স্বীকারোক্তি [১]

Written by Anangapal

।। ১ ।। প্রাককথন
আজও মনে পড়ে সেই দিনটা।
ব্যাচেলর জীবনের দুই কামরার ফ্ল্যাট। কয়েক বছর হল চাকরিতে ঢুকেছি। বাড়ি থেকে দূরে, নতুন পরিবেশ, অচেনা শহর, আস্তে আস্তে সব মানিয়ে গেছে। কর্মজীবনে একের পর এক পদোন্নতি, নিশ্চিত মসৃণ ভবিষ্যতের দিকে একটা একটা করে পদক্ষেপ। রোববারের অলস বিকেলে শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে এলোপাথাড়ি ভেবে চলেছি। মনের মধ্যে কি চলছিল নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবনারা অনবরত আসা যাওয়া করছে, তার মধ্যেই মনের কোণে জেগে উঠেছে অপরাধবোধ। এগুলো কি ঠিক করছি? ও কি ভাববে? আবার এসব কল্পনা করছি জানতে পারলে… সিলিঙ থেকে চোখটা অজান্তেই চলে গেল পাশের দিকে। ও এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
কিছুক্ষণের জন্য ভাবনারা আমায় ছেড়ে চলে গেল। তাকিয়ে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এই নারী কি সত্যিই বাস্তব, না আমার অলীক কল্পনা? দ্বিতীয়টা ভাবার কোনও কারণ নেই, প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল দুজনে প্রেম করছি। কলেজ ফেস্টে আলাপের প্রথম দিনটার বয়স তারও প্রায় এক বছর বেশি। সুতরাং ইঞ্চি কয়েক দূরে শায়িতা ঐ সুন্দরীকে আর যাই হোক অচেনা বলা চলে না। সেই টানা টানা চোখ, বন্ধ থাকায় আঁখিপল্লবগুলো আরো আকর্ষণীয় লাগছে। বালিশের ওপর এলিয়ে থাকা সেই এক ঢাল কালো চুল, বিছানার স্বল্প পরিসরে যাদের সবার জায়গা হয়নি বলে অনেকে অভিমানে লুটিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি। দুই ভ্রূর মাঝখানে সেই পরিচিত ভঙ্গিমায় পরা টিপ, এখন অবশ্য সঙ্গত কারণেই নিজের জায়গা থেকে একটু সরে গেছে। সেই পুরন্ত ঠোঁট, জেগে থাকলে যারা কারণে-অকারণে প্রায়শই স্ফুরিত হয় অভিমানে, এখন যদিও কিঞ্চিৎ দ্বিধাবিভক্ত। সেই উন্নত চিবুক, সেই মরাল গ্রীবা যার প্রান্তভাগ গিয়ে মিশেছে চেনা পাহাড়ি উপত্যকায়। তারপরেই শুরু হয়েছে অসামান্য খাড়াই, দুইদিকের উত্তুঙ্গ প্রতিস্পর্ধী পর্বতশৃঙ্গে যার যাত্রা। চেনা হৃদ্স্পন্দনের ছন্দে সেই উচ্চ পার্বত্যভূমিতে নিয়মিত হারে মৃদু ভূকম্পনের আভাস। পাহাড়চুড়োয় চেনা বৃন্তেরা অবশ্য ঘুমোয়নি, মিলনের তৃপ্তিতে এখনও তারা জেগে আছে মাথা উঁচু করে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে গিয়ে চেনা প্রান্তরে মিশেছে, হাল্কা মেদের চিহ্নসমেত। সুগভীর নাভি ছাড়িয়ে একটু দূরত্বে লতাগুল্মের জঙ্গলে আচ্ছাদিত গোপন গহন গিরিখাত; চেনা, বলাই বাহুল্য। তারও পরে দুই রম্ভাসদৃশ জঙ্ঘা আয়েশে ছড়ানো একটু বাঁদিক ঘেঁষে, পরিচিত ভঙ্গিতে।
কতবার অ্যাডভেঞ্চার করেছি ঐ পরিচিত নারীদেহের অলিগলিতে, প্রতিটি রোমকূপ আমার কাছে চেনা। তবুও আজ এত অপরিচিতা মনে হয় কেন? তাকিয়ে থেকেও আশ আর মেটে না, ঠিক যেন পরস্ত্রীকে দেখার রোমাঞ্চ। নাঃ, কি হচ্ছে এসব, নিজের মনকে ধমকাই। চোখ ফেরালাম অন্যদিকে, দেয়ালের কাছে ট্রলিব্যাগটা দাঁড় করানো। এয়ারলাইন্সের ট্যাগটা এখনও ছেঁড়া হয়নি। বাড়ি থেকে ফিরেছি গত সোমবার, জামাকাপড়-জিনিসপত্র কাবার্ডে না গুছিয়ে রাখার জন্য সকালেই একপ্রস্থ বকুনি খেতে হয়েছে। মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল। বকুনির মধ্যেই যখন ওর জন্য আনা ‘সারপ্রাইজ গিফ্ট’গুলো ব্যাগ থেকে বেরোল, মুখের অবস্থাটা ছিল দেখবার মত। শাড়িটা যে খুবই পছন্দ হয়েছে সেটা বুঝতেই পারছিলাম কারণ বকুনির সুরটা তার পর থেকে আদুরে বিড়ালিনীর মত শোনাচ্ছিল। আর আধুনিক কারুকৃতি-শোভিত লেস দেওয়া ডিজাইনার লঁজারির প্যাকেটটা দেখে তো মনে হল কেউ এক কৌটো আবির লেপে দিয়েছে ওর গালে। যাক্ পরিশ্রম সার্থক। ছোড়দার বিয়ের পরদিন সবার দৃষ্টি এড়িয়ে কিনতে বেরোনোটা তবে বিফলে যায়নি।
বিফলে যে একেবারেই যায়নি সেটা তো পরিষ্কার। সকাল থেকে এখন অবধি মোট তিনবার বিছানার চাদর প্লাবিত হয়েছে রাগমোচনে। আজ পর্যন্ত তো এক দিনেও এতবার কখনও হয়নি, আর একবেলায়… ! শেষবার মিলিত হবার পরে যখন আমার বুকে মুখ গুঁজে পড়েছিল তখন ওর চোখেও কি একটা ছিল। মিলনের আবেশ, বিস্ময় আর অবিশ্বাস মাখানো সেই দৃষ্টিতে। অবাক আমি নিজেও কম হইনি। মানছি প্রায় ষোল-সতের দিন পরে দুজনের দেখা এবং… কিন্তু নিজের মধ্যে এতটা উত্তেজনা এর আগে কি কখনও অনুভব করেছি? নিশ্চিত যে এর জন্য অন্য কোনও কারণ দায়ী নয়? ছোড়দার বৌভাতের দিন থেকে মনের ভেতর যা হয়ে চলেছে সেটা…

।। ২ ।। বিরহপর্ব
আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে যেমন অলস ব্যস্ততা থাকে বৌভাতের দিনে, সেদিনটাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। টুকটাক কায়িক শ্রম বাদে আমারও তেমন কাজ নেই, এদিকে মন পড়েছিল উদ্যান-নগরীতে। সকাল থেকেই অভিমানিনীর ফোন আসছে কিছুক্ষণ অন্তর, একা থাকার বিরহের জ্বালায় সে নিজের সমস্ত ক্ষোভ উজাড় করে দিচ্ছে, সাথে বিয়েবাড়িতে অন্য মেয়েদের ঝাড়ি মেরে আমি নাকি সুখেই আছি-জাতীয় অনুযোগ। উৎসুক অতি-কৌতূহলী আত্মীয়দের কান বাঁচিয়ে মানিনীর মানভঞ্জন করতে অনবরত বাথরুমে আশ্রয় নিতে হচ্ছে, নয়তো ছাদে। মা কয়েকবার দেখল ব্যাপারটা। সেরেছে! বেশিক্ষণ এমন চললে চাপ হয়ে যাবে। ফোনাফুনিটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ না রাখলেই নয়। বিরহিনী রাধা সে কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, আরেক বিপত্তি!
“হ্যাঁ এখন আমার সাথে কথা বলতে খুউউউব অসুবিধে হচ্ছে, সে আর জানিনা!”
“ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর সোনা, আর কতবার এভাবে বাথরুমে সেঁধিয়ে থাকব, ডায়েরিয়া তো হয়নি। বাড়িভর্তি লোক…”
“থাক আমায় বোঝাতে হবে না”
“তুই শুধু শুধু রাগ করছিস”
“হ্যাঁ আমি তো শুধু শুধুই রাগ করি”
“আচ্ছা কালই তো ফেরার প্লেন, তারপর যতখুশি গালমন্দ করিস, আদর করিস”
“আহা, খুব শখ! আমার মোটেও তোকে আদর করার ইচ্ছে নেই”
“ঠিক আছে, আমিই নাহয় আদর করব একতরফা”
“কেউ তোর কাছে দয়া চায়নি”
“তোর মনে হচ্ছে দয়া করে আদর করি আমি?”
“নয়তো কি?”
“কতদিন হাতে জোড়া তরমুজ নিইনি, হাতগুলো নিশপিশ করছে”
“অ্যাই, আবার শুরু করলি!”
“সত্যি বলছি, এত তেষ্টা পাচ্ছে… কেমন আছে রে ওদুটো?”
“নিজে এসে দেখে নিস”
“একই রকম আছে, নাকি বিরহ যন্ত্রণায় আরেকটু ফুলে গেছে?”
“উফ্ফ্ জানি না আমি, অসভ্য ছেলে!”
“বটে? অসভ্যতা করার সময় তো মনে হয়না তোর খুব একটা খারাপ লাগে বলে?”
“চুপ কর! এখন তো ওখানে অসভ্যতা করছিস আমায় একা ফেলে গিয়ে”
অভিমানের সময় এদের যুক্তিবোধ কাজ করে না, আবহমান কাল এরকমভাবেই চলে আসছে। নাঃ, সত্যিই তো মেয়েটা এতদিন একা একা রয়েছে, আমার সাথেই অবসর সময়টা থাকে বলে অফিসেও তেমন বন্ধুবান্ধব নেই দু-একজন ছাড়া।
“আচ্ছা আচ্ছা মিষ্টু রাগ করে না। তুই নাহয় স্বাতীর কাছ থেকে ঘুরে আয় আজকের দিনটা, কাল থেকে তো…”
“স্বাতী নেই, ওরা কোদাইকানাল গেছে”
“তাহলে অন্তরাদির…”
“উফ্ফ্ বলছি না! পুরো গ্রুপটাই গেছে, সঞ্জীব ছাড়া”
“ওওওও কি ব্যাপার? তুই যাসনি বলে যায়নি নাকি?”
“ন্যাকামি করিস না”
এইবার মহাশয়াকে বাগে পেয়েছি। সঞ্জীব ওর অফিসের কলিগ, একই ব্যাচে জয়েন করেছে, এবং গোটা অফিস জানে ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বয়ফ্রেণ্ড আছে জানা সত্ত্বেও। আমাকে বহুদিন আগেই বলেছে কথাটা, প্রচ্ছন্ন গর্বটা চাপা দেওয়ার কোনওরকম চেষ্টা না করেই। একটু খ্যাপানো যাক।
“তাহলে ওর সাথেই কোথাও ঘুরে আয়”
“ফের ন্যাকামি… ?”
“কেন সে বেচারা কি দোষ করেছে?”
“তুই ভাল করেই জানিস কেন, আর এও জানিস যে আমি যাব না”
“আচ্ছা সতীরানী, আমার ঘাট হয়েছে”
জানি একথাটায় কাজ হবেই। আমার প্রতি অত্যধিক পজেসিভ বলেই হোক বা স্বভাবগুণে, ও অতি সন্তর্পণে পরপুরুষদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলে। আজকের দিনে এটা খুব স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। এজন্য মাঝেমাঝে সতীরানী বলে খোঁচা দিই, আর ও চিড়বিড়িয়ে ওঠে। এই শব্দটা একদম সহ্য করতে পারে না।
“কি ভেবেছিস, আমি যেতে পারব না ওর সাথে?”
“দুজনেই জানি যে সেটা কোনওদিন হবার নয়”
“তাই নাকি! Fir your kind information, ও আজকেই আমায় লাঞ্চে যেতে বলেছিল”
“এবং তুই যথারীতি যাসনি”
“তুই… কি বলতে চাস?”
মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। এবার ফাঁদে পড়েছ সুন্দরী!
“বলছি ও ডাকবে সেটা তো স্বাভাবিক, তেমনি তুই যে যাবি না সেটাও আমি জানি”
” Execuse me! আমি কি করব না করব আমার পার্সোনাল ব্যাপার”
“Of course”
ফোনের ওপ্রান্ত খানিক নীরব। তারপর দ্বিধাজড়িত প্রশ্ন-
“বাট যাওয়াটা কি ঠিক হবে?”
“কেন?”
“আহ্ ন্যাকামো করিসনা তো। জানিস না কেন?”
“দ্যাখ ও তোর কলিগ, একদিন লাঞ্চে গেলে মহাভারত দারুণ অশুদ্ধ হয়ে যাবে না”
“কিন্তু… অফিসের বাকিরা জানলে?”
“কার এত খেয়ে দেয়ে কাজ আছে বল তো? সবাই জানে যে তুই পাক্কা সতীরানী”
“আবার!”
“আচ্ছা আচ্ছা সরি। এবার রেডি হ, কটা বাজে দ্যাখ”
“দাঁড়া আগে ওকে ফোন করি”
“ওকে ম্যাম। আমি একটু চান করে আসি, তোর কিছু বলার থাকলে text করে দিস”
ফোন রাখার পর একটু স্বস্তি পেলাম। এবারে তৈরী না হলে মা নির্ঘাত চেঁচাবে। আপাতত এদিকটা সামলে নিই তারপরে নাহয় ওকে ফোন করব।
চান করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। আমার প্রেমিকা অন্য কারোর সাথে লাঞ্চ ডেটে যাচ্ছে। কথাটা ভেবেই কেমন লাগছে, আগে কোনওদিন ওকে অন্য কোনও পুরুষের সাথে দেখিনি বলেই কি? ধুর্ তাই হবে, এ নিয়ে ভাবার কোনও মানে হয়! কিন্তু কথাটা মাথা থেকে তাড়াতেও পারছি না। আচ্ছা ছেলেটার ওর প্রতি ব্যথা আছে সেটা কতটা সিরিয়াস? নাকি শুধু মাত্র ক্রাশ? ওর প্রতি কেউ আকৃষ্ট হলে অবশ্য একেবারেই দোষ দেওয়া যায় না। যাকগে এ নিয়ে ভেবে কি হবে। কিন্তু… একি? এতটা কাঠিন্য… কেন? কেন আবার, এতদিন ওকে কাছে পাইনি, উপবাসী পৌরুষের আর দোষ কি! উফ্ ওর জামবাটির মত স্তনগুলো যে কতদিন চটকাইনি। ওগুলোর কথা ভেবেই জিভে জল চলে এসেছে। এখনও বোধহয় একটু সময় আছে। চান করতে পাঁচ মিনিট বেশি সময় নিলে কেউ কিছু বলবে না।
চান করে বেরিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছি, একইসাথে তৃপ্ত আর একটু পরিশ্রান্ত লাগছে। এমন সময় ফোনে টিং টিং। ও বাবা, এতগুলো টেক্সট মেসেজ!
“Called him, going for lunch at his place. ”
“What should I wear ? ”
“শাড়ি পরাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি?”
“কিরে বল?”
“Are you not OK with this honey ? Please tell me. ”
মোবাইলটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ করলাম। শুধু শেষটার রিপ্লাই।
“Of course I am darling. ”

।। ৩ ।। নীলবসনা সুন্দরী
মেসেজের ডেলিভারি রিপোর্টের পাঁচ সেকেণ্ড না যেতেই ফোন। জ্বালাতন! টাওয়েলটা ছাড়ারও কি সময় দেবে না?
“বল পিপি”
নামটার ছোট্ট ইতিহাস আছে। একদা আমার সাথে মল-ভ্রমণকালে কিছু তৃষ্ণার্ত দর্শকের জুলজুল তাকিয়ে থাকা দেখে উষ্মা প্রকাশ করেছিল। নারীরা, বিশেষত যাঁরা আকৈশোর পুরুষের দৃষ্টিমারফত প্রেরিত অঞ্জলি পেয়ে অভ্যস্ত, তাঁরা যে উত্তর জানা থাকা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে এহেন প্রশ্নের অবতারণা করেন সে কথা সর্বজনবিদিত।
“কি যে এরা দেখে হাঁ করে গড নোস্!”
“এমন পিপি তো আর চট করে দেখা যায় না”
“পিপি? পিপি স্ট্যাণ্ডস ফর হোয়াট?”
অগত্যা ব্যাখ্যা করতে হয়। পিপি হল ‘পীনপয়োধরা’-র ল্যাটিন হরফের সংক্ষিপ্ত রূপ। কনভেণ্ট শিক্ষিতাকে শব্দটার মানে বুঝিয়ে বলতে আমায় এই মারে কি সেই মারে।
সেই থেকে পিপি।
আমার গলা পাওয়ামাত্র ওপ্রান্ত ঝংকার দিয়ে উঠল।
“উফ্ কোথায় ছিলিস তুই? একটাও রিপ্লাই নেই, কি করছিলিস?”
“আরে সকাল থেকে তো ফোন কানেই রয়েছি, চানটা করার সময় দিবি তো অন্তত নাকি? তোর মত ভোর পাঁচটায় উঠে চান আমার দ্বারা হয় না”
“এতক্ষণ লাগে চান করতে?”
উত্তরটা চেপে যাওয়াই শ্রেয়।
“তুই রেডি হয়েছিস?”
“সেজন্যই তো টেক্সট করেছিলাম তোকে, কি পরে যাই বল তো?”
“আপনি যা পরবেন তাতেই মানাবে সম্রাজ্ঞী, এমনকি যদি কিছু নাও পরেন তাতে সবচেয়ে ভাল…”
“আবার ইয়ার্কি, বল না ঠিক করে প্লিজ”
“পর যেটা তোর মন চায়”
“শাড়ি পরব? অকোয়ার্ড হবে না সেটা?”
“দুর এত ভাবিস কেন? যাবি তো কয়েক ঘণ্টার জন্য”
“ওকে ওকে, উম্ম্ম্ম কোনটা পরে যাই বল না?”
“নীলটা পরে যা যেটা গত পুজোয় কেনা”
“তোর দেওয়া শাড়িটা? না না ওটার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ নেই”
“কি ভুলভাল বলছিস, ওটা পরেই তো দিওয়ালিতে এসেছিলিস, মনে নেই?”
“উফ্ ওটা sleeveless রে হাঁদা”
“So what ?”
“আছে, তুই বুঝবি না”
বুঝতে ঠিকই পেরেছি, আমার আবদারে ব্লাউজটা বেশ সংক্ষিপ্তাকারে বানানো হয়েছিল। পরলে ওর বাহুমূল, পেলব হাত, কাঁধের ডৌল, বুকের চাতাল অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে; পুরুষ দর্শকের মনে ঝড় তুলে, অন্য নারীদের ঈর্ষান্বিত ক’রে। তাই এত দ্বিধা। তাই লজ্জা।
“তাহলে তুঁতে রঙেরটা পর”
“আমার আবার তুঁতে রঙের শাড়ি কোথায় পেলি তুই?”
“যাচ্চলে কদিন আগেই তো পরেছিলি”
“হায় ভগবান! কোন অন্ধের হাতে এনে ফেলেছ আমায়? ওটা মভ কালার হাঁদারাম”
এই হল double X chrosome র মহিমা, তুঁতে আর মভের মধ্যে সূক্ষ্ম বিচার করে! কি করে বোঝাই শাড়ির আবরণে ঘেরা নারীটি দ্রষ্টব্য, তার পোষাকের রঙের তারতম্যে আমাদের কিস্সু এসে যায় না। তুঁতে-মভ-বেগুনি-গোলাপীর চাইতে শঙ্খিনী-পদ্মিনী-চিত্রিনী-হস্তিনীর প্রকারভেদটাই আগে ধরা পরে পুরুষচোখে, বাকি সব তো গৌণ।
“আচ্ছা বেশ মভ, মভটাই পরে যা”
“ধ্যাত্, ওটায় বিচ্ছিরি ভাঁজ পড়ে গেছে, আয়রন না করলে পরা যাবেনা”
এ তো মহা গেরো!
“আয়রন করা গুলোর মধ্যেই একটা পর তবে”
“বললি যা হোক, তোকে দিয়ে যদি কোনও কাজ হয়”
“আরে চটে যাচ্ছিস কেন, যেটা হোক পর না”
“একটাও পছন্দ হচ্ছে না, দুর ভাল্লাগে না”
“আলমারি ভর্তি শাড়ির মধ্যে একটাও আপনার অঙ্গে ওঠবার যোগ্য নয়?”
“তুই থামবি? সালওয়ার পরেই যাব”
“বেশ তো ঐ ময়ূরকণ্ঠী রঙের…”
“থাক তোকে কিচ্ছু ডিসাইড করতে হবে না, আমাকেই বুঝে নিতে দে”
দূরভাষ যোগ আচমকাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ম্যাডামের রাগ হয়েছে। এটা অবশ্য নিয়মিত ব্যাপার, কোনও কিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেই তার সব রাগ এসে পড়ে আমার ওপর। যাক এখন না ঘাঁটানোই ভাল, নিজের মত শৃঙ্গার-প্রসাধন করলে রাগ আপনিই উবে যাবে।
কি মনে হতে একটা textকরলাম।
“জম্পেশ করে সাজুগুজু করিস আর এই অধমকে যাওয়ার আগে একবার চক্ষু সার্থক করার সুযোগ দিস”
No reply. মুঠোফোন নীরব। কিন্তু আমার থেকে থেকে এরকম হচ্ছে কেন? তোয়ালেতে তাঁবুর আবির্ভাব, আবার! একটু আগেই তো বাথরুমের নিভৃতে শান্ত করে এলাম। নাহ্ ওকে সত্যিই বড্ড মিস করছি। কালকে ফিরে গিয়েই ওর ফ্ল্যাটে একবার ঢুঁ মারতে হবে।
ভাবনার মাঝেই বাইরে থেকে কাকিমার উচ্চগ্রামে আহ্বান, বৌভাতের জন্য সবাই একে একে যেতে আরম্ভ করেছে, একমাত্র দেবর হিসেবে আমারও যাওয়াটা কর্তব্য বৈকি। কিন্তু এদিকে যে… চেঁচিয়ে বলে দিলাম বাকিদের রওনা দিতে, আমি ছোড়দার বাইক নিয়ে সময়মত পৌঁছে যাব। হাজার হোক সে নতুন বর, আজকের দিনে দ্বিচক্রযানে চড়ার অনুমতি পাবেনা। যদিও ভালমতই জানি দূরবাসিনীকে একবার চোখের দেখা না দেখে এখন আমি কোথাও নড়তে পারব না। অন্তত রেডি হয়ে থাকি যাতে অনুষ্ঠানবাড়ি গিয়ে ঝাড়টা কম খেতে হয়।
ঘড়ির কাঁটা নিজের নিয়মে আবর্তিত হয়ে চলেছে। পাঁচ, দশ, পনেরো করে করে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত। এরইমধ্যে জেঠুর দু’বার ফোন করা হয়ে গেছে, ক্রুদ্ধ তিরস্কারের সাথে দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কিত ছোটখাট ভাষণ শোনার মাঝেই মোবাইলে টেক্সট অ্যালার্টের শব্দ। জেঠুকে কোনওরকমে নিরস্ত করে ফোন রেখে মেসেজবক্স খুলতেই অভীপ্সিত বার্তা।
“Can you come to skipe now ?”
তড়িঘড়ি ল্যাপটপ অন করতে করতেই ফোনে উত্তর পাঠিয়ে দিলাম, “এসো সখী”। উঃ এই ইন্টারনেটটা এত দেরি করে কেন? কয়েক সেকেণ্ডকে মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল। অবশেষে স্কাইপের নীল জানলা খুলতেই দেখি আকাঙ্ক্ষিত মহিলাটির নামের পাশে সবুজ আলো জাজ্বল্যমান। কয়েকটা অধৈর্য চ্যাটও আছে তবে সেগুলো পড়ার এখন ফুরসত নেই। ভিডিওতে কল যাওয়ামাত্র ওপাশ থেকে সংযোগস্থাপন, এত বিস্ময়ও অপেক্ষা করে ছিল আমার জন্য?
কম্পিউটার স্ক্রিনের ওপারে একটি অপ্সরা, যেন দেবলোকের সভায় যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে অনেক যত্নে। মর্ত্যের সামান্য মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগল তার। এ কি অপরূপ বেশ! জলপাইরঙা তনুতে সমুদ্রনীল শাড়ি, তার সাথে মানানসই নীল আভরণ হাতে-কানে-গলায়, কপালে নীল বিন্দি, অধররাগের আলতো প্রলেপ বিম্বোষ্ঠে, আর… আর অঙ্গে শোভিত স্লিভলেস বক্ষাবরণী যা নিয়ে একটু আগের মনকষাকষি। আবৃত করার ছলে আরও যেন প্রকট করেছে দু’কূল উপচানো ভরা যৌবন। চমকের উপর চমক, ঈষদচ্ছ ব্লাউজের ভিতর নীলরঙা কাঁচুলি দৃশ্যমান।
আনত চোখে ও বসেছিল ওয়েবক্যামের সামনে, হয়তো আমাকে স্বাভাবিক হওয়ার সময়টুকু দিতে। তারপর লজ্জারুণ দৃষ্টিতে তাকাল, চাহনিতে অব্যক্ত জিজ্ঞাসা, যেন বলছে “কেমন লাগছে আমায়?” অজস্র উড়ন্ত চুমুতে ভরিয়ে দিলাম ল্যাপটপের পর্দা, কয়েক মুহূর্ত ধরে ও সিক্ত হল চুম্বনস্নানে, তারপর ঠোঁট মুচড়ে একটা অপার্থিব ভঙ্গিমায় আমার কাঠিন্য বাড়িয়ে দিল কয়েকগুণ। সেটা ওর নারীইন্দ্রিয় সহজেই ধরতে পেরেছে, চোখের ইশারায় জানতে চাইল নীচে কি অবস্থা। কোনওরকম দ্বিধা না করে ল্যাপটপের ডালা নামিয়ে নিজের লৌহকঠিন অবস্থা দেখালাম। একইসাথে ওর চোখে তৃপ্তি আর কৌতুকের ঝিলিক খেলে গেল, গালে আবির ছড়িয়ে পড়ল আরেক পোঁচ। বাড়িতে এখন বোধহয় কেউ নেই, কান পেতে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলাম- নাঃ কিছু শোনা যাচ্ছে না। দূর কেউ থাকলে থাকবে, এখন আমার মন নিজের বশে নেই, একটানে খুলে নামিয়ে নিলাম প্যাণ্ট আর অধোবাস। ফুঁসে উঠতে থাকা উত্থান তীব্র লালসায় চেয়ে রইল ওপারের মাদকতাময়ী রূপসীর দিকে। তার চোখেও ঝরে পড়ছে কামনা, অধর স্ফুরিত। কয়েক মুহূর্ত দুজনেই স্থাণু, তারপর শব্দ তরঙ্গ বেয়ে একটা অর্ধস্ফুট আকুতি ভেসে এল।
“I miss you so much honey. ”
“Miss you too baby. ”
“Dying to be in your arms. ”
“I wanna make love to you sexy. ”
মদির কটাক্ষে আমায় বিদ্ধ করে একটা অদ্ভুত দেহভঙ্গি করল, পীনোন্নত বুকজোড়া চোখের আরো কাছে এখন। আর বোধহয় নিজেকে ধরে রাখতে পারব না। নিষ্ঠুর রমণী সেটা উপলব্ধি করেই বিদায় চাইছে।
“এবার যাই? Keep missing me. ”
“So will he. ”
নীচের দিকে ইঙ্গিত করলাম।
“Noughty boys. ”
আদুরে স্বরে কথাটা বলে একটা বিদায়চুম্বন, তারপরেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
অনেক হয়েছে, বেরোনোর আগে আরেকবার মুক্ত না হলেই নয়। সন্তর্পণে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকলাম। স্নানঘরের নির্জনে নিজের পৌরুষকে তীব্র পেষণ করছি, বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠছে নীলবসনা সুন্দরীর প্রতিচ্ছবি। একটা একটা করে আবরণ উন্মোচিত হচ্ছে, পেষণের গতি বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। আঃ কি ভীষণ রিরংসা, যেন ভিতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে; গোটা শরীরটা অণু-পরমাণুতে বিভক্ত হয়ে বাতাসে ভেসে যেতে চাইছে, আছড়ে পড়তে চাইছে দু’হাজার কিলোমিটার দূরের প্রযুক্তি নগরীতে অবস্থিত প্রিয়তমার দেহে। খুঁজে নিচ্ছে তার শরীরের অন্ধিসন্ধি, কল্পনায় দলিত মথিত করছে উদ্ভিন্নযৌবনাকে।
সহসা মোবাইলে পরিচিত টেক্সট আগমন ধ্বনি।
“Almosy there. But তুই কিন্তু আমায় থেকে থেকে ফোন করবি না। উম্ম্ম্ম ওকে? Love you sweety. ”
মনের অন্দরে কি যেন একটা হল। একটা বিস্ফোরণ, বা ঐ জাতীয় কিছু। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, কেউ যেন আমায় এক অতলস্পর্শী খাদের দিকে গড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তি, নাকি বন্ধন? জানি না।
যুগান্তরের পর চেতনা ফিরে আসতে দেখি সেই বাথরুমেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। চারপাশ ভেসে যাচ্ছে কামনার লাভাস্রোতে। এঃ এটা পরিষ্কার না করে গেলেই নয়।
দুর্বল পায়ে বেরিয়ে এলাম খানিক পর। ঘড়ির কাঁটা সবেগে দৌড়চ্ছে। আজ প্রচুর গালাগাল জুটবে। আপনমনেই হেসে ফেললাম। Isn’t that worth it?

।। ৪ ।। কল্পনা
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আগে কোনওদিন পড়িনি।
বৌভাতের অনুষ্ঠানে চারিদিকে আনন্দের ফোয়ারা ছুটছে। নতুন বৌদির প্রশংসায় গুরুজন স্থানীয়রা পঞ্চমুখ, স্নেহের বশে নয়তো নিতান্ত লৌকিকতার স্বার্থে। ছোটদেরও উৎসাহের অবধি নেই, একটা আস্ত অপরিচিত বাড়িময় দৌরাত্ম্য করে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছে, মারধর-বকুনির বালাই নেই, শাসন হলেও তাতে প্রশ্রয়ের ভাগটাই যে বেশি কচিকাঁচারা সেটা বিলক্ষণ বোঝে। সঙ্গে পরিবারের নবতম সংযোজনটির ব্যাপারে হাল্কা কৌতূহলও রয়েছে। ওদিকে মাঝবয়সীর দল সাংসারিক কূটকচালিতে ব্যস্ত, নিজ নিজ কর্তা বা গিন্নীকে ঠাট্টা ইয়ার্কির ছলে নির্দোষ তীরে বিদ্ধ করার এমন উপলক্ষ বড় একটা তো আসে না! মাঝেসাঝে উত্তেজনার বশে শ্লেষের পরিমাণ বেড়ে গেলে আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তখন নারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে বাকিরা। মিঠেকড়া বাক্যালাপের আঁচ পোয়াচ্ছে কমবেশি সবাই। রোজকার বাঁধাধরা নিয়মের আগল খুলে গেছে, আদিরসাত্মক টিপ্পনীতেও কারও ভ্রূকুঞ্চন নেই। দুয়ারে বসন্ত আগতপ্রায়, সঙ্গতি রেখে সবার মন তাই উদার, কোনরকম মালিন্য রেখাপাত করতে পারছে না। আর সদ্য যৌবনের চৌকাঠ পেরোনো বা পেরোতে চলাদের তো কথাই নেই, তাদের আজ মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটার পালা। সন্ধ্যায় দুদিন আগে পরিচয় হওয়া আগন্তুকদের কে কোন সাজে বরণ করবে সেই ভাবনায় মশগুল। আসরের কোণে দৈবাৎ কাউকে দেখা যায় জানলার বাইরে উদাস তাকিয়ে। নির্ঘাত বর অফিস থেকে ছুটি পায়নি, বিরহিনীর তাই প্রাণপণ চেষ্টা নিজের ম্লান মুখখানা সকলের চোখের আড়ালে রাখার। সে রসভঙ্গ অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য। তারপরেই নিজেকে আবার ভাসিয়ে দিচ্ছে বাকিদের সাথে, সম্মিলিত আনন্দসাগরে।
কেবল একটিমাত্র যুবক শতচেষ্টা সত্ত্বেও পারছে না, পারছে না এই আনন্দযজ্ঞের অংশীদার হতে। তার মন পড়ে আছে ‘অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে’।
গত পাঁচ বছরে একটা ব্যাপারে কিছুতেই অবন্তিকা তার পুরুষসঙ্গীটিকে হার মানাতে পারেনি। ভারতীয় সমাজে পুরুষহৃদয়ের যে চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, তার সর্বাঙ্গে সঙ্কীর্ণ পজেসিভনেসের গাঢ় দাগ। নারী তার কাছে কামনার বস্তু, আরাধ্যা দেবী, তাকে সে পেতে চায় বিভিন্ন রূপে। নারীস্বাধীনতার বুলি মুখে আউড়িয়ে আর প্রগতির ধ্বজা উড়িয়ে বিতর্কসভায় শোরগোল ফেলে দিয়ে যখন সে ঘরে ফিরে আসে, নিজস্ব রমণীটিকে তখন চলতে হয় তার অঙ্গুলিহেলনে। এমনকি সে কতটা (অ)শালীন পোষাক পরবে বা কোন কোন পরপুরুষের সাথে কতক্ষণ এবং কতখানি দূরত্ব রেখে কথা বলবে, সে বিষয়েও তার সিদ্ধান্তই শেষ কথা। অন্তত ভারতীয় নারীদের একটা বড় অংশের তেমনই অভিযোগ। কখনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কখনও নেহাত খেলাচ্ছলে। সত্যিমিথ্যে জানা নেই, বাস্তবে দু’রকম নজিরই মেলে। দুর্ভাগ্যের বিষয় অবন্তিকা এমন দোষারোপের সুযোগ আজ পর্যন্ত পায়নি।
কারণ আর সব ব্যাপারে যাই হই, এ প্রসঙ্গে আমি খুব একটা মাথা ঘামাই না। হয়তো তার জন্য ওর একনিষ্ঠতাই দায়ী। বিশদে ভেবে দেখিনি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, অবন্তিকা, আমার ‘ও’। আমার সর্বস্বও বলতে পারেন। যাকে একটু আগে রাগিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে বাধ্য করেছি ওর কলিগের বাড়িতে লাঞ্চের নিমন্ত্রণে যেতে। নির্জন ফ্ল্যাটে, কারণ সঞ্জীব একাই থাকে। এবং সর্বোপরি যার পরিচয় আমার ‘ও’-র প্রেমে দ-হয়ে থাকা প্রেমিক। অন্য পুরুষের অধিকৃত জেনেও ওকে যে একান্তভাবে চায়।
কেন করলাম? কেন আবার, আমি একজন প্রগতিশীল, উদারমনস্ক, না-শভিনিস্ট প্রেমিক, তাই। আমার প্রেমিকার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আমার রুচিবিরুদ্ধ, তাই। ওর একনিষ্ঠতায় আমার পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে, তাই। ওর দেহের শুচিতার চাইতে ওর হৃদয়ের ভালবাসা আমার পাথেয়, তাই।
নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়ার সময় মানুষ এ-ই করে। বোঝেও না যে সবার কাছে ফাঁকি চলে, কেবল নিজের কাছে ছাড়া।
অশান্ত মন পড়ে আছে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা, দুঘণ্টা, সোয়া দুঘণ্টা, আড়াই ঘণ্টা, দুঘণ্টা সাঁইত্রিশ মিনিট… ওহো ভুল বললাম। এ ঘড়ির কাঁটা নেই। শুধু ডিজিটাল ডিসপ্লেতে সংখ্যা দিয়ে সময়ের সূচক। তবে সময় দেখাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বারংবার দেখতে হচ্ছে কোনও মিস্ড কল অ্যালার্ট আছে কিনা, বা মেসেজবক্সে অপঠিত কোনও বার্তা। এতবার মোবাইল পকেট থেকে বার করে শুধু সময় দেখলে যা হয়, অতি-উৎসাহী দর্শকের চোখে ধরা পড়তে বাধ্য। কোথাও কিছু নেই, বড়পিসি হঠাৎ বলে উঠল,
“কি ব্যাপার রে অন্তু, কোথাও যাবি নাকি?”
“অ্যাঁ, না তো, কেন?”
“এতবার মোবাইল বার করে দেখছিস তো তাই ভাবলাম…”
বাক্যটা উহ্য রইল তবে ইঙ্গিতটা নয়। হাওয়ায় ভাসমান সে ইঙ্গিত লুফে নিতে কয়েক মুহূর্তের দেরী, ফিল্ডার জেঠিমা।
“কোথায় আবার যাবে, কনেযাত্রীদের গাড়ি আসতে কতক্ষণ বাকি সেটাই দেখছে থেকে থেকে”
“সে তো এখনও অনেক বাকি, সাতটার আগে এসে পৌঁছবে বলে মনে হয়না”, ওপাশ থেকে ছোটপিসির ফোড়ন।
“সাতটা কি বলছিস, আটটার আগে এসে উঠতে পারে কিনা দ্যাখ্। কিন্তু তাই নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কিসের?”, বড়পিসির ধরতাই।
“সেকি দ্যাখোনি সেদিন দিদিভাই, সন্তুর বৌয়ের মাসতুতো বোন কেমন আমাদের অন্তুর খবরাখবর নিচ্ছিল, কোথায় থাকে, কি করে, মাস গেলে কত পায়!”, কাকিমা সম্ভবত গুগলের করেস্পণ্ড্যাণ্ট, এই বিয়েটার কভারেজ ফ্রিল্যান্স করছে।
সন্তু ছোড়দার ডাকনাম। ছোটবৌদির মাসতুতো বোন দীপান্বিতা, বিয়ের দিন যে সাদা বাংলায় ‘হেভি মাঞ্জা’ দিয়েছিল, থেকে থেকে ‘ঝাড়ি মারছিল’ এবং শেষে ছলছুতোয় আলাপও করে গিয়েছিল। আর এইমাত্র হাসির হররা ওঠা ঘর থেকে যে বেরিয়ে এল, সেটা আমি।
এরা পারেও বটে। বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই, কুলোপানা চক্কর! বাণপ্রস্থে যাওয়ার বয়সে প্রাণে এত রস আসে কোথা থেকে দেবা ন জানন্তি। নেহাত গুরুজন, তাই মনে মনেও গালাগালটা দিতে পারছি না। আপাতত এখান থেকে কেটে পড়াই শ্রেয়। ভাবতে না ভাবতেই সামনে রিংকুদি। ছোটপিসির মেয়ে। ঠিক এই মুহূর্তে আমার অবস্থাটা ওর চেয়ে ভাল এখানে কেউ বুঝবে না।
চাকরির পোস্টিং পাওয়ার পর প্রথমদিকে ভিনরাজ্যের শহরে রিংকুদিই ছিল আমার গাইড। এবং অন্যদিক থেকে দেখলে অস্বস্তির জায়গাও বটে। স্বাভাবিক কারণেই। বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ি, প্রেম করা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার ভয় না থাকলেও জানতে পারলে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, উপরন্তু সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন মাতৃদেবীর দুশ্চিন্তা সামলানোর গুরুভার। রিংকুদি অবশ্য একেবারেই পেটপাতলা স্বভাবের নয়, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তবু দ্বিধা কাটিয়ে ওকে আমার ‘ও’-র কথাটা জানাতে পারিনি। দুজনের বাসস্থান শহরের দুইপ্রান্তে হওয়ায় এ নিয়ে তেমন ভাবনা ছিল না। কিন্তু ভবিতব্য খণ্ডাবে কে?
বছর দেড়-দুই আগে এক রবিবারের বিকেল, মিঞাবিবি শপিংয়ে বেরিয়েছি। প্রায় গোটা সকালটা বিছানায় আদর আর ভালবাসাবাসির পর দুজনেরই মেজাজ ফুরফুরে। আমার কনুই বাঁধা পড়েছে ওর কোমল বাহুপাশে, থেকে থেকে সুবর্তুল নারীস্তন পুরুষালি পেশীর সংস্পর্শে আসছে, তড়িৎস্পৃষ্ট হচ্ছে দুই মন। একদিকের কাঁধ ঢেকে রয়েছে ওর খুলে রাখা মেঘবরণ চুলে। দুজন দুজনাতে বিভোর। অকস্মাৎ ছন্দপতন। বিশালায়তন মলের প্রবেশদ্বারের সামনে রিংকুদি। এক্কেবারে সামনাসামনি। ‘জাস্ট বান্ধবী’ বলে উল্লেখ করার কোনওরকম অবকাশ নেই, এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে দুজনে দাঁড়িয়ে। রিংকুদিও জোর চমকেছিল, তবে সামলে নিয়ে একটা মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে রেখে ওর সাথে আলাপ-পরিচয় পর্ব শুরু করে দেয়। সহজাত নারীপ্রবৃত্তিতে ওরও মিশে যেতে তেমন অসুবিধে হয়নি। গোটা ব্যাপারটায় আমার ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। পরে অবশ্য দুজনের কাছ থেকেই আলাদা ভাবে টিটকিরি হজম করতে হয়েছিল।
সেই থেকে পরিবারের একজন অবন্তিকার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। বাস্তবে ওর সাথেই রিংকুদির তুলনামূলকভাবে বেশি যোগাযোগ আছে। একদিক থেকে সেটা কিছুটা স্বস্তিদায়ক। তবে এর খেসারতস্বরূপ কালেভদ্রে রিংকুদির সাথে দেখা হলে কিছুটা টীকাটিপ্পনী সহ্য করতে হয়। আজও ওর মুখে ফুটে ওঠা কৌতুকচিহ্ন দেখে বুঝলাম তার ব্যতিক্রম হবে না। তাই সই, প্রবীণাদের খোরাকের বিষয়বস্তু হওয়ার চাইতে সে অনেক বেশি সহনীয়।
“কার কথা বলছে রে ছোটমাইমা?”
রিংকুদির প্রশ্নে বুঝলাম বাজে আলোচনার শেষাংশ ওরও কানে গেছে।
“ধুর, কেউ না, ছোড়দার এক শালি”
“কোনজন? ঢ্যাঙামত, ন্যাকা আধো-আধো স্বরে কথা বলে যে?”
ধন্য এদের পর্যবেক্ষণশক্তি।
“তুই চিনিস নাকি?”
“ঐ, একটা-দুটো কথা হয়েছে, বেশিক্ষণ পোষায়নি। তোকে তো সারাক্ষণ মাপছিল”
“প্লিজ এবার তুই আর শুরু করিস না”
“এবার না হয় বাড়িতে অবন্তিকার কথাটা বলেই দে”
“মাথা খারাপ!”
“এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আর অবন্তিকাকে দেখলে কেউ তোকে ঐ নেকুর ব্যাপারে bother করবে না”
“যেচে বাঁশ নিতে পারছি না এখন, বিশ্বাস কর”
“ওকে বুঝলাম… কেমন আছে রে মেয়েটা, অনেকদিন কথা হয়নি ওর সাথে”
“হুমম্ ঠিকই আছে”, প্রসঙ্গটা এড়ানোই ভাল।
“তুই তো এবারে প্রায় দু’সপ্তাহ আছিস, ও কি করছে ওখানে একা একা? বোর হচ্ছে নিশ্চয়ই”
জ্বালাতন। মেয়েরা নিজেদের বেডরুমের গল্প শেয়ার করতে এত পছন্দ করে, সময় সময় সেটা চূড়ান্ত বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উনি নির্ঘাত আমার দিদির সাথে বিছানাপ্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন, কারণ রিংকুদি কি ইঙ্গিত করছে বোঝা শক্ত নয়। ঐ আলোচনার দিকে কোনওমতেই যাওয়া চলবে না, তার চেয়ে সত্যিটা বললে যদি অব্যাহতি মেলে।
“নাঃ দিব্যি আছে, ইন ফ্যাক্ট আজ এক কলিগের বাড়ি গেছে লাঞ্চে”
“Good for her. ওর সেই আশিকও সেখানে গেছে নাকি?”, রিংকুদির চোখেমুখে ঝিলিক দিচ্ছে দুষ্টুমি।
প্রবল ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মানে???
“তুই… তুই, মানে কার কথা বলছিস?”
“কেন ওর অফিসের সেই কলিগ, সঞ্জীব। অবন্তিকা যে বলেছিল তুই সব জানিস?”
আমি বাক্যহারা। কি জবাব দিই এর?
“হ্যাঁ তা জানি বটে, ইয়ে… মানে, সেই সঞ্জীবের বাড়িতেই গেছে”, কোনওমতে বললাম। এবার অবাক হওয়ার পালা রিংকুদির।
“Are you serious? আমি কিন্তু ঠিক মেলাতে পারছি না”
“কি বল তো?”
“ওকে যতদূর চিনি, She avoids that guy. I mean, its not that big deal. আর অন্যদের সামনে its also safe I guess. ”
“Actually, ও একাই গেছে”
“What???”, বিস্ময়ে রিংকুদির চোখ ছানাবড়া।
নাঃ এ যে হিতে বিপরীত হল। একটা অপরাধবোধ চারিয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর, পুরো সত্যিটাই বলে দেওয়া দরকার।
“আসলে ও যেতে চাইছিল না ঠিক, আমিই কিছুটা জোর করে…”, রিংকুদির হাঁ বুজতে চাইছে না, কোনওক্রমে শেষ করি নিজের বাক্যটা, “পাঠালাম”
“Have you gone crazy অন্তু?”
“কেন?”
“কেন? তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন? কিছু একটা অঘটন ঘটে যায় যদি?”
রিংকুদির মুখে এখন আর কৌতুকের লেশমাত্র নেই। কপালে আর ভ্রূ-তে অনেকগুলো ভাঁজ। কয়েকটা দুশ্চিন্তার, বাকিগুলো সম্ভবত বিরক্তি থেকে। বিরক্তিটা কার ওপর সেটা অনুমান করাও দুরূহ নয়। মরিয়া হয়েই কিছুটা গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করলাম।
“দ্যাখ সবসময় ছেলেদের নীচুনজরে দেখিস না। ওর কাছে যা শুনেছি, সঞ্জীব যথেষ্ট ভদ্র ছেলে। মরাঠি ব্রাহ্মণ, লেখাপড়াতেও উঁচুদরের। সব ছেলেকেই রেপিস্ট ভাবা আজকের দিনে একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে”, একটানা কৈফিয়ত দিয়ে যেতে হল, জানি না বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে কিনা। রিংকুদি চুপ করে আছে, ঠোঁট কামড়ে নিজের মনে কি যেন ভাবছে। ফাঁড়াটা কি এযাত্রা কেটে গেল?
“May be you are right, after all ছেলেটাকে আমি চিনি না, So I should not be judgemental.”, অবশেষে মুখ খুলেছে রিংকুদি, “But make sure, God forbid if anything bad happens, that you nstand right beside her.”
“Anything bad মানে…”
“তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস, আমি কি বলেছি তার মানে না বোঝার মত কচি আর নোস… ছেলেটা যদি ফাঁকা ফ্ল্যাটে ওর সাথে অসভ্যতা করে তার দায় তুই এড়াতে পারিস না”, ওঘর থেকে কারোর ডাকে সাড়া দিয়ে রিংকুদি উঠে গেল। ওর রাগত দৃষ্টি আর সশব্দ পদক্ষেপে বেশ বুঝলাম আমার ওপর ভালমত চটেছে।
একটা ফাঁকা ঘর দেখে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম। এদিকটায় তেমন কেউ নেই, কিছু সময়ের জন্য আমার খোঁজ না করতে এলে বাঁচি। একটু একাকিত্বের প্রয়োজন এখন। বিমনাভাবে জানলা দিয়ে কর্মব্যস্ত শহরের একফালি ছবির দিকে তাকিয়ে আছি। মনে চিন্তারা আনাগোনা করছে। কি মনে হতে একবার মোবাইলটা বার করে দেখলাম। না কোনও ফোন, না টেক্সট। প্রায় চার ঘণ্টা হতে চলল শেষবার যোগাযোগ হয়েছে ওর সাথে। রিংকুদির শেষ কথা গুলো মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। সত্যি যদি তেমন কিছু ঘটে যায়? যদি ওকে একা পেয়ে ছেলেটা কিছু করে বসে? নাঃ আর ভাবতে পারছি না। চোখ বুজে এল আপনা থেকেই। মাথার ভেতর এক অজানা, অদেখা ফ্ল্যাটের দৃশ্যপট ভেসে উঠেছে।
শেষ বিকেলের মরা আলোয় ঘরটা আধো-অন্ধকার। উঁচু উঁচু জানলাগুলোর পর্দা পরিপাটিভাবে টানা, একপাশ দিয়ে কোনমতে চুরি করে গোধূলির আলো ঢুকছে। সেই আলোয় দৃশ্যমান একটা সিঙ্গল কট, ব্যাচেলরের জন্য পর্যাপ্ত হলেও দুজন মানুষের পক্ষে অপ্রতুল। তার উপর বসে নীল শাড়িপরিহিতা এক এলোকেশী সুন্দরী। চোখের পাতা বন্ধ, টানা টানা আঁখিপল্লব আরো মোহময়ী লাগছে। ঈষৎ পুরন্ত ঠোঁট কাঁপছে তিরতির। বুকের আঁচল খসে পরে আছে কোমরের নীচে। উন্মুক্ত সুগভীর নাভিদেশ, দ্রুত শ্বাসের তালে ওঠানামা করছে ভারী বুক। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ব্লাউজ আর সংক্ষিপ্ততর কাঁচুলির শাসন অগ্রাহ্য করে স্বাধীন হতে চাইছে বর্ষার সুপক্ব তালকে লজ্জা দেওয়া স্তনজোড়া। নারীটি উদ্গত উত্তেজনাকে দমন করতেই বুঝি এলিয়ে পড়ল তার ঠিক পিছনে বসে থাকা সবল পুরুষটির গায়ে। আকার-আকৃতিতে সে আমার প্রায় সমান, তবুও একবারই কমন গ্যাদারিঙে আলাপ হওয়া ছেলেটাকে চিনতে এতটুকু ভুল হল না, সঞ্জীব। দুই বাহু দিয়ে বেষ্টন করে রয়েছে আমার প্রেয়সীকে, একটা হাত কোমরের কাছে খেলা করে বেড়াচ্ছে, অন্যটা ব্যস্ত ব্লাউজের উপরিভাগের লোভনীয় খাড়াই ঢাল বেয়ে নামতে। ওর মুখ হারিয়ে গেছে রূপসীর গভীর নেকলাইনে, তপ্ত শ্বাসের হল্কায় কেঁপে উঠছে রমণীশরীর। আলতো চুম্বনে তার কাঁধের অনাবৃত ডৌল সিক্ত, পুরুষের দাঁত নরম কানের লতিতে আক্রমণ শানাতেই হিসিয়ে উঠল ও। ধীরে ধীরে সে কানের লতি চুষছে সঞ্জীব, আর তার দুই হাত এখন ব্যস্ত আমার পছন্দের ডিজাইনে বানানো বক্ষাবরণীর হুকে। একটা একটা করে অর্গল খুলছে, একটু একটু করে উন্মুক্ত হচ্ছে আমার প্রেমিকার স্তন, আর সেই উদ্ভাসে গোটা ঘর যেন আলোয় ভরে উঠছে। ওর চোখ এখনও বন্ধ আবেশে, রক্তিম অধরে উপরের দাঁতের পাটির চাপ ক্রমবর্ধমান। লোভী পুরুষের জিভ লেহন করে নিচ্ছে গোলাপী আভাময় গালের সঞ্চিত সবটুকু মধু। কামনার প্রতিবর্তে ওর মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে গেল সেদিকে। চোখ বন্ধ, তবু একপক্ষকাল উপোসী ঠোঁট খুঁজে নিল বহুদিনের তৃষ্ণার্ত ঠোঁটকে, মিশে গেল একবিন্দুতে। লেহন করছে, প্রবল আগ্রাসে তারা খেলা করছে পরস্পরের সাথে। সঞ্জীব এখন চুষে চলেছে প্রেয়সীর উষ্ণ বিম্বোষ্ঠ, আস্বাদ নিচ্ছে তার কামনাসিক্ত মিষ্টি লালার, যা আমার পরমপ্রিয়। দুই থাবার তৎপরতায় এতক্ষণে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। শেষ হুকটিও তাদের মালকিনের আব্রুরক্ষার অসমযুদ্ধে পরাভূত। নতমস্তকে রণভূমি ত্যাগের সময়টুকু পেল না তারা, প্রবল এক টানে ঐ পরপুরুষ নির্মমভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিল নীল স্লিভলেস ব্লাউজ। ধর্ষিতা রমণীর মত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে আমার প্রিয়ার বক্ষাবরণী। ধর্ষক তখন ব্যস্ত ওর কাঁচুলিবদ্ধ স্তনজোড়া দলিত মথিত করতে। প্রবল নিষ্পেষণে কামনাবিষ্ট কুচযুগ সমুন্নত, উত্তপ্ত বোঁটাগুলো শেষ লজ্জাবস্ত্রের আচ্ছাদন উপেক্ষা করে জেগে উঠেছে জ্বলন্ত ভিসুভিয়াসের ন্যায়, অচেনা আঙুলের ছোঁয়াতে তাদের ভিতর কাঁপন জাগছে আরো আরো। মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল।
আচমকাই উধাও দৃশ্যপট, অদেখা ঘরের আশ্লেষদৃশ্য মুছে গিয়ে ফিরে এসেছে পরিচিত রাস্তা। আমি এখনও জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, পকেটের মুঠোফোন জানান দিচ্ছে কারওর বার্তালাপের ইচ্ছা। আর, আর… এ কি সত্যি? বাস্তব? কখন নিজের অজান্তে হল এমন? ডানহাতের মুঠোয় দৃঢ়ভাবে ধরা আমার জাগ্রত পৌরুষ। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ নিয়ে কখনওই হীনম্মন্যতার কারণ ঘটেনি, বরং ওর চোখে বরাবর মুগ্ধ বিস্ময় দেখে শ্লাঘা অনুভব করেছি; কিন্তু আজকের উত্থান অতীতের সব রেকর্ডকে ধুয়েমুছে দিয়েছে!
ফোনটা বেজেই চলেছে, ওর নয়তো? তড়িঘড়ি পকেট থেকে বের করে নামটা দেখে নিরাশ হলাম। আমার উৎকণ্ঠিতা নয়, রিংকুদির ‘নেকু’। এ কেন এখন রসভঙ্গ করে? যা হোক কুটুমবাড়ি বলে কথা, ফোনটা ধরা কর্তব্য, জেঠুর দুপুরবেলার উপদেশাবলী মনে পড়ে গেল।
“বলো দীপান্বিতা”

।। ৫ ।। উপেক্ষার প্রহর
সন্ধের মহানগরী। আকাশের কোণ থেকে সূর্যের শেষ রক্তাভাটুকু আরেকটি রবিবারকে বিদায় জানিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। সপ্তাহের কর্মব্যস্ততা শুরুর আগে শহরের ব্যস্ত রাজপথেও যেন আলস্যের ছোঁয়া। উইকেণ্ড উদযাপনকারীদের প্রমত্ত হুল্লোড় বাদ দিলে ইতিউতি কিছু নিঃসঙ্গ পথচারী আর ক্রেতার আশায় অপেক্ষমান বিষণ্ণগম্ভীর কতিপয় দোকানদার, প্রাণের চিহ্ন বলতে এটুকুই চোখে পড়ে। না, একটু ভুল হল। রাস্তার প্রান্ত বরাবর দুদিকেই কিছুদূর অন্তর আলোকমালায় সেজে ওঠা বহুতলগুলিকে ভুললে চলবে না, বহু নতুন জীবনের গাঁটছড়া বাঁধার সাক্ষী তারা। সারিসারি রক্তখদ্যোতের মত জ্বলতে থাকা টুনিবাল্বের আলো যেন আগামীর দিশারী, নীরবে বয়ে এনেছে ফাল্গুনের আগমনবার্তা।
এমনই একটি আলোকোজ্জ্বল বহুতলের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি গত দশ মিনিট। সময়ের হিসেবটা অবশ্য ঘড়িমাফিক, আমার ব্যক্তিগত ধারণা অন্ততপক্ষে আধঘণ্টা। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সহজ প্রাঞ্জল উদাহরণটা মনে করে নিজেকে চাঙ্গা করার একটা ব্যর্থ প্রয়াস ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি। লাভের লাভ কিছু হয়নি। মলমাসের অবসানে বাঙালির ঘরে ঘরে শুভ পরিণয়ের ধুম। আর কে না জানে, নিমন্ত্রণবাড়ি যাওয়ার আগে চার ঘণ্টা সাজসজ্জা-প্রসাধনে এবং আরো চার ঘণ্টা তার সংশোধনে বঙ্গনারীকুল ব্যয় না করলে গোটা বিবাহোৎসবটাই মাটি। অতএব অপেক্ষা। অনাদিঅনন্তকাল ব্যাপী অপেক্ষা, কখন কনেযাত্রীদের গাড়ি এসে পড়বে এবং সুসজ্জিত দাঁতের পাটি বার করে তাদের যথোচিত অভ্যর্থনা জানাতে হবে। এমনিতে এসমস্ত পারিবারিক ব্যাপারে সামাজিক শিষ্টাচারের দায়িত্ব কখনওই আমার ওপর বর্তায় না, কিন্তু আজ নেহাত একজনের অনুরোধে বাধ্য হয়ে…
বিকেলে ফোন আসতেই প্রমাদ গুনেছিলাম, না জানি কি অপেক্ষা করছে। তবে আজকের দিনটায় এজাতীয় উপদ্রব এলেও কিছু করার নেই জেনে গাম্ভীর্যের মুখোশ টেনে কথোপকথন শুরু করি। ফল হয় উল্টো।
“বাব্বাঃ কি গম্ভীর! বরের ছোট ভাই না বড় জেঠু?”
রীতিমত অপ্রস্তুত আমি। সদ্যপরিচিতার কাছ থেকে শুরুতেই ন্যাকা-ন্যাকা গলায় এমন সপাটে অভিযোগ ধেয়ে আসবে এ বোধহয় চিন্তার বাইরে ছিল। কোনওমতে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়।
“আমার গলাটা এরকমই, পছন্দ হোক বা না হোক”
“এম্মা, সে কথা বলিনি। ইশ্শ্ তুমি রাগ করলে?”
সত্যি, রিংকুদি ঠিকই বলেছে। এ যে দেখছি…
“No, its OK. বলো হঠাৎ ফোন? ওদিকে সব ঠিকঠাক তো?”
“Yah! Everything is fine. বাট একটা প্রবলেম হয়েছে…”
“সে কি? কারোর শরীর টরির খারাপ হল নাকি?”
“নো, বললাম না everything is fine. বাট আসলে the thing is আমাদের যে ড্রাইভারটা যাবে সে নর্থের দিকে তেমন চেনে না। আর আমরাও কেউ আই মীন ঐদিকটা যাইনি”
“সেটা এমন কিছু অসুবিধে নয়, অ্যাড্রেস তো জানোই, দরকার পড়লে কাছাকাছি এসে আমাদের যে কাউকে একটা ফোন করে দিলেই হবে”
“ওঃ ওকে, বাট তুমি কি একটু গেটের কাছে থাকতে পারবে? Then it will be easier for us to locate….”
“বেশ তো, থাকব, বেরোনোর সময় শুধু একবার জানিয়ে দিও”
“Great, thanks a lot. I hope I am not… I mean we are not bothering you too much. ”
“Certainly not.”
এত বাজে অজুহাত বোধহয় এরকম ন্যাকা মেয়েরাই দিতে পারে। ড্রাইভার নাকি ডিরেকশান জানে না!
পাতি লাইন করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। বিরক্তির মধ্যেও হাসি পেল, ওকে এই ব্যাপারটা এক্ষুণি বলতে হবে।
পকেট থেকে মোবাইল বের করতে গিয়েও অজান্তেই হাতটা থেমে গেল, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ওর শেষ মেসেজটা। এই মুহূর্তে তো ওকে কিছু বলা যাবে না, ও এখন এক পরপুরুষের ফ্ল্যাটে। সম্ভবত ভীষণ ব্যস্ত।
আচ্ছা এটা কি ধরনের ছেলেমানুষি করছি, ও তো নিজে থেকে যেতে চায়নি, আমিই প্রকারান্তরে বাধ্য করে পাঠালাম। এখন ওর ওপর রাগ করাটা স্রেফ বালখিল্যতা ছাড়া কিছু নয়। আর ফ্ল্যাটে গেলেই কি ঘনিষ্ঠ হতে হবে নাকি? এসব তো হীনম্মন্যতায় ভোগা দুর্বল পুরুষদের ভাবনা, আমায় মোটেই মানায় না। কিন্তু এখনও ফোনই বা করছে না কেন? লাঞ্চে গিয়েছিল, তা দ্বিপ্রহর গড়িয়ে আরও প্রায় চারটি ঘণ্টা কেটে গেছে। সুবোধ কলিগটি কত কোর্সের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিল? নাঃ মাথা থেকে প্রসঙ্গটাকে তাড়ানো দরকার। অতিথিসমাগমও শুরু হল বলে, এইবেলা ধরাচুড়ো পরে নেওয়া যাক।
অন্যমনে পোষাক পরিবর্তন করে নেমে এসেছি প্রবেশ-তোরণের কাছে। কনেযাত্রীদের গাড়ি রওনা দিয়েছে অবশেষে, সে বার্তাও মুঠোফোন মারফত পৌঁছে গেল। অতঃপর প্রতীক্ষা। কখন যে আসবে?
রাস্তার বিপরীতে একটা অন্ধকার পার্ক, পথবাতির চুঁইয়ে পড়া আলোর ক্ষীণ আভাসে যেটুকু দৃশ্যমান তা থেকে মনে হয় খেলাধুলোর পাট বহুদিন চুকে গেছে, এখন পরিত্যক্ত, হয়তো রাত বাড়লে অসামাজিক কাজকর্মের ভরসাস্থল। তরল আঁধারে দোলনা, সি-স, পীথাগোরাসের অতিভুজ-আকৃতির স্লাইড- সব কেমন হিমযুগের প্রস্তরীভূত প্রাগৈতিহাসিক পশুদের মত ঠায় দাঁড়িয়ে। আচ্ছা হঠাৎ করে যদি ওরা জেগে ওঠে? দ্যুৎ, যত্তসব উদ্ভট চিন্তা… দুপুর থেকে কি যে শুরু হয়েছে মাথার মধ্যে। ‘স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালবাসা নয়/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়’। অসংখ্য ঘুণপোকারা কুরে কুরে খাচ্ছে মস্তিষ্কের অগুনতি কোষ। মস্তিষ্ক, না হৃদয়? দুটো কি আলাদা করা যায়? করা সম্ভব? জটিল সে প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। সমগ্র সত্তা প্রাণপণ চেষ্টা করছে মনটাকে অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে। যতবারই চোখের পাতা বন্ধ করছি, ভেসে উঠছে আধো-আলোছায়ায় আচ্ছন্ন একটা অপ্রশস্ত ঘর। উঃ কি দুর্বিষহ এই দৃশ্যকল্প! মনের মধ্যে আরেকটা মন জেগে উঠে প্রতিবাদ জানায়। অতই যদি দুর্বিষহ হবে তবে ঐ কাঠিন্যের উৎস কি? কি কারণ দুপুরে স্নানঘরে সহসা বিস্ফোরণের?
আর পারছি না, দমবন্ধ হয়ে আসছে। অসহ্য এ প্রতীক্ষা। কখন আসবে কনেযাত্রীদের গাড়ি?
কখন আসবে, ওর ফোন?
ভগবান বলে কেউ থেকে থাকলেও তাঁর অস্তিত্ব বড়ই বায়বীয়, আজ অবধি প্রমাণ করা যায়নি। শুধু কিছু ব্যতিক্রমী মুহূর্তে তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় যখন মানুষের একান্ত মনোবাঞ্ছা তিনি পূরণ করেন। তবে আমার মত নাস্তিকের প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার কারণটা বোধগম্য হল না। সে না হোক, তিনি যে আছেন, ভীষণভাবেই আছেন সেটা উপলব্ধি করলাম ঠিক সেইসময় কয়েকগজ দূরত্বে কনেযাত্রীদের বাসটাকে থামতে দেখে। কিছু সেকেণ্ডের অপেক্ষা, বাড়ির চত্বরে আর তিলধারণের জায়গা রইল না। লোকলৌকিকতা, কুটুম্বিতা, ব্যজস্তুতি, ব্যজনিন্দা, পরনিন্দা-পরচর্চা- বিয়েবাড়ির আবশ্যিক উপকরণের সবই মজুত। কোনওকালে ভিড়ভাট্টা আমার তেমন পছন্দ নয়, আজ তারই আড়ালে নিজের অশান্ত মনের টানাপড়েনকে দিব্যি লুকিয়ে ফেললাম।
অচেনা-আধাচেনা মানুষজনের কোলাহল, চোখধাঁধানো সাজপোষাকের উগ্রতা, রকমারি বিদেশী সুগন্ধির ঘ্রাণে ভারী বাতাস আর হরেক আত্মীয়-সম্বোধন- এসবের মাঝে চোখে পড়ল সুসজ্জিতা একটি যুবতীকে, লাজনম্র নয়নে আমার দিকেই এগিয়ে এল, যদিও উন্নতনাসা আর উদ্ধত চিবুকে রূপের অহমিকা স্পষ্ট। দিন দুই আগে বিবাহবাসরে বা আজ বিকেলের ফোনালাপে কথা বলার তেমন আগ্রহ বোধ করিনি বরং উপেক্ষাই করতে চেয়েছি। ঠিক এই মুহূর্তে ওকেই সম্ভবত আমার সবথেকে বেশি প্রয়োজন। চুলোয় যাক আতিথেয়তা, পরিবারের সম্ভ্রম। কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মেতে উঠলাম আলাপচারিতায়। আত্মীয়-পরিজনদের সামনে বেশি কথা বলতে অস্বস্তি হবে হৃদয়ঙ্গম করামাত্র দীপান্বিতাকে নিয়ে সটান ছাদে। কিছুটা অবাকই হয়েছে, তবে হঠাৎ পাওয়া নিভৃতির পুলক ওর চোখমুখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। অতিথিসমাগমের এটা ব্যস্ততম সময়, আমন্ত্রিত জনসংখ্যার অধিকাংশই নীচে। হাতেগোনা কিছু স্বভাব-ধূমপায়ী আর খোলা হাওয়ার সন্ধানে ভিয়েনের গোটা দুই কারিগর ব্যতিরেকে এই নিরালায় আমাদের কূজনে কান পাতার জন্য কেউ নেই। তাও কথাবার্তা যা হচ্ছে নিম্নগ্রামে। অন্তরঙ্গতার জন্য সে একদিক থেকে ভালই। বিশেষত বার্তালাপের উদ্দেশ্য যখন মূলত পরস্পরের সান্নিধ্যলাভ। দখিনা হাওয়ায় সম্মুখবর্তিনীর খোলা চুল উড়ছে, মুখমণ্ডলে অবাধ্য ঝাঁপ দিলে তার ভাগ্যে জুটছে শাসন, আর স্খলিত স্বাধীনচেতা আঁচলের উপরি প্রাপ্তি শিথিল প্রশ্রয়। নির্বিকারে লক্ষ্য করে যাই। বাঙ্ময় চোখের তারায় কৌতূহল, আকুতি; ঈষৎ স্ফুরিত ওষ্ঠে না-বলতে পারা কথাদের ভিড়। যৌবনমদে গরবিনী গ্রীবা সামান্য তির্যক, হৃদয়াবেগ দমনে অপারগতা পরিস্ফুট অঞ্চলপ্রান্তে চঞ্চল আঙুলের অশান্ত যাতায়াতে। ভাললাগার রোমাঞ্চে স্ফীত বক্ষের স্পন্দন কিঞ্চিৎ দ্রুততর। মনকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে উপভোগ করি, ক্ষতি কি?
না, অপরাধবোধ জাগছে না, কেনই বা জাগবে? কথার ফাঁকে একটু আগে দেখে নিয়েছি, মোবাইলের কললিস্ট আর অপঠিত বার্তা, দুয়েরই ভাঁড়ার শূন্য। সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। একা আমিই কি নীরবে প্রতীক্ষা করে যাব?
আমারও আছে উপেক্ষার ভাষা।

।। ৬ ।। ব্যভিচার
রাত বাড়ছে, মধুযামিনী সমাগতপ্রায়। মিলন-আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ দুইটি হৃদয় অধৈর্য হয়ে উঠছে, জনারণ্যের মাঝে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগের অভাবে অসহিষ্ণু দু’জোড়া চোখ থেকে থেকে নিবদ্ধ হচ্ছে পরস্পরের প্রতি। কখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে, একের বাহুডোরে বাঁধা পড়বে অন্যজনের তনুলতা, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশে যাবে, কানে কানে হবে অস্ফুটে উচ্চারণ, “প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁপে প্রতি অঙ্গ মোর”। হাত বাড়ালেই তার হাত, তবু এই মুহূর্তে ছোঁয়ার অনুমতি নেই, এতটাই অনতিক্রম্য সে দূরত্ব। একটুকু নিরালার প্রত্যাশায় দুইজনেই লুকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ছোড়দা আর নতুনবৌদির কথা বলছি।
আকাশে পূর্ণচন্দ্রের উদ্ভাসে চরাচর সাদা চাদরে ঢাকা বিস্রস্তকেশ রাজকুমারীর মত অভিমানী দেখাচ্ছে। মাঘ আর ফাল্গুনের সন্ধিক্ষণে শহরে মলয় মারুতের আবির্ভাব। ভূরিভোজের তাড়নায় অতিথিরা সকলে নীচের তলায় নেমে গেছে, ফাঁকা ছাদ তাই আরও রোম্যাণ্টিক, আরও নিবিড়। একটানা আলাপচারিতার পর কথার অভাবে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা, মাঝেমাঝে আড়চোখে অন্যজনকে লক্ষ্য করা। কথার অভাবে, না একটু আগের দুর্ঘটনার অভিঘাত?
প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তাগিদে অথবা মলিন হতে থাকা প্রসাধনে নতুন রূপটানের প্রণোদনায়, অথবা দুটোই। দীপান্বিতা রেস্টরুমে যাওয়ামাত্র ফোন বার করে পরিচিত নম্বরে ডায়াল। কিছুক্ষণ বাজতে না বাজতেই সুরেলা কলার টিউন নির্মমভাবে থামিয়ে দিয়ে দুর্বোধ্য বিজাতীয় ভাষায় খেদপ্রকাশ, মর্মার্থঃ এই উপভোক্তা এখন আপনার সাথে বার্তালাপে ইচ্ছুক নন। অধৈর্য হয়ে তৎক্ষণাৎ বার্তাপ্রেরণ করলাম, “কি করছিস? কোথায় আছিস? Are you OK?” শতচেষ্টা সত্ত্বেও এতক্ষণের জমিয়ে রাখা উৎকণ্ঠা চেপে রাখা গেল না। কিন্তু মুঠোফোন বোবার মত চেয়ে আছে। ব্যাপারটা কি? ঈর্ষা আর অভিমানকে হঠিয়ে মনের দখল নিচ্ছে দুর্ভাবনারা। ও ঠিক আছে তো? প্রায় দশ মিনিট অতিক্রান্ত, দীপান্বিতা যে কোনও মুহূর্তে চলে আসবে হয়তো। আসুক, পরোয়া করি না। আবারও ফোন লাগালাম। আবারও সেই পরিণতি। কয়েক সেকেণ্ড পরে মেসেজ, সম্ভবত আমায় করা ওর ক্ষুদ্রতম টেক্সট, “Busy now”.
আটটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ আগে, লাঞ্চ ডেট এখনও চলছে। ব্যস্ত থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক! মনের ভেতরটা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে যাচ্ছে, কেমন নির্লিপ্ত-নিশ্চিন্ত বোধ জাগছে ক্রমশ। সবই মায়া, কেউ কারওর নয়। গোটা জগতটা আদতে একটা প্রহসনের মঞ্চ।
“হাই, বোর হচ্ছিলে খুব? Did I take too long? So sorry”.
রিনিরিনি আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল। এতক্ষণের বিলম্বের কারণটা একপলক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চুলটা আরেকটু পরিপাটি ভাবে খোলা, ঠোঁটে ওষ্ঠরঞ্জনীর প্রলেপ দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার নয়, বুকের কাছে ব্লাউজটা যেন সামান্য উন্মুক্ত আগের চেয়ে, শাড়িটাও ষড়যন্ত্র করে অন্যদিকে খানিকটা সরে গেছে। মন মাতাল করা মৃদুমন্দ সুরভি ভেসে আসছে ঈষৎ দৃশ্যমান বিভাজিকা থেকে। চোখেমুখে চাপা আবেদন, সামান্য বিভক্ত ওষ্ঠাধরে চটুল ইঙ্গিত। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
প্রায় এক মিনিট গোটা ছাদ নীরব, শুধু কিছু অর্ধস্ফুট শীৎকার বাদ দিলে অখণ্ড মৌনতা। শ্বাস নেবার তাগিদে একটু বিচ্ছিন্ন হলাম।
“এইমাত্র লাগালাম লিপস্টিকটা”, দীপান্বিতার চোখে মৃদু ভর্ৎসনার সাথে প্রশ্রয়। এটুকুরই অপেক্ষা ছিল, কথাটা ভাল করে শেষ হবারও সুযোগ পেল না। পুনরায় মৌনতা। মুখে তপ্ত শ্বাসের হল্কা, ঘাড়ের কাছে রক্তরাঙা ম্যানিকিওরড নখগুলো আরও গভীরভাবে বসে যাচ্ছে, পেলব স্তন উন্মুখ হয়ে নিজেদের মেলে ধরেছে আমার পুরুষালি বুকে। আস্তে আস্তে ওর চুলের মধ্যে খেলা করছে আমার আঙুল, অভিজ্ঞ হাতে চুলের গোড়ায় মৃদু চাপ দিচ্ছি, নারীশরীর কেঁপে উঠছে থরথর। নীচের ঠোঁটে হাল্কা কামড়ের আভাস পেলাম, সাথে সাথে প্রত্যুত্তর। অন্য হাতে বেষ্টন করা বাইশটি বসন্ত পেরনো ক্ষীণকটি। দুষ্টুমির ইচ্ছে জাগল, সামান্য স্থান পরিবর্তন করতেই মুঠোয় তানপুরার খোল। বাসন্তীরঙা শাড়ির উপর থেকেই মর্দন করছি নধর নিতম্ব, নিজস্ব নারীর মত গুরুনিতম্বিনী না হলেও যথেষ্টই পরিপুষ্ট। পুরুষহাতের নিষ্পেষণে কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল নারীদেহে। কাঁধ জড়িয়ে থাকা মৃণালভুজ আরো একটু ঘনিষ্ঠভাবে টেনে নিল নিজের দিকে। হাতে এখন নিটোল স্তনের মসৃণতা, হল্টার নেক ব্লাউজের আস্তরণের ওপর থেকে অনুভব করছি তার উষ্ণতা, তার জ্যামিতিক গঠন। তালুতে আগুন ধরাচ্ছে উন্মুখ হয়ে জেগে থাকা সুদৃঢ় নারীবৃন্ত। প্রবল মথনে মোমের মত গলে যাচ্ছে সদ্যপরিচিতা, নিজেকে সঁপে দিচ্ছে গভীর আলিঙ্গনে।
বহু যুগের ওপারে পরস্পরের ঠোঁট বিচ্ছিন্ন হল। বড় বড় দুই চোখ তাকিয়ে রয়েছে স্থির, অতিরিক্তের আর্তি নিয়ে। নাভিমূলে আলতো হাত রাখতেই ফের কম্পন, ছিন্নলতার মত আমার বুকে আশ্রয় নিল।
“যাওয়ার আগে একবার মীট করবে?”
“কাল সকালেই ফ্লাইট”
এক আকাশ অভিমান নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে দীপান্বিতা, ঠোঁটের অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়া অনুযোগ। একটুক্ষণ নীরবে ওর মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে চুল ঘেঁটে দিলাম। আসন্ন বিচ্ছেদের আভাস পেয়েই চোখ ছলছল। বেদনার্ত দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।
“সামার ইন্টার্নশিপের একটা অফার আছে এনসিবিএসে”, একটু থেমে পাদপূরণ, “ওটা ব্যাঙ্গালোরে”
আঁতকে ওঠার কথা, উঠলাম না। নিজের মধ্যে প্রতিটি শব্দের মর্মোদ্ধার করতে করতেই শান্তভাবে আরেকবার এই নারীকে বুকে টেনে নিয়েছি, “কন্ট্যাক্ট কোরো”
আরো কিছু নীরব মুহূর্ত কেটে গেল, আপাতত শেষবারের মত তাজা নতুন নারীঘ্রাণ ফুসফুস ভরে নিলাম, “চলো নীচে যাই, লাস্ট ব্যাচের বেশি দেরি নেই”। মৌন সম্মতি জানিয়ে বাধ্য মেয়ের মত সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল দীপান্বিতা। ছাদের দরজার কাছে এসে আবারও নিবিড় আলিঙ্গন, পার্থক্য বলতে উদ্যোগটা এবার আমার তরফ থেকে নয়। চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতেই চমকে দিয়ে প্যাণ্টের ভিতরের উত্থানকে নিজের মুঠোবন্দী করেছে। কয়েক সেকেণ্ডের প্রবল বিমর্দনে আমি হতবাক, তীব্রকঠিন। মিষ্টি করে চোখ মেরে শেষ একটা চুম্বন, তারপরই লাজুক মুখে হরিণীর মত তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। ও জানে ঠিক এই অবস্থায় আমি বাকিদের সামনে যেতে পারব না।
পাপবোধ? কই, জাগছে না তো! কয়েকপল দাঁড়িয়ে রইলাম, অভিজ্ঞতাটা নিজের মধ্যে জারিত হওয়ার সময়টুকু দিয়ে। ভালই কাটল ছুটিটা। অজান্তেই পকেট হাতড়ে মোবাইলটা বার করেছি, ডিজিটাল সূচক আস্তে আস্তে নয়ের দিকে এগোচ্ছে। এখনও রিক্ত মেসেজবক্স।
‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ, সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ’
এবার আরও নীচে নামার পালা।

।। ৭ ।। প্রত্যাবর্তন
নীল, তারপর সাদা, আবার নীল, আবার সাদা। পর্যায়ক্রমে নীল আর সাদার আধিপত্যের দৌড়, কার ভাগে শেষমেষ জিত আছে জানার চাইতে প্রতিযোগিতাটাই বুঝি মুখ্য। নীলের মধ্যে আবার রকমফের, কখনও গাঢ় নীল তো তারপরেই আকাশী, আবার কোথাও ধূসরবর্ণ গম্ভীর নীল। সাদার মাঝেও রয়েছে প্রভেদ, পুরোটাই একটানা ধবলশুভ্র নয়, জায়গায় জায়গায় খয়েরির ছিটে। স্বর্গলোকে যাওয়ার পথ কি এরকমই হয়? দুর এই কচি বয়সে স্বর্গারোহণের কোনওরকম বাসনা নেই। এটা মনে হয় মেঘের দেশ, চতুর্দিকে মেঘেদের রাজত্ব। নীল মেঘ, সাদা মেঘ, কয়েক জায়গাতে ভীষণদর্শন কালো মেঘেরও দেখা মিলল, রাগের চোটে এক্ষুণি যেন মাটিতে আছড়ে পড়বে। মেঘ থেকেই তো বৃষ্টি, ক্লাস থ্রি-তে ভূগোল বইতে দেখা সেই ছবি। তীরচিহ্ন দিয়ে কিভাবে জল থেকে বাষ্প, বাষ্প জমে মেঘ, তার থেকে বৃষ্টি সব একেবারে জটিল করে বোঝানো। বৃষ্টিপাতের কারণ না বলতে পারলেই বনানী ম্যাডাম বেঞ্চের ওপর গোটা পিরিয়ড দাঁড় করিয়ে রাখতেন। সে তবু মন্দের ভাল, শোভনা ম্যাডামের ক্লাসে ইতিহাসের উত্তর ভুল বলেছ কি পিঠে দমাদ্দম স্কেলের বাড়ি, তখন ‘চোখে নামে বৃষ্টি’। আচ্ছা বৃষ্টিতে শেষ কবে ভিজতে হয়েছিল? নভেম্বর? হ্যাঁ, প্যাণ্টালুনসের কিসব সেল চলছিল, বাহাদুরি দেখিয়ে ছাতা নিয়ে যাইনি। হবি তো হ সেদিনই আকাশ ভেঙে অঝোরধারে বরিষণ। অনবরত গজগজ শুনতে শুনতে আর এক হাতে অ্যাপারেলস ভর্তি প্যাকেট, অন্যহাতে একচিলতে বাহারি লেডিজ ছাতা নিয়ে জলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটার যৌথ খেলা। অনর্থক বীরত্বের তিরস্কার, সাথে হাত ধরাধরি করে জলের ছাঁট থেকে বাঁচাতে সোহাগভরে কাছে টেনে নেওয়া। খোলারাস্তায় জনসমুদ্রের মাঝে নৈকট্যের আতিশয্যে অতিরিক্ত দুষ্টুমি করে ফেললে, হোক না সে ছাতার আড়ালে, শাস্তি দেওয়া জলের তলায় পা মাড়িয়ে। উঃ, এত আলো কিসের?
প্রায়স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ ভেদ করে আলোর রশ্মি সটান এসে পড়ছে মুখের ওপর। সারি দেওয়া মেঘেদের মাঝে একদল অনুপস্থিত, সেই ফাঁক গলে অর্কদেব উঁকি মারার সুযোগ পেয়ে গেছেন। যেটুকু তন্দ্রা দুচোখের পাতায় অবশিষ্ট ছিল, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বিমানসেবিকার যান্ত্রিক ঘোষণার চোটে তাও উধাও। কাল রাতে শুতে এমনিতেই দেরি হয়েছে, সকালের ফ্লাইট ধরার তাড়ায় ভোর-ভোর ওঠা, ক্লান্তিতে সারা শরীর বিদ্রোহ করছে। আরেকটু ঘুমিয়ে নিলে হয়, কিন্তু এদিকে বিমানসেবিকার কথামত ‘থোড়ি হি দের মে’ ব্যাঙ্গালোরের ‘হাওয়াই আড্ডায়’ পৌঁছে যাব। অগত্যা নিরুপায় হয়ে নিজেকে সজাগ রাখা। নেমেই আবার অফিস ছুটতে হবে। যন্ত্রণা! একটা হাফ সিএল নিয়ে নেব? নাঃ এবারের ছুটিতে অনেকগুলো খরচ হয়ে গেছে, তার চেয়ে কোনওমতে দিনটা পার করে বিকেল-বিকেল বাড়ি ফিরে লম্বা ঘুম দিলেই চলবে। অবশ্য দিন খারাপ গেলে সন্ধ্যা নামার আগে পরিত্রাণ জুটবে না, মরুকগে এতশত ভেবে লাভ কি, নেমেই একটা কড়া করে ডাবল কফি নিয়ে নেব নাহয়।
ভাবনার মাঝেই অবতরণের প্রস্তুতি। প্লেনের চাকা প্রযুক্তিনগরীর মাটি ছোঁয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চেনা ভিড়, ঠেলাঠেলি, গাদাগাদি করে যাত্রীবাহী বাসে চড়ে টার্মিনাস। নামেই এয়ারলাইন্স, যেন সকাল ন’টার আপ লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল! তাড়াহুড়ো করে কনভেয়র বেল্ট থেকে মালপত্র উদ্ধার পর্ব, ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে পৌঁছ-সংবাদ প্রেরণ। লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমান বাসগুলোর একটাতে বসে দম নেওয়ার সময় পেলাম। ওকেও কি জানাব? এখন বোধহয় অফিস যাওয়ার প্রস্তুতিতে মগ্ন, বিরক্ত করা ঠিক হবে না। নাঃ, কাল রাতে পইপই করে বলে দিয়েছিল সকালে নেমেই খবরটা জানাতে, এরপর এই ছুতোয় মান-অভিমানের পালা আরম্ভ হলে সন্ধেবেলাই ছুটতে হবে ঘুম-টুম ফেলে। মধ্যপন্থা অবলম্বন করা যাক। “Reached safely. Going straight to the office”.
টিংটিং। সফল বার্তাপ্রেরণের আশ্বাসবাণী।
এবার গন্তব্যে পৌঁছনোর অপেক্ষা, অফিস আসতে ঢের দেরি, প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেওয়ার অবসর পাওয়া যাবে। তড়িঘড়ি কণ্ডাক্টরকে ডেকে দায়িত্ববান যাত্রীর মত টিকিটটা কেটে রাখছি যাতে পরে নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটে, পকেট থেকে পরিচিত বার্তাগমন ধ্বনি।
“That’s great. Getting ready, will call you on the way. Have something important to tell you. Hope you are not angry”.
কে কার ওপর রাগ করে! মনটা ভারি হয়ে গেল।
“OK dear”
ভাগ্যিস মেসেজের মধ্যে মানুষের মনের পুরোটা প্রতিফলিত হয় না, ধরা পড়ে না মুখের অভিব্যক্তিও। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বেলা খুব একটা কম হয়নি, তাও এ শহরের ইতিহাস আর ভূগোল বলে এখন আকাশ এমন মেঘলা থাকাটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই। আমার মনের আকাশও মেঘাচ্ছন্ন গত রাত থেকে, তাই বোধহয় সূর্যালোকের অভাবটা আরও বেশি চোখে লাগছে। নিদ্রাহীনতার ক্লান্তি আর মানসিক দ্বন্দ্বের টানাপড়েনে কখন চোখ লেগে গেছে নিজেও টের পাইনি। ঘুম ভাঙল সহযাত্রীর ডাকে, মুঠোফোন বেজে চলেছে শব্দের জলতরঙ্গ ছড়িয়ে সে কথাই জানান দিতে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম, যাক অফিস আসতে এখনও কিছুটা দেরি আছে, পেরিয়ে গেলে আরেক কেলেংকারি হত। আশ্বস্ত হয়ে ফোনে চোখ বোলালাম, বাপরে, তিনটে ডাকছুট, একটা অপঠিত বার্তা। কলব্যাক করলাম, ওপারে অবন্তিকা।
“ঘুমিয়ে পড়েছিলিস?”
“ঐ একটু চোখ লেগে গেছিল। সরি কলগুলো শুনতে পাইনি”
“Its OK honey, জানি তুই খুব টায়ার্ড আছিস”
“হুম, তুই কি অফিস পৌঁছেছিস?”
“নোপ, Still on my way. Another ten to fifteen minutes”
“ঠিক আছে”, কি বলব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না, এমন তো কখনও হয়নি আগে ওর সাথে?
“তুই ঠিক আছিস তো? তোর গলাটা কেমন শোনাচ্ছে, Are you not well?”
“না না Everything is fine ”
“Sure honey?”
“হ্যাঁ, জাস্ট একটু sleep deprived. বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে নেব বেশি করে তাহলেই…”
“তো এখনই চলে যা না, আজ নয় একটা লিভ নিলি”
“না রে অফিসে যেতেই হবে একবার”
“OK, as you wish “, ওর গলাটা কি ম্রিয়মাণ লাগছে?
“তুই কি আজ, মানে… সন্ধেবেলায়, You wanna catch up?”
“Actually about that, তোকে বলা হয়নি”, খানিক থেমে, “… আমি বম্বের কনফারেন্সটায় যাচ্ছি”
এর জন্য একেবারেই তৈরী ছিলাম না, বহুদিন আগে থেকে শুনে আসছি ঊর্ধ্বতনদের পরোক্ষ চাপ সত্ত্বেও ও যেতে নারাজ। শুধু এটাই বা কেন, বেশিরভাগ কনফারেন্সই ও এড়িয়ে যায় নানা ছলছুতোয়। হাতেগোনা যে কবার গেছে তা শুধু মহিলা সহকর্মীরা সঙ্গে ছিল সেই ভরসায়, এবারে তো তারা কেউ যাচ্ছে না বলে জানি। হিসেবটা মিলছে না।
ও কি আমার মন পড়তে পারে? বহুবার প্রশ্নটা নিজেকে করেও সদুত্তর পাইনি, তবে আমার এখন নিশ্চিত ধারণা, পারে।
“You must be wondering কেন সাডেনলি ডিসিশানটা চেঞ্জ করলাম?”
প্রশ্নটা যখন আন্দাজ করেই নিয়েছেন, উত্তরটাও আপনিই দিন দেবী।
“The thinh is “, ও যেন কোনও কারণে ইতস্তত করছে, “প্রজেক্টটার কোর সেকশনের প্রেজেন্টেশনটার চাংক আমার বানানো, অন্য যে পার্টনার যাচ্ছে সে এটা ঠিকমত হ্যাণ্ডেল করতে পারবে না”
“I see! কিন্তু সেটা এরকম লাস্ট মোমেণ্টে জানানোর মানে কি? This is not professional ”
ওপ্রান্ত মুহূর্তখানেক নীরব। তারপর…
“The other partner is সঞ্জীব, So… You know, how shy he is with me “, ভুলটা তৎক্ষণাৎ সংশোধন করল, “I mean, he used to be ”
কাল রাতের কথোপকথনের পর এই সংশোধনটার সত্যিই প্রয়োজন। প্রসঙ্গটা এড়াতে অন্য প্রশ্নে যেতে হল, “কবে যাওয়া? টিকিট ম্যানেজ করতে পেরেছিস”
“ইয়া, আজ সকালেই অফিসের এজেণ্ট কনফার্ম করেছে, বাট ট্রেনে যেতে হবে, নো ফ্লাইট টিকিট available, not within their budget ”
“Trust me, Trains are much better than Flights these days. তাছাড়া ডিসট্যান্সও এমন কিছু নয়… সো যাচ্ছিস কবে?”
“To Night 11:00 PM ”
“Oh! Then no catching up till you return?”
“Know, Sorry Honey ”
“So now its my turn to be alone in this city for a few days ”
“For fewer days. “, নিজেকে যে বেশিদিন একা থাকতে হয়েছে এই সামান্য ব্যাপারটাও এরা মনে রাখবে এবং বারংবার মনে করিয়ে দেবে… “I will be back by Saturday evening ”
“এতদিন? কদ্দিন ধরে কনফারেন্স চলবে?”
“Three days. Starts day after tomorrow, Wrap up by Friday. ”
“বুঝলাম, তাহলে আজকে সি অফ করতে যাব স্টেশনে”
“No don’t “, মাঝপথেই প্রস্তাবটা মুলতুবি হয়ে গেল, “প্লিজ নো, অফিসের কলিগরা থাকবে”
“তারাও ট্রেনে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, I mean…”, যেন শ্বাসরোধ করে কথা বলছে এমন চাপা গলায় উত্তর এল, “আমি আর সঞ্জীব”
“ওঃ ওকে”
“আমার জন্যই ও ফ্লাইট টিকিট ক্যানসেল করে ট্রেনের বুকিং করাল, বলল একা মেয়েদের জন্য এসব জার্নি সেফ নয়”
সাফাই দিচ্ছ প্রিয়তমা? কোনও প্রয়োজন নেই, আমার মনের মধ্যে কি চলছে তা যদি জানতে…
“Are you angry Honey?”, ত্রস্ত স্বরে প্রশ্ন ভেসে এল।
“আরে না না, বরং এটা একদিক দিয়ে সেফ হয়েছে, আজকাল যা অবস্থা রাস্তাঘাটের…”
“Are you sure you are not…”
“Trust me, I really am ”
“Are you angry about yesterday?”
হাসি পেয়ে গেল, আমি রাগ করব কালকের জন্য? নিজের মনের ভেতরটা যদি খুলে ওকে পড়াতে পারতাম। কি জবাব দেব একটু ভেবে নিই। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি ও এখন অভ্যাসবশত ডানদিকের নীচের ঠোঁটটা কামড়ে রয়েছে, উত্তরের অপেক্ষায়। নাঃ, অযথা হয়রানি করার মানে হয় না কোনও।
“Of course I am baby, sent percent ”
পুরোপুরি যে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি জানি, তবে ছোট্ট করে শ্বাস পড়ার শব্দে বুঝলাম বুকের ভার অনেকটাই লাঘব হয়েছে। আবারও হাসি পাচ্ছে, ঐ গুরুভার বক্ষের অধিকারিণীর সাথে কথাটা এক্কেবারে বেমানান। বলতে গিয়ে চেপে গেলাম, বাড়ি থেকে ফিরেই ঝাড় খাওয়াটা উচিত কাজ হবে না।
“OK Honey, I have reached there. Will call you latar, OK? Bye “, সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের বিরতি, তারপর, “ম্মমুয়াহহ”
দূরভাষযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মনের মধ্যেও মেঘের আঁধার সরিয়ে রোদ্দুরের উঁকিঝুঁকি। এইজন্যই কি এত চোখে হারাই ওকে? জানি না, জানতেও চাই না বোধহয়। আমার গন্তব্য এসে গেছে, মনটাকে সংযত করা দরকার। বহুদিন পরে অফিসে ঢুকছি, আজ কোনওক্রমেই কাজে ভুল কাম্য নয়।
বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে কসরত করে নামতে হল। এই গন্ধমাদনের বোঝা সারাদিন বইতে হবে? অন্তত ট্রলিব্যাগটা কেয়ারটেকারকে বিকেল পর্যন্ত গছানো যায় কিনা চেষ্টা করে দেখি, তারপর তো সুযোগ পেলে আমিই কাট মারব… কেজো ভাবনাদের মাঝে মোবাইলে দৃষ্টি যেতেই গলাটা শুকিয়ে কাঠ। সেই অপঠিত মেসেজ, বার্তাপ্রেরিকার নাম- দীপান্বিতা! নামটা কাল রাত থেকেই যেন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল, অথচ তার কিছুক্ষণ আগে ছাদের ওপর… মনের ভেতরে পাপবোধটা ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
“Hope you have reached safely… I am feeling so lonely here, missing you tons… wish you could stay a bit longer ”
শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোতের নেমে যাওয়াটা টের পেতে একটুও কষ্ট হল না। এমন আহাম্মক আমি, এরই মধ্যে ভুলে মেরে দিয়েছি যা যা হয়েছে… অবশ্য মনেরই বা দোষ কি? কাল ফিরে আসার পরে চ্যাটে ও যা বলল তারপর…
এমন অবিস্মরণীয় রাত কটাই বা আসে এক জীবনে?

।। ৮ ।। স্মৃতিচারণঃ মানভঞ্জন
“ওরে এবার তো তোরা বেরো, অনেক রাত হয়েছে, ওদেরকে আর জ্বালাতন করিস না”
“কেন গো বড়মাইমা, সবে সাড়ে এগারোটা বাজে, আমরা থাকলে কি ওদের গল্প করতে অসুবিধে হবে?”
“তোর না সামনে পার্ট ওয়ান ঝিল্লি? কাল কলেজ নেই? বেশি রাত করে শুলে সকালে উঠতে পারবি?”
“ও কাল কলেজ যাবে কি গো, আজ যে আমরা সারারাত নতুন বৌদির সাথে আলাপ করব”
“আলাপ করার সময় পরে অনেক পাবি তোরা, এখন চল তো বাপু, নতুন বৌমা কিছু পালিয়ে যাচ্ছে না”
“ছোড়দাও তো পালিয়ে যাচ্ছে না জেঠিমা”
“আর যদি পালায় তবে নতুনবৌদিকে নিয়েই পালাবে, চিন্তা কোরো না”
“হিহিহিহি”
“উফ এই ধিঙ্গি মেয়েগুলো বড় অবাধ্য হয়েছে, দাঁড়া তোর মাকে ডাকছি, সে এসে ব্যবস্থা করুক”
দোতলায় ছোড়দার ঘর থেকে ভেসে আসা তর্জন আর কলকাকলিতে গোটা বাড়ি মুখর। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের ঝক্কি বড় কম নয়, একটা গোটা উৎসবের আয়োজন। আইবুড়োভাত থেকে শুরু হয়ে বিয়ের দিনের নানা আচার-উপচার, শতেক নিয়মের গেরো, বধূবরণ, কালরাত্রি, বৌভাতের অনুষ্ঠান- সমস্ত পার করে বৃত্ত এসে সম্পূর্ণ হয় পুষ্পাভরিত যৌথ শয্যায়। দুটি প্রাণের একসাথে জীবনের পথে চলার শুভ সূচনা এই মধুলগ্নে। তবে সে পথের শুরু কণ্টকাকীর্ণ। ফুলে যেমন রয়েছে কাঁটার জ্বালা, নবদম্পতির প্রথম (অন্তত সমাজস্বীকৃত) মিলন দুর্বিষহ করতে হাজির অনূঢ়া বা সদ্যবিবাহিত নবযৌবনার দল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে সে কল্পনায় তারা ভিতরে ভিতরে যারপরনাই উত্তেজিত; উচ্ছৃংখল, বল্গাহারা আদিম রসিকতার ইঙ্গিতে প্রায়শই তা প্রকট হয়ে পড়ছে। ‘কলকল্লোলে লাজ দিল আজ নারীকণ্ঠের কাকলি’… বাড়ির প্রতিটি দেওয়াল রণিত হচ্ছে সে কলতানের ঝংকারে।
চিলেকোঠায় দশ ফুট বাই দশ ফুটের নিজস্ব কোটরে বসে থাকা আমার মনে অবশ্য এসব বিন্দুমাত্র রেখাপাত করতে পারছে না। করবেই বা কি করে? ঘণ্টা দেড়েক আগে আসা ফোনটার পর থেকেই ধীরে ধীরে সমস্ত বাহ্যচেতনা লোপ পেয়েছে। বিকেল থেকে জমানো উৎকণ্ঠা… বিকেলই বা বলি কেন, দুপুরে ও সঞ্জীবের সাথে লাঞ্চ ডেটে রওনা দেওয়ার পর থেকেই তো… একটু একটু করে জমে যা সন্ধে নাগাদ অভিমান, আর সবশেষে রাগের আকার নিয়েছিল, ফোনে ওর গলা শোনামাত্র সেসব কোথায় উধাও! না, ভুল হল, শুধু ঐ মাদকতাময়ীর স্বরের জন্য নয়, দূরভাষে ওর ঈষৎ কাঁপা-কাঁপা গলায় যা বলল তাতে যেন কি এক অজানা রহস্যের আভাস।

খাওয়া-দাওয়ার পাট তখন সবে চুকেছে, অতিরিক্ত গুরুভোজনের পর পৃথুলাতর হওয়া এক লতায়পাতায় আত্মীয়ার কাছে নিজের কর্মজীবন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কৈফিয়ত দাখিল করতে করতে বিরক্ত হচ্ছি; কিন্তু উপায় কিছু নেই, এগুলো না করলে ‘অসামাজিক’, ‘উন্নাসিক’, ‘উন্মার্গগামী’ ব্যাচেলরের তকমা জুটতে বেশি দেরি হবে না। খানিক আগে দীপান্বিতাও বিদায় নিয়েছে, অবশ্য সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে আজকের মত দ্বিতীয়বার চোখ মেরে, একটা ফ্লাইং কিস দেওয়ার পরে। হাতের বিচিত্র মুদ্রায় ফোনে যোগাযোগ রাখার ইশারা করতেও ভোলেনি। যান্ত্রিকভাবে একবার ঘাড় নাড়া, এছাড়া কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না আমার তরফ থেকে। সায়াহ্নকালীন ব্যভিচারের জন্য়ই হোক বা অন্য কোনও কারণে, একটা অবসাদ আস্তে আস্তে গ্রাস করছিল গোটা শরীর-মনকে। উপরন্তু কাল থেকে আবার সেই চেনা ছকের জীবন, অফিস-বাড়ি-কর্মব্যস্ততা-দৌড়ঝাঁপ, এসব ভেবে মনটা আরও বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। নিমপাতা খাওয়া মুখে শুভানুধ্যায়ী মহিলার উপদেশ গিলছি, এমন সময় রাধিকার দূতী হয়ে মোবাইলে চেনা মেসেজবার্তার ধ্বনি। ভক্তকে তবে দেবীর মনে পড়েছে?
“I am free now. Call me whenever you are ”
হৃৎপিণ্ডের অলিন্দ-নিলয়ে রক্তেরা সহসা দ্রুতগামী। ‘অফিসের দরকারী ব্যাপার’ বলে আত্মীয়াটিকে কাটালাম, তিনি অবশ্য এ অজুহাতে মোটেই প্রসন্ন হতে পারেননি, বাঁকা চোখে গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছেন। তাতে আমার ছেঁড়া যায়। ভগ্ন আসরে ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিড়ের মাঝেই একফাঁকে জায়গা করে ফোন লাগালাম। শ্যামের বাঁশি বিফলে গেল না, তিন সেকেণ্ডেই শ্রীমতীর সাড়া-
“কোথায় তুই?”
“রিসেপশানেই…”
“এখনও শেষ হয়নি?”
“তোর নিজের বিয়েতে দশটার মধ্যেই সবাইকে ভাগিয়ে দিবি বুঝি? পাবলিকে ক্যালাবে ধরে”
“উফফ Don’t be ridiculus! বাড়ি কখন ফিরবি?”
“তা তো বলতে পারছি না, আরও একটু দেরি তো হবেই… তুই বল না কি বলবি, এখানে আমি ফ্রিই আছি”
“না, বাড়ি গেলে give me a call”
“কি ব্যাপার বল তো? সিরিয়াস কিছু?”
“বললাম তো বাড়ি ফিরে কল করিস”
“আরে বেকার টেনশানে ফেলছিস কেন! খারাপ কিছু হয়েছে নাকি? তুই ঠিক আছিস? Anything wrong?”
“No, I am allright ”
“তবে কি?”
“Do you trust me?”
“মানে???”
“বল না… Do you trust me?”
“আরে কি ব্যাপার কিচ্ছু না বলে…”
“Just answer this, Do you trust me? Yes or No?”, ওপ্রান্ত থেকে অধৈর্যস্বরে ধমক এল।
“তুই নিজেই জানিস ভাল করে”
“Are you going to tell me or not?”
“Of course, এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে?”
“পরে বলব”
“এখনই বল না, তুই কোথায়?”
“ঘরে ঢুকেছি জাস্ট, ডিনার প্যাক করে নিয়ে এলাম”
“আর লাঞ্চ কেমন হল?”
“বললাম তো Call me after reaching home ”
“সাসপেন্স ক্রিয়েট করছিস কেন এত?”
“আহহ বলছি তো… call me when you are alone ”
“কটা অবধি জেগে থাকবি?”
“I will be awake, don’t worry ”
“কাল অফিস নেই?”
“সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না”
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে”
“ডিনার হয়ে গেছে?”
“টেন কোর্স, বিয়েবাড়িতে যেমন খ্যাঁটন হয়”
“গ্রেট, আমি ততক্ষণ করে নিই, কেমন? বাই”
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, রাজনন্দিনীর মতিগতি বোঝা ভার। এই শাসন তো এই আদর। এই মেঘ, এই রোদ্দুর। কিন্তু ব্যাপারটা কি? সঞ্জীবের সাথে কোনও ঝামেলা? লুকিয়ে গেল কি না কে জানে… উঁহু, একটু পরেই তো বলবে বলল। তবে? আচ্ছা, হঠাৎ ট্রাস্টের কথাই বা তুলল কেন? কিসের ট্রাস্ট?
তবে কি… তবে কি…
দুপুরে স্নানঘরে মনের মধ্যে ফুটে ওঠা ছায়াছবিরা ভেসে উঠল। সত্যিই কি ওরকম কিছু হয়েছে? এ যে কল্পনারও অতীত! ওর মত মেয়ের পক্ষে… নাহ আর ভাবতে পারছি না। এক্ষুণি বাড়ি ফিরতে হবে যাহোক করে। জানি গালাগাল খাব তবু এখন ভিতরে গিয়ে জানতে হচ্ছে কারা শিগগিরি রওনা দেবে বাড়ির দিকে। ‘কাল সকালের ফ্লাইট, ব্যাগ গোছানো হয়নি বলে এখন না গেলেই নয়, আবার ভোরে ওঠা’- এটাই সবচেয়ে মোক্ষম অজুহাত। এক দৌড়ে রিসেপশানের জটলার মাঝে, একে তাকে প্রশ্ন করে পেয়েও গেলাম সন্ধান, জেঠুর শালা-শালাজ রাতেই ফিরবেন, তাঁদের গাড়িটা আমাদের বাড়িতে রাখা অতএব ভাড়া করা গাড়িটা যাবে ওনাদেরকে বাড়ি অবধি নামিয়ে দিতে। হাতে চাঁদ পাওয়া আর কাকে বলে? অম্লানবদনে এক ঝুড়ি মিথ্যে বলে বাইরে যেতে পা বাড়িয়েছি, টনক নড়ল… ভাগ্যিস!
দে ছুট, দে ছুট, দোতলায় উঠে সোজা তত্ত্ব রাখা রয়েছে যেখানে সেই ঘরে গিয়ে হাজির। যথারীতি একদঙ্গল নিকটাত্মীয়া কৌতূহলী-অভিজ্ঞ চোখ মেলে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত। কোন সামগ্রীর গুণাগুণ… অর্থাৎ দাম কেমন সে বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার চলছে। মেঝেতে সার দিয়ে রাখা অনেক যত্নে সাজানো ট্রেগুলোর একটা টপ করে তুলে নিলাম। বিচারকমণ্ডলী ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, কেউ কেউ সশব্দেই বিরক্তি জানান দিলেন।
“বাড়ি যাচ্ছি তো, একটা নিয়ে গেলাম যাতে পরে তোমাদের বেশি প্রবলেম না হয়”
ব্যাখ্যাটা সন্তোষজনক হয়েছে কিনা জানি না, ঘুরে তাকিয়ে ওনাদের মুখের অভিব্যক্তি থেকে সেটা আঁচ করার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই। উর্ধ্বশ্বাসে নেমে সোজা অপেক্ষমান যাত্রীদের কাছে।
“স্যরি, একটু দেরি হয়ে গেল”
এনারাও কি বিরক্ত? হলে হবেন, কিছু করার নেই। এখান থেকে আমাদের বাড়ি কিছু না হোক দশ মিনিট লাগবে যেতে। আমার মনের মধ্যে নিষিদ্ধ উত্তেজনার যে ঝড় এখন বইছে, তার বহিঃপ্রকাশ থ্রি-পিস স্যুটের ট্রাউজারের ওপরে এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে। সময় যত এগোবে, কল্পনারা ততই ডানা মেলবে ইচ্ছেমত, আর তার প্রভাব আরো বৃহৎ, আরো কঠিন হয়ে দেখা দেবে গাড়ির সিটে বসে থাকা আমার অধোবাসে। ঐ দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সে ভয়ানক দৃশ্য থেকে আড়াল করতে রক্ষাকবচ তত্ত্বের এই ট্রে।
ছোড়দাকে আজ ফুলশয্যার আবেগঘন মুহূর্তে তার মামা-মাইমার হার্টঅ্যাটাকের খবর শুনিয়ে আমার কি লাভ?

গল্পটি কেমন লাগলো ?

ভোট দিতে স্টার এর ওপর ক্লিক করুন!

সার্বিক ফলাফল 0 / 5. মোট ভোটঃ 0

এখন পর্যন্ত কোন ভোট নেই! আপনি এই পোস্টটির প্রথম ভোটার হন।

Leave a Comment