আছ, পাপা আছে দিয়া দিপ আছে আর কি চাই।”
আম্বালিকা ছেলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলে, “দিয়া বড় হচ্ছে, এরপর কোথায় পড়াশুনা করতে যাবে সেটা জানি না, তারপর ওর একদিন বিয়ে হয়ে যাবে। একদিন দিপ ও বড় হবে তার একটা পরিবার হবে, তুই তখন বুড় হয়ে যাবি, তোকে কে দেখবে?”
মাকে জড়িয়ে উত্তর দেয়, “কেন তুমি দেখবে?”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “আমি কি আর চিরকাল থাকব নাকি রে পাগল?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় রিশু, জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা রবে। এক এক করে সত্যি একদিন সবাই ছেড়ে চলে যাবে, “তোমার কি ইচ্ছে আমি বিয়ে করি?”
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসে আম্বালিকা, “আগে সব কিছু শুনে তবেই বল।”
হেসে ফেলে রিশু, “মাম্মা, তুমি দেখেছ, তোমার পছন্দ এই যথেষ্ট আমার কাছে।”
চোখে জল চলে আসে আম্বালিকার, “এরপর জীবন তোর, তাই বলছিলাম যে একবার শুনে নে পুরো ঘটনা।”
চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে রিশুর, “এতদিন পরে আমার জীবন আমার নিজের হয়ে গেল?”
আম্বালিকা বুঝতে পারে কথাটা ঠিক হয়নি বলা, “না রে বাবা, আমি ঠিক সেই অর্থে বলিনি।”
চোখের কোনা মুছে হেসে উত্তর দেয় রিশু, “আচ্ছা বাবা বল কি বলতে চাও।”
আম্বালিকা শুরু করে পিয়ালীর বড় মেয়ে সঙ্ঘমিত্রার কথা, কয়েক মাস আগে তেইশে পা দিয়েছে, পড়াশুনায় ভালো, ইংরেজি নিয়ে স্নাতক তারপরে কোলকাতার এক কলেজ থেকেই এমবিএ করেছে এইচআর নিয়ে। কলেজে পড়ার সময়ে একটা ছেলের সাথে প্রেম হয়, পার্থ তার নাম, বাবা মায়ের অমতেই বিয়ে তবে ঝিনুকের প্রচন্ড জেদের জন্য শেষ পর্যন্ত সোমনাথ আর পিয়ালী মেনে নেয় ওদের বিবাহ। এই বিয়ে নিয়েই অনেক ঝামেলা হয়েছে ওদের বাড়িতে, কথায় কথায় আত্মহত্যা করবে এমন বলেছিল। ছেলেটা শেষে পর্যন্ত ঝিনুকের সাথে প্রতারনা করে, শুধু মাত্র টাকার লোভেই আর ঝিনুকের শরীরের লোভেই ছেলেটা এতদিন প্রেমের ছলনা করে গেছে। ওইদিন বিকেলে একটা ফ্লাটে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর সাথে জোর জবরদস্তি করতে যায়। পার্থের আসল চেহারা আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে খুব ভেঙ্গে পড়েছে মেয়েটা। রাত পার হলে আর দুইদিন পরেই বিয়ে, সোমনাথের অফিসের লোকজন আত্মীয় সজ্জন সবাইকে নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে, এখন এই অবস্থায় বিয়ে না হলে মান সন্মান খুইয়ে দেবে পিয়ালী আর সোমনাথ। আম্বালিকা আরো জানায়, যে ঝিনুক একটু বেশি জেদি, চঞ্চল প্রকৃতির তবে যতটা শুনেছে পিয়ালীর কাছে, মেয়েটা একদম উচ্ছন্নে যায়নি। আজকালের যুগে ছেলেরা মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, প্রেমিক প্রেমিকারা বিয়ে থা না করেই একসাথে লিভ-ইন থাকে, যত জেদি হোক না কেন, মেয়েটা সেই পথে যায়নি, বিয়ে করেই পার্থের সাথে যেতে চেয়েছিল। চুপ করে মায়ের সব কথা শুনে যায় রিশু।
সব কিছু শোনার পরে রিশু দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “সব বুঝলাম, এরপর তুমি কি বলতে চাও?”
আম্বালিকা হেসে বলে, “আমি এই মেয়েকে বৌমা করতে চাই।”
একটু হেসে ভুরু নাচিয়ে বলে রিশু, “বদরাগী আর জেদি মেয়ে কিন্তু…”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “তাতে কি হয়েছে, তোর মা ও ওই বয়সে কম জেদি ছিল না।”
রাস্তায় আসার সময়ে ওর বোন ওকে সঙ্ঘমিত্রার ছবি দেখিয়েছিল, মানস চক্ষে সেই মুখবয়াব মনে করতে চেষ্টা করে রিশু। ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে, কাজল টানা চোখ দুটো সত্যি খুব উচ্ছল প্রানবন্ত, বেশ ছটফটে মেয়ে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। চুলে আবার রঙ করা, হাল ফ্যাশানের সাথে তাল মিলিয়ে গাড় বাদামি রঙ আবার সামনের দিকের এক গোছা চুল লাল রঙের। মনে মনে হেসে ফেলে রিশু, ভবিষ্যতে ধাক্কা আছে অনেক। তবে মায়ের ইচ্ছে মায়ের বিশ্বাস সেই বিশ্বাসকে আঘাত হানার শক্তি ওর নেই।
মাকে জড়িয়ে হেসে ফেলে রিশু, “সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”
ছেলের মাথার চুলে বিলি কেটে স্নেহ ভরা কন্ঠে বলে, “আমার বিশ্বাস সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মাথা নিচু করে একটু ভেবে রিশু বলে, “কিন্তু মাম্মা আমি শুধু জেদের কথা ভাবছি না…”
ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় আম্বালিকা তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ঠিক কি কথা বলতে চাইছে, “দ্যাখ বাবা, আগের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল, সেই ক্ষেত্রে ব্যাবধান আসাটাই স্বাভাবিক সেটাই বর্তমান যুগের নিয়ম। এই ক্ষেত্রে পিয়ালী আমার ছোটবেলার বান্ধবী, অন্তত সেই ভয়টা আমার নেই যে এই মেয়ে আমাদের পরিবারের মাঝে একটা দেয়াল তুলে দাঁড়াবে।”
মাথা দুলিয়ে শেষ পর্যন্ত সায় দেয় রিশু, “তোমার বিশ্বাস যখন তখন আমি আর কিছু বলব না।”
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে বলে, “আমি আছি ত সাথে, ভয় কি। দ্যাখ বাবা, যে গাছের শিকড় যত গভীরে যায় সেই গাছ তত অটল অবিচল হয়ে সকল প্রকার ঝড় ঝঞ্ঝায় দাঁড়িয়ে থাকে।” শেষ পর্যন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় রিশু। ছেলের মাথায় স্নেহের চুম্বন এঁকে দরজা খুলে পিয়ালীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “যা এবারে তোর জামাইকে মিষ্টি খাওয়া।”
খুশির অশ্রু ধারা বয়ে যায় পিয়ালীর দু’চোখ দিয়ে। সোমনাথ জড়িয়ে ধরে নীলাদ্রিকে, “কি যে বলব আপনাদের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।”
দিয়া আর দিপ দৌড়ে ঢুকে পরে ঘরের মধ্যে। দিয়া দাদার কাছে আবদার করে, “বিয়েতে আমার কিন্তু একটা গাউন চাই আর বউভাতের দিনে লেহেঙ্গা পড়ব।”
দিপের আবদার, “আমি কিন্তু একটা সুট পড়ব।”
ঘরের মধ্যে তাকায় আম্বালিকা, রিশুকে জিজ্ঞেস করে, “কিছু খাবি?”
রিশু মাথা নাড়ায়, সারা রাত ঘুম নেই একটু খিধে পেয়েছে বটে নিজের বাড়ি হলে মাকে বলত গরম ভাত আর মুশুরির ডাল সেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ বানাতে। দিল্লীতে রান্নার লোকের হাতের রান্না খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেছে, মায়ের মতন ডাল রান্না করতে জানে না কাজের লোক।
মুচকি হেসে উত্তর দেয় রিশু, “তোমার হাতের ডাল সেদ্ধ পাওয়া যাবে কি…”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “আচ্ছা দেখছি…”
দিপ আর দিয়ার সাথে গল্প করতে শুরু করে রিশু। দিয়ার খুব আনন্দ, ওর প্রিয় বান্ধবী ঝিলিকের দিদির সাথে ওর দাদার বিয়ে হবে। কথার ফাঁকে একবার ঘরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে সব কিছু, ঘরটা ছোট, এক পাশে একটা চেয়ার আর পড়ার টেবিল, বই গুলো দেখে বুঝতে পারল এটা ঝিলিকের ঘর। একদিকে একটা বিছানা, এতক্ষন মায়ের সাথে বিছানায় বসেই কথা হচ্ছিল। এর মাঝে সোমনাথ আর নিলাদ্রী ঘরে এসে রিশুর সাথে কুশল বিনিময় করে।
এমন সময়ে আম্বালিকা আর পিয়ালী, ঝিনুক কে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিশু, সোমনাথ একটা চেয়ার এগিয়ে দেয় রিশুর দিকে। রিশু চোখ তুলে ঝিনুকের দিকে দেখে মাথা নুইয়ে সম্ভাষণ জানায়। মাথা নিচু করে থাকার ফলে ঝিনুক সেটা দেখতে না পারায়, মা আর আম্বালিকা আন্টির সাথে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে। রিশুর পাশের দুটো চেয়ারে নিলাদ্রী আর সোমনাথ বসে পরে। রিশুর চুপচাপ মায়ের দিকে তাকায়, আম্বালিকা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় জানায় যে পাশের মেয়েটাই সঙ্ঘমিত্রা যার ব্যাপারে এতক্ষন কথা বলছিল। রিশু তাকিয়ে দেখে ঝিনুকের দিকে, পরনে একটা ঘিয়ে রঙের সালোয়ার কামিজ তার ওপরে একটা শাল জড়ান। মাথা নিচু করে থাকলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে মেয়েটার চোখের পাতা ভিজে, কেঁদে কেঁদে চোখ জোড়া ফুলে গেছে। চুপচাপ বসে নরম চাঁপার কলির মতন আঙ্গুল খুঁটছিল মেয়েটা। নরম ফর্সা গালের ওপরে নখের আঁচর, অনাবৃত হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেখানেও নখের আঁচড়ের দাগ। সাধারন পাঁচটা বাঙালি মেয়েদের চাইতে একটু লম্বা গড়নের, দেহের গঠন বাড়ন্ত, মুখবয়াব বেশ মিষ্টি। ছবিতে যে চোখ দেখেছিল এখন সেটা বুক ভাঙা কান্নার পেছনে হারিয়ে গেছে, যে হাসি খুশি চেহারা দেখেছিল সেটা আর নেই।
হটাত করে ডাক্তারি স্বভাব বশত ঝিনুকের গালের আর হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে রিশু, “এহ বাবা এই আঁচড় কি করে লেগেছে? বেশ খারাপ অবস্থা দেখছি, আমি একটা অয়েন্টমেন্ট লিখে দেব নিয়ে আসবে, না হলে এই দাগ পরে ঘা হয়ে যেতে পারে।”
হটাত রিশুর মুখে এই কথা শুনে ঝিনুক কি বলবে ভেবে পায় না, এতক্ষন বুকের এক কোনায় একটা অজানা আশঙ্কার কালো মেঘ ছেয়েছিল সেটা একটু কেটে গিয়ে এক ক্ষীণ সূর্যের আলো উঁকি মারে এক কোনায়। সামনের অচেনা মানুষটার কথা শুনে কান্না ভুলে ভেজা চোখেই তাকিয়ে দেখে রিশুর দিকে। বাকিরা হেসে ফেলে রিশুর কথা শুনে। ওকে প্রথম দেখে রিশু যে এই কথা বলবে সেটা একদম আশাতীত, ঝিনুক কাঁদবে না হাসবে ভেবে পায় না। নিচের ঠোঁট চেপে ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে থাকে রিশুর দিকে। সামনের ছেলেটার দিকে দেখে ঝিনুক, পরনে একটা অতি সাধারন শারট আর একটা জিন্সের প্যান্ট। ভাইয়ের হাত ভেঙ্গেছে শুনেই সেই রাতে যা পেরেছে সেই পরেই নিশ্চয় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে, কথাটা ভাবতেই কেমন যেন লাগে ওর। কতটা নিবিড় বন্ধন না হলে সুদুর দিল্লী থেকে এই ভাবে কেউ এত রাতে আসে না। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, তাও দুটো চোখ ভীষণ উজ্জ্বল। বেশ বলিষ্ঠ দেহের গঠন, চওড়া কাঁধ, চওড়া ছাতি, ওকে দেখে যখন উঠে দাঁড়িয়েছিল তখন বুঝে গিয়েছিল যে ছেলেটা বেশ লম্বা চওড়া। মুখবয়াব হুবহু আম্বালিকা আন্টির মতন, বিশেষ করে উজ্জ্বল চোখ জোড়া।
পিয়ালী মেয়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে রিশুর দিকে তাকিয়ে বলে, “অম্বরীশ, তোমার মা তোমাকে সব বলেছেন হয়ত।” রিশু মায়ের দিকে দেখে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়, হ্যাঁ।
আম্বালিকা আন্টি এতক্ষনে অম্বরীশকে সব বলে দিয়েছে? কি বলেছে, কতটা বলেছে? বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে ঝিনুকের। শরীর কাঠ হয়ে যায় ওর, চেহারা রক্ত শুন্য হয়ে যায়। হাতের মুঠো শক্ত করে, চোখ বুজে দম বন্ধ করে শুধু ভাবে, মা ধরণী দ্বিধা হও আমাকে তোমার কোলে নাও। সামনের ছেলেটা জানে পার্থ ওর সাথে কি করেছে? সামনের ছেলেটা কি জানে যে পার্থের মোবাইলে ওর অর্ধ উলঙ্গ ছবি ছিল, যদিও সেই মোবাইল ভেঙ্গে দিয়েছে ঝিনুক। জানে কি, যে পার্থের সাথে থাকতে থাকতে মদের নেশা আর সিগারেটের নেশা ধরেছে ওর। পার্থের সাথে দেখা হলেই লুকিয়ে একটু মদ খাওয়া, ফাঁক পেলেই লুকিয়ে চুরিয়ে একটু সিগারেটে টান মারা এই সব বদ অভ্যেস আছে ওর। মনে হয় কেউ যেন ওর গলা চেপে ধরেছে, দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। সত্যি কি সব কিছু জেনে শুনেও এত বড় এক ডাক্তার ওর সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? কেন হয়েছে, কি কারণ? ওর বাবা কি আম্বালিকা আন্টিকে টাকার লোভ দেখিয়েছে? ওর বাবা কি বলেছে যে এই ছেলেকে গাড়ি কিনে দেবে অথবা দিল্লীতে বাড়ি কিনে দেবে? টাকা পয়সা সম্পত্তির লোভ অনেকের থাকে। লোকের চোখ দেখে কি আর বোঝা যায় মনের মধ্যে কি চলছে?
আম্বালিকা বাকি সবার দিকে চোখ বুলিয়ে পিয়ালীকে বলে, “সবাই যখন এখানে আছে, তখন আমি রিশুর ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাই।” রিশু এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। আম্বালিকা প্রতি উত্তরে একটু হেসে ছেলেকে বল জুগাতে অনুরোধ করে বলে, “সবাই এখানে আছে, সবার সামনে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত।” একটু থেমে বলতে শুরু করে, “রিশুর একটা অতীত আছে।” পিয়ালী আর সোমনাথ হা করে তাকায় আম্বালিকার দিকে। আম্বালিকা হেসে ফেলে ওদের চেহারার ভাব দেখে, “না না তোরা যেমন ভাবছিস তার কিছুই নয়।” তারপরে বলতে শুরু করে চন্দ্রিকার কথা, কি ভাবে প্রেম হয়েছিল রিশুর সাথে এবং কি ভাবে একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য সেই ভালোবাসা ভেঙ্গে যায়।
সব শেষ করে আম্বালিকা, নীলাদ্রির হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে ঝিনুক আর রিশুর দিকে তাকিয়ে বলে, “যাকে ভালোবাসো তার ওপরে বিশ্বাস রাখবে। আমি হয়ত এক সময়ে এর ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম” বলতে বলতে চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে, “কিন্তু এ আমার ওপর থেকে বিশ্বাস হারায়নি।”
ঝিনুক আড় চোখে একবার রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে, মাথা নিচু করে বসে সামনের মানুষটা, ঠিক ভাবে ঠাহর করা যায় না যে ওর মনের মধ্যে কি চলছে। চশমার পেছনের চোখের ভাষা পড়তে অক্ষম হয় ঝিনুক। আম্বালিকা আন্টি ওর পাশে বসে থাকলেও ঝিনুকের কানে কোন কথাই ঠিক করে পৌঁছায় না, ঝিনুক নিজেকে ততক্ষণে এক অন্ধকার বাক্সের মধ্যে বন্দী করে ফেলেছে। কাঁধের ওপরে মায়ের হাতের আলতো ধাক্কায় নিজেকে ফিরে পায় ঝিনুক।
পিয়ালী জিজ্ঞেস করে মেয়েকে, “কিছু বলার আছে তোর?”
মাথা নাড়ায় ঝিনুক, না, ওর আর কি বলার থাকতে পারে। ওর সব স্বপ্ন ভুঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে অনেক আগেই। এক কাঁচের পুতুল ছাড়া এখন ও আর কিছুই নয়। চুপ করে বাবা মায়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া ওর সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।
আম্বালিকা রিশুর দিকে দেখে প্রশ্ন করে, “তোর কিছু বলার থাকলে বল। কিছু প্রশ্ন থাকলে করতে পারিস।”
রিশুও মাথা নাড়ায়, না ওর মা যখন ঠিক করেছে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে তাহলে ওর কিছুই করার নেই। প্রেম ভালোবাসা সঠিক অর্থে কোনদিন চন্দ্রিকার সাথে ছিল না হয়ত, হয়ত চন্দ্রিকা এমএসের ডাক্তার দেখেই ওর কাছে এসেছিল। মাথা নাড়ায় রিশু, না ওর কোন প্রশ্ন নেই।
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সোমনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে সবাইকে বলে, “তাহলে কাজে লেগে পড়া যাক আর কি?”
হেসে ফেলে নীলাদ্রি, “হ্যাঁ হ্যাঁ, হাতে সময় নেই একদম। আমাদের ত কিছুই করা হয়নি, কোন প্রস্তুতি নেই।”
গতকাল সকাল থেকে ঘুম হয়নি রিশুর, গতকাল ট্রমা সেন্টারে অনেক চাপ ছিল, তারপরে এই অবস্থা, সারা রাত সবাই জেগে। আলাপ আলোচনা শেষে আম্বালিকা সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়ি ঢাকুরিয়া ফিরে আসে। হাতে মাত্র দুইদিন সময়, কেনা কাটা কিছুই নেই। বাড়ি ফিরে স্নান সেরে নেয় রিশু, স্নানের পরে শরীর একদম ছেড়ে দেয় ওর। বিছানায় আধা শোয়া হয়েই বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দেয় বিয়ের কথা, সেই সাথে এইচওডিকে জানিয়ে দেয়। তারপরে একটু ঘুমিয়ে নেয় রিশু, শরীরে আর শক্তি বেঁচে নেই ওর। সন্ধ্যের মধ্যে শালিনীকে নিয়ে ইন্দ্রজিৎ উপস্থিত হয়ে যায় ওর বাড়িতে, সেই সাথে বেশ কিছু বন্ধুরাও আসে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় শুরু হয় ওর বিয়ের প্রস্তুতি, কেনা কাটা ইত্যাদি। ছুটি একদম নেই, ঠিক হয় যে বিয়ের একদিন পরেই ফিরে যাবে দিল্লীতে, বউভাত হবে না ওদের।
ঝিলিক আর দিয়ার আনন্দ আর ধরে না, পারলে ক্লাসের সব বন্ধু বান্ধবীকেই নেমন্তন্ন করে ফেলে। দিয়ার সেই সাথে একটাই দুঃখ, ভেবেছিল বিয়ের দিন গাউন পড়বে আর বউভাতে লেহেঙ্গা, কিন্তু বউভাত হবে না শুনে মুষড়ে পরে যায়। দিয়া আর ঝিলিকের জন্য দামি লেহেঙ্গা কেনা হয়। আম্বালিকা আর নিলাদ্রী ফোনেই সব নেমন্তন্ন সেরে ফেলে, বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করার মতন হাতে সময় একদম নেই।
সেদিনের পরে ঝিনুক নিজের খোলসের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে সেঁধিয়ে যায়। বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা শুরু, নতুন উদ্দমে বিয়ের কাজে সবাই মেতে উঠেছে, কিন্তু ঝিনুক নিজেকে সেই সাথে একদম মেলাতে সক্ষম হয় না। যত সময় পার হয় তত ওর মনে হয় যেন মৃত্যুর হাতছানি ওকে ভীষণ ভাবে কাছে ডাকছে।
বিয়ের দিন সকাল থেকেই তোরজোড় শুরু, বিয়ের জন্য যে ব্যাঙ্কোয়েট হল ভাড়া করা হয়েছে সেটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। এই কয়দিনে বন্ধু বান্ধবীদের অনেক ফোন এসেছিল কিন্তু কারুর সাথে কথা বলার মতন মানসিকতা ওর ছিল না। যার সাথে বিয়ে হবে তার ফোন আসেনি এই কয় দিনে, জানে না তার পছন্দ অপছন্দ। কিন্তু বাবা মায়ের মুখেই শুনেছে যে বিয়ের একদিন পরেই সেই অচেনা মানুষটার হাত ধরে পাড়ি দিতে হবে সুদুর দিল্লী। বাবা মাকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই মন কেঁদে ওঠে ওর, এর আগে এইভাবে কোনদিন ওর মন কেঁদে ওঠেনি।
স্নানের জন্য বাথরুমে ঢুকে নিজেকে একা পেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলে ঝিনুক। অজানা এক ব্যাথায় সারা শরীর কেঁপে ওঠে বারে বারে। “উড়তে মানা আকাশে তোর, বসতে মানা ডালে, বাসা বাঁধিতে ও মানা কি আছে কপালে বলি ঝড়ে হারাতে ত মানা নাই…” এই কি সেই ঝড় যার সাথে এবারে হারিয়ে যেতে হবে কোন অচিন পুরিতে, সঠিক জানে না ঝিনুক। দুপুরের পরেই বাড়িতে বিউটিসিয়ান পৌঁছে যায় ওকে সাজাতে। সাবেকি আঠপৌরে ধাঁচে লাল বেনারসি পরান হয় ওকে, হাতে গলায় ভারী সোনার গয়না। আগের দিনেই দুই হাতে কুনুই পর্যন্ত মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছিল বিউটিসিয়ান সেইসাথে আবার দুপায়েও হাঁটু পর্যন্ত মেহেন্দি পড়িয়ে দিয়েছিল। খুব হাসিহাসি হয়েছিল এই মেহেন্দি পড়ান নিয়ে, বিউটিসিয়ান বলেছিল দুইজনের নাম লিখে দেবে কিন্তু ঝিনুক মানা করেছিল। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, গাড় বাদামি রঙ হয়েছে দুই হাতে। সেদিন একটা মলমের নাম লিখে দিয়েছিল ওই অচেনা ডাক্তার, সেটা এই দুইদিনে লাগিয়ে গালের হাতের বুকের নখের আঁচর কিছুটা মিলিয়ে গেছে। সাজের মাঝে একবার ঝিলিক দিদিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে যায় যে ওকে ভারী সুন্দরী দেখাচ্ছে। ছলছল চোখে বোন কে দেখে, বোনের চেহারায় খুশির আমেজ আনন্দে যেন মাটিতে আর পা পড়ছে না। সময় পেরিয়ে যায় সেই সাথে হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। গতদুই দিনে কারুর সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনি ঝিনুক। মাটির পুতুলের মতন সাজিয়ে ওকে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে বিয়ে হবে। সন্ধ্যের পরেই লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। এর মাঝেই মা ওর কানে কানে এসে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে, ঝিলিক ও এসে ওর কাছে প্রবোধ দিয়ে গেছে।
পিঁড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হল অম্বরীশের সামনে। দুই হাতে ধরা পান পাতা কিছুতেই সরাতে ইচ্ছুক নয় ঝিনুক। শরীরের শেষ শক্তিটুকু বুকের মধ্যে জড় করে বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ঝিনুক, “না আমি এই বিয়ে করব না। আমাকে জোর করে বিয়ে দিলে আমি বিষ খাবো, আমি আত্মহত্যা করব।” ঝিনুকের গলা পর্যন্ত সেই আওয়াজ ঠিকরে উঠে এসেছিল কিন্তু পারেনি আওয়াজ করতে। হাতের পান পাতা সরিয়ে কোন রকমে তাকিয়ে ছিল সামনে দাঁড়ান সেই অচেনা পুরুষের দিকে। কেমন যেন শরীর অবশ হয়ে আসে ওর, কোন কিছু ভাবনা চিন্তা করার শক্তি লোপ পেয়েছে, ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর মা ওকে যেমন ভাবে নির্দেশ দিচ্ছে চাবি দেওয়া কলের পুতুলের মতন করে চলেছে ঝিনুক। বিবাহের যজ্ঞ শুরু, পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হয় দুজনকে। হাতের ওপরে হাত রেখে বেশ খানিকটা মন্ত্র উচ্চারণ করে গেল ব্রাহ্মন, পাশে যে বসে তার দিকে ক্ষনিকের জন্যেও তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে করছিল না ওর।
এই কটা দিন রিশুর কেমন যেন স্বপ্নের মতন মনে হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঘটে চলেছে ওর আশেপাশে যে ঠিক ভাবে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছিল না। এমন কি যখন ঝিনুককে ওর সামনে এসে দাঁড় করান হয় তখন ওর মনে হয়েছিল এটা একটা দুঃস্বপ্ন, এখুনি হয়ত ওর মা এসে ডাক দেবে আর রিশু ঘুম থেকে উঠে পড়বে। স্বপ্নের ঘোর তখন কাটে রিশুর যখন সামনা সামনি বসিয়ে ওর হাতের ওপরে ঝিনুকের কোমল হাত খানি রাখা হয়। ডাক্তার হিসাবে বহু দেহ স্পর্শ করেছে ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, তবে সামনে বসা মেয়েটার হাত যেমন কোমল তেমন শীতল, যেন ওর সামনে একটা বরফের পুতুল বসে রয়েছে। ওর কঠিন তপ্ত হাতের ছোঁয়াতে ঝিনুকের চাঁপার কলির মতন কোমল আঙ্গুল গুলো বারংবার কেঁপে উঠছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। পদ্ম কুসুমের মতন নরম হাত খানি কুঁকড়ে ছোট হয়ে যায় রিশুর হাতের থাবার মধ্যে। অনুষ্ঠানের পর্ব পেরিয়ে যায়, একে একে মন্ত্র উচ্চারন করে চলে ব্রাহ্মন। এক সময়ে মা এসে ওর পাশে বসে জানিয়ে দিল যে এইবারে পাশে বসা ওই অচেনা মেয়েটার সিঁথিতে ওকে সিঁদুর পরাতে হবে। আড় চোখে তাকিয়ে দেখে পাশে বসা সুন্দরীর দিকে। পাশে বসার পর থেকেই ঘন ঘন রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চলেছে, নাকের ডগা লাল, চোখের পাতা ভিজে। একবারের জন্য মনে হয়েছিল অভয় জানিয়ে মেয়েটাকে বলে, “আমি আছি ত সাথে” না সে কথা বলতে পারে না রিশু, ভয় হয় আবার সেই কে ছেড়ে যাবে আর কে থাকবে জানা নেই এই মুহূর্তে। সেই যে একবার দেখা হয়েছিল ওদের বাড়িতে তারপরে এই দুইদিনে দেখাও হয়নি কথাও হয়নি। এই ভাবে অচেনা একজন মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গিনী করতে হবে সেটা রিশু স্বপ্নেও ভাবেনি।
ঘনিয়ে আসে মহেন্দ্রক্ষন, সিঁদুর দানের পর্ব। ভেজা চোখে ঝিনুক শেষ বারের মতন চারপাশে দেখে আর বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। সোমনাথ অদুরে দাঁড়িয়ে ছিল, মেয়ের জল ভরা চোখ দেখে কাছে এসে দাঁড়ায়। রিশু আংটিতে সিঁদুর নিয়ে ঝিনুকের কপাল ছুইয়ে সিঁথির মাঝে টেনে দেয়, ফর্সা কপাল, ফর্সা নাকের অনেকটাই সিঁদুরের লাল রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ঝিনুকের, সেই সাথে চারপাশের তুমুল হর্ষধ্বনি। অচেনা এক মানুষের আংটির সিঁদুরে বদলে গেল সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ হয়ে গেল মিসেস সঙ্ঘমিত্রা সান্যাল।
বাবাকে ইশারায় কাছে ডাকে ঝিনুক, বাবার সেই ছোট মেয়ে ঝিনুক আর নেই। সোমনাথ মেয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পিঠের ওপরে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে রে মা?”
যখন ছোট ছিল, যখন খেলতে গিয়ে পরে যেত আর ব্যাথা লাগত কোথাও, তখন ঠিক এই ভাবেই ওর বাবা ওকে কোলে নিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করত, কি হয়েছে রে মা? অনেকদিন পরে বাবার কন্ঠে সেই আওয়াজ শুনে আর চোখের জল বাঁধ মানাতে পারল না ঝিনুক।
বাবার পা জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে, “বাবা, প্লিজ বাবা শুধু একবার, একটা চান্স দাও বাবা, আমি তোমার ভালো মেয়ে হয়ে দেখাব, প্লিজ বাবা তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না।”
============= পর্ব চার সমাপ্ত ============